বছর কুড়ি আগের কথা। সবে তখন চাকরিতে ঢুকেছি। ডবলু বি সি এস-এ দুবার ফেল করবার পর রাজস্থানে বড়মামার বাড়ির ঠিকানা দেখিয়ে ওখানে স্টেট গবমেন্টের পরীক্ষা দিয়ে সি গ্রুপের চাকরি। ল্যান্ড রেভেন্যু দপ্তরে। জমির মাপজোক করে বেড়াবার কাজ।
চাকরিতে ঢোকবার পর চা, ভাত আর অম্বলের ত্র্যহস্পর্শ জীবন থেকে বিদেয় হতে বছরখানেক সময় লেগে গিয়েছিল। তারপর জীবনটাই বদলে গেল একেবারে। উঝাবর সিং বলে চেনম্যান ছোকরার কাছে সেই প্রথম মোম দিয়ে গোঁফ পালিশ করতে শিখেছিলাম। অভ্যেসটা আজও বজায় আছে। বাজরার রুটি আর খাঁটি দুধ-ঘি খেয়ে চেহারাটাও খোলতাই হয়েছিল বেশ। মাথায় চওড়া বারান্দাওয়ালা টুপি, ছ পকেটওয়ালা খাকি জামা আর হাফপ্যান্টে আমায় হঠাৎ দেখলে তখন ইছাপুর কলোনির নগেন বলে চিনবে কার সাধ্য!
পোস্টিং পেয়েছিলাম ঝালাবার জেলার ল্যান্ড রেভেন্যু দফতরে। সেখানে তখন সব মিলিয়ে আমরা চারজন রেভেন্যু অফিসার। তার মধ্যে দুজন বুড়ো মানুষ। খাতায় কলমে বয়স পঞ্চাশ আর বাহান্ন। আসল বয়সের অবশ্য গাছপাথর নেই। একজন আধপাগলা। তাকে দিয়ে কোনও কাজ হয় না। অফিসেও আসত না বিশেষ। আমাদের কোয়ার্টারের দেখভাল, রান্নাবান্না, এইসব কাজে লাগানো হয়েছিল তাকে। তার কাজকম্ম আমরাই ভাগ করে সামলাতাম। আর দু নম্বর বুড়োটি ছিল যাকে বলে একটি হর্তেল ঘুঘু। চেনম্যান থেকে প্রমোশন হয়ে হয়ে এই অবধি উঠেছে। ডিপার্টমেন্টের হাড়হদ্দের খবর রাখে। ঘাঁতঘোঁত বুঝে বেশ দুপয়সা উপরিও জোগাড় করে ফাঁকে-ফোকরে। আর ফিল্ডে যাবার নাম হলেই বাতের ব্যথার ওজর দেখায়। আমি আর সুগণ সিং যখন জয়েন করলাম, প্রথম প্রথম তো আমাদের ওপর মহা খাপ্পাই ছিল সে। টেরিয়ে টেরিয়ে দেখে আর কাঁচা তামাকপাতার খৈনি ডলতে ডলতে বাঁকা কথার তুবড়ি ছোটায়। সরকারের নাকি ভীমরতি ধরেছে; নইলে দুধ-পীতা বাচ্চা ধরে ধরে অফসর বানিয়ে পাঠিয়ে দেয়?
আমি সচরাচর ঝগড়ার মধ্যে যেতাম না, তবে সুগণ মাঝেমাঝেই ঘুঘুবুড়োকে বেশ দু কথা শুনিয়ে দিত। সে নাকি জাতে সোলাংকি। শিশোদিয়া বুড়োর মুখঝামটা সইলে তার জাতের ইজ্জত যাবার ভয় রয়েছে।
মাসছয়েক যেতে না যেতে অবশ্য ঝগড়াঝাঁটি সব মিটে গেল। শিশোদিয়া বুড়োর আর দশটা বদগুণের সঙ্গে একটা সদগুণও ছিল। খাসা গল্প বলত। তারই মৌতাতে মজিয়েছিল সে আমাদের। তীব্র গরমের দুপুরগুলো ফাইলের ধুলো ঘেঁটে কাটাবার পর বিকেলে যখন হালকা গরম কিন্তু ফুরফুরে হাওয়া ছাড়ত; তখন লস্যির গেলাস হাতে করে কোয়ার্টারের সামনে দড়ির খাটিয়ায় বসে সে গল্প শুনতে খাসা লাগত। সেসব শুনলে মনে হবে, বিংশ শতাব্দীটা বোধ হয় ভুল করেই এই ঝালাবার শহরটাতে এসে জুড়ে বসেছে। শহরের চৌহদ্দি ছাড়ালেই একেবারে সেই গল্পকথার হুরি,পরি,রাজপুত্রদের দেশ।
আমাদের কোয়ার্টারগুলো একেবারে শহরের পশ্চিম ধারে। পাশাপাশি দুটো বাড়ির একটাতে আমি আর সুগণ সিং থাকতাম। আর অন্যটাতে দুই বুড়োর ডেরা। বাড়ির সীমানা ছাড়ালেই পাথর বালি মেশা রুক্ষ জমি ঢেউ খেলিয়ে চলে গেছে যতদূর চোখ চলে। মাঝে মাঝে ফণীমনসা আর বাবলার ঝোপ ছাড়া সবুজের আর কোনও চিহ্ন নেই সেখানে। বুড়োর মুখে গল্প শুনতে শুনতে সূর্যটা মিলিয়ে যেত, পশ্চিমের আকাশ লাল থেকে ঘন বেগুনি হয়ে আসত আস্তে আস্তে, গাছপালার রঙ গাঢ় হতে হতে অবশেষে অন্ধকারের মধ্যে মিশে যেত একেবারে। সেই অন্ধকারের মধ্যে বুড়োর পাঁচমেশালি ঠেঁট ভাষার গল্প শুনতে শুনতে অবিশ্বাস করবার শক্তি কমে আসত আমাদের। মনে হত, কে জানে, ঐ অন্ধকারের মধ্যে কোথাও হয়তো রাজারানিরা আজও বেঁচে আছে। আছে সত্যিকারের নাগিনীকন্যারা, কিংবা সেই মানুষগুলো, ইচ্ছেমত যে কোনও জীবের চেহারা ধরে যারা ঘুরে বেড়াতে পারে দিন ও রাতের সন্ধিক্ষণদুটিতে। সে সময়টা প্রকৃতির নিয়মকানুনে নাকি বেশ ঢিলে পড়ে। বুড়ো বলত, ভোর আর সন্ধেতে, আলো আর অন্ধকার যখন হাতবদল করে সেই সময়টা এখানকার গাঁ-গঞ্জের অনেক মানুষ নাকি আজও অমনটা করবার শক্তি ধরে।
সুগণ অবশ্য অতটা মুগ্ধ-টুগ্ধ হত না। তার্কিক ছেলে। জুলজির গ্র্যাজুয়েট। গল্প চলতে চলতে মাঝেমাঝেই মূর্তিমান ছন্দপতনের মতো ঠা ঠা করে হেসে উঠত আর বলত, “ওসব জাদুটোনার জারিজুরি আমার কাছে খাটবে না দাদাজি। অ্যায়সা-ওয়সা কিছু চোখে পড়লে রাইফেলের নিশানা লাগাব আর দমাদ্দম দুটো টোটা… ব্যাস! সব মন্তরটন্তর আর ভোজবাজির পর্দা ফাঁস হয়ে যাবে।” বুড়ো রাগ করত না। শুধু মাথা নেড়ে বলত, “সে করলে সব্বনাশ হবে রে! ভগবানের দেওয়া শক্তি। আংরেজের বানানো যন্তর দিয়ে তার মোকাবেলা করতে গেলে ফল ভালো হয় না। সাহাবলোগ এতদিন ধরে তো এদেশে রাজত্ব করে গেল। কামান বন্দুক তো তাদের অনেক ছিল। তবু বদলাতে পারল এদের কিছু?”
এর ওপর আর কথা চলে না। যুক্তি, যুক্তির সঙ্গে লড়াই করতে পারে। কিন্তু অন্ধ বিশ্বাসের সামনে তার শক্তি থাকে না।
।।২।।
বর্ষার মুখ-মুখ ওপরমহল থেকে অর্ডার এল, কুঁঅরখেরা তহশিলে সেটলমেন্টের কাজ শুরু হবে। খবর আসবার সঙ্গে সঙ্গে শিশোদিয়া বুড়োর বাতের ব্যথা ফের চাগিয়ে উঠল। দিনরাত হাঁটু ধরে বসে কোঁ কোঁ করে চলেছে। অবশ্য অতটা কাতর তার না হলেও চলত। ঐ তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকা বুড়োকে সাহেব এমনিতেই ও জায়গায় পাঠাতেন না। জেলার একেবারে দক্ষিণ পশ্চিম কোণে একটা অখাদ্য এলাকা। ভালো রাস্তা পেলে সদর থেকে বড়জোর আধবেলার ড্রাইভ। কিন্তু ও এলাকায় রাস্তাঘাটের যা অবস্থা তাতে সময় তো অনেক বেশি লাগেই, তার ওপর ঝাঁকুনির চোটে জোয়ান মানুষকেও কাহিল করে ছাড়ে। ঠিক হল, আমি আর সুগণ সিং প্রথমে যাব। আমিন হরিদেও সিং যাবে সঙ্গে। ভদ্রলোকের ড্রাইভিংয়ের হাত বেশ ভালো। ফলে আলাদা করে ড্রাইভার আর নিতে হবে না। হপ্তা তিনেক ওখানে থেকে মোটামুটি মাপজোকের কাজ এগিয়ে নিয়ে গেলে পরে সাহেব আসবেন দিনকয়েকের জন্য দলবল নিয়ে, বাকি সমস্ত আইনি কাজকর্ম সামলাতে। একমাসের প্রোজেক্ট। তাতে কাজ যতটুকু এগোয় এগোবে, তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
জুনের মাঝামাঝি সবকিছু গুছিয়ে গাছিয়ে রওনা দেওয়া গেল। সুগণ দেখি মালপত্রের মধ্যে ওর পাখিমারা বন্দুকটাও নিয়েছে। সঙ্গে একগাদা টোটা। বুঝলাম, এ যাত্রা মাংসের অভাব হবে না। নিজে বন্দুক চালাইনি কখনও। সময় সুযোগ মিললে সে বিদ্যেটাও এ যাত্রা শিখে নেওয়া যেতে পারে। ছোকরা শাহেনশা ছেলে। পড়াশোনায়, অফিসের কাজে, বন্দুকের নিশানায়, সবটাতেই মাথা আর নজর বেজায় সাফ।
*****
ম্যাপে দেখেছিলাম, পাহাড়পুরা থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে ছেড়ে বাঁদিকের কাঁচা রাস্তায় ঢুকতে হবে। ম্যাপের গায়ে কাঁচা রাস্তার চিহ্নটা সাপের মতই এঁকেবেঁকে গিয়ে পৌঁছেছে লাল মার্কা দেওয়া গন্তব্যটিতে। মোটামুটি তিরিশ মাইল মতো হবে। সদর থেকে পাহাড়পুরা ষাট মাইল মতো পথ। দুয়ে মিলে নব্বই মাইল রাস্তা। গোঁফ চুমরে সুগণ বলেছিল, “সিমপল অ্যাসাইনমেন্ট। ভোর ভোর বেরিয়ে দুপুরের মধ্যে পৌঁছে যাব, কী বলো দাদা?”
রওনা হবার পর অবশ্য বোঝা গেল ব্যাপারটা তত সহজ নয়। হরিদেও আমিন স্টিয়ারিঙয়ে বসে একগাল হেসে জানাল, কুঁঅরখেরার নাম অবধি সে কখনও শোনেনি, যাওয়া তো দূরস্থান। দ্বিতীয়ত, পাহাড়পুরা জায়াগাটা বেশ অনেকটা এলাকা জুড়ে। তার ঠিক কোনখান থেকে যে রাস্তাটা পাওয়া যাবে তার কোনও ঠিক নেই। সকাল আটটা নাগাদ বাড়ি থেকে রওনা দিয়ে পাহাড়পুরা লেভেল ক্রসিংয়ে গিয়ে পৌছুতে পৌছুতে বেলা প্রায় একটা বাজল। পুরোনো গাড়ি। তার গিয়ার বক্সে কী এক দোষ হয়েছে। হরিদেও গিয়ারের ডাণ্ডাটাকে পা দিয়ে চেপে ধরে গাড়ি চালাচ্ছিল। নইলে বারবার পিছলে নিউট্রালে চলে আসছে। নিট ফল, ষাট মাইল যেতে পাক্কা পাঁচ ঘণ্টা। লেভেল ক্রসিংয়ের পাশে একটা ছোট ঝুপড়িমার্কা দোকানে বসে পুরি, আরভির সবজি আর পোড়া মকাই দিয়ে লাঞ্চ সারলাম। হরিদেও গিয়েছিল মেকানিকের খোঁজে। খাওয়া শেষ হতে হতে সে ফিরে এল। খবর ভাল নয়। এ চত্বরে নাকি একটাই গাড়ি সারাইয়ের ঝুপড়ি, সে-ও বন্ধ। মেকানিক গাঁয়ে গেছে ক্ষেতের কাজ সামলাতে। বর্ষার মুখে এখন বীজ বোনবার সময়।
আকাশ মেঘলা করে আসছিল। দোকানদারকে কুঁঅরখেরার পথ জিগ্যেস করতে সে জানাল, আরও মাইলদুইটাক এগিয়ে গেলে হাতের বাঁয়ে নাকি রাস্তা। অগত্যা দুগগা বলে সেই মুখেই রওনা দেওয়া গেল।
*****
রাস্তাটাকে ঠিক রাস্তা বলা যাবে না। নুড়ি বিছানো খাড়াই ঢাল বেয়ে হাইওয়ে থেকে নেমে এসে দুপাশের একমানুষ পাথুরে দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে একটা পায়ে চলা পথ এগিয়ে গেছে সামনে। দূর অতীতে কোনও ভূমিকম্পে হয়তো সামান্য একটা চিড় ধরেছিল পৃথিবীর পাথুরে ত্বকে। সেটাই এখন যাতায়াতের পথ হয়েছে। কখনও কখনও এ পথে আজও যে জল বয়ে যায় তার নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল দুপাশের পাথুরে দেওয়ালের গায়ে লেগে থাকা শ্যাওলার দাগ থেকে। যতদূর চোখ চলে ছোট বড় পাথর আর নুড়ি ছড়িয়ে আছে পথ জুড়ে।
হাইওয়ে থেকে গড়গড়িয়ে নেমে এসে রাস্তায় পড়েই জিপটা একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিল। তারপর বিচিত্র সব শব্দ করতে করতে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে চলল অসমান রাস্তা ধরে। দুপাশের উঁচু জমিতে সবুজের অভাব নেই। বড় বড় ঘাসের গোছা দুপাশ থেকে ঝুঁকে পড়েছে রাস্তার ওপর। তার মধ্যে বাবলার ঝোপের ভেজালও আছে। ফলে খানিক বাদে বাদেই জিপের খোলা চারপাশ দিয়ে কাঁটার খোঁচা টের পাওয়া যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে আখ, বাদাম কিংবা জনারের ক্ষেত। সম্ভবত এই এককালের নদীর কল্যাণে তার ধারে ধারে মাটির নিচে জলের জোগান রয়ে গিয়েছে এখনও। গাছেদের তাই এত বাড়বাড়ন্ত। সুগণও ঝাঁকুনি খেতে খেতে গাছপালা ঝোপঝাড়ের দিকে চেয়ে দেখছিল। তবে গাছের বদলে তাদের ডালপালার আড়ালে বসা পাখিদের খোঁজেই যে তার এই প্রকৃতিপ্রীতি সেটা বুঝতে জ্যোতিষ জানবার দরকার ছিল না। মাঝেমাঝেই “উওহ রহা হরিয়াল কা ঝুন্ড” কিংবা, “মোর ভী দিখতা হৈ য়ার” ইত্যাদি হাঁকডাকে কান ঝালাপালা হবার জোগাড়। আমার অবশ্য তখন পাখি, গাছপালা সব মাথায় উঠেছে। রাস্তায় গোটাচারেক বাঁক নেবার পর সামনে পেছনে শুধু একইরকম চেহারার জঙ্গল চলেছে বহুক্ষণ ধরে। বন্ধুর পথ আর ঝুঁকে পড়া ঝোপঝাড়, দুয়ে মিলে যেন ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছে আমাদের পথ আটকাবার জন্য। ওদিকে আকাশ কালো হয়ে আসছিল। ঘড়িতে দেখলাম প্রায় ছটা বাজে। দূরে কোথাও বৃষ্টি নেমেছে। ঠান্ডা, ভেজা হাওয়া এসে লাগছিল গায়ে মাথায়। প্রায় শামুকের মতন হামাগুড়ি দিয়ে গাড়ি এগোচ্ছে সামনে। কতটা দূর যে এসেছি আর কতটা পথ যে বাকি তার হদিশ পাবার জো নেই। খানিক পরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নামল, আর হরিদেও-ও হঠাৎ ব্রেক মেরে গাড়ি নিউট্রালে করে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলে, “অব রাস্তা বতাইয়ে হুকম্।”
সমস্যাটা বেশ জটিল। এই অবধি, ভালো হোক মন্দ হোক, রাস্তা একটাই ছিল। এইখানটাতে এসে পথটা সাপের জিভের মতো দুটো ফালি হয়ে দুদিকে চলে গেছে। কিংবা বলা যায়, মূল খাতটার সঙ্গে আরও একটা সরু নদীখাত এসে মিশেছে পূর্বদিক থেকে।
হরিদেওয়ের অনুরোধ রক্ষা করা মুশকিল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে একে অন্যের মুখ চাইছি, এমন সময় বাঁদিকের জঙ্গল থেকে তীক্ষ্ণ কর্কশ একটা শব্দ ভেসে এল। ডাকটা আমার চেনা নয়। আওয়াজটা কানে যেতেই সুগণ সিং নিচু হয়ে গাড়ির মেঝেতে রাখা ছররা বন্দুকটা তুলে নিয়েছে হাতে। বললাম, “ও কীসের শব্দ সুগণ?”
বন্দুকের মাথা ভাঁজ করে তার ভেতরে টোটা পুরতে পুরতে সুগণ জবাব দিল, “ভয় নেই দাদা। চুপ করে বোসো। ভালো মাংস খাওয়াব আজ।” হরিদেও-ও দেখি, ঘাড় টান করে বাঁদিকের অন্ধকার জঙ্গুলে প্রান্তরটার দিকে তাকিয়ে আছে। বন্দুক নিয়ে লাফিয়ে গাড়ি থেকে নামতে নামতে সুগণ সিং ইশারায় হাতঘড়িটা দেখিয়ে বলে গেল, “আধ ঘণ্টার ভেতর কাজ শেষ করে ফিরে আসব দাদা। রাস্তার খোঁজও করে আসব। ময়ূরের মাংস আগে কখনও খাওনি নিশ্চয়? কপাল ভালো থাকলে আজ রাতে খেতে পাবে। একবার খেলে আর ভুলবে না দেখো।”
বুঝলাম, মহা পাগলের পাল্লায় পড়েছি। রাতের মুখ-মুখ একটা ভাঙা গাড়ি নিয়ে অচেনা জায়গায় রাস্তা গুলিয়েছি, আর তার ভেতর উনি চললেন ময়ূর শিকার করতে। যেতে যেতে হাত বাড়িয়ে সবেধন চার ব্যাটারির ফ্ল্যাশলাইটটাও হাতে করে নিয়ে গেছে।
একটা অদ্ভুত নৈঃশব্দ ছেয়ে ছিল আমাদের চারদিকে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিটা থেমে গেছে। সন্ধ্যা ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছিল। নিউট্রালে রাখা ইঞ্জিনের মৃদু গরগর শব্দ, শিস দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়া আর ক্রমশ তীব্র হয়ে ওঠা ঝিঁঝিঁর ডাক, এই তিনে মিলে দিন ও রাতের এই সন্ধিক্ষণে নৈঃশব্দের এক অপরূপ কনসার্ট গড়ে তুলছিল আমাদের চারপাশে। তাকে ভাঙবার সাধ্য আমার ছিল না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে ছিলাম চুপচাপ, আর, প্রায় নিজেরই অজ্ঞাতে কান পেতে ছিলাম, সুগণ সিংয়ের বন্দুকের আওয়াজের জন্য। হোক না মৃত্যুমুখী, তবু আমার চেনা দুনিয়ার শব্দ তো!
খানিক বাদে, কান খাড়া করে কিছু একটা শুনে হরিদেও বলে, “সাহেব ফিরছেন।”
“সে কী! বন্দুকের আওয়াজ পেলাম না যে! তার মানে…”
কথাটা শেষ করবার আগেই একটা অপ্রত্যাশিত শব্দ কানে আসতে থেমে গিয়ে কান খাড়া করলাম। দুটো মানুষের গলার শব্দ। তার মধ্যে একটা যে সুগণের সেটা পরিষ্কার টের পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু অন্যটা একটা মেয়ের গলার আওয়াজ। এই ভর সন্ধেবেলা, নির্জন মাঠে বনে একা একটা মেয়ে কোথা থেকে এল!
মিনিট কয়েকের মধ্যেই চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হল অবশ্য। বন্দুকটা ঘাড়ে করে আগে আগে সুগণ এসে নামল গাড়ির কাছে, আর তার পেছন পেছন বছর সতেরো-আঠারোর একটা মেয়ে। অতি সাধারণ ঘাগরা চোলি পরনে, পায়ে খাড়ু, নাকে নথ। মাথায় চুন্নিটা আছে, তবে ঐটুকুই। তাই দিয়ে ঘোমটা দেবার কোনও চেষ্টা নেই। উজ্জ্বল, বড় বড় চোখ দুটি দিয়ে জিপগাড়িটাকে দেখছিল। খানিক পরে বলল, “বিশ্রী গন্ধ।”
সুগণ হাসল, “পেট্রলের গন্ধ আগে কখনও শুঁকিস নি, নারে মুন্নিবাই?”
মেয়েটা তার দিকে ঘুরে বলে, “সেটা আবার কী জিনিস?”
একটু মজাই পাচ্ছিলাম। সুগণের দিকে চেয়ে বললাম, “কী হে শিকারি? বন্দুক নিয়ে জঙ্গলে গেলে শিকার করতে, আর ফিরে এলে, শিকারের বদলে একটা জ্যান্ত মানুষ সঙ্গে করে। আমাদের ময়ূরের মাংস যে খাওয়াবে বললে তার কী হবে?”
মেয়েটা হঠাৎ শিউরে উঠে আমাদের দিকে তাকাল। মুখের খুশি খুশি ভাবটা একেবারে উধাও। কাঁপা কাঁপা গলায় শুধু একবার বলে উঠল, “মৎ মারো সাহাব।”
সুগণ ভেংচি কেটে বলে, “মৎ মারো সাহাব! ঐ করেই তো আমার শিওর শটটা বানচাল করে দিলি। উঃ!”
জানা গেল, ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে খানিক এগিয়ে ময়ূরটাকে দেখতে পেয়েছিল সুগণ। শেষ বিকেলের মরে আসা আলোয়, পশ্চিম আকাশে জমে ওঠা মেঘের দিকে মুখ করে পেখম ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে। মাত্র কুড়ি গজ দূর থেকে নিশানা লাগিয়েছিল সুগণ। ভুল হবার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। ঘোড়া টিপতে যাবে এমন সময় হঠাৎ করে এই মেয়েটা কোত্থেকে উদয় হয়ে বন্দুকের নলটা ধাক্কা মেরে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়। সেইসঙ্গে প্রাণপণে চিৎকার, “মৎ মারো সাহাব।” বন্দুক ছাড়িয়ে নিতে-নিতেই ময়ূর উধাও। আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও আর তার টিকির নাগাল পাওয়া যায়নি নাকি।
ময়ূর হারিয়ে সুগণ রাগ করে থাকলেও আমাদের উল্লসিত হবার যথেষ্ট কারণ ছিল। ততক্ষণে অন্ধকার নেমে গেছে। হাওয়া আর বৃষ্টির জোরও বেড়েছে বেশ। সেই অবস্থায় যখন জানা গেল মুন্নি কুঁঅরখেরার তহশিলের রিলায়তি গ্রামের মেয়ে, আর পুবের রাস্তাটা দিয়ে বড়জোর আধমাইলটাক গেলেই তাদের গ্রাম, তখন সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
মেয়েটাকে বললাম, “গাড়িতে ওঠ। তোদের গ্রামের দিকেই যাব। রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাবি।” সে একগাল হেসে মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু। আমি আগে আগে যাচ্ছি। জঙ্গল ছাড়িয়ে গ্রামের প্রথম বাড়িটাই আমাদের। আজ তোমরা আমার বাড়িতে অতিথি হবে। রাস্তার যা হাল তাতে ঐ গাড়ি নিয়ে তোমাদের আসতে অনেক সময় লাগবে। আমি ততক্ষণে বাড়ির লোককে সব কথা বলে আটা-দাল বের করতে থাকি গিয়ে। তোমরা পিছে পিছে এসো।” বলতে বলতে পেছন ঘুরে লাফাতে লাফাতে অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেল মুন্নি। হরিদেও সেইদিকে চেয়ে চেয়ে হাসছিল। এই বয়সি একটা মেয়ে আছে তার। শুনেছি ক’দিন আগে তার বিয়ে দিয়েছে। হাসতে হাসতে নিজের মনেই বলে, “বচপনা আভিতক গঈ নহি বিটিয়াকি!”
*****
মুন্নিদের বাড়িটা ওদের গ্রামের একেবারে একটেরেতে। প্রায় একমানুষ উঁচু দাওয়ার ওপর একটা বারান্দাকে ঘিরে চারপাঁচটা বড় বড় ঘর। সবে কিছুদিন হল বিয়ে হয়েছে তার। একটা ঘরে বৃদ্ধা শাশুড়ি থাকেন। তার পাশেরটা মুন্নিদের শোবার ঘর। বাকি ঘরগুলো এমনিতে খালিই পড়ে থাকে। সেদিন রাতের খাওয়াদাওয়ার পর মুন্নির বর রামপ্রতাপের সঙ্গে কথা বলে হরিদেও দুটো ঘর ভাড়া নেবার বন্দোবস্ত করে নিল। যে ক’দিন এ তহশিলে থাকব, এখানেই থেকে যাওয়া ঠিক করে নিলাম আমরা। খাওয়াদাওয়াও এখানেই। পেয়িং গেস্ট জাতীয় ব্যাপার। টাকাপয়সার ব্যাপারে রামপ্রতাপ প্রথমে একটু তা না-না করেছিল। বয়স এখনও কম। কথায় কথায় চোখে মুখে হাসে। দুনিয়াদারির কায়দাকানুন এখনও ভালো করে রক্তে বসেনি তার। মুন্নিও সেই একই গোঁ ধরেছিল। শেষমেশ হরিদেও বকাঝকা করে ভাড়া নিতে রাজি করায় দুজনকে। দৈনিক পঞ্চাশ টাকা। ওতেই নাকি থাকা, খাওয়া দুটোই কুলিয়ে যাবে।
পরদিন সকালে উঠে তহশিলদারের অফিসে গিয়ে দেখা করে, চেন ফেলবার জন্য মজুরের বন্দোবস্ত থেকে শুরু করে এলাকায় সেটলমেন্টের ঢোল দেওয়া অবধি সব ঠিকঠাক করতে করতেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তার পরদিন সেটলমেন্টের টেবিল পড়বে কুঁঅরখেরার পুবপাশে। ওখান থেকে আস্তে আস্তে পশ্চিমদিকে এগোব এই প্ল্যান ছিল। বিকেল নাগাদ অফিসের কাজকর্ম সেরে পরদিনের স্পটটা একবার দেখেশুনে নিয়ে ফিরতে ফিরে সন্ধে পেরিয়ে গেল। ক্লান্ত ছিলাম খুব। ডাল, রুটি আর আলুর সবজি দিয়ে ডিনারের শেষ পাতে লোটাভরা ভাপ ওঠা কাঁচা দুধ এনে দিল মুন্নি। ভারী মিষ্টি। খেয়েদেয়ে বিছানায় মাথা ঠেকাতে না ঠেকাতেই ঘুম।
ভোরবেলা ঘুম ভাঙল সুগণের ধাক্কাধাক্কিতে। চোখ খুলতেই জিজ্ঞাসা করল, “আমার টোটার বাক্সটা দেখেছ?” রেগে গিয়ে বললাম, “কোথায় না কোথায় ফেলেছো, এখন খোঁজবার জন্য আমার কাঁচা ঘুমটা ভাঙাও কেন বলো তো?”
“তুমি তো ঘুমিয়েই খুশ। ওদিকে গত দুটো দিন যে রুটি আর সবজিতে চালাচ্ছি, তার কী হবে? ভাবলাম, ভোর ভোর বন্দুকটা নিয়ে চুপচাপ বার হয়ে চিড়িয়া মেরে আনব কটা। বন্দুক আর টোটার বাক্স দুটোই শিয়রের কাছে রেখে শুয়েছিলাম কাল রাতে, আমার স্পষ্ট মনে আছে। সকালে উঠে দেখি টোটার বাক্স নেই।”
“নেই তো নেই। বন্দুক দিয়ে পিটিয়ে পাখি মারো গে যাও।” বলে আমি পাশ ফিরে শুলাম। খানিক পরে চ্যাঁচামেচির শব্দে ঘুম ভাঙতে বেরিয়ে এসে দেখি মহা হল্লা বেধেছে। রসুইঘরের সামনে টোটার বাক্স হাতে সুগণ দাঁড়িয়ে। বারান্দায় বসে বসে রামপ্রতাপ আর তার বুড়ি মা দুজনে মিলে মুন্নিকে বেজায় বকছে। আর রসুইঘরের ভেতর আটা ঠাসতে ঠাসতে ফুলে ফুলে কাঁদছে মুন্নি। নাকি তার রসুইঘরের চ্যালাকাঠের গাদার মধ্যে টোটার বাক্স লুকোনো ছিল। চুলোর জন্য কাঠ নামিয়ে দিতে গিয়ে রামপ্রতাপ সেটা খুঁজে পেয়েছে।
অবশ্য অত বকুনি খেলেও দোষ অস্বীকার করবার কোনও চেষ্টাই তার মধ্যে দেখা যাচ্ছিল না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে আর বলে, “বেশ করেছি। আবার লুকোব। ছুঁড়ে ফেলে দেব একেবারে জাহান্নুমের মুল্লুকে। নইলে ঐ দিয়ে সাহাবজি…”
বাক্যটা পুরো করবার আগেই রামপ্রতাপ একটা চ্যালাকাঠ হাতে তেড়ে গেল রসুইঘরের দিকে। একে তো অতিথির জিনিস চুরি, তার ওপর ধরা পরেও লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে বলে বেশ করেছি? বউয়ের এত বড় অন্যায় সে মোটেই সহ্য করতে রাজি নয়। তখন তার রাগ ঠেকাতেই সুগণ সিংয়ের জেরবার অবস্থা। টোটা চুরির দুঃখ আর তার মাথায় নেই।
।।৩।।
সেটলমেন্টের ফিল্ডওয়ার্ক বেশ পরিশ্রমের কাজ। আমাদের অবশ্য হাতে করে চেনটা টানতে হয় না। সেজন্য ভাড়া করা লোক আছে। তবে তাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকতে হয়। রোদে-জলে মাঠের ওপর টেবিল পেতে ‘খাকা’ তৈরি করা থেকে শুরু করে কথায় কথায় জমিওয়ালাদের মধ্যে ঝগড়া মেটানো অব্দি সব কাজই করতে হয়। দুপুরে, যে এলাকায় কাজ করছি তার আশেপাশে কারও বাড়িতে কিছু খেয়ে নিই। এরা অতিথির যত্ন করে খুব, তবে বড় গরিব। যে যা পারে, দেয়। শুকনো পুরি বা বাজরির রুটি, একটু শাক, আচার, কপাল ভালো থাকলে ডাল বা একটু দইও জুটে যায় কোনও কোনও দিন। সন্ধেবেলা গ্রামের সরপঞ্চের বাড়ির দাওয়াতে সারাদিনের কাজের কাগজপত্র ঘাঁটতে বসা। তখন আবার হাজারো লোকের কাজিয়া ঝগড়ার আইনি মীমাংসা করতে হয় বসে বসে। শিষ ওঠা লম্ফের দপদপে আলোয় বড় বড় পাগড়ি ঘেরা মাথাগুলো ঘিরে বসে থাকে আমাদের। একটা ছোট সিগরি জ্বালিয়ে তাইতে বাদাম সেঁকে ছাড়িয়ে দিতে থাকে একজন, আর বাড়ির ভেতর থেকে মাঝে মাঝেই পাথরের গ্লাসে করে ফেনাভর্তি কাঁচা দুধ আসে।
সব সারতে সারতে রাত হয়ে যায় প্রায়ই। বাড়িতে যখন ফিরি তখন দূর থেকেই দেখা যায় একটা লন্ঠন জ্বেলে বারান্দার খুঁটির গায়ে ঝুলিয়ে রেখে রামপ্রতাপ বসে আছে বারান্দায়। মাঝে মাঝে দরাজ গলায় গানেরও আওয়াজ ওঠে। সরল দেহাতি সুর। রামপ্রতাপের গলাটাও ভালো। দিব্যি লাগে শুনতে। তার মুখের একটা পাশ রান্নাঘর থেকে আসা দপদপে আগুনের আভায় উজ্জ্বল হয়ে থাকে। বুঝতে পারি, গানের অন্য শ্রোতাটিও রসুইঘরে বসে আছেন অতিথিদের ফেরবার পথ চেয়ে। তখন মাঝেমাঝেই নিজের বাড়ির কথা মনে হয়। মন খারাপ হয়, আবার ভালোও লাগে।
মুন্নিদের গ্রামটা তহশিলের একেবারে পশ্চিমপ্রান্তে। জমি মাপতে মাপতে আস্তে আস্তে আমরা সেইদিকেই এগোচ্ছিলাম। সপ্তাহদুয়েক পরে মোটামুটি কাছাকাছি চলে আসতে একটু সুবিধে হল। ঘর থেকে ফিল্ডে হেঁটেই যাতায়াত করা যায়। এ তহশিলে রাস্তা বলতে বিশেষ কিছু নেই। উঁচু-নিচু মাঠঘাট বেয়ে গাড়িতে চড়ে যাতায়াত করতে বেশ কষ্টই হচ্ছিল এতদিন।
রামপ্রতাপ আর মুন্নির সঙ্গেও বেশ ভাব হয়ে গেছে এই ক’দিনে। ছেলেমেয়ে দুটো বড় ভালো। নিজেদের নিয়ে মহা খুশিতে আছে দুজনে। বাকি দুনিয়ার খবর রাখে না কোনও। সে ইচ্ছেও নেই তাদের। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঝগড়া যেমন বাঁধে, ভাবও তেমনই। সারাটা দিন সেই মেঘ-রোদ্দুরের খেলা চলে দুজনের মধ্যে। সেদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি দুটোতে মিলে ঝগড়া করতে করতে ফিরছে কোত্থেকে। এগিয়ে গিয়ে বললাম, “কী হল রে মুন্নি, রাগ কেন?” সে মুখটা গোমড়া করে রামপ্রতাপের পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বলল, “দেখো না ভাইয়া, জঙ্গলে একটা এত বড় হিংগোঠিয়ার গাছ দেখলাম। কতবার বললাম, কটা ফল পেড়ে এনে দাও; তা বলে, ‘ওতে হবে কী? তোকে হাট থেকে শুক্কুরবারে বিলাইতি সাবুন এনে দেবখন।’ আচ্ছা বলো দেখি, ভগবানের দেওয়া এত ভালো জিনিস থাকতে শুধুমুদু পয়সা খরচ করবার শখ কেন?”
জানা গেল, হিংগোঠিয়ার ফল থেঁতলে ভালো সাবানের কাজ হয়। এ গাছের নাম জানি না শুনে ওরা একটু অবাকই হল। বলে, সীতাজি, শকুন্তলাজী সবাই নাকি ঐ গাছের ফলের মন্ড মেখে চান করত। ঐ ফলের তেল মাখত। রামায়ণ, মহাভারত সবেতেই নাকি ওর নাম আছে।
আমার ভ্যাবাচ্যাকা দশা দেখে সুগণ এসে শেষমেশ রহস্য উদ্ধার করল। বলে, “ও হল ইঙ্গুদির গাছ। গাঁয়ের লোকের মুখে হিংগোঠিয়ার গাছ হয়ে গেছে।”
রামপ্রতাপ রেগেমেগে আমায় সালিশ মানছিল। বলে, “সাহেব, ছ-সাত মানুষ উঁচু গাছ। তাইতে বেয়ে উঠে ওনার জন্য ফল পেড়ে আনতে হবে। আমি মোটে গাছে চড়তে জানি না, উঠব কেমন করে?” মুন্নি ফের রেগে উঠে বলে, “উঁচা তো ক্যা হুয়া। উড়কে পঁহুচ যাতে। ইসমে তকলিফ…” বলতে বলতে নিজের রসিকতায় নিজেই মজা পেয়ে হেসে অস্থির। শেষমেশ বললাম, “ঠিক আছে। যেখানে টেবিল পড়েছে তার কাছেই জঙ্গল আছে। সেখানে তোর হিংগোঠিয়ার গাছ পেলে কাউকে দিয়ে পাড়িয়ে এনে দেবখন আজ।” মুন্নি ভারী খুশি হল শুনে। চোখ পাকিয়ে রামপ্রতাপকে বলে, “যাও জি, তুমি না দিলে আমার ভাইয়া আমাকে এনে দেবে ঠিক।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ হয়েছে। এবারে যা। ভাইসাবদের পুরি সবজি তৈরি কর গে। ওনাদের কাজকাম তো আছে, নাকি সারাদিন তোর মতো ঘরে বসে হিংগোঠিয়া মাখলেই চলবে?” বলতে বলতে রামপ্রতাপ গোয়ালের দিকে চলে গেল। মনে একটু ব্যথা লেগেছে বোধ হয় বউয়ের কথায়। তাই দু কথা শুনিয়ে দিল তাকে। একেবারে ছেলেমানুষ!
*****
সেদিন আর কাজকর্মের ঠেলায় মুন্নির ফলের কথা মনে ছিল না। তবে লোক দিয়ে খোঁজ করিয়ে পরের দিন বিকেলবেলা মাঠের কাজকর্মের পরে গিয়েছিলাম ইঙ্গুদি ফল আনতে। কাঁটাঝোপের জঙ্গল ঠেলে বনের খানিক ভেতরে ঢুকে একটা ছায়াছায়া ফাঁকা মতো জায়গায় গাছটা। চেন ফেলবার ছোকরাটা কাঠবেড়ালির মতো তড়তড় করে গাছ বেয়ে উঠে গিয়ে একগাদা ফল পেড়ে নিয়ে এল নিচে। খানিক নিজে নিল, আর একরাশ ফল আমাদের জন্য রেখে দিয়ে ফিরে গেল সে।
পড়ন্ত বিকেলের আবছায়া আলোয় জায়গাটা ভারী সুন্দর দেখাচ্ছিল। ক্লান্তও ছিলাম। ভাবলাম একটু বসে নিয়ে তারপর সন্ধের কাজের জন্য রওনা দেওয়া যাবে।
সন্ধে এগিয়ে আসছিল দ্রুত। মেঘে ভরা থমথমে আকাশ থেকে দিনের আলোর শেষ রেশটুকু তখন মুছে যাচ্ছে। গাছতলায় বসে বিশ্রাম নিতে নিতে হঠাৎ সুগণ সিং কান খাড়া করে উঠে বসল। আওয়াজটা আমার কানেও এসেছিল। ময়ূর ডাকছে জঙ্গলের ভেতর। ‘ক্যাঁও ক্যাঁও’ করে কর্কশ ডাকটা এখানকার পরিবেশের সঙ্গে আশ্চর্যরকম খাপ খেয়ে গিয়েছে। বন্দুক সঙ্গে আনেনি বলে আফশোস করছিল সুগণ। খানিক বাদে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “চলো দাদা, ফিরি। খালি হাতে বসে বসে ময়ূরের ডাক শুনতে মোটেই ভালো লাগছে না।”
বললাম, “কাল বরং বন্দুকটা নিয়েই সন্ধেবেলা এদিকে আসা যাবে একবার। ময়ূর আর পালাবে কোথায়? এই তো ওর বাড়িঘর!”
“না, কাল নয়। পরশু।”
“কেন?”
“পরশু দুপুরে সায়েবের আসবার কথা না? ওদিন রাতে ময়ূরের মাংস দিয়ে ওয়েলকাম করব ভাবছি।”
মন্দ বুদ্ধি নয়। বললাম, “চলো তবে, হাঁটা লাগাই।”
উঠে দাঁড়িয়ে এগোতে যাব, এমন সময় একদম মাথার পেছনে ময়ূরের ডাকটা আবার শোনা গেল। চমকে উঠে ঘুরে তাকাতেই সাঁই সাঁই শব্দ তুলে ডানা ঝাপটে পাশ দিয়ে উড়াল দিয়ে গেল দুটো ময়ূর। আমাদের নাগালের ঠিক বাইরে ইঙ্গুদি গাছটার একটা নিচুমতো ডালে গিয়ে বসল ডানা মুড়ে। সুগণের চোখদুটো দিয়ে লোভ ঝরে পড়ছিল। সেটা টের পেয়েই কিনা জানি না, পেখমওয়ালা ময়ূরটা আরেকটা ছোট্ট উড়ানে অপেক্ষাকৃত উঁচু একটা ডালে গিয়ে বসল। তারপর আরও খানিকটা উঁচুতে উঠে একদম গাছটার পাতাভরা মাথাটার ভেতর ঢুকে পড়ল গিয়ে। সম্ভবত ওখানেই রাত কাটায় এই দুটিতে।
সুগণের হাত ধরে টান দিলাম। এবার আর দেরি করা ঠিক হবে না। বৃষ্টি আসছে। জঙ্গল থেকে বেরোতে দেখি গোপাল যাদব টেবিলের কাছে অপেক্ষা করে বসে আছে। তিন শতক জমি নিয়ে একটা পুরোনো ঝামেলা। ক্ষত্রিয় বনাম যাদবে লেগেছে। লাঠিসোঁটা নিয়ে দু দলই তৈরি হচ্ছে নাকি। জমির পরিমাণটা বড় কথা নয়। ইজ্জত কা সওয়ালই আসল কথা। আজকের মধ্যে আমাদের সিদ্ধান্ত না দিলে দু একটা লাশ পড়ে যেতে পারে রাতের ভেতর। অতএব ক্লান্ত শরীরে ফের গিয়ে খাতাপত্র খুলে বসা। কাজটা শেষ হল যখন, ঘড়িতে দেখি রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে।
বাড়ি ফিরতে, খুঁটি থেকে হ্যারিকেনটা তুলে নিয়ে নেমে এসে রামপ্রতাপ বলে, “আজ এত দেরি যে সাহেব?”
ফলের পুঁটুলিটা তার হাতে তুলে দিতে দিতেই বললাম, “আর বোলো না। সন্ধের মুখে তোমাদের সুরজ সিং আর শ্যামলাল যাদবের মামলা এল। দুটোই মহা কুচুটে সে তো জানোই। সেই বখেরা মিটিয়ে আসছি। নাও ধরো এটা এবারে।”
পুঁটুলিটা আমার হাত থেকে নিতে নিতে সে বলে, “এত হিংগোঠিয়া! এতে তো সারা বছরের কাজ চলে যাবে! কেন আপনি শুধুমুদু…”
“আহা, ভাইয়া বলে ডেকে আবদার করেছে… কিন্তু তুমি জানলে কী করে, এতে কী আছে?”
রামপ্রতাপ একটু চমকে উঠল যেন। তারপর মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “আপনার বহেন তো আজ সারাদিন ঐ একই কথা বলে চলেছে। আজ ভাইয়া হিংগোঠিয়া এনে দেবে। তাই মনে হল আর কি!”
“সে কী? সারাদিন তোমায় বিরক্ত করেছে বুঝি?”
“হাঁ সাহেব। ঐ এক বড় দোষ এ মেয়ের। বড় আবদেরে। বাপের এক মেয়ে কিনা! যখন যা চাইবে, মুখ থেকে কথাটি খসবার আগেই সেটি চাই। আর আজকে তো দুনো লাভ হয়েছে। কদিন ধরে ঘ্যানঘ্যান করে আমাকে দিয়ে তো আনিয়েছেই, আজ আপনাদেরও বোঝা টানিয়ে ছেড়েছে।”
“তুমিও এনে দিয়েছ আজ? ফল পাড়লে কেমন করে?”
“ঐ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যে দু-একটা নিচে ফেলতে পেড়েছিলাম তাই কুড়িয়ে নিয়ে এসেছে খুশি হয়ে। এবারে এই একঝুড়ি ফল পেলে তো আরও খুশি হবে। বদমাশ কাঁহিকি!”
তার দুচোখ দিয়ে স্নেহ ঝরে পড়ছিল। পুঁটুলিটা নিয়ে বারান্দায় উঠে রসুইঘরের দোরে সেটা নামিয়ে রেখে বলে, “এই নে, ভাইয়ার আবদেরে বোন, তোর সারা বছরের হিংগোঠিয়া পাড়িয়ে নিয়ে এসেছেন ভাইয়াজি।”
*****
ঠিক করেছিলাম ময়ূর শিকারের পরিকল্পনাটা মুন্নিদের কাছে ফাঁস করা হবে না। যা পাগলি মেয়ে! জানতে পেলে এবারে হয়তো বন্দুকটাই লুকিয়ে ফেলবে, কিংবা কেঁদেকেটে আবদার করে একশা করবে। তার চেয়ে পরশু বিকেল নাগাদ জঙ্গলে গিয়ে একটা ময়ূর মেরে, কেটেকুটে মাংসটা বাড়িতে নিয়ে এলেই হবেখন। শুনেছি এরা জল ছাড়া শুধু নুন, লংকার গুঁড়ো দিয়ে ঘিয়ে সেদ্ধ করে দুর্দান্ত শুকনো মাংস রাঁধে এই এলাকায়। সেভাবেই রাঁধতে বলা যাবে।
রাতে খেতে বসে রামপ্রতাপকে বললাম, “পরশু সাহেব আসছেন। বড় অফসর। ওনাকে তো আর দালরুটি দিলে চলবে না! একটু মাংসের ব্যবস্থা করব ভাবছি। তোমাদের বাড়িতে মাংস ঢোকে তো?” সে একটু অপ্রস্তুত মুখ করে বলল, “না, মানে সাহেব, আমরা তো শাকাহারী, নিজেরা ওসব খাই না। তবে অতিথির তৃপ্তি না হলে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়। মাংস আমিই হাট থেকে আনিয়ে দেব। আলাদা একটা চুলহাও বানিয়ে দেব। মুন্নি ওতে রান্নাবান্নাও করে দেবে। তবে আমরা খাব না।” এই অবধি বলে সে মুনির দিকে চোখ তুলে বলে, “কী রে মুন্নি। রেঁধে দিবি তো?”
হাতে ডালের হাতাটা নিয়ে আমাদের সামনে মাথা নিচু করে বসে ছিল মুন্নি। ঐ অবস্থাতেই আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। রামপ্রতাপ অবশ্য অত সহজে বিশ্বাস করবার পাত্র নয়। বউকে হাড়ে হাড়ে চেনে, অতএব আবার বলল, “দেখ মুন্নি, অতিথ নারায়ণ। তাঁর সেবার জন্য ধরম তো ধরম, নিজের জান দিলেও মহাপুণ্য হয়। সেই নারায়ণের সেবার জন্য কথা দিলি কিন্তু। কোন শরারতি করিস না যেন আবার।”
মেয়েটার সম্ভবত জীবহত্যার ব্যাপারে একটি নিউরোসিস মতো আছে। হঠাৎ চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকাল সে। সে চোখে তীব্র বেদনা আর ভয়ের ছাপ। রামপ্রতাপ তার দিকে চেয়ে হাসছিল। ভারী সংকটে ফেলে দিয়েছে সে তার বউকে। দুয়েকটি মুহূর্তমাত্র। তারপর মাথা নামিয়ে নিল মুন্নি। ডালের বাটিটা হাতে করে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে প্রায় ফিসফিস করে রামপ্রতাপকে উদ্দেশ্য করে বলল, “মেহমানদের কোনও অসুবিধে হবে না। আমি সব ঠিকঠাক করে দেব। শুধু মাংসটা তুমি একটু দেখেশুনে এনে দিও।”
আমি বললাম, “উঁহু। রামপ্রতাপ শাকাহারী মানুষ। মাংসের ভালোমন্দ ও কিছুই বুঝবে না। শেষে বাজে মাংস গছিয়ে দিলে সাহেবের সামনে বেইজ্জত হতে হবে। তার চেয়ে, মাংস আমরাই দেখেশুনে এনে দেব।”
মুন্নি চমকে উঠে বলল, “শিকার খেলবেন?”
আমি হাসলাম, “শিকার করা তো আর তোর জ্বালায় হবে না রে মুন্নিবাই। তাহলে তুই কি আর রক্ষে রাখবি? মাংস আমাদের কিনেই আনতে হবে। পরশু তো শুক্রবার। হাটবার তোদের এখানে। আমি সব খবর নিয়ে নিয়েছি। সন্ধেবেলা হাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মুর্গা কাটিয়ে নিয়ে আসব।”
ঘর থেকে বের হয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ে ঘুরে দাঁড়াল মেয়েটা। মুখের মেঘ হঠাৎ করেই উধাও। একগাল হেসে বলল, “তা হলে তো খুব ভালো হয় ভাইয়া! নইলে এ লোকের ওপর ভরসা করা যায় না। যে ভুলো মানুষ…”
বুঝলাম, শিকার যে করব না, সেই খবরটা শুনে প্রাণ ঠান্ডা হয়েছে। কত সহজে এদের ভোলানো যায়। আমাদের কথায় যে কোন মিথ্যে থাকতে পারে, সে সন্দেহ ঘুণাক্ষরেও জাগেনি মেয়েটার মধ্যে।
সন্দেহ তার জাগল না পরদিন সন্ধেবেলাও, সুগণ যখন তার বন্দুকটাকে সাফ করতে বসল। সরু লোহার কাঠির আগায় প্যাঁচানো ন্যাকড়া গান অয়েলে চুবিয়ে নলদুটির ভেতর ঘসে ঘসে পরিষ্কার করছে, এমন সময় মুন্নি একবার এসেছিল এ ঘরে। সুগণের দিকে চোখ পড়তে জিগ্যেস করেছিল, “এ কী করছ ভাইজি?” সুগণ বলেছিল, “বন্দুকটা কোনও কাজে না লেগে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, তাই তেল মাখিয়ে তুলে রাখছি।”
শুক্রবার সকালে উঠে জিপ নিয়ে হরিদেও চলে গেল পাহাড়পুরা, সাহেবের গাড়িকে পথ দেখিয়ে আনতে। ভোর ভোর উঠে আমরা দুজনও ফিল্ডে চলে গিয়েছিলাম। সাহেব আসার আগে অনেক কাজ গুছোবার আছে। মুন্নিরা তখনও ওঠেনি সম্ভবত। কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না।
জঙ্গলের একেবারে কাছাকাছি টেবিল পড়েছিল সেদিন। চারটে খুঁটি পুঁতে তার ওপরে এক টুকরো ত্রিপল বেঁধে নিয়েছিলাম। সেই ছাউনির তলায় বড় বড় জলচৌকি পেতে বসে কাজ করতে করতেই চোখে পড়ছিল, পুঞ্জ পুঞ্জ নীল মেঘ দিগন্ত থেকে উঠে এসে আকাশের দখল নিচ্ছে। জমি মাপজোকের কাজ এদিনের মতো মুলতুবি করে দিয়েছিলাম দুপুরবেলাতেই। তারপর সাহেবের জন্য ফাইলপত্র ঠিকঠাক করে সাজাতে সাজাতে আরও অনেকটা সময় গেল। সে কাজ যখন গুছিয়ে এল, তখন চেয়ে দেখি, পুবের আকাশে স্তূপ স্তূপ মেঘ, দিগন্তের মাটি ছুঁয়ে স্থির হয়ে আছে। আর, একেবারে সেই স্পর্শরেখা থেকেই তার গায়ে উঠে এসেছে রামধনুর একটা সুবিশাল অর্ধবৃত্ত।
সাহেবের সটান মাঠের আসবার প্ল্যান ছিল যদিও, কিন্তু হরিদেওকে আমরা বলেই পাঠিয়েছিলাম, কোনও কারণে যদি পৌঁছতে বিকেল পড়ে আসে তবে আর এদিকে না এসে একেবারে রামপ্রতাপের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলতে। এখনও আসেনি, তার মানে সাহেবের আর আজকে মাঠে আসবার কোনও সম্ভাবনাই নেই। তার মানে, কালকের আগে আর ফাইল-টাইলের কাজ হবে না কোনও। কথাটা ভাবতেই মনটা বেশ খুশি খুশি হয়ে উঠল। সুগণকে ঠেলা দিয়ে বললাম, “দেখো, কী সুন্দর রামধনু উঠেছে।” সুগণ মুখ বেঁকিয়ে বলল, “ঐ রামধনুই দেখ তবে। বিকেলটা এখানে বসে বসেই কাটিয়ে দিয়ে তারপর সন্ধেবেলা ময়ূরের বদলে মুরগির মাংস কিনে নিয়ে সাহেবকে দিও, দেখো তোমার ওপর কেমন খুশি হয়। সন্ধেবেলা পাখি দুটো একবার যদি বাসায় ঢুকে পড়ে তবে অন্ধকারে আর খুঁজে পাবে?”
এই কথার ওপরে কথা চলে না। সাহেবের জ্বালা বড় জ্বালা। চেনম্যান ছোকরাদুটো একপাশে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে ছিল। তাদের জাগিয়ে, কাগজপত্রের বান্ডিল দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। তারপর বন্দুক নিয়ে দুজন মিলে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম পশ্চিমদিকের জঙ্গলটার দিকে। ইঙ্গুদি গাছটার কাছে গিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে পজিশান নিল সুগণ। আমার কাছে একটা কুকরি থাকে সবসময়। সেটা নিয়ে আমিও উলটোদিকের একটা ঝোপে গিয়ে লুকোলাম। গুলিতে যদি শুধু চোট হয়ে তবে পালাবার আগেই গিয়ে ছুরি দিয়ে নিকেশ করে দেওয়া যাবে। ময়ূর আজকে যেনতেনপ্রকারেণ নিয়ে যেতে হবেই। হরিদেও নিশ্চয় পথে আসতে আসতে সাহেবকে সাতকাহন করে ময়ূরের গাওনা গেয়ে শুনিয়েছে। এরপর খালি হাতে ফিরলে আজ রাতে লজ্জার একশেষ।
এ অঞ্চলে জঙ্গল তুলনায় ফাঁকা ফাঁকা। মাথার ওপর গাছের ছাতায় আকাশ ঢেকে দেয় না। বসে বসে দেখছিলাম, জলভরা মেঘ পুবদিক থেকে এগিয়ে এসে আস্তে আস্তে উপুড় হয়ে পড়েছে বনের আকাশে। সবুজ আর কালোর ঠাসবুনোট নকশার ঘেরাটোপে গাছতলার ফাঁকা জমিটাকে একটা ছোট মঞ্চের মতো লাগে। যেন এখনই অভিনয় শুরু হবে সেখানে। ঝিঁঝিঁর ডাক, আর এলোমেলো হাওয়ায় গাছের পাতার দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই চারপাশে।
তারপর হঠাৎ সেই শব্দকে ছাপিয়ে বনের ভেতর অনেক দূর থেকে ভেসে এল ময়ূরের ডাক। আস্তে আস্তে শব্দটা এগিয়ে আসছিল কাছে। মিনিটকয়েক পড়ে হঠাৎ-ই খানিক দূরের একটা ঝোপের ভেতর থেকে লম্বা লম্বা পদক্ষেপে বার হয়ে এল আগের দিনের সেই ময়ূর দম্পতি। সেই মেঘলা আকাশের নিচে ফাঁকা জায়গাটার ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়াল ময়ূরীটি। ময়ূরটি তার পেখম মেলে ধরেছে। উজ্জ্বল বর্ণচ্ছটায় চোখ ঝলসে যায়। ধীর পদক্ষেপে সে তার ময়ূরীকে ঘিরে পাক খায়। তারপর, আস্তে আস্তে তার নাচের গতি বেড়ে উঠল…
সাধারণ মানুষ আমি। ইস্কুল-কলেজের পড়াশোনা বাদে আর কিছু শিখিনি কখনও। সুর-তাল-ছন্দের জগতটার সঙ্গে আমার বিশেষ আলাপ কোনওদিনই হয়নি। তবু, ক্রমাগত ঘুরে চলা সেই বর্ণঝলকের যাওয়া-আসা, সেই ছন্দোবদ্ধ পদক্ষেপ, আমায় মুগ্ধ করে রেখেছিল অনেকক্ষণ। খেয়াল করিনি সন্ধ্যা কখন দিনের সীমানা ছাড়িয়ে রাতের দুনিয়ার দিকে পা বাড়িয়েছে।
হঠাৎ বাজ পড়ার মতো শব্দ করে জেগে উঠল বন্দুকের আওয়াজ। আগুনের ঝলক, বারুদের গন্ধ, নাচতে নাচতেই হঠাৎ লুটিয়ে পড়া ময়ূরটা… তার দেহ থেকে ফিনকি দিয়ে বার হয়ে আসা রক্তের ধারা…
ময়ূরীটি মুহূর্তের জন্য কেমন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল এক জায়গায়। তারপর হঠাৎ এক ছুটে পালাতে গেল আমার পাশ দিয়ে। সুগণ ততক্ষণে দ্বিতীয় গুলিটা ছুঁড়েছে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সেটা গিয়ে ইঙ্গুদি গাছটার গায়ে বিঁধে গেল। প্রায় প্রতিবর্ত ক্রিয়াতেই ছুরিটা চালিয়ে দিয়েছিলাম। ময়ূরীটার ডানদিকের ডানায় গিয়ে লাগল তা। রক্তের একটা ক্ষীণ ধারা ছড়াতে ছড়াতে জঙ্গলের মধ্যে উধাও হয়ে গেল সে। চুপ করে তাকিয়ে ছিলাম সেইদিকে। চমক ভাঙল সুগণের ডাকে। কুকরিটা চাইছে। ময়ূরের ছাল ছাড়াবে।
*****
বেশ কিছুক্ষণ পরে, সদ্য ছাড়ানো তাজা মাংসের টুকরোগুলো একটা বড় প্লাস্টিকে ভরে নিয়ে বাড়িতে ফিরলাম দুজনে। রাত হয়ে গেছে ততক্ষণে। টুকরোগুলো তখনও গরম। মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। পেশিগুলো এখনও মৃত্যুকে পুরোপুরি মেনে নিতে পারেনি।
বাড়ির সামনে দুটো জিপ দাঁড়িয়ে ছিল। হরিদেও দেখি এক বালতি জল নিয়ে গাড়ির কাদা ধুচ্ছে। বলল, মিনিট পনেরো আগে এসে পৌঁছেছে। বার দুয়েক টায়ার ফেঁসেছিল রাস্তায়। তাই দেরি। বন্দুকটা গাড়ির মধ্যে রেখে দিয়ে দুজনে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম এসে। বাড়িটা আজ আশ্চর্যরকম নিস্তব্ধ। বারান্দায় রামপ্রতাপ বসে নেই। হ্যারিকেনটাও লটকানো নেই রোজকার মতো। দাওয়ার নিচে এসে দাঁড়িয়ে ডাক দিলাম, “রামপ্রতাপ। কাঁহা হো?”
উত্তরে রামপ্রতাপের বদলে মুন্নি বার হয়ে এল ভেতর থেকে। হাতে ধরা হ্যারিকেনের অনুজ্জ্বল আলোতেও তার চোখে একটা গভীর বিষণ্ণতার ছাপ ধরা পড়ছিল। মাংসের পুঁটলিটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সুগণ বলল, “এই নে। তোদের হাটে মুরগি তো বেশ সস্তা রে! আমাদের ওখানকার থেকে অর্ধেক দাম। কাটিয়ে কুটিয়েই নিয়ে এসেছি একেবারে।”
মুন্নি কোন প্রশ্ন করল না। শুধু পুঁটলিটা হাতে নিয়ে কেমন যেন শিউরে উঠল একবার। বললাম, “কী হল রে? মাংস রাঁধতে হবে বলে মন খারাপ? কথা দিয়েছিস কিন্তু। মনে আছে তো, অতিথ নারায়ণ!” চুপ করে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল মুন্নি। তারপর দ্বিতীয় কোনও শব্দ উচ্চারণ না করে মাংসের পুঁটলিটা হাতে নিয়ে ভেতরে চলে গেল।
সাহেব ঘুমিয়ে নিচ্ছিলেন একটু। ক্লান্ত ছিলেন। সারাটা দিন রাস্তায় কেটেছে। এ বয়সে এতটা ধকল শরীরে সয় না। রাত দশটা নাগাদ হরিদেও এসে ডাকল। খাবার জায়গা হয়েছে। জিগ্যেস করে জানলাম, রামপ্রতাপ তখনও ফেরেনি। মুন্নিকে নাকি হরিদেও একবার জিজ্ঞাসাও করেছিল। জবাব দেয়নি কোনও।
চারজনে মিলে খেতে বসলাম গিয়ে। ঘি মাখানো গরম চাপাটির গোছা একটা গামলায় সাজানো। পাশে, বিরাট একটা পেতলের ডেচকিতে ঘিয়ে সেদ্ধ করা, শুকনো লংকার গুঁড়ো ছড়ানো ময়ূরের মাংসের স্তূপ। সাহেব একটা বড় টুকরো তুলে নিয়ে কামড় বসালেন। আরামে চোখ বুজে এসেছে প্রায়। সুগণ সিং একরাশ মাংস তুলে নিয়েছে নিজের পাতে। আমার পাতেও একগাদা তুলে দিতে যাচ্ছিল। বারণ করেছি। মাংস আমি ভালোবাসি। কিন্তু ঐ দু-এক টুকরোর বেশি নয়।
সুগণ, হরিদেও আর সাহেব গল্প করতে করতে খাচ্ছিল। বাইরে তুমুল বৃষ্টি নেমেছে। সারাদিন ধরে জমে ওঠা মেঘ এইবারে তার সমস্ত সঞ্চয় ঢেলে দিচ্ছে এই গ্রামটার মাটিতে। আকাশচেরা লকলকে বিদ্যুতের আভায় মাঝেমাঝেই একটা নেশা ধরানো শব্দ তুলছিল। আমার খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল অনেকক্ষণ। খানিকক্ষণ এঁটো হাতে বসে থেকে উঠে পড়লাম। ওরা খেতে থাক। আমি বাইরে থেকে হাতটা ধুয়ে আসি।
ছাঁচতলার বৃষ্টির জলে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে ধুচ্ছি, তখন হঠাৎ কানে এল, জল, হাওয়ার শব্দের মধ্যে প্রায় মিশে থাকা আর একটা আওয়াজ… মুন্নির গলার শব্দ। বারান্দার খুঁটির হুক থেকে খুলে এনে হ্যারিকেনটা বাড়িয়ে ধরলাম বাইরের দিকে। নিচের উঠোনে, বৃষ্টির মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে চিৎকার করে কাঁদছিল মুন্নি। অন্ধকার আর বৃষ্টির শব্দের আড়ালটুকু সম্বল করে আছাড়ি পিছাড়ি করে কাঁদছিল মেয়েটা।
বাতিটা হাতে করে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে গেলাম। তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, “পাগলি, এমনভাবে কাঁদছিস কেন রে? কী হয়েছে, আমায় বল। রামপ্রতাপের সঙ্গে ঝগড়া করেছিস? সে কিছু বলেছে তোকে? নাকি রাগ করে বাড়ি ছেড়ে…”
আমার গলা পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল সে। ভয়ার্ত চোখে একঝলক আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, “মৎ মারো সাব… মৎ মারো মুঝে…” তারপর পাগলের মতো হাঁচড়পাঁচোড় করে উঠে গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। শব্দ পেয়ে বুঝলাম, ভেতর থেকে হুড়কো আটকে দিয়েছে। মাথার ব্যামো আছে নাকি মেয়েটার? আচরণটা একটু অদ্ভুত ঠেকল বটে, তবে দুদিনের অতিথি হয়ে এসে অন্যের পরিবারের ব্যাপারে বেশি কৌতূহল না দেখানোই উচিৎ মনে হল আমার। হাতটা ধুয়ে ঘরে ফিরে এলাম। সেখানে তখন জোরদার গল্প চলছে শিকারের। ময়ূরের মাংস খেয়ে সাহেব বেজায় খুশি। সুগণ সিংকে বেশ খাতির-টাতির করে কথা বলছে দেখা গেল।
পরদিন আমাদের ডেরা-ডাণ্ডা গোটানোর পালা। ভোর ভোর মালপত্র বেঁধে-ছেঁদে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবার কথা। সারাদিন মাঠে কাজ করে বিকেল বিকেল সদরের পথ ধরব এই ঠিক হয়েছিল। সকালে উঠে দেখি মুন্নিদের ঘরের দরজা তখনও বন্ধ। হরিদেও গিয়ে দুয়েকবার শেকল নেড়ে দেখল। কোনও সাড়াশব্দ নেই। একবার ভাবলাম, রামপ্রতাপের মা বুড়ির হাতে ভাড়ার টাকা কটা দিয়ে দায় চুকিয়ে বেরোই। কিন্তু সাহেব আপত্তি করলেন। হিসেবি মানুষ। বলেন, “নিরক্ষর অন্ধ বুড়ি। কী বুঝতে কী বুঝবে; পরে ওর ছেলে-বউ মিলে কমপ্লেন না করে দেয়, গবমেন্টের চাকুরে এসে থেকে খেয়ে পয়সা দেয়নি। এই দেহাতিদের বিশ্বাস নেই।”
হক কথা। অতএব ঠিক হল, মাঠের কাজেরই এক ফাঁকে দুপুরবেলা নাগাদ আমি গাড়ি নিয়ে এসে মুন্নি বা রামপ্রতাপ যেই বাড়ি থাক তার হাতে টাকা দিয়ে একটা রসিদে টিপছাপ দিইয়ে নিয়ে যাব। টি এ ক্লেইমের কাজে আসবে।
মাঠে কাজ ছিল অনেক। দু সপ্তাহের সমস্ত মাপজোকের হিসেবনিকেশ। কম নয়। দুপুরে বাড়ি আসা দূরস্থান, শ্বাস পর্যন্ত ফেলবার ফুরসত পাওয়া যায়নি। শেষমেশ বিকেল পড়ে আসতে সব যখন বাঁধাছাঁদা চলছে, তখন সাহেবকে বলে একবার চলে এলাম মুন্নিদের বাড়িতে। রামপ্রতাপ আর মুন্নিকে দেবার জন্য সামান্য কিছু উপহার কিনে রেখেছিলাম কদিন আগে হাট থেকে। হাড়ের চিরুনি একটা, একটা গন্ধ সাবান, কাঁচা চামড়ার জুতি একজোড়া। ভাড়ার টাকার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোও একেবারে দিয়ে যাওয়া যাবে।
বাড়িতে ঢুকলাম যখন এসে তখন আলো একেবারে কমে এসেছে। রামপ্রতাপের মা দাওয়ায় বসেছিল। চোখে একেবারেই দেখতে পায় না বুড়ি। আমার আওয়াজ পেয়ে জিগ্যেস করল, “কওন, রামু? কহাঁ গায়ব থে কাল শাম সে? বদমাশ লড়কা, যা কে দেখ তো জরা, তেরা মুন্নি কেয়া হাল বনাকে বৈঁঠি হৈ তেরে নিয়ে?”
একটা অজানা আশংকার হিমস্রোত বয়ে গেল আমার মেরুদণ্ড দিয়ে। মুন্নি কাল রাতে কাঁদছিল কেন অমন করে? কোথায় চলে গেছে রামপ্রতাপ? মুন্নিরই বা হঠাৎ করে কী এমন হল? দিব্যি সুস্থসবল মেয়েটা! কালকেই তো রান্নাবান্না করে খাওয়ালও আমাদের।
দাওয়ার ওপর উঠে নিঃশব্দে বুড়ির পাশ কাটিয়ে মুন্নির ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দরজাটা এখন আর ভেতর থেকে খিল দেওয়া নয়। কপাটদুটো ভেজানো রয়েছে শুধু। আস্তে আস্তে ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালাম। মেঝেতে একটা শিষ ওঠা হ্যারিকেন জ্বলছিল। চৌকির ওপর অজ্ঞানের মতো পড়ে ছিল মুন্নি। বিড়বিড় করে কী যেন বলছিল। এগিয়ে গিয়ে তার কপালে হাত ছোঁয়ালাম। হাতটায় ছ্যাঁকা লাগল যেন। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে মেয়েটার। আমার হাতের ঠান্ডা ছোঁয়া পেয়ে হঠাৎ লাল টকটকে চোখদুটো খুলে, বোধহীন দৃষ্টিতে ঘুরে তাকাল আমার দিকে। অস্ফুট স্বরে বলল, “রামপ্রতাপ? চলো জি, শাম হো রহা হৈ। জঙ্গল মে নহি যাওগে? আজ ম্যায় ভি নাচুঙ্গী তুমহারে সাথ। লেকিন তুম য্যায়সা খুবসুরত পুছ…” বলতে বলতে হঠাৎ চোখদুটো প্রাণপণে বুঁজে তীব্র গলায় চিৎকার করে উঠল মেয়েটা, “উড়ান ভরো রামপ্রতাপ… উওহ বন্দুক লে কে আ রহা হৈ… পেড় কে উপর চলো… জলদি… অওর উপর… ওহ মা… কিৎনা খুন! হায় রে মেরি রামপ্রতাপ!”
মূক হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম তার বিছানার পাশে। কী বলছে মেয়েটা? জ্বরতপ্ত মস্তিষ্ক নিয়ে কোন রহস্যের ইঙ্গিত দিতে চাইছে ও? ঠিক তখনই চোখ দুটো আবার খুলে গেল তার। আমার দিকে ফিরে একেবারেই স্বাভাবিক গলায় বলল, “অতিথি নারায়ণ, খানা তৈয়ার হৈ জি। ঘিউ ডালা, লাল মির্চি ছড়কায়া আচ্ছা সে। খাওগে নহি? আও না। কাম নিপটাকে মুঝে জানা ভি তো হৈ উনকে পাস। শাম যো হো রহা হৈ…”
কোনও মতে ডান হাতটা তুলে ধরে আমায় ডাকছিল সে। হ্যারিকেনের আলোয় দেখলাম, কলাগাছের মতো ফুলে উঠেছে তা। কনুইয়ের কাছ থেকে প্রায় কাঁধের কাছ অবধি লম্বালম্বি একটা ছুরির কোপের দাগ। তার ধারে ধারে শুকিয়ে ওঠা রক্তের ছোপের নিচে নিচে হালকা হালকা বেগনি রঙয়ের পচনের চিহ্ন। ভগবান দয়া করেছেন ওকে। ক্ষতটা বিষিয়ে উঠেছে। ভালোবাসার মানুষটিকে সদ্য হারিয়ে এই মুহূর্তে তার সবচেয়ে কামনার বস্তু যেটি, সেই মৃত্যু এগিয়ে আসছে দ্রুত… চোখদুটি আবার ধীরে ধীরে বুজে আসছিল তার। রোগের যন্ত্রণাকে অগ্রাহ্য করে ঠোঁটদুটিতে কী অমল হাসিটি ফুটেছে। তাদের স্বপ্নের অরণ্যে ময়ূর-ময়ূরী হয়ে তার দুজনে ঘুরে বেড়াবে এবার। আকাশে জমে উঠবে ইস্পাতনীল মেঘ… তার নিচে একটি নীলবর্ণ ময়ূরী, আর তাকে ঘিরে সুবিশাল মনোহর পেখমটি মেলে নেচে চলবে তার সঙ্গী। চিরদিন…
‘ফিরে পড়া গল্প’ বিভাগে প্রকাশিত গল্প সংকলন থেকে গল্প তুলে আনছি আমরা। সম্পাদকের পছন্দ অনুসারে সৃষ্টি-র এই সংখ্যায় রইল দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য-র ‘ঈশ্বরী’ গল্প সংকলন থেকে একটি গল্প। বইটি অনলাইন অর্ডার করা যাবে এখানে।