বিলুচাচা আর তার বাক্স

মহম্মদ কাইফ

বিলুচাচাকে তার বাক্স ছাড়া কেউ কোনোদিন দেখেনি। শীতকালের ভোরের ঘন কুয়াশায় বা বর্ষার মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে, বিলুচাচা ক্রমশ অষ্পষ্ট হয়ে গেলেও, পিঠে ফেলে রাখা বাক্সটা কিন্তু জ্বলজ্বল করতে থাকত। সেই বাক্সে কী আছে কাউকে বলত না বিলুচাচা। ছোট্টো স্টিলের তৈরি বাক্স পিঠে ফেলে আপন মনে ঘুরে বেড়াত সে। কারও সঙ্গে কথা বলত না। বিলুচাচার বাক্সের রহস‍্য নিয়ে অনেক গল্প ভেসে বেড়াত হাওয়ায়, গল্পগুলো লেগে থাকত অ্যান্টেনায় আটকানো ভোকাট্টা ঘুড়ির সঙ্গে। কেউ বলত ভিনগ্ৰহীদের সঙ্গে বিলুচাচার সম্পর্ক আছে। তারা নাকি খুব রাতে নেমে আসত বিলুচাচার সঙ্গে কথা বলতে। আমাদের বাড়ির পাশেই যে পার্কটা, যেখানে আমরা দল বেঁধে খেলতাম, সেখানেই এলিয়েনদের সঙ্গে বিলুচাচাকে আড্ডা দিতে দেখেছিল সুবীরকাকু‌। পরেরদিন সকালে পার্কের রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল সুবীরকাকু। জ্ঞান ফিরে সবাইকে সেই গল্প বলেছিল সে। কেউ বিশ্বাস করেনি হয়তো, কারন সুবীরকাকু প্রায়শই রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরত। নেশার ঘোরে কী না কী দেখেছে!
কিন্তু মা বলত বিলুচাচা বাক্সে ভূত পোষে। ভাতের থালা নিয়ে মা বলত, “সবটা না খেলে বিলুচাচাকে ডাকব আর বাক্সটা খুলে দিতে বলব, ভেতরে কী আছে জানিস তো?”

তখন ছোট ছিলাম , বুঝতাম না। সব গল্পকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার সাহস বুকপকেটে জন্মায়নি‌। কিন্তু তারপর বড় হতে হতে সেই গল্পগুলোকে ক্রমশ ফিকে হয়ে যেতে দেখেছি। বিশ্বাস করতে শুরু করেছি বিলুচাচা পাগল আর পাগলদের এক একটা জিনিসের প্রতি অদ্ভুত মায়া থাকে, বাক্সটার উপর হয়তো বিলুচাচার নিতান্ত একটা মায়া জড়িয়ে আছে; আর কিছু নয়!

কিন্তু আমার ভুল ভাঙল একদিন। সেবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছিল বেশ ক-দিন ধরে। আমি পার্কের বেঞ্চটায় বসে ছিলাম সেরকমই একটা বৃষ্টির দিন। পাশে বাইসাইকেলটা দাঁড় করিয়ে রেখেছি। সাইকেলে রাখা স্কুলব‍্যাগ। ব‍্যাগের মধ্যে লাল-নীল চিঠি; আইসক্রিম আর অনেকটা মনখারাপ। আমার চোখেও সেদিন মেঘ করেছিল। চুপচাপ বসেছিলাম‍। খেয়াল করিনি পাশে কখন এসে বসেছে বিলুচাচা। খুলেছে তার বাক্স। হঠাৎ চোখ পড়তেই চমকে গিয়েছিলাম‍। ভয়ে তার পাশ থেকে সরে এসেছিলাম একটুখানি। কিন্তু বিলুচাচার মুখে এক অদ্ভুত হাসি লেগেছিল। আমার ভালো লাগছিল। খোলা বাক্স থেকে বিলুচাচা বের করে আনল একটা কাঁচের গ্লোব। আকাশে মেঘের ঘনঘটায় চারপাশটা স্লেটের রঙের মতো হয়েছিল। কিন্তু তার মধ‍্যেই গ্লোবটার ভেতর সাতটা রামধনু রঙ ভেঙে ভেঙে অদ্ভুত একটা রঙিন মেঘ তৈরি করছিল। আমি হাতে নিতে চাইলাম সেটা। বিলুচাচা বাড়িয়ে দিল সেটা আমার হাতে। হাতে নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলাম সেই গ্লোবের ভেতর। আস্তে আস্তে একটা আবেশে চোখ বুজে আসছিল আমার। শুনতে পাচ্ছিলাম খুব মৃদু একটা ঝরনার শব্দ। কোথাও কুহু কুহু করে একটানে একটা পাখি ডেকে যাচ্ছে। আমার চোখ বুজে আসছিল ক্রমশ…
ঘুম ভাঙলে নিজেকে আবিষ্কার করলাম ছোট্টো একটা চার দেয়ালের ঘরে। একটু যেন নড়ছে ঘরটা। তারপর আরও অনেককে দেখতে পেলাম সেই ঘরে। সবাই হাসিমুখে বসে আছে। কারও কোনও মনখারাপ নেই। আমারও নিজেকে অনেক হালকা লাগছে। এখান থেকে আর বেরোতে ইচ্ছে করছে না। মুখ তুলে দেখলাম উপরে নীল আকাশ। তুলোর মতো মেঘ বিভিন্ন আকৃতি নিয়ে ছুটে চলেছে। একটা পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে নিজেকে দেখলাম উড়ে যেতে। এই ঘরে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। বিলুচাচার বাক্সের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি৷ ঘুমের মধ্যে সময় পেছনে ছুটতে লাগল। আমার ফেলে আসা সময়গুলোকে আলোর গতিতে পেরিয়ে যেতে দেখলাম।
দেখলাম, মা ভাতের থালা নিয়ে আমার সামনে বসে৷ বলছে, “পুরোটা খেতে হবে কিন্তু, নইলে…”
মাকে থামিয়ে আমি বললাম, “মা, বিলুচাচা বাক্সের ভেতর ভূত পোষে না…”

মনমর্জিয়া – পর্ব এক

সঙ্গীতা দাশগুপ্তরায়

বিশ্বাস

যারা ঘুমের মধ্যে মুখ দিয়ে নিশ্বাস নেয়, তাদের মুখখানা অল্প একটু খুলে থাকে ঘুমন্ত অবস্থায়, যা দেখে আনরোমান্টিকরা বলে, “দ্যাখ, হাঁ করে ঘুমোচ্ছে কেমন!” রোমান্টিকরা অবশ্য বলে, “আহা কেমন ফুলের মতো ঠোঁটদুটো ফাঁক হয়ে থাকে, সুরেলা সুগন্ধী শ্বাস ভেসে ভেসে বিলীন হয় পঞ্চভূতে। কার্বন ডাই অক্সাইডটুকু লুফে নেয় জানলায় উঁকি দেওয়া মাধবীর পাতাগুলো।”
আমি নিজেও ওভাবেই ঘুমোই, যার ফলে শুকনো ঠান্ডা জায়গায় ভীষণ গলাব্যথা হয় ঘুম থেকে উঠলে। ডাক্তারের পরামর্শে তাই বস্টনে বা ওই রকমই শুকনো ঠান্ডার মধ্যে থাকলে হিউমিডিফায়ার চালিয়ে ঘুমোতে হয়।
যে হিউমিডিটি আমাকে কলকাতায় পোস্ট-ইট প্যাড বানিয়ে দেয় ঘামিয়ে, যে হিউমিডিটির চোটে রসিকাদির হাত থেকে শোনপাপড়ি নিতে গিয়ে পাই মিষ্টি বেসনের চ্যাটচ্যাটে চৌকো, যে হিউমিডিটি নেহাতই ‘ম্যাগোঃ’, সেই হিউমিডিটিই পয়সা খচ্চা করে আমাকে ঘরে ছড়াতে হয় এই বিদঘুটে মুখ দিয়ে শ্বাস টানার কারণে।
নিজেকে বোঝাই মুখ থেকে আশ্বাস বেরোক না বাপু, এই তো যেমন রাজনৈতিক নেতাদের বেরোচ্চে! তা না, আ গেছে আমবাগানে, শ্বাস নিতে গিয়ে জীবনে বেদনা ও গাঁটের গচ্চা… যদি ফকির বা সুফি ধরনের মানুষ হতাম তো এই নিয়ে কিছু গান লিখতে পারতাম। এই সব শ্বাস-আশ্বাস বাস-সুবাস নিয়ে লেখা যত গান শুনি, ততই বুঝি কী অপদার্থতাময় এ জীবন আমাদের। আসলে তো শেষে সেই ছাই… তাও আবার ভাসিয়ে দেওয়া। অনেক সময় সিনেমায় দেখি খুব সুন্দর কোনও মুখ বন্ধ পাত্রে ‘গ্র্যান্ডমা’স অ্যাশ’… ঘরের মধ্যে মরা মানুষের দেহাবশেষ নিয়ে ঘুম কী করে আসে জানি না। তবে আসে নিশ্চই লোকের। যদিও আমি ভিতু নই, তাও মানুষ পোড়া ছাই পাশে নিয়ে ঘুমোনো আমার জন্যেও অসম্ভব, সে তুমি হিউমিডিফায়ার দাও বা না দাও।
সাধারণত কবরস্থানের পাশ দিয়ে মাঝরাতে যাতায়াতে আমার অসুবিধা হয় না। অবশ্য আমি ওই পার্ক স্ট্রিটের বিখ্যাত ফটো-অপ কবরখানায় যাইনি কখনও। যেগুলোর পাশ দিয়ে গেছি, সেগুলো সবই ঘুটঘুটিয়া এক অংশ শহরের ধারে ধারে। বস্টনে তো শহরের মধ্যেও অনেক ক-টি আছে। পাঁচিল উঁচু নয়, পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সারি সারি টুম্বস্টোন দেখতে দেখতে মানুষ নিচু গলায় কথা বলে। মৃতরা তো কানে শোনে না, তাও জোরে কথা বলে না কেউ ওঁদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়।
আমার বন্ধু রুথের কাছে শুনেছি, তাঁদের বাড়িতেও আছে ‘গ্র্যান্ডপা’স ভাস’– আসলে ভাস-এর মধ্যে গ্র্যান্ডপা-ই ছাই হয়ে রয়েছেন।
সবিতাব্রত হাঁ করে শুনছিল সে গল্প। সে বান্দা ভারী বিশ্বাসী। কলকাতায় যখন সবে সুলভ শৌচালয় তৈরি হচ্ছিল, তখন সে অনেক নতুন শৌচালয়ের দিকে না তাকিয়েই সেটাকে মন্দির ভেবে মাথায় হাত ঠেকিয়েছে। রাত হয়ে গেলে সে বস্টনেও কবরখানার রুট দিয়ে যায় না। অবশ্য একবার ও আমাকে একটা কবরখানা দেখিয়ে বলেছিল, এইটার পাশ দিয়ে যেতে আমি ভয় পাই না, কারণ এটা মিলিটারিদের আর মিলিটারিরা কখনও কারুর ক্ষতি করে না। এটাও ওর বিশ্বাসের লিস্টিতেই আছে। তা আমাদের আড্ডায় রুথের দাদুর ছাইয়ের ভাসের গল্প শুনে তাকে সবিতাব্রত জিগিয়েছিল, “তাহলে তো তোমাদের বাড়িতে কখনও ঝগড়াঝাটি হয় না, বা জোরে গান শোনা, পার্টি-টার্টি? গ্র্যান্ডপা-র ওই ওইটা…”
রুথ ভুরু কুঁচকে বলল, “হোয়াই ডু ইউ অ্যাজিউম মাই গ্র্যান্ডপা ওয়াজ আ বোরিং পার্সন?”
হক কথা! মরণের পরে এন্টারটেনমেন্টের ব্যবস্থা এমনিতেই জিরো। উঁহু, যদি ভাবেন মরার পরে স্বর্গে গিয়ে অপ্সরাদের নাচ দেখবেন তো, আগেই বলে রাখি সেখানেও এখন ওরা ফ্রি ইউটিউব চালিয়ে রাখে ইন্দ্রসভা জুড়ে। তার কিছু কিছু ঝলক আমি এদেশের ইন্ডিয়ান রেস্তঁরাতে দেখেছি। বিশাল চেহারার ভয়ানক গুঁফো হিরো হাম্বা চাম্বা করে হিরোইনকে তুলে ফেলে ছুঁড়ে লুফে নাচছে গাইছে। আর হিরোইন? তাঁদের শরীরে হাড় নাই, চুইংগামের দেহ। এই মোচড় সেই আঁচড় এই ঠুমকা ওই ঝঙ্কার দিয়ে নেচে নেচে পাহাড় মরু সাগর সব কভার করে ফেলল ভিজে তিন হাত শাড়িতে, বাকি আড়াইহাত রাখা আছে, পরের নাচে পরবে।
এ নাচ আমি দুর্বোধ্য গান এবং বারো ডলার প্লাস ট্যাক্সের বুফের সাথে চিবিয়ে গিলে দেখেছি অনেকবার। চারিপাশে আরও লোকজনও ওই– খায় আর দেখে। শুধু আম্রিকান লোকজন ওই টিভির দিকে তাকায় আর আমাদের দিকে তাকায় বারে বারে। মেলাতে চায় বোধ হয়… মিল যে পায় না সে তাঁদের পরবর্তী সময়ে মুরগির পদসেবার ধুম দেখেই বুঝি।
তবে দিনকাল যেভাবে এগোচ্ছে, মানুষ হয়তো আর পাঁচ বছর পরে ইয়ারফোনের জায়গায় পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের ছ সেমি নিচে একটা চিপ লাগিয়ে নেবে। মরে ছাই হোক বা মাটির নিচে যাক, সেখান থেকেও ফোন, গান ইত্যাদি মিস করবে না বলেই মনে হয়।
এই যে আমি আইডিয়াটা ভাসিয়ে দিলাম, এটাই দেখবেন কোন অগমেন্টেড রিয়ালিটির চামচা একজিকিউট করে এক হপ্তায় বিলিয়নিয়র হয়ে যাবে এবং তখন কেউ বিশ্বাস করবে না যে এ আইডিয়া আমার।
আসলে বিশ্বাস ব্যাপারটা তো এক্কেবারে নিজের ওপর। আমি যদি বলি বহুদিন আগে আমি এক ভাঙা বাংলোর মেঠো বারান্দায় বসে পূর্ণিমার রাতে একজনকে বলেছিলাম রবীন্দ্রনাথ মুরগির চেয়ে হাঁস বেশি পছন্দ করতেন তো কেউইই কি তা বিশ্বাস করবে না? করবে মশাই। কেউ কেউ তো করবেই, কারণ প্রমাণ আছে আমার কাছে। রবিঠাকুর যে লোক দিয়ে হাঁসের কবিরাজি কাটলেট ভাজিয়ে ভোরবেলা লুকিয়ে প্রাতঃরাশে খেতেন সে প্রমাণ তিনি নিজেই গানে লিখে গেছেন– “তুমি duck দিয়েছ কোন সকালে, কেউ তা জানে না”– অতএব?
তবে হ্যাঁ, বাকিটা, মানে আমি, ভাঙা বাংলো, পুন্নিমা ইত্যাদিগুলো নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামাবেই না অথচ ইয়ে, ওটাই আসলে… হে হে…
যদিও হলফ করে বলতে পারি লোকে জিগাবে কোন জায়গার বাংলো, কার সঙ্গে গেছিলাম, বাড়িতে বলে নাকি না-বলে ধরনের কূট বোকা প্রশ্ন, কিন্তু আমার যাওয়াটা বিশ্বাস করেই নেবে অথচ ওটাই বিশ্বাস করার নয়। এ ব্যাপারটা আমাকে শিখিয়েছিল পিনাকীকাকু। পিনাকীকাকু বাপির বন্ধু ছিল। আমাদের বলত, “লোকের সব কথা বিশ্বাস করবি না। এই যে আমার বাড়ির সবাই, মায় তোর কাকিমাও বলে, উফহ, তুমি কী জোরে নাক ডাকো! তা কি আমি বিশ্বাস করি? একদম করি না। অত যে ডাকি কেউ কি সাড়া দিয়ে আমাকে বলে, এই যে পিনাকী, অ্যাত ডাকাডাকি কীসের? কী বলছিস? আসলে সব বাজে কথা। ডাকলে সাড়া দেবে তো মানুষ, নাকি?”
এটা বলেই অবশ্য আমাকে বলেছিল, “খবদ্দার এটা তোর কাকিমাকে বলিস না যেন।”

ভাবছেন এসব কেন লিখছি? কারণ একটু আগে ইউটিউবে একটা ফিল্মি অনুষ্ঠানে দেখলাম স্টেজে সুন্দরীরা নাচছেন আর অমিতাভ অল্প একটু হাঁ করে হাসি-হাসি মুখে নাচ দেখছেন। কই তাঁর সাথে কোনও হিউমিডিফায়ার তো দেখলাম না। বুঝছি না অমিতাভকে বিশ্বাস করব, না ডাক্তারকে…

লাগামছাড়া

ঝিরি ঝিরি বরফ নামে শরীর, মাথা ঘিরে। রাস্তা ঢেকে থাকে বরফে এ দেশে। অনেকদিন অবধি চালগুঁড়ো, খাবার সোডা আর আইসিং সুগারের তফাত বুঝতাম না। আজও যে বুঝি তা নয়। তবে বরফ বুঝি। এক বাটি গুঁড়ো আকাশ থেকে নামা বরফের মেঘ আর এক বাটি চালগুঁড়ো রাখলে তফাৎ বুঝব না এত বড় মাধু গড়াই নই আমি।
মাধু গড়াই একেবারেই বুঝত না কোনোকিছু। ছেলে-বউ শুয়ে থাকার কালে তাদের ঘরে দুমদাম ঢুকে পড়তে নেই বুঝত না। ধুধুল আর ঝিঙে বাজারে পাশাপাশি থাকলে বুঝত না কোনটা পোস্তয় দেয় আর কোনটা শুকিয়ে ছোবড়া বানায়। ধার চাইতে গিয়ে খেদানি খেলেও বুঝত না লোকে ধার দিতে চাইছে না কারণ সবাই জানে মাধু শুধবে না। এমনকী এও বুঝত না বউ মরে যাওয়ার পর বউয়ের বোন সংসার সামলাতে এলে ধেনো কী বাংলা খেয়ে তার আঁচলে টান দিতে নেই।
এসব অবুঝপানা মাধু গড়াইকে বউ বেঁচে থাকার দিনগুলোয় আতাক্যালানে আর বউ মরার পরে হারামি এক বুড়োর আখ্যা পাইয়েছিল।
এসব আখ্যা মরণোত্তর। দেশ গাঁয়ে কিপটে কী দিলদার, সাধুপ্রতিম কী বিষ শয়তান এসব অর্জিত আখ্যা চিতায় ধোঁয়া হয়ে যায় না। বংশানুক্রমে মানুষ বাপ ঠাকুদ্দার ভালো মন্দের ভাগ কাঁধে বয়ে বেড়ায়।
সুকু ছিল মাধুর নাতি। তবে সুকুর মন ছিল পড়াশুনোয়। অনেক কষ্টে ভালো রেজাল্ট করে সে অনেকদূর অবধি গেছিল। শেষে বাপের কিছু জমি বেচে এলাকায় একটা প্যাথলজি সেন্টার করে। মানুষের বর্জ্য নিয়ে নাইলনের ব্যাগে করে সে চালান পাঠাত বড় জায়গায়, রাতে ফলাফল ফিরে এলে যত্ন করে গুছিয়ে রাখত। পরদিন লোকে রিপোর্ট নিতে যাওয়ার সময়ে পথে কারুর সাথে দেখা হলে বলত, “ওই যে হারামি গড়াইয়ের নাতির ওখানে যাচ্ছি। ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা করতে বলেছে। পেচ্ছাপও দিয়েছি। নাকি ইউরিক অ্যাসিড না কীসব থাকতে পারে।”
ধীরে ধীরে এলাকার বুড়োরা বিভিন্ন সময়ে চোখ বুজতে শুরু করলে মাধুর নামটা মুছে যায়। কারণ তদ্দিনে সুকু গড়াই কিছু ভালো কাজ করেছে। যেমন, মানুষের ক্ষমতা বুঝে দু-চারটাকা কম নেওয়া বা বিপদে-আপদে কোন ডাক্তারের কাছে যাওয়া বিধেয় তা খোঁজ নিয়ে জানানো।

এভাবেই ভালো দিয়ে মন্দকে মুছে দিতে হয়, বলত নাজমা বুয়া। বুয়াদের ধর্মে দোল নেই, মেড়াপোড়াও নেই। কিন্তু বিহারি উল্লাসে রাবণ পোড়ানোর পর ধিকি ধিকি আগুনে আলু পুড়িয়ে খাওয়া তো আছেই। অতএব নাজমা বুয়া কোঁচড়ে মেটে আলু, রাঙা আলু নিয়ে মেড়াপোড়ার উৎসবে অংশীদার হত এবং পোড়া আলুতে ঝাল নুন ছিটিয়ে খেয়ে আঁচল দিয়ে নাক মুছতে মুছতে বলত, “এভাবেই বুঝলে মণি, খারাপ সব কিছুকে পুড়িয়ে জ্বালিয়ে জল ঢেলে ধুয়ে পরদিন অমনি আলো আলো রং দিয়ে খেলা করে ভুলে যেতে হয়।” ভোলা নাজমা বুয়ার জন্য সহজ ছিল না এমনিতে। বুয়ার দাদারা কবে কী করে ওর বরকে ঠকিয়েছে, সে নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদার সময় কারুর ক্ষমতা ছিল না বুয়ার গায়ে এক খাবলা রং দিয়ে বলবে, “এই নাও, আলো আলো রং দিয়ে খেলা করে সব ভুলে যাও।”
আসলে এত স্পষ্ট সত্যি বলার ক্ষমতা তো থাকে না তেমন। সবাই সবাইকে সব সত্যি বলছে, এমন দিন এলে যুদ্ধ অনিবার্য– দেশে দেশে না, ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায়।

অভিজিৎ সেনগুপ্ত ছিল আমাদের টিন এজের শেষের দিকের বন্ধু। সতেরো-আঠেরো বছরে আমরা সবাই যখন বেতসলতা কী সদ্য গজানো সজনে ডাঁটার মতো চেহারার, অভিজিৎ তখন ইয়াব্বড় বৃকোদরটি। বন্ধুরা কেউ সেদিকে ইঙ্গিত করলে অভিজিৎ হেসে হেসে বলত, “আরে বুঝলি না, আমাদের এক হাঁড়ি বিশ পেটা বাড়ি। ঘরে ঘরে হাজার কথা। স—ব গোপন। কাউকে কিচ্ছু বলা যাবে না বাবা। পেটে কথা রেখে রেখেই ফুলে গেছে।”
আমাদের মতো ছোট পরিবারের ছেলেমেয়েরা একান্নবর্তী পরিবারের ছেলেপুলের ভুঁড়ি সমস্যার কারণ শুনে হাসতাম।
যদিও বড় হওয়ার কালে বহু লোকের ক্রমবর্ধমান ভুঁড়ি দেখে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে জাগে বটে যে বসের প্রতি না দেওয়া গালি, ঘরে বাইরে নিত্যিদিনের না বলতে পারা বহু স্পষ্ট সত্যি কথা জমে ভুঁড়ি বাড়ে– এ ধারণা ভুল না হতেও পারে।
সেনগুপ্তকে দুটো কারণেই মনে পড়ে। এক এইটি আর অন্যটি হল ওর হারানোর স্বভাব। তার সঙ্গে মাত্র দুটি বছরের জার্নি আমার এই এত বড় জীবনে এবং ওই দু-বছরে তাকে যা যা হারাতে দেখেছি, তা দিয়ে সম্ভবত একটি দিন আনি দিন খাই সংসার দুই সিকি পরিমাণ গুছিয়ে উঠতে পারত।
পরবর্তীকালে আমার একটি মেয়ের সাথে পরিচয় হয় যে জন্মেছে জিনিস ‘পাওয়া’র ভাগ্য নিয়ে। রাস্তায় পড়ে থাকা কয়েন, সাবানের স্ক্র্যাচ কার্ডে ঝুটো মুক্তোর পেন্ডেন্ট, সবজিওয়ালার কাছে শেষ বেলায় পড়ে থাকা চারটে লেবু একটাকায়, যখন নাকি সারা দিন লোকটা একটাকায় তিনটে লেবু দিচ্ছিল…
একবার একটা বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে বড় বাস্কেটে ক-টা পিংপং বল আছে গেস করে হাজার টাকার গিফট সার্টিফিকেটও পেল। যদিও তাতে তার মন ভরেনি। সে বছরের পর বছর অপেক্ষায় আছে টিভির একটি গেম শোয়ে ডাক পাবে নতুবা রান্নার অনুষ্ঠানে, যাতে সারা বছরের তেল নুন মশলা বাড়িতে আনতে পারে শুধু একটিমাত্র পদ রেঁধে। কিছুদিন আগেই বিয়ে হয়েছে তার। এখন সে একদিন রেঁধে এক বছরের র‍্যাশন রোজগারের চমক শ্বশুরবাড়িতে দিতে চাইবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে সম্ভবত নান্দিমুখের ছাড়া শাড়িটির মতো ‘পাওয়া’ ভাগ্যটিও বেচারির বাপেরবাড়ির চৌকাঠে আটকে গেছে। অবশ্য তার বাপের বাড়িতে চৌকাঠ নাও থাকতে পারে। ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকলে চৌকাঠ থাকার সম্ভবনা নেই। আমাদের ছোটবেলায় বাড়িগুলোতে ইয়াব্বড়বড় চৌকাঠ দিয়ে ঘরের গণ্ডি দেগে দেওয়া হত। ঘর আর বারান্দার মধ্যের ওই চৌকাঠে উঠে নেমে আমরা কুমিড্ডাঙা খেলতাম। বর্ষার দুপুরে চৌকাঠ আমাদের খেলা দিত। লোডশেডিং-এর সন্ধেয় আমরা চৌকাঠে মোমবাতি লাগাতাম ঠিক সেই জায়গাতেই, যেখানে কালীপুজোর এঁটো মোমটুকু নাছোড় হয়ে লেগে আছে। আমাদের পুরোনো বাড়িতে এখনও অনেক জায়গায় অমনি মোম আটকে আছে… চৌকাঠও রয়েছে সব ঘরেই…
শুধু আমরাই নেই… আর থাকার সম্ভবনাও নেই। বাড়িটা চৌকাঠ সমেত অপেক্ষায় আছে অনিশ্চিত ভবিতব্যের…

বাইরের বরফ এখনও ঝিরিঝিরি নামছে। সদ্য নামা এই বরফের রাশিও ভবিষ্যৎ জানে… তাপমাত্রার তারতম্যে কিছু ব্ল্যাক আইস জীবন বা ধারাবাহিক এইচটুও। অতঃপর কোনও না কোনও আধারে সুখসমর্পণ। কেবল সঠিক উত্তাপটুকুই স্থির করে এই সব আগমনী ভবিষ্যৎ, যা আমরা আর আমাদের সাবেকি বাড়িটিকে দিতে পারি না… ফলত বাড়িটি এক বিশাল আমগাছ এবং বিভিন্ন ঘরের দেওয়ালে আমাদের ফেলে আসা স্মৃতি নিয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকে উষ্ণতার অপেক্ষায়।
এদিকে আমরা উষ্ণায়নবিরোধী এ পৃথিবীর ভালোর জন্যই।
পারস্পরিক টানাপোড়েনের মধ্যে আমি টের পাই এখনও আমি কেবল বরফটুকুই আলাদা বুঝি। কিন্তু চালের গুঁড়ো, খাবার সোডা আর আইসিং সুগার আলাদা করে চিনতে আমাকে জিভ দিয়ে স্পর্শ করতেই হয়…
ইন্দ্রিয়নির্ভর আমি ঘরে বসে বরফের ঝড় দেখি পুরনো বাড়িটির কথা ভাবতে ভাবতে।

হলুদ আলো

কাজরী ভৌমিক গায়েন

অনেকদিন না কি অল্পদিন, অনেকমাস না কি অল্পমাস, এই বাড়িটাতে থাকি। কত ঘর, সিঁড়ি, খাট, টেবিল, চেয়ার। আর নীলজামামেয়ে। কত আলো। কী সুন্দর জায়গা। কত ফুলগাছ। কিন্তু সেই বাড়িটা কোথায়? সেই ছেলেটা, কী যেন নাম… সেই লোকটা… ওরা কোথায় কে জানে। আমার এখানে বেশ লাগে। পাখিরা ‘গুড মর্নিং’ বলে। ওই যে পাহাড়ের গায়ে উনুনে রান্না হয়। মা রান্না করে। ছোট ছেলেটা খেলা করে। বিকেলে কীসের যেন গান শোনা যায়। শুধু মাঝে মাঝে শীত করে। তখন একটা হলুদ রঙের কম্বল গায়ের ওপর দিয়ে দেয়।
এখন বোধ হয় সকাল। নীলজামামেয়ে জানলা খুলে দিল। ছোট ছোট ওগুলো কী যেন দেখা যাচ্ছে? ‘ওগুলো টিলা।’ সাদা সাদা কী যেন চামচ করে খাইয়ে দিল। ওই তো ওরা হেঁটে হেঁটে টিলার ওপর উঠছে মায়ের হাত ধরে। হাত ছেড়ে দৌড় দৌড়। মা নিশচয়ই বকছে, ‘পড়ে যাবি তো!’ ওরা কী সব নিয়ে গোল হয়ে বসেছে। খেলনাবাটি বোধ হয়। আমার খেলনাবাটিগুলো কোথায় যে গেল। সেই যে সেবার মেলা থেকে দিদা কিনে দিল! ওরা এবার সব নুড়িপাথর সাজিয়ে রান্নারান্না খেলছে। ওগুলো কী? পাতা বোধ হয়। ওই যে ছোট ছেলেটা সব কাঠকুটো নিয়ে এল। ওর নাম কি ইভান? ‘খুদে ইভান বড় বুদ্ধিমান।’ পাহাড়ের একপাশে কী ধোঁয়া, ওদের মা বোধ হয় উনুন ধরাল। ভাত চাপাতে হবে, ডাল রাঁধতে হবে, ইস্কুলে যাবে তো! মা তো বড় ইস্কুলে যায়। ওরাও কি ইস্কু্লে যাবে? কিন্তু এখনও তো খেলেই চলেছে! কখন লেখাপড়া করবে কে জানে! আচ্ছা ওরা কোথায় ঘুমোয়? ওদের কি হলুদ কম্বল আছে? ওদের নাম কী? আমার নাম কী? আমার বাড়ি কোথায়?
নীলজামামেয়ে চুল আঁচড়িয়ে দেয়। বলে যায়— মা, এবার তোমার ন্যাপ টাইম। আরও কে যেন বলল, ‘মা।’ ওই যে সেদিন বলে গেল— ‘দেখেছ, এখানে কত সবুজ! তুমি তো পাহাড় ভালোবাস। ওই যে টিলা দেখা যাচ্ছে! বারান্দায় কত ফুলগাছ!’
‘শুয়ে পড়ো, শুয়ে পড়ো। ও মা, তুমি তো দেখছি দই ছাড়া কিছুই খাওনি। বিকেলে তোমার লেবু লজেন্স নিয়ে আসব।’ নীলজামামেয়ে চলে গেল। বাবা নিশ্চয়ই ট্রেন থেকে নিয়ে এসেছে লেবু লজেন্স, আর মা ঠিক কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। ইস্কুল থেকে ফেরার আগেই খুঁজেপেতে বার করে নিতে হবে।
আলোগুলো জ্বলে ওঠে। শীতজড়ানো লাল র‍্যাপারখানা গায়ে দিয়ে কাঠের চেয়ারে যেই না বসা, নীলপাখি এসে হাজির! এ গাছ থেকে ও গাছ। শুধু লাফায়। বড্ড চঞ্চল। আবার দুষ্টুমি করে দু-চারটে পাতা ছিঁড়েছে। মা দেখলেই বকবে। আমায় দেখে হাসলও। মাটিতে কী সব খোঁজে আর বকবক করে। এ কথা ও কথা, হঠাৎ বলে— ‘একটা কথা বলব?’ আমি ঘাড় নাড়তেই বলে, ‘নাহ, পরের দিন বলব।’ বলেই ফুড়ুৎ। আমি বসে থাকি, আর আসে না। বন্ধুদের কাছে যায় বোধ হয়।
এই তো সেদিন আমি লালফুলদের সঙ্গে গল্প করছি, হঠাৎ দেখি ও মা, ওই তো! আমার দিকে পিছন ফিরে বসে কার সঙ্গে যেন বকরবকর করছে। আমায় যেন চেনেই না। ক-দিন পরেই ফুড়ুৎ করে চেয়ারের হাতলে এসে বসে আবার কত গল্প, ওর ইস্কুলের গল্প, পাহাড়ের গল্প, গাছের গল্প, বাড়ির গল্প। অনেকক্ষণ নাকি অল্পক্ষণ, নীলপাখি গল্প করে, গান করে, তারপর বলে ওঠে, ‘শোনো।’ কী একটা হয় আর দৌড়ে চলে যায়। কী যে বলতে চায়…
আলোগুলো কতক্ষণ জ্বলে থাকে কে জানে! গাছ, পাখি, টব সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, অন্য একটা চেয়ারে এসে বসি। একটা বেড়াল চোখ পিটপিট করে। ওর নাম বোধ হয় ‘তুপা’। ও তো পাখি ধরে না। খালি ঘুমোয়। অনেক লোক এখানে কথা বলে, গান করে— আমি কি এদের চিনি? এদের নাম কী? এরা কি আমার বন্ধু? নীলজামামেয়ে বলে, ‘ওরা তো টিভিতে কথা বলছে। তুমি চা খাও।’ আমার মন কেমন করে।
মাঝেমাঝে সেই লোকটা আসে। নীলজামামেয়ে বলে, ‘আজ তোমায় ন্যাপ নিতে হবে না।’ ব্যাগে করে কত কী নিয়ে আসে। কী নিয়ে আসে? চেয়ারে বসে বই পড়ে দেয়, ছবি দেখায়, হাত ধরে বসে থাকে, কিছু বলে না। এ কি সেই লোকটা? সবসময় আমার আঁচল দিয়ে চশমার কাচ মুছত? ওর নাম কী? কবে যেন বলেছিল, ‘একটা কথা বলব?’ ওর চশমা কোথায়? কী দিয়ে মোছে? আমার তো কোনও শাড়ি নেই। তাই বোধ হয় আর চশমাও পরে না।
চেয়ার থেকে উঠে আলো জ্বালিয়ে দেয়। আস্তে আস্তে পড়তে শুরু করে, ‘ছোট্ট গোল রুটি, চলেছি গুটি গুটি…’ আমার একটু একটু শীত করে, ঘুম পায়। কম্বলটা আমার গায়ে দিয়ে দেয়।

ধূসর পাকদণ্ডি

ইফতিকার জাহিদ

“আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে।”
আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগের একটি সকাল। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে একটি সুঠামদেহী বেঁটেখাটো মানুষ। হাতে পাথরের তৈরি ছোটখাটো একটা বল্লম জাতীয় কিছু। কোমরে বাঁধা গাছের ছালের বন্ধনীতে ঝুলছে ঘষে ঘষে তীক্ষ্ণ করে রাখা পাথরের চাকু। সকালের নরম রোদে মেপে নিচ্ছে পাহাড়ের চারদিক। যুদ্ধে বেরোনোর আগে নিখুঁত প্রস্তুতি। প্রতিদিনের মতো। বেঁচে থাকার, জীবনযুদ্ধ। তারপর…

*

বিকেলে সমুদ্রের পাড়ে বসেছিলাম আমরা। আমি আর শিল্পা। ঢেউ গুনতে। রোজই যেমন আসি। আমাদের ইউনিভার্সিটি থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্ব। সারাদিন জ্ঞানগর্ভ লেকচার শোনার পর সমুদ্র দেখতে বড্ড ভালো লাগে। জীবনের ছোট্ট ছোট্ট আনন্দের গল্প করতে করতে ঠিক সন্ধ্যা নেমে যায়। এই ঢেউগুলোর মতো জীবনও কতটা অনিশ্চিত সেটা শিল্পা বোঝায়। এর পেছনে একটা গল্প আছে।

*

পন্ডিচেরীতে সেসময় খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। নিয়মিত। একটা ছাতার বড্ড প্রয়োজন ছিল। নইলে ক্যাম্পাসের লং ওয়াকগুলো নিয়মিতভাবে মিস হচ্ছিল। শিল্পার কিছু জমানো টাকা ছিল, তা থেকেই কিছুটা নিয়ে একটা সাধের ছাতা কিনল ও। আমি একটা ছোট্ট স্কলারশিপ পেতাম। টানাটানি সংসার। ওতেই সাহস করে কোপ বসাব কিনা ভাবছি, সেই সময় ব্রিটিশ কাউন্সিল একটা কুইজ কম্পিটিশন-এর ঘোষণা করে ফেলল। ড্যাং ড্যাং করে নামও লিখিয়ে ফেললুম। উপরওলার কী লীলা! আমাকে তো প্রথম করলেনই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আর একজন ললনাকেও একই সঙ্গে প্রথম করলেন। অথরিটি বললেন রাজ্যপাট ওই কন্যার সঙ্গেই ভাগাভাগি করে নাও বাপু, নইলে হিসেব মিলছে না। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, এও কি কখনও হবার! তাই সেই চিরাচরিত প্রথা মেনে এক টাকার কয়েনেই আমার ভাগ্য ঝুলে রইল। টস ভাগ্যটা আমি সারাজীবন গাঙ্গুলির সঙ্গেই শেয়ার করে এসেছি। যথারীতি হারলাম। আর আমার চোখের সামনে থেকে লোভনীয় আই-পডটা নিয়ে কন্যাও খুশি মনে বিদায় নিল। কিন্ত লীলার শেষটা তখনও বাকি ছিল। ওটার পরিবর্ত হিসাবে আমি যে পুরস্কারটা পেলাম, সেটা আর কিছুই না। একটা নীল রঙের রেইনকোট। ডাক ওয়ার্থ লুইসে আমরা দুজনেই জিতলাম। কিন্তু রোসো। গল্পের এখানেই শেষ না। ছাতা আর রেইনকোট দুটোই যেদিন আমরা পকেটে পুরলাম, বৃষ্টি সেদিনই হাওয়া হয়ে গেলেন। ওই সিজনে আর এক ফোঁটাও ঝরলেন না। ওই অনিশ্চিত ঢেউগুলোর মতো। জীবনের পরের মুহূর্তে তোমার জন্যে কী অপেক্ষা করে আছে, কেও তা জানে না।

*

শিল্পা আপাদমস্তক নোমাড। মুক্তি ওর নেশা। পায়ের তলায় সর্ষে নিয়ে হাওয়ায় উড়ে বেড়ায়। এই মুহূর্তেও জীবনের যাবতীয় সেভিংস বনে জঙ্গলে পাহাড়ে উড়িয়ে দিয়ে আসে। সেদিন ওর কাছ থেকেই আইডিয়াটা এল। ট্রেকিং-এর। পূর্বঘাট পর্বতমালার মাঝখানে কোনও এক জোয়াদু হিল পাহাড়ের উপর মানচিত্রে উপেক্ষিত একটি স্থান। ঘোরার ব্যাপারে আমার যেহেতু না নেই, তাই মাথা নাড়ালাম। জয় চন্দ্রণকে সঙ্গে নিলাম। ওখানকার এক আদিবাসী গ্রামে ওর একটা রিসার্চের কাজ আছে। আর নিলাম রামকে। রামকুমার ধর্মপুরী। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সহজ সারল্য ভরা তরুণ।
ব্যাগপত্র নিয়ে রাতে পন্ডিচেরী বাসস্ট্যান্ড থেকে রওনা দিলাম। গন্তব্য থিরু আননামালাই। প্রায় একশ কুড়ি কিলোমিটার। রাত দ্বিপ্রহর তখন, পৌঁছলাম মন্দিরের শহরে। প্রচুর মন্দির এখানে। সেই রাতে কোথাও যাবার নেই, আর আমাদের থাকার জায়গাও নেই। অগত্যা বাস স্টেশনেই কাটিয়ে দিলাম রাতটা। চায়ের পর চায়ের চুমুকের মধ্য দিয়ে ভোর হল। এতক্ষণ নজরে পড়েনি, বাস স্টেশনের বাঁ পাশেই উঠে গেছে সুউচ্চ পাহাড়। তার উপরে শিবের মন্দির। প্রতি প্রথমা আর পূর্ণিমায় এখানে শিবের পুজো হয়। লাইন ধরে আবালবৃদ্ধবনিতা ক্লেশে অক্লেশে উঠে যায় ভক্তি নিবেদনের উদ্দেশ্যে।

*

ফ্রেশ হয়ে আমরা জোয়াদু হিলের উদ্দেশ্যে আবার বাসে চড়ে উঠলাম। নিতান্তই সাধারণ লোকাল বাস। লোকজন খুব কম। প্রচণ্ড তর্জন গর্জন করতে করতে সেই বাস উঠতে থাকল পাহাড়ের পাকদণ্ডি বেয়ে বেয়ে। এই রাস্তায় সবুজের ছড়াছড়ি বেশ ভালোই চোখে পড়ল। প্রায় সত্তর-আশি কিলোমিটার এঁকেবেঁকে যাওয়ার পরে নেমে পড়লাম আমাদের গন্তব্যে। তামিলনাড়ুর লোকাল বাস চড়ার অভিজ্ঞতা যাদের নেই, তাদের বলি, এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। তোমার নিজের সিটে বসে আছো নিপাট ভদ্র হয়ে। জানালার পাশে বসে একটু কবি-কবি ভাব আনার চেষ্টা করছ। হঠাৎ বাসের মিউজিক সিস্টেমে বেজে উঠবে— ‘আড়া রা মাজা দা, আড়া মাজা দা…’ রিদমিক মিউজিকের তালে তুমি লক্ষ করবে তোমার পা-ও তাল ঠুকছে। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ একটি লোক লুঙ্গি তুলে দুলতে শুরু করবে। তুমি ভাববে, এ কী রে বাবা! লোকটি কি লজ্জার মাথা খেল নাকি? ওর কথা ভাবতে ভাবতে মনে মনে একটু সহানুভূতি প্রকাশ করবে। কিছুক্ষণ কাটতে দাও। ওর সঙ্গে জুটে যাবে আরও কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ। উদ্দাম নৃত্যের তালে তালে জীবনের প্রকাশ বিচ্ছুরিত হতে থাকবে। একসময় মনে হবে পুরো বাসটাই গানের তালে তালে নাচছে। তুমি তখন তোমার নিজের কথা ভাববে। লজ্জার মাথা খেয়ে তুমি চুপচাপ ভদ্র হয়ে বসে আছো। চুক করে কখন যে নিজের প্রতি একটু সহানুভূতি দেখিয়ে ফেলবে, সেটা বুঝতেও পারবে না। প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ আর রিদমিক এই জাতিটা। না ভালোবেসে উপায় নেই।

*

এবার আমাদের সভ্য পথ শেষ। শুধু হাঁটার পালা। বন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পথ খুঁজে পাথর ধরে। একটি জলের ধারার গুনগুনানি অনেকক্ষণ থেকেই পাচ্ছিলাম। অবশেষে সেই তন্বী স্রোতস্বিনীর সান্নিধ্য পেলাম। হাত মুখ ধুয়ে শীতল হলাম। তারপর এগিয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ পর একটি আদিবাসী গ্রামে পৌঁছলাম। কুট্টা কারাই। ছোট্ট জনবসতি। আদিমতার গন্ধের সঙ্গে মিলে মিশে আছে ডিস টিভি। একটু বিশ্রাম করে জল টল খেয়ে পা বাড়ালাম। জয় চন্দ্রণ, রামকুমার ওদের কাছে রাস্তাটা একবার বুঝে নিলাম। বুঝতে পারলাম হেঁটে যাওয়াতে কিছু লোকের বিশেষ সায় নেই। তবুও। কী আর করা। উত্তর দিক ধরে নাক বরাবর সোজা হাঁটা দিলাম।

*

একটি পাহাড়। দুইটি পাহাড়। তিনটি পাহাড়। আমাদের গলা পর্যন্ত শুকিয়ে এসেছে। বাধ্য হয়ে কখনও গাছের পাতা চিবুচ্ছি। পৃথিবীর অভিকর্ষ হঠাৎ কিছুটা বেড়ে গেছে। টলছি। আর সে অবস্থাতেও দেখছি এক অদ্ভুত অবিশ্বাস্য ছবি। আদুল গায়ে আদিবাসী বালক হেলায় পর্বতপ্রমাণ জিনিসপত্র নিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। আমাদের টলোমলো ব্যাল্যান্সে সেই নিখুঁত চলার ছন্দ সেই সময়ে কবিতা মনে হল।

*

শেষমেশ আমাদের পাহাড়টি দূর থেকে দেখতে পেলাম। মধ্যে তিন-চার কিলোমিটারের এক প্রান্তর। আমাদের তিনজনের হাতে লাঠি। মাথায় অত্যধিক গরমের কারণে গামছাকে পাগড়ির মতো বেঁধেছি। পিঠে ব্যাগ। মাঝে মাঝে কিছু জিজ্ঞাসু চোখ আমাদের জরিপ করে যাচ্ছে। আমরা এগোচ্ছি। সেই বিশাল মাঠের ভেতরে দুইটি বাড়ি। ছড়ানো ছিটানো টুকরো ধানের জমি। কাকিমার মতো এক মহিলা আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। সব শুনে আমাদের জল খেতে দিলেন। অমৃত মনে হল। তারপর এগিয়ে চললাম। এবার চড়াই পথ। শেষ পাহাড়। সব কিছু ঠিক থাকলে এর চূড়াতেই আছে আমাদের স্বপ্ন। লাঠি দিয়ে গাছ সরিয়ে সরিয়ে এগুচ্ছি। অনেকটা উপরে উঠে এসেছি। অদ্ভুত বন্য আওয়াজ ভেসে আসছে বিভিন্ন দিক থেকে। জনমানবহীন এই চরাচর। সভ্যতা থেকে কয়েক যোজন দূরে। গহিন আদিমতার ভেতর দিয়ে একটা বাঁক ঘুরতেই শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। শিল্পাকে আমি আড়াল করে দাঁড়ালাম।
কে ও! আমাদের থেকে প্রায় দশ মিটার দূরে বসে আছে সে। গায়ের রং মিশকালো। অনেক বছরের চুল দাড়িতে মুখটা ভর্তি। খালি গা। একটা ছোট্ট হাফ প্যান্ট জাতীয় কিছু পরনে। এই শুনশান মনুষ্যবিহীন স্থানে চুপচাপ বসে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। বুকটা হিম হয়ে গেল, যখন দেখলাম ঠিক তার হাতের কাছেই পড়ে আছে একটি ধারালো অস্ত্র। দা সম্ভবত।
এখানে এসে সময় কিছুক্ষণ থমকে গেল। রামকুমার আর জয় চন্দ্রণকে দেখেও কিছুটা আড়ষ্ট মনে হল। প্রথম প্রশ্নটা এদিক থেকেই গেল। উত্তর এল। আবার প্রশ্ন। এটারও উত্তর এল। স্বাভাবিকতা ফিরতে শুরু করল। যা কিছু হল সব তামিলে। কিছুক্ষণ পর আমরা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলাম। নিতান্তই দরিদ্র একজন। গাছের কাঠ কাটে। সংসার বলে কিছু নেই। এভাবেই দিন চলে। এখনও স্বীকার করি, ওই পরিবেশে দেখে আমি সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছিলাম।

*

চরম উৎসাহে আমরা উঠে এলাম পাহাড়ের চূড়ায়। কিন্তু কোথায় কী? পুরোটাই তো ফাঁকা। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এত পরিশ্রমের ফল কি তবে এভাবেই পেতে হবে? জয় চন্দ্রণ চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে পাশের আর একটা চূড়ার দিকে হাত দেখাল। আবার নামা। আবার ওঠা। ফিঙ্গার ক্রসড হয়ে আছে। আমাদের সাধ কি পূরণ হবে? পাব তো দেখা সেই অমূল্য দৃশ্যের।
শেষ বাঁকটি পার হয়ে ভয়ে ভয়ে উঁকি দিলাম পাহাড়ের উপরে, আর তারপরেই দিলাম একটা রাম লাফ। ইউরেকা। ভাগ্যিস কাছেপিঠে কোনও বাথটাব ছিল না।

*

পাহাড়ের উপরে ছড়ানো রয়েছে অনেকগুলি গুহা। চৌকো চৌকো পাথর, ছোট ছোট করে কেটে সাজিয়ে বানানো গুহাগুলি। লম্বায় প্রায় পাঁচ ফুট, চওড়াই তিন ফুট মতো। এর কম বেশিও হতে পারে। নিওলিথিক পিরিয়ড অর্থাৎ নব্য প্রস্তর যুগে বানানো এই গুহাগুলি। অদ্ভুত অনুভূতিতে ভরে গেল চারপাশ। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলাম পাথরগুলিকে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম পাহাড়ের খাদের ধারে। অসম্ভব সুন্দর নিসর্গ। একটা অদ্ভুত হলুদ রঙের ফুল ফুটে আছে দেখলাম। অজানা। বেশ বড়। উজ্জ্বল। বসে পড়লাম গুহার গায়ে হেলান দিয়ে। দূরে আলগোছে বিছিয়ে থাকা পাকদণ্ডিগুলো ক্রমশ ধূসর হয়ে উঠল। ঠিক তখনই দেখলাম। “আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে।” আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগের একটি সকাল। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে একটি সুঠামদেহী বেঁটেখাটো মানুষ। হাতে পাথরের তৈরি ছোটখাটো একটা বল্লম জাতীয় কিছু। কোমরে বাঁধা গাছের ছালের বন্ধনীতে ঝুলছে ঘষে ঘষে তীক্ষ্ণ করে রাখা পাথরের চাকু। সকালের নরম রোদে মেপে নিচ্ছে পাহাড়ের চারদিক। যুদ্ধে বেরোনোর আগে নিখুঁত প্রস্তুতি। প্রতিদিনের মতো। বেঁচে থাকার, জীবনযুদ্ধ। ঠিক পেছনেই গুহার চারধারে খিলখিলিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে তার ভবিষ্যৎ। অনেক সকাল, অনেক সন্ধ্যার রূপকথা তাদের বুকে বুকে। কত হাসি, কত কান্না। কত সুখ, কত দুঃখ। আনন্দ, হাসি, বেদনা। কিছু জন্ম, কিছু মৃত্যু। সে জানে তার পথ কত দীর্ঘ। সে সময়ের হিসেব তার কাছে নেই। তবে সে জানে, সেই পথের আশেপাশে আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর পরে তারই মতো কেউ এসে বসবে। এইখানে। সে যেন বুঝতে পারে, ভবিষ্যতের জন্যে সে কী করে গেছে।