একটি বাসি এবং বাজে ঘটনা

কিশোর ঘোষাল

হাওড়া দু-নম্বর প্ল্যাটফর্ম এখন যুদ্ধক্ষেত্র। ট্রেন ঢুকলেই যেমন হয়, গেটের সামনে তুমুল ধস্তাধস্তি। একদল “আরে, নামতে দিন, নামতে দিন, কী সব লোক রে, বাবা? নামতে দেবেন না নাকি?” বলে নামার জন্যে হাঁকপাঁক করছে। আরেকদল “একপাশ দিয়ে নামুন না, কত জায়গা লাগে নামতে?” বলে কনুইয়ের গুঁতো মেরে ঠেলে উঠছে। তাদের সঙ্গে আমরাও উঠে পড়লাম। আমি, আমার বন্ধু অভ্রময়। ভেতরে ঢুকে দুটো সিট দখল করতে যাব, ফুটবলের মতো গোল বয়স্কা এক মহিলা আমাকে ধাক্কা দিয়ে বেদখল করে নিলেন সিটদুটো। একটায় নিজে বসে, অন্য সিটে ব্যাগ চেপে, চেঁচাতে লাগলেন, “ভালো, অ্যাই ভালো, বাসি, অ্যাই বাসি।”
হাতের সিটটা ফস্কে গেল, কিন্তু বয়স্কা মহিলার সঙ্গে বিবাদ করাও চলে না। আমরা গোমড়া মুখে দাঁড়িয়েই রইলাম সামনে। এখন মহিলার ওই ডাক শুনে, আমি অভ্রকে বললাম, “এই বয়সেও ভালোবাসার খোঁজ করছেন!” অভ্র খুকখুক হাসল।
ভদ্রমহিলার কানে কথাগুলো না যাওয়ার কথা নয়, তিনি মুখ তুলে ভুরু কুঁচকে আমাদের দুজনকে নিরীক্ষণ করলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। ওঠা-নামার ধস্তাধস্তি এখন আর নেই, একটি মেয়ে মহিলার সামনে এসে দাঁড়াতে, হাতের ব্যাগ সরিয়ে মহিলা মেয়েটিকে বসতে দিলেন, আর জিগ্যেস করলেন, “ভালো কোথায়? উঠেছে?”
মেয়েটি ঘাড় নাড়ল, মৃদুস্বরে উত্তর দিল, “উঠেছে, ওই তো দাঁড়িয়ে আছে।”
“দঁড়িয়ে কেন? কোথাও একটু বসার জায়গা করতে পারল না?”
“আহ মা, এইটুকু তো যাব, তার জন্যে…”
“চুকঃ, তোদের শুধু আলসেমি, একটু উয্‌যোগ নিলেই সিট পাওয়া যায়। বললাম, আমার সঙ্গে উটে আয়, তা না, তোরা সেই উটের মতো দাঁড়িয়েই রইলি।”
“ও, আর দশ মিনিটের জন্যে এই বসাটা আলসেমি নয়?”
“চুকঃ, মুকেমুকে তক্কো করিস না।” মা আর মেয়ে সিটে গুছিয়ে বসল। তারপর মেয়েটি আমার দিকে তাকাল। আর সেই দৃষ্টিপাতে আমার যে অনুভূতি হল, সেটা বাসি নয়, যথেষ্ট টাটকা। বাসি মুচকি হেসে লাজুক চোখ নামাল, কিন্তু বাসির মা আমার দিকে এবার মুখ তুলে তাকালেন, বললেন, “এই বয়েসে আমি ভালোবাসা খুঁজিনি, বুঝেছ ডেঁপো ছোকরা? আমার ছেলের নাম ভালো, আর এই মেয়ের নাম বাসি। মা-কাকিমাদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটাও শেখোনি? যাবে তো অনেকদূর, নাকি?” অভ্র কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমি ওর হাত চেপে ইশারা করে বললাম, “হ্যাঁ, অনেকটাই দূর।”
মহিলা একটু ব্যাঁকা হেসে বললেন, “সে আমি দেখেই বুঝেছি। আমরা নামব এই উত্তরপাড়ায়, তখন আরাম করে বসে যেও।”
মাকে কনুইয়ের ঠেলা দিয়ে, মেয়ে মৃদু স্বরে বলল, “মা, চুপ করো না।”
“চুকঃ, চুপ করে থাকলে সবাই মাথায় চড়ে যায়।” এই সময় ভোঁ শব্দ করে ট্রেনটা ছাড়ল। বাসির মা জিগ্যেস করলেন, “লেট করল না? ক মিনিট দেখ তো।”
বাসি ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখে বলল, “ন-টা বাইশ।”
“তার মানে, পাঁচ মিনিট লেট! হ্যাঁ রে বাসি, সাড়ে দশটার মধ্যে পৌঁছতে পারব তো?”
“আরামসে পৌঁছে যাব, মা। টেনসান কোরো না তো।”
“চুকঃ। টেনসান করব না? তোদের কালকে সন্ধেতেই চলে আসতে বললাম, শুনলি না। জানতাম এটাই হবে। সকালে তোদের ঘুম ভাঙাতে ছেনি-হাতুড়ি ঠোকার অবস্থা!”
“মা? কী হচ্ছে কী? এটা ট্রেন!”
“চুকঃ, ট্রেন তো কী হয়েছে? আমি কখন বললাম যে এটা বাস?”
বাসির অস্বস্তি অনুভব করে, আমি কথা ঘোরানোর জন্যে বললাম, “কাকিমা, আমাদের কী দেখে বুঝলেন, আমরা অনেক দূরের যাত্রী?”
আমার এই আচমকা প্রশ্নে মহিলা একটু থতমত খেলেন, বললেন, “ইয়ে, মানে, ও আমি তোমাদের চেহারা, আচার-ব্যাভার দেখেই বুঝে গেছি। ডেঁপো আর ফক্কর।” হালুয়ার রেললাইনের জটিলজট ছাড়িয়ে ট্রেনের সবে একটু স্পিড উঠেছিল, আবার কমতে লাগল, লিলুয়া আসছে। আমি খুব নিরীহ মুখ করে জিগ্যেস করলাম, “দূরের ছেলেরা ডেঁপো আর এদিককার, মানে উত্তরপাড়ার ছেলেরা খুব লালু হয় বুঝি?”
“লালু মানে?”
“ডেঁপোর উলটো। ব্যাকরণে যাকে বিপরীতার্থক শব্দ বলে।”
মহিলা রাগ-রাগ গলায় বললেন, “মোটেও তা নয়, লালু মানে নিশ্চয়ই খারাপ কিছু।”
ভিজে বেড়ালের মতো আমি বললাম, “না, কাকিমা, লালু মানে ভালো।”
মহিলা এবার সত্যি রেগে গেলেন, বললেন, “আমার ছেলে ভালো, তুমি তাকে বলছ?”
উত্তরে আমি বললাম, “ভালো ভালোই তো, ভালো নয়?”
লিলুয়া পার হয়ে ট্রেন আবার দৌড়তে শুরু করল, মহিলা বললেন, “ভালো ভালো তো বটেই, ওর মতো ভালো আর হয় না।”
বাসি বলল, “মা, বাজে না বকে, একটু থামো না।”
“চুকঃ, বাজে বকছি মানে? আমার বাপু পেটে-মুখে এক কথা, যা বলার মুখের ওপর বলে দিই। সত্যি বলব তাতে ভয় কী?”
“ঠিকই বলেছেন। দূরের স্টেশনের ছেলেরা ডেঁপো আর বাজে। ট্রেনের গার্ডবাবুর ঘণ্টাটাও বাজে। ট্রেন যত দূরদূর যায়, ঘণ্টাটাও ততবার বাজে। এই বেলুড় ছাড়ার সময় দেখবেন, উনি ঘণ্টা বাজিয়ে দেবেন।”
মহিলা চোখ সরু করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
বললেন, “তার মানে? ঘণ্টা বাজার সঙ্গে বাজে ছেলের কী সম্পর্ক?”
বাসি ছোট্ট রুমালে হাসি মুছল। আমি বললাম, “সম্পর্ক নেই কাকিমা? দুটোই তো বাজে। ঘণ্টাটা আর দূরের ছেলেগুলোও…” আমার কথা শেষ হবার আগেই ঝালমুড়ির টিন নিয়ে ‘ঝালমুড়ি-ই-ই-ই’ এলেন। আমি কথা না বাড়িয়ে বললাম, “কাকিমা, ঝালমুড়ি খাবেন? বাসি নয়, টাটকা, বেশ ভালো ঝালমুড়ি। পাঁচটা দিন তো, দাদা।”
শেষ কথাটা আমি মুড়িওয়ালাকে বললাম। মহিলা খুব অবাক হলেন, আমার সাহস দেখে; রেগেও গেলেন খুব, বললেন, “ঝালমুড়ি বাসি কী ভালো সে আমি খুব জানি। তোমাকে আর ডেঁপোমি করতে হবে না।”
বাসি এবার হাসতে হাসতে বলল, “আমি কিন্তু ঝালমুড়ি খাব, মা। সকালে তাড়াহুড়ো করে বের করে আনলে, খিদে পেয়েছে।”
বাসির সমর্থন পেয়ে ঝালমুড়িওয়ালা নারকেল তেলের সাজানো ডাব্বাগুলো থেকে, দড়িতে বাঁধা ঢাকনাগুলো খুলে ফেলল চটপট। তারপর মাঝের বড় টিনের ডাব্বার ঢাকনা খুলে, স্টেনলেস স্টিলের মুড়িমাখা ডাব্বার মধ্যে মুঠো মুঠো মুড়ি তুলতে লাগল। এর পর শুরু হল, নানান ডাব্বা আর চামচের জলতরঙ্গ, তার সঙ্গে লাগাতার প্রশ্নমালা! পেঁয়াজ দেব? হুঁ। ধনেপাতা? হুঁ। শসাকুচি? না। কাঁচালংকা? কম। আচারতেল? হুঁ। ঝালমুড়িওয়ালা আর বাসির এই আলাপ আমি মন দিয়েই শুনছিলাম, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। সব বক্কাল দেওয়ার পর, মুড়িমাখা ডাব্বার মধ্যে চামচ আর হাতের বিপুল ঠনঠন মিশ্রণের আওয়াজ যখন চলতে লাগল, আমি অভ্রকে বলতে বাধ্য হলাম, “মুড়িমাখার এই ডাব্বাটা আর চামচেটাও তো দেখছি বাজে!”
পকেট থেকে পঞ্চাশটাকা বের করতেই, মহিলা বলে উঠলেন, “অ্যাই, তুমি টাকা দেবে না!”
“কাকিমা, আমরা বাজে, কিন্তু আমাদের নোট কাগজের, ওগুলো বাজে না। ঝালমুড়ির কথা আমি বলেছিলাম, দাম আমিই দেব।”

উত্তরপাড়া অব্দি আর কথা হল না, মুড়ির ঠোঙা শেষ হল। মহিলা ভালোছেলে এবং বাসিমেয়েকে নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমরাও। মহিলা মেয়েকে বললেন, “বাসি, ব্যাগট্যাগ সব নিয়েছিস তো?”
“নিয়েছি মা।”
“ক-টা বাজছে রে?”
“নটা বিয়াল্লিশ।”
“সাড়ে দশটার মধ্যে পৌঁছে যাব, বল? এখন একটা রিকশা পেলে হয়!”
“উত্তরপাড়ায় রিকশা পাওয়া যাবে না, মা? স্টেশনের বাইরে গেলেই দেখবে কয়েকশ রিকশ। তুমি এমন কথা বলো না!”
“বলা যায় না রে। কপাল মন্দ হলে… এ কী! তোমরাও উত্তরপাড়ায় নাকি? দূরে নামবে বললে?” হঠাৎ পিছন ফিরে আমাদের দেখতে পেয়ে মহিলা জিগ্যেস করলেন। আমি একটু হাসলাম, কোনও উত্তর দিলাম না। উত্তরপাড়ায় সবই তো উত্তর, কিছু প্রশ্ন আপাতত নিরুত্তরই থাক!

ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে, স্পিড কমে আসছে। বাসিমেয়ে আমার পাশে। সামনে কাকিমা আর ভালোছেলে। আমার পিছনে অভ্র। বাসি মুখ তুলে খুব মৃদুস্বরে যা বলল, শুনে আমি মৃদু হাসলাম। আমি বাসির ব্যাগ ধরা হাতটা আলতো ধরে, একটু চাপ দিলাম। বাসি মুখ তুলে তাকিয়ে, মুচকি হাসল।

ট্রেন থেকে নামা-ওঠার ভিড়ে আমি আর অভ্র প্ল্যাটফর্মে নেমেই, প্রায় দৌড়ে রিকশাস্ট্যান্ডে চলে এলাম। রিকশায় উঠে বিধানজেঠুর বাড়ির ঠিকানা বলতেই, রিকশা ভেঁপু হাঁকিয়ে দৌড়ে চলল। অভ্র এতক্ষণে কথা বলার সুযোগ পেল, বলল, “তুই যে এত ধুরন্ধর জানতাম না, শালা। এই ক-মিনিটের মধ্যে মেয়েটাকে পটিয়ে ফেললি? তাও শুধু ঝালমুড়ি খাইয়ে?”
আমি মুচকি হেসে বললাম, “দেখিস, জেঠু যেন জানতে না পারেন!”
“সে ঠিক আছে, জানতে পারবেন না। কিন্তু তুই তো শুধু নামটাই জানলি, ফোন নম্বর, ঠিকানা কিছুই জানলি না!”
“সে হবে-খন, ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? দাঁড়া, জেঠুর বাড়ি খালি হাতে যাব নাকি? ভাই, ভালো মিষ্টির দোকান দেখে একটু দাঁড়াবেন তো, মিষ্টি কিনব!” শেষ কথাটা রিকশওয়ালাকে বললাম।
রিকশওয়ালা প্যাডেল করতে করতে বলল, “সামনেই রাধাগোবিন্দ সুইটস পড়বে। ওতোরপাড়ায় ওরাই নাম করা মিষ্টি বানায়।”
“সেই ভালো, কিন্তু বাসি হবে না নিশ্চয়ই।”

জেঠুর বাড়িতে ঘণ্টাখানেক বসলাম। চা জলখাবার আর কিছু কথাবার্তার পর জেঠু বললেন, “চল তাহলে, ব্যাপারটা মিটিয়েই আসি। বাকি কথা দুপুরে খাওয়ার সময়ও সেরে ফেলা যাবে।”
বেরোনোর সময় জেঠিমাকে আরেকবার প্রণাম করলাম, আমার চিবুক ছুঁয়ে চুমো খেয়ে জ্যেঠিমা বললেন, “আমাদের ছেলেকে যে মেয়ে অপছন্দ করবে, তার কপালে অনেক দুঃখ আছে। তবে নবস্মিতাও খুব ভালো মেয়ে, বাবা। আমি বলছি দেখিস, তোদের জুড়ি খুব মানাবে!” আমি লজ্জা লজ্জা মুখে হাসলাম।

বড়রাস্তা পার হয়ে, গলিতে ঢুকে প্রথমবার বাঁদিকে, তারপর একটু এগিয়ে ডানদিকে ভাঁজ নিয়ে, বেশ খানিকটা গিয়ে জেঠু একটা বাড়ির দরজায় বেল টিপলেন। দরজায় নেমপ্লেট সাঁটানো, অমিয় চট্টোপাধ্যায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এক ভদ্রলোক দরজা খুললেন। বললেন, “আরে আসুন, আসুন বিধানদা। এসো বাবা, ভেতরে এসো। শুনছ, ওঁরা সব এসে গেছেন।” শেষের কথাটা উনি চেঁচিয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে বললেন।
আমরা তিনজন বাইরের ঘরের বড় সোফাটায় বসলাম। ভদ্রলোক বসলেন উলটোদিকের সোফায়। অমায়িক হেসে জিগ্যেস করলেন, “আসতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো, বাবা?”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “জেঠুর বাড়ি থেকে আপনাদের বাড়ি তো হাঁটা পথে দশ মিনিট, জেঠুর সঙ্গেই এলাম, অসুবিধে হবে কেন?”
“না না, তা নয়। আমি বলছিলাম কলকাতা থেকে আসার কথা। অনেকটাই তো দূর।” এই সময়েই ট্রেনের সেই মহিলা আর ভালোছেলে ঢুকল। আমি অবাক হইনি, কিন্তু ওঁরা হলেন, আর আমার পাশে বসা অভ্রও। অভ্র সোফা ছেড়ে লাফিয়ে উঠল, “আপনি?”
কাকিমা বললেন, “তোমরা? এই অব্দি হানা দিয়েছ? বিধানদা ওরা আপনার সঙ্গে এসেছে?”
জেঠু বললেন, “হ্যাঁ। কথাই তো ছিল, ওরা তোমাদের সঙ্গে, নবস্মিতার সঙ্গে আলাপ করতে আসবে! তুমি চিনতে পারোনি?”
কাকিমা বললেন, “না। ইয়ে হ্যাঁ, চিনি মানে… কলকাতা থেকে সকালে আমরা একই সঙ্গে এলাম। কিন্তু ছবিতে তো অন্যরকম দেখতে ছিল।”
জেঠু হো হো করে হেসে উঠে বললেন, “ছবিতে ওর গালে দাড়িগোঁফের জঙ্গল ছিল, এখন মরুভূমি। বাজের ওইরকমই আজে বাজে কাণ্ডকারখানা।”
“বাজে? এই ছোঁড়া আমাকে সারা রাস্তা বাজে কথা শুনিয়ে এসেছে, এখন আপনিও বাজে বলছেন?”
“আরে ওর নাম বজ্রপাণি, আমরা বাজে বলে ডাকি।” জেঠু বললেন।
আমিও চুপ করে থাকতে পারলাম না, বললাম, “নবস্মিতা যদি বাসি হতে পারে, তাহলে আমি বাজে হতে পারি না, কাকিমা?”
এই কথায় কাকিমা হইহই করে হেসে উঠলেন, সঙ্গে বাকি সবাই, আর তখনই বাসি চায়ের ট্রে আর বিস্কিট নিয়ে ঢুকল। সকলকে চা দিয়ে বাসি বসল উলটোদিকে, বাবার সোফার হাতলে।
কাকিমা বললেন, “তুই কি ওকে চিনতে পেরেছিলি, বাসি?”
বাসি লাজুক মুখে ঘাড় নেড়ে সায় দিল।
“আমাকে বললি না কেন?”
উত্তরটা আমিই দিলাম, “আপনি বলতে দিলে তো? আপনার চুকঃ-র ঠেলায় সুযোগ পেল কখন?”
“ও বাবা, এখন থেকেই এত আন্ডারস্ট্যান্ডিং?” কাকিমা মুচকি হাসলেন।
অভ্র এবার মুখ খুলল, “তাই তোদের দুজনের মধ্যে এত চোখাচোখি… ইশারা?”
আমি বললাম, “চুকঃ, হাটে হাঁড়ি ভাঙছিস! তোর আর বুদ্ধিশুদ্ধি হল না।”
এতক্ষণ খেয়াল করিনি, এখন করলাম, চুকঃ কথাটা মন্দ না, বেশ পাওয়ারফুল এবং এফেক্টিভ!
আমি বাইরে থাকি, দুদিন হল বাড়ি এসেছি। জেঠিমার ঘটকালিতে আমাদের বিয়েটা মোটামুটি পাকা। কিন্তু আমার মা-জেঠিমার নির্দেশ, বিয়ের আগে পাত্রপাত্রীর নিজেদের মধ্যেও চাক্ষুষ পরিচয়টা জরুরি। আর সেই উদ্দেশেই আজ আমাদের উত্তরপাড়ায় আসা।
আমাদের ট্রেনযাত্রার সব কথা শুনে জেঠু হাসতে হাসতে বললেন, “আমদের বাজেটা আসার পথেই বাসি আর বাজে একটা ব্যাপার ঘটিয়ে ফেলেছে দেখছি। মনে হচ্ছে এ একেবারে প্রজাপতির নির্বন্ধ। কী বলো অমিয়?”
“এই বাজে ঘটনাটা যাতে কিছুতেই বাসি না হয়ে যায়, সেটা দেখা এখন আমাদের কর্তব্য। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা, আমি কিন্তু আপনাকে আর কোনোমতেই বিধানদা বলতে পারব না… সে আপনি যাই মনে করুন।”
জেঠু অবাক হয়ে বললেন, “সে কী! কেন?”
অমিয়বাবু গম্ভীরভাবে আমাদের এবং জেঠুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, কোনও উত্তর দিলেন না। একটু পরে আমাদের আশ্চর্য হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন, “আপনাকে আর রেহাই দেব না, বিধানদা, আপনাকে এখন থেকে বেহাইদা বলব!”
জেঠু স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললেন, “তাই বলো, আমি ভাবছি কী না কী!” তারপর তিনজনেই খুব হাসতে লাগলেন।
আমি বাসির দিকে তাকালাম, ও আমার দিকেই তাকিয়েছিল, চোখাচোখি হতে লাজুক চোখ নামাল।

6 comments on “

একটি বাসি এবং বাজে ঘটনা

কিশোর ঘোষাল

  1. বাহ বাহ বাহ। এমন নিপাট সুন্দর আকর্ষক আর মজাদার প্রেমের গল্প অনেনেনেকদিন পর পড়লাম। খুব খুব ভাল লেগেছে। অনবদ্য স্টাইল। তোমার কলমকে হাজার নমস্কার।

    1. @ হিমাদ্রিঃ অনেক ভালোবাসা নিও, অস্ট্রেলিয়া থেকে কবে ফিরছো?

  2. বাহ বাহ! খুব সুন্দর গল্প। নিটোল, মজাদার। পড়ে খুব মজা পেলাম। মিষ্টি প্রেমের গল্প। ঝালমুড়িওয়ালার জায়গাটা অনবদ্য।

  3. নির্মল এবং অত্যন্ত উপভোগ্য একটি গল্প…খুব ভালো লাগলো

Leave a Reply to কিশোর ঘোষাল

Your email address will not be published. Required fields are marked *