ওপেনিং সিন
“আরে ধুর কোথায় গেল ওয়াইড লেন্সটা? মা, ও মা, মা-আ-আ। আরে সাড়া তো দাও। বলছি আমার ওয়াইড লেন্সটা গেল কই। ১০-২০-র নিকনের লেন্সটা? অ্যাই দিদি, দিদি অ্যাই, আরে ক্যানন ইএফ এস ১০-১৮-টাও কই গেল? আরে ফ্লাইটের দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!” ঘরের মধ্যে এদিক সেদিক তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে যাচ্ছে প্রিয়াঙ্কা। কাল রাতেই নতুন অ্যাসাইনমেন্টটা কনফার্মড হয়েছে, ইন্ট্যারন্যাশানাল ডকুমেন্টরি প্রজেক্ট। ফ্লাইটের টিকিটও ওরা কেটে পাঠিয়ে দিয়েছে। প্রথমে হিথরোতে নেমে লন্ডনে কিছুদিন। তার পরে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। এই প্রথম একটা এত বড় প্রোজেক্টের ও ডি ও পি, একবারে ড্রিম প্রোজেক্ট। এর জন্যই তো অনেক কিছু ছেড়ে থাকা। এই জন্যেই তো…
কাট টু
ময়দানে তখন বৃষ্টি নামব-নামব, অরিত্র নিজের ম্যানিবাগটা প্রাণপণে খুঁজছিল। দুটো আইসক্রিম কিনেছে, কিন্তু সিক্স পকেট আর হালকা ছ-পকেটের ছাই রঙের জ্যাকেটের চারটে পকেটের মাঝে কোথায় যে রেখেছে মনেই করতে পারছিল না। চুলটা একটু অগোছালো, দাড়িটা মুখের সঙ্গে মানিয়ে সুন্দর করে শেপ করা। সদ্য অপারেশন করিয়ে চশমাটা বিদায় দিয়েছে। যদিও ফিল্ম স্কুলের সবাই বলে যাচ্ছে এখনও ওকে চশমাতেই বেশি ভালো লাগে। দুটো সরকারি ফ্লিম স্কুলেই পড়াচ্ছে অরিত্র, ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ে ফার্স্টক্লাস পায়নি বলে চাকরির চেষ্টাই করেনি। ফিল্ম নিয়ে পড়তে ঢুকেছিল। তারপর একের পর স্কলারশিপ নিয়ে নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, বুদাপেস্ত আর চেক রিপাবলিকের স্কুলে এখন মাঝে মাঝে যায় ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি হিসাবে। মানিব্যাগটা হাঁটুর কাছে রাখা পকেট থেকে বের করে ইন্দ্রানীর দিকে এগিয়ে যায় আইসক্রিম দুটো নিয়ে।
একটু দূরে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিল প্রিয়াঙ্কা এগিয়ে কথা বলতে যাবে অরিত্রর সঙ্গে। এমন সময়ে ঝেঁপে বৃষ্টি এল। ঝাপসা হয়ে যাওয়া শহরে ইন্দ্রানীর সাথে মিলিয়ে যেত দেখল অরিত্র কে। আর ঠিক তখনই ভলভো বাসটা সামনে এসে দাঁড়াল দৃষ্টি আটকে।
কাট টু
প্নেনের বিজনেস ক্লাসে চড়া এই প্রথম প্রিয়াঙ্কার। মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনে বিজনেস ক্লাসে চড়ে একটু উঁচু লেভেলে উঠে যাওয়া সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়াররা বা অগাধ পৈত্রিক সম্পত্তির মালিকরা, যারা পয়সা কীভাবে খরচা করবে ভেবে পায় না। ক্যামেরাটা কোলের উপরে রেখে জানলা দিয়ে দেখতে থাকে আকাশ রাতটা কেটে ভোর-ভোর হচ্ছে, সকালের নরম আলোটা জানলায় একটু ট্যারাভাবে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চটক ভেঙে ক্যামেরা তুলে তাক করে বাইরের দিকে। একের পর এক ছবি তুলতে থাকে, বর্ষার কালো মেঘগুলো অনেক দূরে।
কাট টু
অরিত্র ক্লাসে পড়াচ্ছে, প্রিয়াঙ্কা শুনছে মন দিয়ে আইজেনস্টাইন, রেনোয়া, জিগা ভের্তভ, কুরোসাওয়া, ঋত্বিক, মৃণাল, সত্যজিৎ, পোলানস্কি, গোদার, ত্রুফো তারকোভস্কি, শট ডিভিশন আর ক্লোজ আপে অরিত্রর মুখ। অরিত্রর অনেক বান্ধবী, প্রিয়াঙ্কার কোনও চান্সই নেই। অরিত্র প্রজেক্টারের দিকে পিছন করে ক্লাসের দিকে ফিরে টেবিলে ভর দিয়ে দাঁড়ায়। একটা পা আর একটা পায়ের উপর ক্রস করে একটা হাত টেবিলে সাপোর্ট নেয়। প্রিয়াঙ্কাকে বলে, “ক্লোজ শট ভালো, রিয়াকশ্যান বোঝা যায়। কিন্তু ওয়াইড একটা ছবিতে অন্য মাত্রা আনে, ব্যাপ্তি বাড়ে, অনেক লেয়ার থাকে আর তুলনায় অনেক কঠিন কিন্তু।” প্রিয়াঙ্কা চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারে না, পা দুটো যেন গেঁথে দিয়েছে কে মাটির সঙ্গে। অরিত্র কাঁচাপাকা ঝাঁকড়া চুলটা কপাল থেকে সরিয়ে, মৃদু হাসে। প্রিয়াঙ্কার পাশ থেকে দেওয়ালগুলো সরতে থাকে, দৃশ্যপট বড় হতে থাকে, চওড়া হয়, ভিড় জমে চরিত্রের।
স্তরের পর স্তর জমতে থাকে, প্রিয়াঙ্কা ফোকাস করতে থাকে ক্যামেরার লেন্সটা।
ক্ল্যাইমাক্স
তিন বছর পর দেশে ফিরে, নিজের ঘরে ঢুকে হাঁফ ছাড়ে খানিক, নিজের ঘরটা যে কী, সেটাই ভুলতে বসেছিল। তিন বছরে সুযোগ পেলেই তার নিরীহ, বাঙালী মা বিয়ের কথা ইনিয়ে বিনিয়ে তুলেছে। মা তাকে জানে। সময় বদলেছে সেটাও বোঝে। তবে ৫০ বছরের শিক্ষা চট করে তো আর কেউ ভুলতে পারে না। এক-একটা প্রজন্ম এক-একটা শিক্ষার মধ্যে দিয়ে, পরিবেশের মধ্যে দিয়ে যায়, আগের বা পরের প্রজন্ম সেটা বুঝতে পারে না পুরোপুরি। কেউ সংঘাতে যায় আর কেউ গুটিয়ে নেয়। ইন্ট্যারনাশানাল সিমটা বের করে, লোকাল সিম ভরল। মেল চেক করতে হবে। অনেক মেসেজও জমেছে। হোয়াটসঅ্যাপ পারতপক্ষে করে না। ল্যাপটপ খুলতে ইচ্ছে করছে না। খাটে শুয়ে মেসেজ আর মেল পড়তে শুরু করল।
অরিত্রর একটা মেল, বাংলায় লিখেছে।
প্রিয়াঙ্কা,
সিনেমা জীবন থেকে আসে, না জীবন সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত হয়, এ কথা এখনও তর্কের মধ্যেই থাকবে। একটা অন্যের পরিপূরক বলে মেনে নিলে হয়।
গোদার বলেছিলেন–
“The cinema is not a craft. It is an art. It does not mean teamwork. One is always alone on the set as before the blank page. And to be alone… means to ask questions. And to make films means to answer them.
“Cinema is not a series of abstract ideas, but rather the phrasing of moments”
জীবনে সবাই একা, মাঝে মাঝে সেট বদলায়, দৃশ্যপট বদলায়, চরিত্র বদলায়, কিন্তু আমরা সবাই একা। ভালোলাগা ভালো, কিন্তু সময়ের সাথে বদলে যায় অনেক কিছু।
ক্লাসরুমে তোমার ভালোলাগা সবার সামনে প্রকট হয়ে আসছিল, অথচ তুমি মুখে কিছু বলতে পারছিলে না। যেটা পারবে না সেটা ছেড়ে দিলে ভালো হয়। আর যদি না-পারাটাকে পারবই বলে ধরে নাও, তাহলে সময়ের সাথে সাথে সেটাও আস্তে আস্তে কাছে আস্তে শুরু করে।
আমার খোঁজ করতে চাইলে, করতে পারো।
তবে এর পরে কোথায় আমাকে পাবে আমি জানি না।
শেষ অংক
৬ মাস ধরে দৌড়াদৌড়ি করে নিজের জমানো পয়সা প্রায় নিঃশেষ করে, ইউ এস-এর জেল থেকে প্রিয়াঙ্কা ছাড়িয়ে আনে অরিত্রকে। ছ-ফুটের চেহারাটা গুটিয়ে কালশিটে মেরে সাড়ে চার ফুটের মনে হচ্ছে। রেপ, ড্রাগ আরও চার-পাঁচটা কেসে জোর করে ফাঁসানো হয়েছিল। ফাঁসানোই, কারণ পরের দিকে ডিফেন্স কাউন্সিল যুক্তি তুলে ধরায় পালানোর পথ পায়নি শেয়ালের দল। অরিত্রর নাম, প্রতিপত্তি কিচ্ছু কাজে আসেনি। সবাই সরে গিয়েছে। ডাক্তার জানিয়েছেন আগামী ১০ বছর কাউন্সেলিং আর ওষুধ চলবে, সিভিয়ার, ডিপ্রেশন, ওসিডি আর স্কিজোফ্রেনিয়া। ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে মানুষটা। প্রিয়াঙ্কা প্লেনের জানলা দিয়ে তাকায়। বাইরে অন্ধকার আকাশে অনেক দূরে কিছু তারা দেখা যাচ্ছে জানলায় চোখ লাগিয়ে রাখলে। প্রিয়াঙ্কা পুরো আকাশটা দেখতে চাইছে ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে, খুব দরকার দেখাটা, খুব…
গল্পটি ভাল। কারণটি অনুধাবন করতে সক্ষম হলেম না।
মানে খুঁজতে গিয়ে সময় ন ষ্ট না করে এইটুকু বলতে পারি, ‘অন্য স্বাদের গল্প’। এটাও তো একটা প্রাপ্তি।