রেডিও এবং বন্ধুর গল্প

যুগান্তর মিত্র

জুতো পরার জন্য বারান্দায় বেঞ্চে বসার পরেই দেখলাম দাদাই বসে আছেন। প্রতিদিন অফিসে বের হওয়ার সময় এখানে বসেই জুতোটা পরি। এই লম্বা বেঞ্চটার একপাশে কাঠের জুতোর র‍্যাকে সারি সারি সবার জুতো সাজানো থাকে। বেঞ্চের যেদিকে জুতোর র‍্যাক, ঠিক তার উলটোদিকে বসেছিলেন দাদাই। ঠাকুরদাকে আমি দাদাই বলে ডাকি। দেখলাম দাদাই আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। এইসময় আমার তাড়াহুড়ো থাকে। আটটা আটত্রিশের ট্রেনটা না পেলে সমস্যা হয়। একদল একসাথে ট্রেনে যাই। বসার জায়গা পালটাপালটি করি। তাছাড়া পরবর্তী ট্রেন বেশ খানিকটা পরে, এটা না পেলে তাই অফিসের খাতায় লেট মার্ক পড়ে। এইসব কারণেই দাদাইয়ের বসে থাকা নিয়ে মাথা ঘামাই না।

– আমার রেডিওটা চলছে না ছোট্টু। একবার কোনও দোকানে দেখাতে পারিস?
দাদাই বিড়বিড় করে বললেন। আমাকেই বলছেন কথাটা, কিন্তু অনেকটা স্বগতোক্তির মতো শোনাচ্ছে। এর আগে কোনোদিন রেডিওটা খারাপ হয়েছিল কিনা মনে পড়ে না। সেই ছোট্টবেলা থেকে দেখছি একভাবে রেডিও চলছে।

– এত ঢাউস রেডিও কোথায় দেখাব দাদাই? নিয়ে যাওয়াই তো ঝামেলার!

– অ। তাহলে কি একজন ভালো মেকানিককে ডেকে আনবি?

– রেডিও সারাইয়ের দোকানই বা কোথায় কে জানে! খোঁজ নিতে হবে।

– আচ্ছা, খোঁজ নিস। একটু তাড়াতড়ি দেখিস। রেডিওটাই তো আমার সম্বল। তোর ঠাকুমা চলে যাওয়ার পর…

– হ্যাঁ হ্যাঁ, খোঁজ নেব। এখন আমি আসি দাদাই। ট্রেনটা মিস হয়ে যাবে।

– আচ্ছা আয়।

ইতিমধ্যে প্রতিদিনকার মতো মা এসে দাঁড়িয়েছেন বারান্দায়। যথারীতি আমার ‘মা আসি’ আর মায়ের ‘দুগগা দুগগা’ পর্বও শেষ।
আমি ছুটলাম ট্রেন ধরতে। যেতে যেতে দাদাইয়ের কথাটা কানে বাজল। তোর ঠাকুমা চলে যাওয়ার পর… আরও কিছু বলতেন। আমিই থামিয়ে দিলাম। তাড়াহুড়োর সময় এত কথা শোনা যায় নাকি? কিন্তু ঠাকুমার চলে যাওয়ার সঙ্গে রেডিও সম্বল হওয়ার কোনও সম্পর্ক আছে নাকি?
দাদাই বরাবর নিজের মতো চলেছেন। ঠাকুমা সকাল থেকে অনেকক্ষণ পুজোর ঘরে কাটাতেন। কালেভদ্রে রান্নাঘরে যেতেন। অবসর সময়ে খবরের কাগজ আর বই পড়তেন। দুপুরে খাওয়াদাওয়া মিটতে আড়াইটে-তিনটে বেজে যায়। তারপরে খানিকক্ষণ যা অবসর পেতেন। দাদাইয়ের সারাক্ষণ এটা চাই, ওটা দিও, সেটা নেই কেন— এইসব ফাইফরমাশ সামাল দিতে দিতেই অনেক সময় চলে যেত। দাদাই শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা ভোরে উঠে স্নান সেরে আহ্নিক করেন, তারপর চা-বিস্কুট খেতে খেতে রেডিওতে খবর শোনেন। বোতাম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খবর, রবীন্দ্রসঙ্গীত, কৃষিসমাচার, মাঝে মাঝে নাটক শোনা— এসবই করেন সারাদিন। আর সকাল আটটায় টিফিন, বেলা একটার মধ্যে দুপুরের খাওয়া, বিকেল চারটেয় শুধু চা, এরপর দলবলের সঙ্গে একচিলতে মাঠে বসে তাস খেলা। সন্ধে ছ-টা সাড়ে ছ-টায় মুড়ি জাতীয় হালকা খাবার, রাত নটার মধ্যে রাতের খাবার খাওয়া। ঘড়ি ধরে এসব করেন। একসময় কর্পোরেশনের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। অবসর নিয়েছেন যখন, তখন আমি সদ্য জন্মেছি। এর মধ্যে ঠাকুমার থাকা না-থাকার কোনও সম্পর্ক নেই। ঠাকুমা বেঁচে থাকতে যা-যা করতেন, মানে ফাইফরমাশ জোগানো, মারা যাওয়ার পর মা বা শোভাপিসি সেসব করেন। শোভাপিসি আমাদের বাড়ির সর্বক্ষণের কাজের লোক। আমার বাবার ছোটবেলা থেকেই কাজ করেন। ব্রাহ্মণ, বাল্যবিধবা ও নিঃসন্তান বলে আমাদের ঘরের লোকের মতোই থাকেন। আসলে শোভাপিসির কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই। না বলে দিলে কেউ বুঝবেই না উনি আমাদের বাড়ির কাজের লোক। আমি, বাবা, মা কোনও কাজে ভুল করলে পিসি ধমকও দেন। আমার নিজের পিসি নেই। বাবাও আমার মতোই একমাত্র সন্তান। ছোট থেকেই দেখে আসছি বাবাকে ফোঁটা দেন আর বাবাও শোভাপিসিকে প্রণাম করেন। সেই পিসিও দাদাইয়ের দাপট সহ্য করেন বরাবর। ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর দাদাই কি স্ত্রীর অভাবটা বুঝতে পারছেন? কিংবা বলতে হয় বলেই বললেন ঠাকুমার চলে যাওয়ার কথা। যেন ঠাকুমা মারা যাওয়াতে খুব ভেঙে পড়েছেন। আমার ধারণা তা নয়। শুধু মৃতদেহটা ম্যাটাডোরে তোলার আগে দু-হাত দিয়ে গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন মনে আছে। তারপর নিঃশব্দে সোজা নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলেন। শ্মশান থেকে ফেরার পরও কোনও ভাবান্তর দেখিনি। এমনকী ঠাকুমার শ্রাদ্ধের দিন শ্রাদ্ধবাসর ও খাওয়াদাওয়ার দিকে হেঁটে চলে বেড়িয়েছেন নির্লিপ্তভাবে। তাঁর মুখে ঠাকুমার চলে যাওয়ার জন্য আক্ষেপটা কেমন যেন বেমানান ঠেকল। এইসব ভাবতে ভাবতেই দেখি ট্রেন ঢুকছে সামান্য লেটে। তাড়াতাড়ি ট্রেনে ওঠার দিকে মন দিই।

(২)

দুপুরে অফিসে টিফিনের সময় হঠাৎ মনে পড়ল দাদাইয়ের রেডিওর কথা। অফিসের বিশ্বাসদাকে জিজ্ঞাসা করলাম। কলকাতায় থাকেন। যদি ভালো কোনও রেডিও সারাইয়ের দোকানের ঠিকানা বলতে পারেন। আমাদের বাজারে যাদব রেডিও সার্ভিস নামে পুরনো একটা দোকান ছিল। সেটা উঠে গেছে। দোকানটা অন্য একজন কিনে কম্পিউটার সেন্টার করেছে। আর কোথায় দোকান আছে জানা নেই। বিশ্বাসদাকে দেখেছি খেলা-টেলা থাকলে পকেট রেডিও নিয়ে আসতেন আগে। ইদানীং অবশ্য মোবাইলেই খেলার আপডেট পেয়ে যান। খেলা দেখতেও পারেন।

– না রে ভাই, রেডিওর পাট কবেই উঠে গেছে আমাদের। তবে শ্যামবাজারের কাছে নাকি একটা ভালো দোকান আছে। আমার ভায়রাভাই গতবছর ওখান থেকে রেডিওটা সারিয়েছিল শুনেছি।
‘যেখানে দেখিবে ছাই’ মনে করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমি। কিছু একটা খোঁজ না নিয়ে বাড়ি ফিরলে দাদাই ঘ্যানঘ্যান করেই যাবেন।

– দোকানের ঠিকানাটা জোগাড় করে দেবেন দাদা? আর ফোন নম্বর থাকলেও দেবেন।

– দাঁড়া দেখি ফোন করে।

বিকেলের আগেই একটা চিরকুটে ঠিকানা আর ফোন নম্বর লিখে দিলেন বিশ্বাসদা। অফিস থেকে খুব দূরে নয়। বাসে দু-তিনটে স্টপেজ। একটু আগে অফিস থেকে বেরিয়ে সেই দোকানে গিয়ে পৌঁছলাম।
ছোট্ট দোকান। শোকেসে পরপর কয়েক রকম মডেলের রেডিও সাজানো। বয়স্ক একজন বসে আছেন। মাথাজোড়া টাক। তাঁর সামনে একটা রেডিও। ঝুঁকে পড়ে রেডিওর ভেতর কী যেন দেখছেন। আমার মনে পড়ে গেল, ছোটবেলায় আমিও অমন করে রেডিওর ভেতরে দেখতাম। যারা গান গায়, খবর পড়ে, নাটক করে, নানা কথা বলে, তারা এই বাক্সের মধ্যে থাকে কী করে? তাদের চেহারা কতটুকু? তারা কী খায়? কে-ই বা তাদের খেতে দেয়? নাকি তাদের খাওয়াদাওয়ার দরকার পড়ে না এই বাক্সে ঢুকলে? কে তাদের এই বাক্সের মধ্যে পুরে দিল? এইসব ভাবতাম আর আঁতিপাঁতি করে খুঁজতাম লোকগুলোকে। কাউকেই দেখতে পেতাম না। একবার ছোটমাসির বাড়ি গেলাম বাবা-মায়ের সঙ্গে। মেসোমশাই দেখলাম সন্ধ্যাবেলায় একটা কালো ছোট রেডিও নিয়ে বসেছেন। আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আমাদের রেডিওতে যেমন-যেমন গলা শুনি, এখানেও সেই চেনা গলা। দাদাইয়ের এত বড় রেডিওতে যারা ঢুকে বসে আছে, তারা এখানে এল কী করে? এখানে কি তাদের আরও ছোট ছোট করে ঢুকিয়ে দিয়েছে কেউ? এসব কথা কাউকে জিজ্ঞাসা করতাম না। কেন যেন ভয় হত। বাড়ি ফিরে ভয়ে ভয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসাই করে বসলাম। বাবা বড্ড রাগী। সবসময় মেজাজ তিরিক্ষি থাকে। তবু অদম্য কৌতূহল থামাতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। ও মা! বাবা দেখি হেসে ফেললেন। তারপর বললেন, ওখানে কেউ ঢুকে বসে নেই রে পাগলা। ইথার তরঙ্গে এইসব কথা, গান ভেসে ভেসে আসে। কলকাতায় একটা ঘরে ওরা বলে আর আমরা শুনতে পাই। আমার বিস্ময় আরও বেড়ে গেল। অত দূরে কথা বলে, গান গায় আর আমরা শুনতে পাই?

– হ্যাঁ রে ছোট্টু, বাতাসে ভেসে আসে।

– আমাদের কথাও বাতাসে ভাসে?

– ভাসে হয়তো। কিন্তু যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে বললে সেই কথা, গান সব বাতাসের ডানায় চড়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়।

– বাতাসের ডানা আছে বাবা? কই, দেখতে পাই না কেন?

– এটা একটা কথার কথা। বাতাসই দেখা যায় না তো তার ডানা দেখবি কেমন করে? অনুভব করতে হয়।

বাবা আরও নানাভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আমি কিছু বুঝেছি, বেশিরভাগই বুঝিনি। এই লোকটাকে দেখে সেইসব কথা মনে পড়ে গেল। লোকটা আসলে রেডিও সারাই করছেন। বিশ্বাসদা ঠিক ঠিকানাই দিয়েছেন। কিছুক্ষণ রেডিওটা ভালো করে দেখার পর আমার দিকে চোখ তুললেন। যেন এইমাত্র দেখলেন আমাকে। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। চোখে জিজ্ঞাসা।

– আমাদের একটা রেডিও আছে। হঠাৎই চলছে না, বন্ধ হয়ে গেছে। সেটা সারাই করতে হবে। সেইজন্যই আসা।

– কই দেখি?

– না, মানে, আনিনি। এত বড় রেডিও…
হাত দিয়ে আকার বোঝানোর চেষ্টা করি।

– ও, আনেননি। তা রেডিও না দেখলে সারাই হবে কী করে?
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন। গলার স্বরে কোনও ওঠানামা নেই। বিস্ময় বা কৌতুক নেই।

– আসলে ঢাউস রেডিও, আনাটা সমস্যার।
আবার দু-হাত দিয়ে আকার দেখাই।

– অনেক পুরানো রেডিও? এত বড় রেডিও তো আজকাল তৈরিই হয় না।
এমন কিছু মানুষ আছে, যাদের কথাবার্তা শুনলে রাগ, ক্ষোভ, কৌতুক, বিস্ময় কিছুই বোঝা যায় না। ইনি এই গোত্রের মানুষ। কথার মধ্যে কোনও তরঙ্গ নেই, ওঠানামা নেই, সোজা পথে কথাগুলো হাওয়ায় ভেসে আসে।

– নিয়ে এলে দেখে দিতে পারি।

– কোনও মেকানিককে পাঠানো যায় না? যা খরচ লাগে…

– মেকানিক আর কে আছে! আমিই দোকানদার, আমিই মেকানিক। কারও বাড়িতে যেতে গেলে তো দোকান বন্ধ রাখতে হয়। সেটা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।

– খুব দূরে নয়, ট্রেনে আধঘণ্টা মতো…

– বললাম তো।
বলেই বসে পড়লেন। বসার ভঙ্গি দেখে মনে হল চূড়ান্ত হতাশ হয়েছেন তিনি। চশমার মোটা কাচ ভেদ করে আমার মুখে দৃষ্টি পেতে দিয়ে বললেন, সময় করে রেডিওটা একটু কষ্ট করে নিয়ে আসুন, দেখে দেব। না হলে নতুন একটা কিনে নিন।
আবার ঝুঁকে পড়লেন সারাইয়ের কাজে। আমি ধীরে ধীরে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। বাড়ি ফিরে দেখি দাদাই বসে আছেন সেই বেঞ্চে। একই জায়গায়। যেন সকাল থেকে ওখানেই বসে আছেন। লুঙ্গির মতো করে ধুতি পরা। সকালে খালি গা ছিল, এখন হালকা নীল রঙের একটা ফতুয়া আছে গায়ে। এটুকুই যা পার্থক্য।

– কোনও খবর পেলি ছোট্টু?

– একটা দোকানে খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। বলল রেডিওটা দোকানে নিয়ে যেতে হবে। কোনও মেকানিক বাড়িতে আসবে না।

জুতো খুলতে খুলতে জবাব দিলাম।

– তাহলে কালই নিয়ে যাস। আমি ব্যাগে ভরে দেব সকালে।

– আমার কি মাথা খারাপ নাকি? অফিসে অতবড় ব্যাগ নিয়ে যাওয়া যায়? ভিড় থাকে না ট্রেনে? শনিবার নিতে পারি। আমার কলকাতায় একটু কাজ আছে। ট্রেনও হালকা থাকে। তখন নিয়ে যাব।

– আজ বিষ্যুদবার, কাল শুক্কুর, তারপর শনি। দিলেই তো আর ঠিক করে দেবে না। ক-দিন অপেক্ষা করতে হবে কে জানে!
দাদাইয়ের স্বগতোক্তি শুনতে শুনতে ঘরে চলে গেলাম।

– তোর দাদাইয়ের রেডিও ঠিক হয়ে গেছে। সন্ধ্যাবেলায় চা দিতে গিয়ে দেখলাম খবর শুনছেন।
পরদিন অফিস থেকে ফেরার পর মা বললেন।

– তাই নাকি? বাঁচা গেল। কী করে হল ঠিক?

– কী জানি। বললেন তোর বাবা নাকি ঠিক করে দিয়েছে।

– বাবা? বাবা আবার রেডিও মেকানিক হল কবে থেকে?
আমি হেসে বলি।

– জানি না। যা বললেন শুনলাম। একদিকে ভালোই হল। না হলে রোজ রোজ তোর কাছে ঘ্যানোর ঘ্যানোর করতেন। তোর বাবাকে তো আর কিছু বলেন না, যা বলার তোকে আর আমাকে…
একটু বাদে দাদাইয়ের ঘরে উঁকি মেরে দেখি চোখ বুজে বসে গান শুনছেন। শচীনদেব বর্মন গাইছেন, ‘তুমি এসেছিলে পরশু/ কাল কেন আসোনি…’ গানটা তখন শেষের দিকে। আমি ঘরে ঢুকে পড়লাম। সম্ভবত চটির শব্দে চোখ খুললেন। মুখে একঝলক হাসি ফুটে উঠল।

– কী করে ঠিক হল?

– তোর বাবা এসে ব্যাটারি নাড়াচাড়া দিল। তারপর রেডিওর ওপরে জোরে এক থাবড়া মারল। ব্যস, চালু হয়ে গেল।

– বাহ্, খুব ভালো। এবার থেকে রেডিও বন্ধ হয়ে গেলেই থাপ্পড় মারবে। তাহলেই ঠিক হয়ে যাবে।
দাদাইয়ের মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। আমি চলে আসার জন্য পিছন ফিরেছি সবে, শুনলাম দাদাই বলছেন, খবরে রায়টের কথা কিছু বলল না তো!

– রায়ট? মানে দাঙ্গা? কোথায়?

– কী জানি। মিত্তিরবাবু বলছিলেন। কোথায় যেন রায়ট হয়েছে আমাদের রাজ্যে।

– এমন খবর তো শুনিনি! আর মিডিয়ায় রায়টের খবর এভাবে দেয় না দাদাই। ওদের কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে।
দাদাই আমার কথা ঠিকমতো শুনলেন কিনা বোঝা গেল না। তাকিয়ে দেখি চোখ যেন ঝলসে যাচ্ছে।

– মোল্লারা বড্ড বাড় বেড়েছে। ওদের মেরে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত।

– কী বলছ দাদাই! তুমি না একসময় ১৫ই আগস্ট ক্লাবের পতাকা তুলতে আর বক্তৃতা দিতে? দেশের স্বাধীনতায় হিন্দু-মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে বলতে?

– হুঁহ্, জানা আছে কত লড়েছে! ওই ব্যাটা জিন্নাহ কম করেছে? দেশটার চোদ্দোটা বাজিয়ে দিল। এতই যখন তোদের আলাদা দেশ দরকার, তাহলে সব ব্যাটা মোল্লাকে নিয়ে গেলি না কেন পাকিস্তানে? রক্তবীজের ঝাড় রাখলি কেন এদেশে?
এতক্ষণে পরিষ্কার হল রেডিওর জন্য এত উতলা হয়েছিলেন কেন দাদাই। তাহলে ঠাকুমার না থাকার অসহায়তার কথাটা নেহাতই কথার কথা। এইসব দাঙ্গার খবরাখবর শুনতে চান রেডিওতে! চোখের দৃষ্টি কমে যাওয়ায় খবরের কাগজ পড়তে কষ্ট হয়। টিভিও দেখতে চান না। একসময় টিভিতে রামায়ণ সিরিয়াল হত। তখন কয়েকদিন নাকি দেখেছিলেন। পরে তাঁর মনে হল, এগুলো সব দামি দামি জামাকাপড় পরে নাটক করা। রামযাত্রায় প্রাণ ছিল, এসব কেমন বানানো মনে হয়। তাই সেই ধারাবাহিক দেখাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

– তোমাদের তাসের আড্ডায় বুঝি আজকাল এসব আলোচনা হয়?

– তাসের আড্ডায় কেন? সবাই জানে। সবাই বলাবলি করে। শুনতে পাস না?
দাদাই ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।

– বাবরি মসজিদ ভাঙা হল। তাও তোদের শিক্ষা হল না? হাতের কাছে কোনও মোসলমানকে পেলে কচুকাটা করতাম।
এসব কথা শুনতে ভালো লাগে না। তাছাড়া কথায় কথা বাড়ে। দাদাইকে অনেক যুক্তি দেওয়া যায়। কিন্তু উনি এখন কিছুতেই শুনবেন না, জানি। পরে বোঝাতে হবে।
সাম্প্রদায়িক মানসিকতা আমার কোনোদিনই ছিল না। মনে আছে, একবার নিজের অফিসের বসের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম বাবা। পার্কসার্কাস। তখন সদ্য গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি। যদি কোনও চাকরির সুযোগ করে দেন উনি এই আশায়। উনি কিছু করে দিতে পারেননি বা করেননি। আমি ইন্টারভিউ দিয়েই চাকরি পেয়ে গেছি বরাতজোরে। আমার অনেক ভালো নম্বর পাওয়া বন্ধুও সরকারি চাকরি পায়নি। তাই এই চাকরি পাওয়াটা বরাতই মনে হয় আমার।
বাবার সেই বস ছিলেন মুসলিম। দেখলাম বাবা চেয়ার-টেবিলে বসে দিব্যি পায়েস খেলেন। বামুনের ছেলে হয়ে, পৈতে গলায় বাবাকে পায়েস খেতে দেখে আমিও খেয়ে নিলাম। তারপর বসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রাম ডিপোর কাছে এসে বাবা বললেন, শিককাবাব খাবি ছোট্টু? এরা খুব ভালো বানায়। একটা দোকান দেখালেন আঙুল দিয়ে।

– এগুলো তো বিফ বাবা!

– তাতে কী? দারুণ বানায়। খেয়ে দেখ। বাড়িতে কিন্তু জানাস না!
আমি আর বাবা শিককাবাব খেয়ে ট্রাম ধরলাম। খুব যে আহামরি লেগেছিল আমার তা নয়, তবে মন্দও লাগেনি। মাঝে মাঝে রাগী বাবাকে অন্যরকম দেখি। তখন বুকের মধ্যে সরু একটা নদী কুলকুল করে বয়ে যায়।
দাদাইয়ের ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম।
বাড়ির বাজারহাট বাবা নিজের হাতে করেন। আমি ঠিকঠাক গুছিয়ে আনতে পারি না। কালেভদ্রে আমি বাজারে যাই। তখন আবার বাবা কাগজে লিস্ট করে দেন। সবজি কোনটার সঙ্গে কোনটা আনতেই হবে তাও বুঝিয়ে দেন। রবিবারের সকালে বাজার থেকে ফেরার সময় বাবার সঙ্গে দেখি একজন লোক। আমার থেকে খানিকটা বড়ই হবেন। সাদা চুড়িদার-পাঞ্জাবি পরা। চোখে গোল্ড ফ্রেমের শৌখিন চশমা। পায়ে চামড়ার চটি। গোঁফ নেই, কিন্তু থুতনিতে হালকা দাড়ি আছে। তার মধ্যে দু-একটা পাকাও। চোখ সরু করে আমি দেখি লোকটাকে।

– ছোট্টু, ওকে বসতে দে। আমি বাজারের ব্যাগটা রেখেই আসছি।
আমি সোফার মতো দেখতে ডাবল সিটেড চেয়ারটা দেখিয়ে দিলাম তাঁকে। বাবাও বাজারের ব্যাগ রেখে তাড়াতাড়ি এসে লোকটার পাশে বসলেন। চেয়ারের সামনে একটা সেন্টার টেবিল পাতা থাকে। তাতে খবরের কাগজ থাকে।
টেবিলটা সামনে রেখে বাবা আর ওই লোকটা খুব গল্পে মেতে আছেন দেখে কৌতূহল হল। টেবিলের উলটোদিকে পাতা লাল প্লাস্টিকের চেয়ারে গিয়ে বসলাম আমি। ব্যাপারটা কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে!
দেখলাম তাঁর সঙ্গে আনা চামড়ার কালো ব্যাগ থেকে একটা ডাইরি বের করলেন। সেই ডাইরির পাতা খুলে একটা খাম বাবার হাতে তুলে দিলেন। বাবাও যত্ন করে খামটা খুলে একটা সাদা-কালো ফটোগ্রাফির দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। লোকটা হাসি হাসি মুখে তর্জনি দিয়ে একজনকে দেখিয়ে বললেন, এই হল মন্টু চাচা। এই ছবিটার কোথাই বলছিলাম।
বাবার মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। টেবিলে ছবিটা রেখে আঙুল দিয়ে একজনের উপর নির্দেশ করে আমাকে বললেন, এই দেখ ছোট্টু, আমার বাবা। স্কুলে পড়তেন তখন। ইউনিফর্ম পরা আছে দেখ।
বহু পুরানো ছবি। স্কুলের ইউনিফর্ম পরা চারজন কিশোর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে। এর মধ্যে একজন নাকি আমার দাদাই। আমার তো বোঝার প্রশ্নই নেই, বাবাও চিনেছেন বলে মনে হয় না। তবু কেমন যেন উচ্ছ্বসিত দেখাচ্ছে বাবাকে।

– ওহ্ হো, তোকে তো বলাই হয়নি, এ হল বরকত চাচার ছোটো ছেলে বিলায়েত। ওরা এখন লখনউ থাকে। মেডিকেল কলেজে চাচার চিকিৎসার জন্য এনেছে। খুঁজে খুঁজে আমাদের বাড়িতে এসেছে। কী অদ্ভুত দেখ, আমাকেই জিজ্ঞাসা করছে আমাদের বাড়ির ঠিকানা। হা হা হা… ধরে নিয়ে এলাম ওকে।
বরকত নামটা বহু আগে দাদাইয়ের মুখে কয়েকবার শুনেছি। দাদাইয়ের ক্লাসমেট ছিলেন। খুব দোস্তি ছিল নাকি। বুঝলাম তাঁরই ছেলে এসেছে। সঙ্গে অভিজ্ঞানপত্রের মতো দাদাইয়ের কিশোরকালের ছবি। এই চিহ্ন দেখে বুঝে নাও আমি হলাম আসলি লোক। মনে মনে হাসি আমি। জোড়হাত করে নমস্কার করি। বিলায়েত নামের লোকটা উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়ান। আমি কিছু না বুঝেই উঠে দাঁড়াই। তারপর আমাকে দু-হাতে আঁকড়ে ধরেন বুকে। যেন কতদিন পরে দেখলেন। তাঁর উষ্ণতায় আমার শরীর গলে গলে যেতে লাগল।

– তোরা কথা বল। আমি বাবাকে নিয়ে আসি এখানে।
কথাটা বলেই বাবা ভেতরের ঘরে চলে যান। আমাদের পাশাপাশি তিনটে ঘর। একেবারে ধারের ঘরে আমি থাকি। মাঝের ঘরে বাবা আর মা, তারপরের ঘরে দাদাই থাকেন। তিনটে ঘর জুড়ে লম্বা বারান্দা। ডানদিকে এল প্যাটার্নের হয়ে বেঁকে গেছে বারান্দাটা। তার প্রান্তে রান্নাঘর। সেখান থেকে মাও তাকিয়ে আছেন এদিকে।
বিলায়েতের কথা বলায় টান আছে। বাংলা ভালো বলতে পারেন না। তবু চেষ্টা করে যাচ্ছেন বাংলাতেই কথা বলার। হিন্দি মিশে যাচ্ছে সেই কথায়। ওঁদের বাড়িঘর সম্পর্কে নানা কথা হল। আমার চাকরি নিয়েও কথা হল কিছুটা। তাঁর আব্বুর বুকে জল জমেছে। অন্য কোনও হাসপাতালে কিছুতেই ভর্তি হবেন না। কলকাতার হাসপাতালেই ভর্তি করতে হবে বলে গোঁ ধরে ছিলেন। তাই বাধ্য হয়ে এখানে আনা। জানালেন বিলায়েত।
এইসব গল্পের ফাঁকেই দাদাইয়ের কাঁধ ধরে ধরে বাবা নিয়ে আসছেন লম্বা বারান্দা দিয়ে। মুখে হাসি ঝুলে আছে দুজনেরই।
বিলায়েত প্রায় ছুটে গিয়ে দাদাইয়ের পায়ে হাত রাখলেন। দাদাই বিলায়েতের মাথায় দু-হাত রেখে বিড়বিড় করে কিছু একটা বললেন। তারপর জড়িয়ে ধরলেন বুকে। তাঁর চোখ চিকচিক করে উঠল।
আর একটা প্লাস্টিকের চেয়ার এনে বাবা বসলেন। দাদাই বসলেন বিলায়েতের পাশে। দাদাইয়ের হাতে পুরানো চশমা তুলে দিলেন বাবা। সেই চশমা পরে দাদাই ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।

আমরা চারজন খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। দুজন চলে গেছে ওপরে। আমরা দুই বুড়ো এখনও টিকে আছি।

– আর একটা জিনিস ভি আছে আমার কাছে।

বিলায়েতের কথা শুনে আমরা তাঁর দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। চামড়ার ব্যাগটা থেকে বিলায়েত একটা জুয়েলারি বক্স বের করলেন। দেখে মনে হল বড় আংটির বক্স। সেটা খুলে সোনালি রঙের একটা কী যেন তুলে দিলেন দাদাইয়ের হাতে। চশমার কাচ এফোঁড়-ওফোঁড় করে দাদাই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জিনিসটা দেখছিলেন।

– বিরানব্বইয়ের ঝামেলার সময় আমাদের নিয়ে আব্বু পালিয়ে গেলেন লখনউ। এর দু-চারদিন আগে আপনি আমাদের বাড়িতে এটা ফেলে এসেছিলেন। পালানোর সময় এটা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন আব্বু।

– হ্যাঁ হ্যাঁ, সেনকো জুয়েলারি থেকে সোনার গণেশ কিনেছিলাম আমি। তোমাদের বাড়িতে ফেলে এসেছিলাম ভুল করে। বাড়ি ফিরে তোমার বাবাকে ফোন করেছিলাম বুথ থেকে। আমার বন্ধুদের মধ্যে তোমাদের বাড়িতেই ফোন ছিল। বরকত বলল হপ্তাখানেক পর দিয়ে যাবে। তারপর থেকে আর যোগাযোগ নেই।

এরপর দাদাই কিশোরবেলার গল্প করলেন। লুচি-তরকারি, মিষ্টি খাওয়ার পর বিলায়েত যখন বিদায় নিচ্ছেন আমাদের সবার কাছ থেকে, তখন দাদাইয়ের দু-গাল বেয়ে জলের ধারা পড়ছে। বিলায়েতের শরীরটা দূরে মিলিয়ে যেতেই দাদাই বললেন, কাল একটা গাড়িভাড়া করিস ছোট্টু। আমি আর তোর বাবা বরকতকে দেখতে যাব মেডিকেল কলেজে। ভাড়ার টাকা কিন্তু আমিই দেব। যত লাগে লাগুক। কতদিন দেখা হয়নি! আর যদি দেখতে না পাই!

– হাতের কাছে পেলে মোল্লার বাচ্চাটাকে কচুকাটা করবে না তো?
নিজের ঘরে যেতে যেতে দাদাই থমকে দাঁড়ালেন। পিছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, কচুকাটাই করা উচিত ব্যাটাকে। এতদিন কোনও খোঁজ নিলি? বন্ধুর খোঁজখবর রাখতে নেই? ঠিকানা জানলে আমি ঠিক চলে যেতাম ওর কাছে।

ধীর পদক্ষেপে নিজের ঘরে পা বাড়ান দাদাই।

4 comments on “

রেডিও এবং বন্ধুর গল্প

যুগান্তর মিত্র

  1. আজকের ভারতবর্ষের জন্য এই গল্পটির খুব প্রয়োজন।

Leave a Reply to ইন্দ্রনীল বক্সী

Your email address will not be published. Required fields are marked *