পরিপূরক

সরিতা আহমেদ

(১)

ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল। এই নিয়ে তিন বার চেষ্টা করলাম। তাহলে কি, ওরা ও বাড়িতে থাকে না আর! কিন্তু আজ যে ভীষণ কথা বলতে ইচ্ছে করছে, বারবার মনে হচ্ছে ও বাড়ির একজন কেউ জানুক, আমি পেরেছি।
বিকেলের এই সময়টায় যখন কমলা রঙের সূর্য ব্যালকনির এই অংশে পড়ে তখন আবাসনের গেটের দু-পাশের বোগেনভ্যালিয়াগুলো অদ্ভুত সেজে ওঠে। ওদের দিকে চাইলেই কেন জানি না বাবার কথা মনে পড়ে খুব। আমাদের বাড়ির দু-পাশেও ঠিক এমনই দুটো গাছ ছিল। ঋদ্ধি আর আমি ছোটবেলায় ওর তলায় কত খেলেছি, ফুল কুড়িয়েছি। বাবার হিরো সাইকেলটা ওই গাছদুটোর নিচেই দাঁড় করানো থাকত। কতবার ঋদ্ধিকে পেছনে বসিয়ে সেই সাইকেল নিয়ে এদিক ওদিক বেরিয়ে পড়েছি প্রায় দুপুরেই। মা যখন বকুনি দিত, তখনও কতবার যে ওটার তলায় গিয়ে চুপ করে বসে থেকেছি, টুপটাপ গোলাপি কাগজের মতো ফুলগুলো ঝরে পড়লে মনে হত আমার চাপা কষ্টগুলো ওদের সাথেই ঝরছে। নাহ, কান্না ব্যাপারটা আমার ছোট থেকেই আসে না তেমন। ওসব ঋদ্ধির ঘন ঘন হত। আমার যখন খুব মন খারাপ হয়, তখন চুপ করে বসে থাকি। এই যেমন এখন।
বরানগরের আমার এক কামরার এই ভাড়া ফ্ল্যাটে ওরা সাতজন হই হই করছে ওপাশে। আজ আমি নতুন চাকরিতে জয়েন করলাম। একটা স্পেশাল চাইল্ডদের স্কুল। ভেবেছিলাম মানবাধিকারের পরাকাষ্ঠাধারী পাশ্চাত্যের আদবকায়দা মাখা এই স্কুলে হয়তো আধুনিক উদারনৈতিক মানদণ্ড থাকবে। ভুল ভেঙেছিল ইন্টারভিউয়ের দিন। বিগত ইন্টারভিউ বোর্ডের মতো অত কদর্যভাবে না হলেও ‘জেন্ডার’ কলামে ‘আদারস্‌’ লেখা নিয়ে শ্লেষাত্মক দাঁতনখগুলোর শান পরীক্ষা হয়েছিল তির্যকভাবেই। ভেবেছিলাম এবারেরটাও হবে না। কিন্তু কীভাবে যেন উতরে গেলাম। আজ পড়ানোর প্রথম দিনে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই গিয়েছিলাম। যতই হোক বয়সে কাঁচা হলেও একঘর মানবসম্পদ নিয়েই তো দিনভর কাজ। কিন্তু নাহ, আমায় ভুল প্রমাণ করে কিশলয় কুঞ্জের নবমুকুলেরা দিব্যি ফুল-চকলেটে মেনে নিল আমায়। নিমেষে বুকের ভেতরের জগদ্দল অন্ধকার টুপ করে খসে পড়ল ওদের কলকাকলিতে। হয়তো ওদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হওয়াটাই স্বাভাবিক নিয়তি ছিল। এসব কথাই বড় বলতে ইচ্ছে করছে বাবাকে। মায়ের কাছে কত কী যে বলার আছে বনি, সুমি, লিলিদের গল্প!
ও ঘরে গ্লাসের টুংটাং শব্দ আর নানা স্বরে গান-বাজনার হুল্লোড়ের মধ্যে মন বসাতে পারছিলাম না, ঘিনঘিনে মাছির মতো মগজের খাঁজে খাঁজে অস্বস্তিকরভাবে বাড়ির কথা মনে পড়ছিল খুব। কত বছর হয়ে গেল বাড়ির রাস্তায় যাইনি, তবু কেন জানি না ফোন বাজলেই আজ মনে হচ্ছে ঋদ্ধির গলা শুনব, অথবা বাবার, অথবা মায়ের। অপেক্ষা জিনিসটা বড্ড একপেশে, অন্তহীন! আজকের দিনটাই বোধ হয় এমন ঘোলাটে। তার উপর ওই বিশ্রী ঘটনাটা! মন খারাপ করা ঘটনা আজও আমায় ওদের কথা মনে করায়— সেই কাগজ ফুলের ঝোপ, সেই স্টিকার লাগানো সাইকেল, সেই বড় পুকুরের ধারে ছিপ ফেলে অনন্ত অপেক্ষার দিনগুলো এলমেলো করে দেয় গোছানো ভাবনাদের।
সাত বছর… হ্যাঁ, দীর্ঘ সাত-সাতটা বছর হল ওদের দেখিনি। ঋদ্ধিটার পড়াশুনা কদ্দূর হল, কে জানে। আজও তো কেউ ফোন তুলল না। আচ্ছা, তবে কি ওরা ধরেই নিয়েছে ও বাড়ির বড় মেয়ে মৃত!
ও ঘরে তখন মাউথ অরগ্যানের সুর থেমে গেছে। উচ্চস্বরে সবাই হাততালি দিচ্ছে, টের পেলাম।

– কী ব্যাপার শাওন, এখানে একলা দাঁড়িয়ে যে বড়?
শুভর গলা পেয়ে চটক কেটে গেল। একহাতে ওর প্রিয় মাউথঅরগ্যান আর অন্য হাতে একটা নরম পানীয়ের গ্লাস হাতে এসে দাঁড়িয়েছে পাশে।

– এই আর কী… তা ভালোই তো বাজাচ্ছিলে, উঠলে কেন? আমি এখানে এমনিই, একটু একলা হতে ইচ্ছে হল। তাই…
চোখ থেকে কালো চশমাটা খুলে শার্টের খুঁটে মুছতে মুছতে নরম স্বরে ও বলল, “কিন্তু আজকের দিনে কি একলা থাকা মানায় ম্যাডাম! আর তুমি যেখানে নেই, সেখানে আমার সুর কেটে যাবে সেটা কি খুব অবিশ্বাস্য কিছু?”

– ধ্যাত! কী যে বলো!
আলগোছে চোখের কোনাটা মুছে বললাম।

– শোনো, যা তুমি পারো না, সেটা দেখানোর চেষ্টা কোরো না! আমি দেখতে পাই না বলে ভেব না বুঝতে পারি না। আমি জানি, মিথ্যে বলাটা তোমার আসে না, শাওন। তাই সত্যিটাই বলো, বাড়ির কথা মনে পড়ছিল?
শুভর এই কথাগুলো আমায় স্তব্ধ করে দেয়। মানুষ খোলা চোখেও যা দেখে না, আমার শুভ ওর ওই কালো চশমার পেছন থেকেই কেমন করে যে মনের ভেতর অবধি পড়ে ফেলে, আমি বাক্যহারা হয়ে যাই।

– জানো, এই সময় মা থাকলে নিশ্চয় পায়েস করে খাওয়াত। আর ঋদ্ধিটা তো কত কী কিনে দেওয়ার বায়না করত… ভাবলেই… আচ্ছা, কেন এগুলো বাস্তব হতে পারে না শুভ? এত দিন হয়ে গেল, এখনও ওরা আমায় চায় না! কী এমন দোষ আমার? সত্যি কথা বলাটা? আমার ভেতরের আমিকে মুক্তকণ্ঠে সেদিন বলেছিলাম বলে ওরা আমায় অ্যাসাইলামে পাঠাল। আমি কি সত্যিই অ্যাবনরম্যাল?

– শাওন, শাওন… প্লিজ শান্ত হও। আজ এরকম কথা একদম মানাচ্ছে না তোমার মুখে। ইউ হ্যাভ রিচড ইয়োর ড্রিম। নতুন চাকরিতে জয়েন করলে আজ, সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। সো চিয়ার আপ, ডিয়ার!

– না, শুভ প্লিজ তুমি সত্যিটা বলো। আমি কি সত্যিই অ্যাবনরম্যাল? আচ্ছা, কোনটা আনন্যাচারাল— বয়েজ কাট চুল রাখা, শাড়ি গয়নার দিকে আগ্রহ না রাখা, জিন্স-শার্ট পরা, নাকি আমার ভয়েস! আমি কেন কিছুতেই বোঝাতে পারি না, এটাই আমি। দ্য রিয়েল মি, ড্যাম ইট!

– আমি জানি শাওন। জানি বলেই তো তোমায় তোমার মতো করে চেয়েছি। সমাজ, পরিবার অনেক কিছুই বলবে। কিন্তু যে সত্যিটা তুমি জানো, আমি জানি সেটা তো অন্যদের জন্য বদলে যাবে না। তাই না!
খুব নরম স্বরে ও বলল। ওর এই গলার স্বর আমায় যেন এক সমুদ্র শান্তি এনে দেয়।

– বাট… বাট দে সে ইটস্‌ আনন্যাচারাল। নইলে আজ এতবছর বাদেও ও বাড়ির কেউ আমার ফোন তোলে না! আজকের দিনেও আমায় নোংরা শুনতে হয় বন্ধুর মুখে!

– মানে? কী হয়েছে আজ? প্লিজ টেল মি।
আমি জানি, না শুনে ও ছাড়বে না। বরাবরই শুভ আমার প্রতি এমনই প্রটেক্টিভ। মাঝে মাঝে ভাবি আমায় না দেখেই ও এত জড়িয়ে পড়েছে, দেখতে পেলে কি সত্যি ও এতটা জড়াতে চাইত। তখন হয়তো ‘ন্যাচারাল’ লোকের ভিড়ে শুভও মিশে যেত।

– আই অ্যাম ওয়েটিং শাওন, প্লিজ টেল মি।
ওর ঠেলায় বলতেই হল রায়ানের বিশ্রী আচরণের কথা।
এ নতুন কিছু না আমার কাছে; কিন্তু কাছের মানুষ বা বন্ধুদের খারাপ আচরণে বড্ড অসহায় লাগে। একটু আগেই শুভর বন্ধু রায়ান ও ঘরের হইচই থেকে উঠে এসেছিল আমার কাছে। আমি ফোন হাতে অন্যমনস্ক ছিলাম ঠিকই, তবে রায়ানের যে নেশার মাত্রা একটু বেশিই হয়ে গেছে তা বোঝা গেল ওর অসংলগ্ন কথায়— “কনগ্র্যাটস্‌ ফর ইয়োর অ্যাচিভমেন্ট, ম্যাম! উপস্‌! স্যরি স্যরি, ম্যাম তো বলা যাবে না! সো হোয়াটস ইয়োর জেন্ডার ফ্রেন্ডলি প্রনাউন? হি অর শি? টেল মি, টেল মি প্লিজ।”
ওর কুশব্দের সাথে ভক ভক করে ওর কু-ইঙ্গিতও ঝরে পড়ছিল নেশাতুর গলায়। আমি ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে দিলাম— “গেট লস্ট, ইউ মোরোন!”
বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল এই রায়ান একদিন আমাদের দুজনকে কত উৎসাহ দিয়েছিল, এগিয়ে চলার, পাশে থাকার কথা বলেছিল।

– হোয়াট! রায়ান বলতে পারল? দাঁড়াও দেখছি।
শুভর গলায় স্পষ্ট ক্ষোভ।

– না, প্লিজ শুভ। ওর সাথে ঝামেলায় যেও না। কতজনের মুখে হাত চাপা দেব আমরা! বাদ দাও।
শুভর এই শক্ত চোয়াল আমায় সত্যি চিন্তিত করে। নিজের এত প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও ও আমার হয়ে লড়ে যাচ্ছে। আর কত!
সন্ধে নামছে একটু একটু করে। ওপাশে হইচইও স্তিমিত প্রায়। সবাই উঠছে একে একে। বিশেষত যারা স্বামী-স্ত্রী এসেছে। যে যার মতো ‘বাই’ জানিয়ে চলে গেল। ব্যালকনিতে এখন আমরা দুজন। লক্ষ করলাম শুভ কাউকে প্রত্যুত্তর দিল না। ওর চোখে এখনও রাগ, রায়ানের ব্যাপারটা ও ভুলতে পারছে না। ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে আলতো স্বরে বললাম, “অ্যাই, আজ একটা নতুন টিউন আমার জন্য বাজাবে… প্লিজ!”

(২)

প্রায় একঘণ্টা হল অপেক্ষা করছি। হল কী ছেলেটার? এতক্ষণে তো চলে আসার কথা। কাল রাতে তো এই রেস্টুরেন্টেই দেখা করার কথা হয়েছে আমাদের। আজ ওর সত্যি একটা বড় দিন। ওর প্রথম রেকর্ডিং। আমি যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ও-ই জোর করে স্কুলে যেতে বলল। “সবে জয়েন করেছ, এত ঘন ঘন ছুটি নিলে চলবে কেন ডিয়ার! আর তাছাড়া তুমি সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে আমার নার্ভাস লাগবে। যখন তোমার জন্য বাজাই তখন আলাদা, কিন্তু এটায়…” বলেছিল শুভ।
অ্যাসাইলাম থেকে আমাদের যখন এক অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেদিন ওর সাথে আমার আলাপ। আমি কিন্তু সেদিন ওর মিউজিক শুনেই বুঝেছিলাম মাউথ অরগ্যান ওর প্যাশানের জায়গা। এটাকে সিরিয়াসলি নিলে শুভ অনেক দূর যাবে। তারপর কত শো, কত চেষ্টা চলল। ওই দিনগুলোয়, যখন বাড়ি থেকে কেউ আসুক এমনটা খুব চাইতাম, তখন শুভ প্রায় রোববারই আসত ওদের ছোট গ্রুপের সঙ্গে আমাদের অ্যাসাইলামে। তারপর একা আসা শুরু করল। প্রথম প্রথম একটু অস্বস্তিই হত আমার— কে না কে, হয়তো আমাকে ‘অদ্ভুত জীব’ ভেবেই দেখতে আসে! কিন্তু নাহ, বেশিদিন সময় লাগল না ধারণাটা পালটাতে। প্রতি রোববার ও আসত নতুন নতুন টিউন নিয়ে— স্পেশালি আমার জন্য কম্পোজ করা। কখন যে ওর জন্য অপেক্ষা করাটা আমার অভ্যেসে দাঁড়াল, বুঝতেই পারিনি। একটা সময় তো সবাই ভেবেই নিয়েছিল ও আমার বাড়ির লোক। গেস্টরুমে ও একমনে বাজাত আর আমি ওর মুখের প্রতিটা ভাঁজে লুকানো এক শুভবোধকে দেখতাম দু-চোখ ভরে।

– অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম, তাই না! স্যরি শাওন।
শুভর গলা পেয়ে সম্বিৎ ফিরল। কিন্তু স্বরটা আজ একটু কেমন যেন শোনাচ্ছে না!

– তা একটু বেশিই। তবু… এই তারপর বলো, কেমন কাটল আজকের দিন? রেকর্ডিং কেমন হল?

– হুম, তা হল ভালোই।
চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল শুভ।

– অ্যাই, কী হয়েছে গো তোমার? আজকে এত স্পেশাল একটা দিন। আর তুমি এমনভাবে বলছ যেন…

– তা নয় শাওন। মিউজিক সত্যিই ভালো হয়েছে। কিন্তু সকালে একটা বিশ্রী ব্যপার ঘটে গেল যে, আই স্টিল ফিল সাফোকেটিং!

– কী হয়েছে, প্লিজ বলো আমায়। মা কি আবার কিছু…

– আমি বুঝতে পারি না শাওন, কেন কেউ বুঝতে চায় না, আমি দুর্বল নই। আমার একটা জীবন আছে, কিছু স্বপ্ন আছে নিজের মতো। প্রতিবন্ধী কোটায় নিজেকে ফেলে সেই স্বপ্নগুলোকে আমি মারতে পারব না। আই হ্যাভ টু লিভ মাই ওন লাইফ, ইন মাই ওন ওয়ে! সেই জীবনে, সেই স্বপ্নে আমি কাকে জড়িয়ে বাঁচব সেটা বেছে নেওয়ার কী স্বাধীনতা থাকতে নেই?
শুভ মাথা নিচু করে একটা টিস্যু পেপারকে দোলামোচা করছে। ওর এই ভঙ্গিটা আমার খুব চেনা। কান্না আটকানোর তীব্র প্রচেষ্টা। কিছু না বলে আমি ওর হাতে হাত রাখলাম।
আমার হাতটাকে শক্ত করে ধরে ও আবার বলল, “দু-বছর হয়ে গেল, শাওন। দু-বছর। আর কবে বুঝবে মা? আমি দৃষ্টিহীন বলে কি বোধবুদ্ধিহীন নাকি? তোমার কথা যখনই বলি, মা অদ্ভুতভাবে রিঅ্যাক্ট করে, হয় চুপ হয়ে যায়, নয় প্রসঙ্গ পালটায়। কী অদ্ভুত সব কথা বলে, তোমায় বিয়ে করলে আমার ভবিষ্যৎ নাকি আরও অন্ধকার হবে। আমাদের সন্তান যদি তোমার মতো হয়, এটা ভেবেই নাকি মায়ের প্রেসার হাই হয়ে যাচ্ছে! কোনও মানে হয়? আচ্ছা, সবাই কি একসাথে থাকে বাচ্চা মানুষ করার জন্য, ডিসগাস্টিং! আর যদি সেই বাচ্চা আমার মতো অন্ধ হয়, তবে!”

– আহ, শুভ! কী যা-তা বলছ।

– না না, যা-তা কেন! বলোই না, আমার মতো সেও তো একটা অ্যাক্সিডেন্টে অন্ধ হয়ে যেতে পারে। পারে না? মা কেন বুঝছে না, আমি অসহায় নই। আমার একজন আপনজন আছে, যে আমায় কমপ্লিট করে…
শুভকে এত অস্থির, এত ক্ষুব্ধ আমি আগে কখনও দেখিনি। চেয়ার থেকে উঠে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “শশহহ… শান্ত হও, প্লিজ… হুম, আমি বুঝতে পারছি তোমার প্রতিটা শব্দ। কিন্তু মায়ের দিক থেকে যদি দেখো, দেখবে এটা ওনার কোনও দোষ না। উনি একা নন যিনি এ ধরনের কথা ভাবেন আমায় নিয়ে। আমাদের সমাজে ক-জন এমন উদার মানুষ আছেন, যিনি আমার মতো একজনকে পুত্রবধূ করে ঘরে তুলবেন? এতদিনের লড়াইয়ে আমি বুঝেছি, আমাদের মতো মানুষদের যেমন কঠিন পরিস্থিতির সামনে পড়তে হচ্ছে, ওনারও তাই। ইটস্‌ নট ইজি ফর হার টু! একটু বোঝার চেষ্টা করো শুভ।”
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ও বলে উঠল, “মানে, কী বলতে চাইছ তুমি! মায়ের কথামতো আমি সবকিছু শেষ করে দিই?”

– মোটেই না, আমাদের ওনাকে বোঝাতে হবে ওনাদের মতো করে। আচ্ছা, আমি কি একবার ওনার সাথে কথা বলব?
শুভ কিছু বলল না, শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে আমার হাত দুটো আরও শক্ত করে ধরল। ইতিমধ্যে কফি চলে এসেছে। পরিবেশ হালকা করতে আমি গলা ঝেড়ে বললাম, “আচ্ছা, আজ কিন্তু একবার মেডিকেয়ারে যেতে হবে। ডক্টর রায়ের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে ঠিক সাতটায়। মনে আছে তো?”
শুভ শান্ত বালকের মতো মাথা নাড়ল। কাপ থেকে মুখ তুলতেই দেখি ওর ঠোঁটের ওপরে কফির রেখা গোঁফের মতো ফুটে উঠেছে। হেসে ফেললাম। ওর রাগ, ওর হাসি, ওর উদ্দাম সুরে মিনিটের পর মিনিট ধরে মাউথ অরগ্যান বাজানো, ওর ছেলেমানুষি— সবটাই এত মনকাড়া যে, কেউই বোধ হয় বেশিক্ষণ ওর প্রতি অনুযোগ করতে পারে না। টিস্যু দিয়ে মুখটা মুছিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “থ্যাঙ্কু, মাই সুইটহার্ট!”

(৩)

আজ ২২শে শ্রাবণ। আকাশের মুখ ভার, এমন ‘ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে’ শুভদের বাড়িতে মুখোমুখি বসে আছি আমরা তিনজন। উঁহু, ঠিক তিনজন নয়। চারজন। টেবিলের উপর ওই যে ছবিতে উনিও রয়েছেন হাসিমুখে। আজ শুধু রবি ঠাকুরের নয়, শুভর বাবা শ্যামল সাহারও প্রয়াণ দিবস। আজ ওঁর বার্ষিকী। অতিথি অভ্যাগতরা চলে গেছেন অনেকক্ষণ। আমি আজ শাড়ি পরতে চেয়েছিলাম, কিন্তু শুভ বলল, “তা কেন, তুমি যেমন তেমন ভাবেই এসো। তোমায় কাউকে কিছু প্রমাণ দিতে হবে কেন?” অগত্যা কুর্তি–জিন্সেই আসতে হল, সাথে ছোট একটা টিপ।
কাকিমা ওপাশের সোফায় বসে আছেন, হাতে একতাড়া কাগজ। পাতা উলটাতে উলটাতে বারবার উনি তাকাচ্ছেন আমাদের দিকে। বেশ বুঝছি, কিছু একটা বলতে চাইছেন, কিন্তু শুভর মুখ চেয়ে পারছেন না। আমি ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে ওঁর পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম, “কিছু বলবে কাকিমা? প্রেশক্রিপশানগুলো দেখে কী মনে হচ্ছে?” প্রশ্ন শুনে ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকালেন অশীতিপর মহিলা।
তারপর আস্তে আস্তে বললেন, “কী বলব, কিছুই যে বুঝতে পারছি না। তুমি… তোমরা… কতদিন ধরে এসব… এ-ও কি সম্ভব!”
আস্তে করে ওঁর হাতখানা ধরে আমি বললাম, “কেন সম্ভব নয় বলো। চিকিৎসাবিজ্ঞান কত এগিয়ে গেছে, জানো? সেই কবে কোন ডাক্তার জবাব দিয়েছিল বলে সেটাই তো ফাইনাল কিছু নয় বলো। আমার স্কুলে একজন কলিগের মুখে ডক্টর রায়ের কথা শুনেছিলাম। বিখ্যাত আই স্পেশালিস্ট। প্রচুর জটিল কেসে উনি ধন্বন্তরির মতো সাফল্য পেয়েছেন। গত তিনমাস ধরে আমরা ওনাকে ট্রাই করেছি, কিন্তু উনি ছিলেন বিদেশে। আমাদের পাঠানো মেইলে শুভর কেস হিস্ট্রি সবটাই উনি জানতেন। পরশু ওনার ডেট পেয়েই চেম্বারে গিয়েছিলাম। যাই হোক, আই ডোনার পাওয়া গেছে যখন, তখন আর চিন্তা নেই— এটা আমার কথা না, খোদ ডাক্তারের কথা।” শুনতে শুনতে লক্ষ করলাম ওঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
আমার হাতখানি চেপে ধরে বললেন, “আমার শুভ আবার দেখতে পাবে? অ্যাঁ! সত্যি বলছ তুমি? কিন্তু… সে তো প্রচুর খরচ। অত টাকা…”

– খরচ যে হবে সেটা তো জানা কথাই। তবে এ নিয়ে অযথা তুমি চিন্তা কোরো না। তোমার পক্ষে যেটুকু সম্ভব দিও। বাকিটা না হয় আমি লোন নিয়ে নেব। আফটার অল তোমার ছেলেকে যে কথা দিয়েছি পাশে থাকার। ওহ, আরেকটা খবর, ওর লাস্ট কনসার্টের ভিডিও দেখে একজন বিখ্যাত মিউজিশিয়ান অফার লেটার পাঠিয়েছে, জানো! দু-মাস বাদেই ওকে ব্যাঙ্গালোর যেতে হবে। আমরা চাই তার আগেই ওর দৃষ্টি ফিরুক। কত ভালো ব্যাপার হবে বলো তো।
কথা শেষ হতেই দেখি কাকিমার চোখে জল, আঁচলের খুঁটে চোখ মুছছেন। শুভ সেটা বুঝতে পেরে, উঠে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “একটা ভালো খবর, তাও তুমি কাঁদছ মা…”
মুখের কথা শেষ হতে না হতেই বৃদ্ধা জড়িয়ে ধরলেন ছেলেকে। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, “তোমায় কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই, মা। অনেক কটু কথা বলেছি তোমায় নিয়ে। শুভ আঘাত পেয়েছে। আমি… ঠিক জানি না কেন… আসলে তোমাদের নিয়ে বাইরের সমাজ…”

– আমি সবটা বুঝি কাকিমা। তুমি, তোমার দুশ্চিন্তা সবটা তাদের নিজেদের জায়গায় হয়তো ঠিক। তবে কী জানো, আমাদের জানার বাইরেও এক পৃথিবী মানুষ বাঁচে তাদের নিজ নিজ দোষ-গুণ নিয়ে। লড়াই তো তুমিও করেছ, শুভও করছে, আমরা সবাই করি নিজের মতো করে। তবে কিছুজনের প্রতি সমাজ একটু বেশিই কৃপা করে। তাদের লড়াইটা তাই আরও কঠিন হয়ে যায়। এই যেমন আমি। আমাকে তোমার মনের মতো করে গ্রহণযোগ্য করার জন্য কী করতে হবে তা আমার জানা নেই। শুধু এটুকু বলব, তোমার ছেলের পাশ থেকে সরে যেতে পারব না কোনোদিন।”
উলটো দিকের সোফায় তাকিয়ে দেখি শুভ নেই। বারান্দায় ওর অস্পষ্ট অস্থির অবয়বটার দিকে চেয়েছিলাম, হঠাৎ স্পর্শে চমকে উঠে দেখি কাকিমা আমার হাতে তাঁর নিজের বালাজোড়া পরিয়ে দিচ্ছেন। এটার জন্য একদম প্রস্তুত ছিলাম না, তাই মুখ দিয়ে বেরিয়েই গেল— “এম্মা! এসব কী করছ…”

– আজ আমায় বাধা দিও না, মা। আশীর্বাদ করি, তোমার সুখী হও।

আমি শ্রাবণী মিত্র, যে হাজার লড়াই দাঁতে দাঁত চেপে সয়েছে, কিন্তু কোনোদিন প্রকাশ্যে কাঁদেনি, টের পেলাম নোনা জলের স্রোত নামছে গাল বেয়ে। আমার হাতে বালা-চুড়ি বা গয়না— সত্যি বড্ড বেমানান, তবু আজ ভেতরটা কেন যেন বড্ড হালকা লাগছে। মায়ের কথা আবারও মনে পড়ল।
কিছু পরে বারান্দায় গিয়ে দেখি শুভ আপন মনে সুর তুলেছে— ‘তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্ত রাতে/ আমার ভাঙল যা তা ধন্য হল চরণপাতে।’ চোখ বন্ধ করে ও যখন বাজায়, তখন মনে হয় পৃথিবীতে অসুন্দর বলে যেন কিছু থাকতে পারে না। বাজানো শেষ হলে, ধীরে ধীরে ওর হাতটা তুলে আমার হাতের বালাজোড়ার উপর রাখলাম। প্রথমে ও বেশ চমকে গেল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওগুলো স্পর্শ করে আমায় বুকে টেনে নিয়ে কোনোক্রমে ও বলল, “আমরা তাহলে পেরেছি শাওন।” ওর বুকে মাথা রেখে বললাম, “হুম, কিছুটা পেরেছি। এখনও অনেক পথ হাঁটা বাকি। আমাদের যে পারতেই হবে শুভ। সামনে একটা নতুন সূর্যোদয় দেখতে হবে না!”
বাইরে তখন বৃষ্টি থেমে আকাশ ফরসা হচ্ছে ধীরে ধীরে।

One comment on “

পরিপূরক

সরিতা আহমেদ

  1. চমৎকার গল্প… এমন পজিটিভ ভাইব খুবই দরকার এই অন্ধকার সময়কালে। শুভেচ্ছা জানবেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *