মনমর্জিয়া – পর্ব এক

সঙ্গীতা দাশগুপ্তরায়

বিশ্বাস

যারা ঘুমের মধ্যে মুখ দিয়ে নিশ্বাস নেয়, তাদের মুখখানা অল্প একটু খুলে থাকে ঘুমন্ত অবস্থায়, যা দেখে আনরোমান্টিকরা বলে, “দ্যাখ, হাঁ করে ঘুমোচ্ছে কেমন!” রোমান্টিকরা অবশ্য বলে, “আহা কেমন ফুলের মতো ঠোঁটদুটো ফাঁক হয়ে থাকে, সুরেলা সুগন্ধী শ্বাস ভেসে ভেসে বিলীন হয় পঞ্চভূতে। কার্বন ডাই অক্সাইডটুকু লুফে নেয় জানলায় উঁকি দেওয়া মাধবীর পাতাগুলো।”
আমি নিজেও ওভাবেই ঘুমোই, যার ফলে শুকনো ঠান্ডা জায়গায় ভীষণ গলাব্যথা হয় ঘুম থেকে উঠলে। ডাক্তারের পরামর্শে তাই বস্টনে বা ওই রকমই শুকনো ঠান্ডার মধ্যে থাকলে হিউমিডিফায়ার চালিয়ে ঘুমোতে হয়।
যে হিউমিডিটি আমাকে কলকাতায় পোস্ট-ইট প্যাড বানিয়ে দেয় ঘামিয়ে, যে হিউমিডিটির চোটে রসিকাদির হাত থেকে শোনপাপড়ি নিতে গিয়ে পাই মিষ্টি বেসনের চ্যাটচ্যাটে চৌকো, যে হিউমিডিটি নেহাতই ‘ম্যাগোঃ’, সেই হিউমিডিটিই পয়সা খচ্চা করে আমাকে ঘরে ছড়াতে হয় এই বিদঘুটে মুখ দিয়ে শ্বাস টানার কারণে।
নিজেকে বোঝাই মুখ থেকে আশ্বাস বেরোক না বাপু, এই তো যেমন রাজনৈতিক নেতাদের বেরোচ্চে! তা না, আ গেছে আমবাগানে, শ্বাস নিতে গিয়ে জীবনে বেদনা ও গাঁটের গচ্চা… যদি ফকির বা সুফি ধরনের মানুষ হতাম তো এই নিয়ে কিছু গান লিখতে পারতাম। এই সব শ্বাস-আশ্বাস বাস-সুবাস নিয়ে লেখা যত গান শুনি, ততই বুঝি কী অপদার্থতাময় এ জীবন আমাদের। আসলে তো শেষে সেই ছাই… তাও আবার ভাসিয়ে দেওয়া। অনেক সময় সিনেমায় দেখি খুব সুন্দর কোনও মুখ বন্ধ পাত্রে ‘গ্র্যান্ডমা’স অ্যাশ’… ঘরের মধ্যে মরা মানুষের দেহাবশেষ নিয়ে ঘুম কী করে আসে জানি না। তবে আসে নিশ্চই লোকের। যদিও আমি ভিতু নই, তাও মানুষ পোড়া ছাই পাশে নিয়ে ঘুমোনো আমার জন্যেও অসম্ভব, সে তুমি হিউমিডিফায়ার দাও বা না দাও।
সাধারণত কবরস্থানের পাশ দিয়ে মাঝরাতে যাতায়াতে আমার অসুবিধা হয় না। অবশ্য আমি ওই পার্ক স্ট্রিটের বিখ্যাত ফটো-অপ কবরখানায় যাইনি কখনও। যেগুলোর পাশ দিয়ে গেছি, সেগুলো সবই ঘুটঘুটিয়া এক অংশ শহরের ধারে ধারে। বস্টনে তো শহরের মধ্যেও অনেক ক-টি আছে। পাঁচিল উঁচু নয়, পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সারি সারি টুম্বস্টোন দেখতে দেখতে মানুষ নিচু গলায় কথা বলে। মৃতরা তো কানে শোনে না, তাও জোরে কথা বলে না কেউ ওঁদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়।
আমার বন্ধু রুথের কাছে শুনেছি, তাঁদের বাড়িতেও আছে ‘গ্র্যান্ডপা’স ভাস’– আসলে ভাস-এর মধ্যে গ্র্যান্ডপা-ই ছাই হয়ে রয়েছেন।
সবিতাব্রত হাঁ করে শুনছিল সে গল্প। সে বান্দা ভারী বিশ্বাসী। কলকাতায় যখন সবে সুলভ শৌচালয় তৈরি হচ্ছিল, তখন সে অনেক নতুন শৌচালয়ের দিকে না তাকিয়েই সেটাকে মন্দির ভেবে মাথায় হাত ঠেকিয়েছে। রাত হয়ে গেলে সে বস্টনেও কবরখানার রুট দিয়ে যায় না। অবশ্য একবার ও আমাকে একটা কবরখানা দেখিয়ে বলেছিল, এইটার পাশ দিয়ে যেতে আমি ভয় পাই না, কারণ এটা মিলিটারিদের আর মিলিটারিরা কখনও কারুর ক্ষতি করে না। এটাও ওর বিশ্বাসের লিস্টিতেই আছে। তা আমাদের আড্ডায় রুথের দাদুর ছাইয়ের ভাসের গল্প শুনে তাকে সবিতাব্রত জিগিয়েছিল, “তাহলে তো তোমাদের বাড়িতে কখনও ঝগড়াঝাটি হয় না, বা জোরে গান শোনা, পার্টি-টার্টি? গ্র্যান্ডপা-র ওই ওইটা…”
রুথ ভুরু কুঁচকে বলল, “হোয়াই ডু ইউ অ্যাজিউম মাই গ্র্যান্ডপা ওয়াজ আ বোরিং পার্সন?”
হক কথা! মরণের পরে এন্টারটেনমেন্টের ব্যবস্থা এমনিতেই জিরো। উঁহু, যদি ভাবেন মরার পরে স্বর্গে গিয়ে অপ্সরাদের নাচ দেখবেন তো, আগেই বলে রাখি সেখানেও এখন ওরা ফ্রি ইউটিউব চালিয়ে রাখে ইন্দ্রসভা জুড়ে। তার কিছু কিছু ঝলক আমি এদেশের ইন্ডিয়ান রেস্তঁরাতে দেখেছি। বিশাল চেহারার ভয়ানক গুঁফো হিরো হাম্বা চাম্বা করে হিরোইনকে তুলে ফেলে ছুঁড়ে লুফে নাচছে গাইছে। আর হিরোইন? তাঁদের শরীরে হাড় নাই, চুইংগামের দেহ। এই মোচড় সেই আঁচড় এই ঠুমকা ওই ঝঙ্কার দিয়ে নেচে নেচে পাহাড় মরু সাগর সব কভার করে ফেলল ভিজে তিন হাত শাড়িতে, বাকি আড়াইহাত রাখা আছে, পরের নাচে পরবে।
এ নাচ আমি দুর্বোধ্য গান এবং বারো ডলার প্লাস ট্যাক্সের বুফের সাথে চিবিয়ে গিলে দেখেছি অনেকবার। চারিপাশে আরও লোকজনও ওই– খায় আর দেখে। শুধু আম্রিকান লোকজন ওই টিভির দিকে তাকায় আর আমাদের দিকে তাকায় বারে বারে। মেলাতে চায় বোধ হয়… মিল যে পায় না সে তাঁদের পরবর্তী সময়ে মুরগির পদসেবার ধুম দেখেই বুঝি।
তবে দিনকাল যেভাবে এগোচ্ছে, মানুষ হয়তো আর পাঁচ বছর পরে ইয়ারফোনের জায়গায় পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের ছ সেমি নিচে একটা চিপ লাগিয়ে নেবে। মরে ছাই হোক বা মাটির নিচে যাক, সেখান থেকেও ফোন, গান ইত্যাদি মিস করবে না বলেই মনে হয়।
এই যে আমি আইডিয়াটা ভাসিয়ে দিলাম, এটাই দেখবেন কোন অগমেন্টেড রিয়ালিটির চামচা একজিকিউট করে এক হপ্তায় বিলিয়নিয়র হয়ে যাবে এবং তখন কেউ বিশ্বাস করবে না যে এ আইডিয়া আমার।
আসলে বিশ্বাস ব্যাপারটা তো এক্কেবারে নিজের ওপর। আমি যদি বলি বহুদিন আগে আমি এক ভাঙা বাংলোর মেঠো বারান্দায় বসে পূর্ণিমার রাতে একজনকে বলেছিলাম রবীন্দ্রনাথ মুরগির চেয়ে হাঁস বেশি পছন্দ করতেন তো কেউইই কি তা বিশ্বাস করবে না? করবে মশাই। কেউ কেউ তো করবেই, কারণ প্রমাণ আছে আমার কাছে। রবিঠাকুর যে লোক দিয়ে হাঁসের কবিরাজি কাটলেট ভাজিয়ে ভোরবেলা লুকিয়ে প্রাতঃরাশে খেতেন সে প্রমাণ তিনি নিজেই গানে লিখে গেছেন– “তুমি duck দিয়েছ কোন সকালে, কেউ তা জানে না”– অতএব?
তবে হ্যাঁ, বাকিটা, মানে আমি, ভাঙা বাংলো, পুন্নিমা ইত্যাদিগুলো নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামাবেই না অথচ ইয়ে, ওটাই আসলে… হে হে…
যদিও হলফ করে বলতে পারি লোকে জিগাবে কোন জায়গার বাংলো, কার সঙ্গে গেছিলাম, বাড়িতে বলে নাকি না-বলে ধরনের কূট বোকা প্রশ্ন, কিন্তু আমার যাওয়াটা বিশ্বাস করেই নেবে অথচ ওটাই বিশ্বাস করার নয়। এ ব্যাপারটা আমাকে শিখিয়েছিল পিনাকীকাকু। পিনাকীকাকু বাপির বন্ধু ছিল। আমাদের বলত, “লোকের সব কথা বিশ্বাস করবি না। এই যে আমার বাড়ির সবাই, মায় তোর কাকিমাও বলে, উফহ, তুমি কী জোরে নাক ডাকো! তা কি আমি বিশ্বাস করি? একদম করি না। অত যে ডাকি কেউ কি সাড়া দিয়ে আমাকে বলে, এই যে পিনাকী, অ্যাত ডাকাডাকি কীসের? কী বলছিস? আসলে সব বাজে কথা। ডাকলে সাড়া দেবে তো মানুষ, নাকি?”
এটা বলেই অবশ্য আমাকে বলেছিল, “খবদ্দার এটা তোর কাকিমাকে বলিস না যেন।”

ভাবছেন এসব কেন লিখছি? কারণ একটু আগে ইউটিউবে একটা ফিল্মি অনুষ্ঠানে দেখলাম স্টেজে সুন্দরীরা নাচছেন আর অমিতাভ অল্প একটু হাঁ করে হাসি-হাসি মুখে নাচ দেখছেন। কই তাঁর সাথে কোনও হিউমিডিফায়ার তো দেখলাম না। বুঝছি না অমিতাভকে বিশ্বাস করব, না ডাক্তারকে…

লাগামছাড়া

ঝিরি ঝিরি বরফ নামে শরীর, মাথা ঘিরে। রাস্তা ঢেকে থাকে বরফে এ দেশে। অনেকদিন অবধি চালগুঁড়ো, খাবার সোডা আর আইসিং সুগারের তফাত বুঝতাম না। আজও যে বুঝি তা নয়। তবে বরফ বুঝি। এক বাটি গুঁড়ো আকাশ থেকে নামা বরফের মেঘ আর এক বাটি চালগুঁড়ো রাখলে তফাৎ বুঝব না এত বড় মাধু গড়াই নই আমি।
মাধু গড়াই একেবারেই বুঝত না কোনোকিছু। ছেলে-বউ শুয়ে থাকার কালে তাদের ঘরে দুমদাম ঢুকে পড়তে নেই বুঝত না। ধুধুল আর ঝিঙে বাজারে পাশাপাশি থাকলে বুঝত না কোনটা পোস্তয় দেয় আর কোনটা শুকিয়ে ছোবড়া বানায়। ধার চাইতে গিয়ে খেদানি খেলেও বুঝত না লোকে ধার দিতে চাইছে না কারণ সবাই জানে মাধু শুধবে না। এমনকী এও বুঝত না বউ মরে যাওয়ার পর বউয়ের বোন সংসার সামলাতে এলে ধেনো কী বাংলা খেয়ে তার আঁচলে টান দিতে নেই।
এসব অবুঝপানা মাধু গড়াইকে বউ বেঁচে থাকার দিনগুলোয় আতাক্যালানে আর বউ মরার পরে হারামি এক বুড়োর আখ্যা পাইয়েছিল।
এসব আখ্যা মরণোত্তর। দেশ গাঁয়ে কিপটে কী দিলদার, সাধুপ্রতিম কী বিষ শয়তান এসব অর্জিত আখ্যা চিতায় ধোঁয়া হয়ে যায় না। বংশানুক্রমে মানুষ বাপ ঠাকুদ্দার ভালো মন্দের ভাগ কাঁধে বয়ে বেড়ায়।
সুকু ছিল মাধুর নাতি। তবে সুকুর মন ছিল পড়াশুনোয়। অনেক কষ্টে ভালো রেজাল্ট করে সে অনেকদূর অবধি গেছিল। শেষে বাপের কিছু জমি বেচে এলাকায় একটা প্যাথলজি সেন্টার করে। মানুষের বর্জ্য নিয়ে নাইলনের ব্যাগে করে সে চালান পাঠাত বড় জায়গায়, রাতে ফলাফল ফিরে এলে যত্ন করে গুছিয়ে রাখত। পরদিন লোকে রিপোর্ট নিতে যাওয়ার সময়ে পথে কারুর সাথে দেখা হলে বলত, “ওই যে হারামি গড়াইয়ের নাতির ওখানে যাচ্ছি। ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা করতে বলেছে। পেচ্ছাপও দিয়েছি। নাকি ইউরিক অ্যাসিড না কীসব থাকতে পারে।”
ধীরে ধীরে এলাকার বুড়োরা বিভিন্ন সময়ে চোখ বুজতে শুরু করলে মাধুর নামটা মুছে যায়। কারণ তদ্দিনে সুকু গড়াই কিছু ভালো কাজ করেছে। যেমন, মানুষের ক্ষমতা বুঝে দু-চারটাকা কম নেওয়া বা বিপদে-আপদে কোন ডাক্তারের কাছে যাওয়া বিধেয় তা খোঁজ নিয়ে জানানো।

এভাবেই ভালো দিয়ে মন্দকে মুছে দিতে হয়, বলত নাজমা বুয়া। বুয়াদের ধর্মে দোল নেই, মেড়াপোড়াও নেই। কিন্তু বিহারি উল্লাসে রাবণ পোড়ানোর পর ধিকি ধিকি আগুনে আলু পুড়িয়ে খাওয়া তো আছেই। অতএব নাজমা বুয়া কোঁচড়ে মেটে আলু, রাঙা আলু নিয়ে মেড়াপোড়ার উৎসবে অংশীদার হত এবং পোড়া আলুতে ঝাল নুন ছিটিয়ে খেয়ে আঁচল দিয়ে নাক মুছতে মুছতে বলত, “এভাবেই বুঝলে মণি, খারাপ সব কিছুকে পুড়িয়ে জ্বালিয়ে জল ঢেলে ধুয়ে পরদিন অমনি আলো আলো রং দিয়ে খেলা করে ভুলে যেতে হয়।” ভোলা নাজমা বুয়ার জন্য সহজ ছিল না এমনিতে। বুয়ার দাদারা কবে কী করে ওর বরকে ঠকিয়েছে, সে নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদার সময় কারুর ক্ষমতা ছিল না বুয়ার গায়ে এক খাবলা রং দিয়ে বলবে, “এই নাও, আলো আলো রং দিয়ে খেলা করে সব ভুলে যাও।”
আসলে এত স্পষ্ট সত্যি বলার ক্ষমতা তো থাকে না তেমন। সবাই সবাইকে সব সত্যি বলছে, এমন দিন এলে যুদ্ধ অনিবার্য– দেশে দেশে না, ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায়।

অভিজিৎ সেনগুপ্ত ছিল আমাদের টিন এজের শেষের দিকের বন্ধু। সতেরো-আঠেরো বছরে আমরা সবাই যখন বেতসলতা কী সদ্য গজানো সজনে ডাঁটার মতো চেহারার, অভিজিৎ তখন ইয়াব্বড় বৃকোদরটি। বন্ধুরা কেউ সেদিকে ইঙ্গিত করলে অভিজিৎ হেসে হেসে বলত, “আরে বুঝলি না, আমাদের এক হাঁড়ি বিশ পেটা বাড়ি। ঘরে ঘরে হাজার কথা। স—ব গোপন। কাউকে কিচ্ছু বলা যাবে না বাবা। পেটে কথা রেখে রেখেই ফুলে গেছে।”
আমাদের মতো ছোট পরিবারের ছেলেমেয়েরা একান্নবর্তী পরিবারের ছেলেপুলের ভুঁড়ি সমস্যার কারণ শুনে হাসতাম।
যদিও বড় হওয়ার কালে বহু লোকের ক্রমবর্ধমান ভুঁড়ি দেখে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে জাগে বটে যে বসের প্রতি না দেওয়া গালি, ঘরে বাইরে নিত্যিদিনের না বলতে পারা বহু স্পষ্ট সত্যি কথা জমে ভুঁড়ি বাড়ে– এ ধারণা ভুল না হতেও পারে।
সেনগুপ্তকে দুটো কারণেই মনে পড়ে। এক এইটি আর অন্যটি হল ওর হারানোর স্বভাব। তার সঙ্গে মাত্র দুটি বছরের জার্নি আমার এই এত বড় জীবনে এবং ওই দু-বছরে তাকে যা যা হারাতে দেখেছি, তা দিয়ে সম্ভবত একটি দিন আনি দিন খাই সংসার দুই সিকি পরিমাণ গুছিয়ে উঠতে পারত।
পরবর্তীকালে আমার একটি মেয়ের সাথে পরিচয় হয় যে জন্মেছে জিনিস ‘পাওয়া’র ভাগ্য নিয়ে। রাস্তায় পড়ে থাকা কয়েন, সাবানের স্ক্র্যাচ কার্ডে ঝুটো মুক্তোর পেন্ডেন্ট, সবজিওয়ালার কাছে শেষ বেলায় পড়ে থাকা চারটে লেবু একটাকায়, যখন নাকি সারা দিন লোকটা একটাকায় তিনটে লেবু দিচ্ছিল…
একবার একটা বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে বড় বাস্কেটে ক-টা পিংপং বল আছে গেস করে হাজার টাকার গিফট সার্টিফিকেটও পেল। যদিও তাতে তার মন ভরেনি। সে বছরের পর বছর অপেক্ষায় আছে টিভির একটি গেম শোয়ে ডাক পাবে নতুবা রান্নার অনুষ্ঠানে, যাতে সারা বছরের তেল নুন মশলা বাড়িতে আনতে পারে শুধু একটিমাত্র পদ রেঁধে। কিছুদিন আগেই বিয়ে হয়েছে তার। এখন সে একদিন রেঁধে এক বছরের র‍্যাশন রোজগারের চমক শ্বশুরবাড়িতে দিতে চাইবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে সম্ভবত নান্দিমুখের ছাড়া শাড়িটির মতো ‘পাওয়া’ ভাগ্যটিও বেচারির বাপেরবাড়ির চৌকাঠে আটকে গেছে। অবশ্য তার বাপের বাড়িতে চৌকাঠ নাও থাকতে পারে। ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকলে চৌকাঠ থাকার সম্ভবনা নেই। আমাদের ছোটবেলায় বাড়িগুলোতে ইয়াব্বড়বড় চৌকাঠ দিয়ে ঘরের গণ্ডি দেগে দেওয়া হত। ঘর আর বারান্দার মধ্যের ওই চৌকাঠে উঠে নেমে আমরা কুমিড্ডাঙা খেলতাম। বর্ষার দুপুরে চৌকাঠ আমাদের খেলা দিত। লোডশেডিং-এর সন্ধেয় আমরা চৌকাঠে মোমবাতি লাগাতাম ঠিক সেই জায়গাতেই, যেখানে কালীপুজোর এঁটো মোমটুকু নাছোড় হয়ে লেগে আছে। আমাদের পুরোনো বাড়িতে এখনও অনেক জায়গায় অমনি মোম আটকে আছে… চৌকাঠও রয়েছে সব ঘরেই…
শুধু আমরাই নেই… আর থাকার সম্ভবনাও নেই। বাড়িটা চৌকাঠ সমেত অপেক্ষায় আছে অনিশ্চিত ভবিতব্যের…

বাইরের বরফ এখনও ঝিরিঝিরি নামছে। সদ্য নামা এই বরফের রাশিও ভবিষ্যৎ জানে… তাপমাত্রার তারতম্যে কিছু ব্ল্যাক আইস জীবন বা ধারাবাহিক এইচটুও। অতঃপর কোনও না কোনও আধারে সুখসমর্পণ। কেবল সঠিক উত্তাপটুকুই স্থির করে এই সব আগমনী ভবিষ্যৎ, যা আমরা আর আমাদের সাবেকি বাড়িটিকে দিতে পারি না… ফলত বাড়িটি এক বিশাল আমগাছ এবং বিভিন্ন ঘরের দেওয়ালে আমাদের ফেলে আসা স্মৃতি নিয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকে উষ্ণতার অপেক্ষায়।
এদিকে আমরা উষ্ণায়নবিরোধী এ পৃথিবীর ভালোর জন্যই।
পারস্পরিক টানাপোড়েনের মধ্যে আমি টের পাই এখনও আমি কেবল বরফটুকুই আলাদা বুঝি। কিন্তু চালের গুঁড়ো, খাবার সোডা আর আইসিং সুগার আলাদা করে চিনতে আমাকে জিভ দিয়ে স্পর্শ করতেই হয়…
ইন্দ্রিয়নির্ভর আমি ঘরে বসে বরফের ঝড় দেখি পুরনো বাড়িটির কথা ভাবতে ভাবতে।

4 comments on “

মনমর্জিয়া – পর্ব এক

সঙ্গীতা দাশগুপ্তরায়

  1. তোর এ দুটো লেখাই আগে পড়েছিলাম মনে হচ্ছে! কী ব্যাপার বল তো?

  2. চমৎকার লাগলো…যেমন লাগে আপনার অন্য সব লেখাই…

    শুভেচ্ছা নেবেন

    1. আন্তরিক ধন্যবাদ জয়িতা। শুভেচ্ছা আপনাকেও। লিখতে উৎসাহ পেলাম আরও 🙂

  3. হ্যাঁ কিশোরদা এটা আগে পড়েছ। আমি সিরিজটা নিজের পাতাতেই শুরু করেছিলাম। এবার নতুন লিখতে শুরু করব সৃষ্টির জন্য 🙂

Leave a Reply to সই সঙ্গীতা

Your email address will not be published. Required fields are marked *