মা নিষাদ

দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

বছর কুড়ি আগের কথা। সবে তখন চাকরিতে ঢুকেছি। ডবলু বি সি এস-এ দুবার ফেল করবার পর রাজস্থানে বড়মামার বাড়ির ঠিকানা দেখিয়ে ওখানে স্টেট গবমেন্টের পরীক্ষা দিয়ে সি গ্রুপের চাকরি। ল্যান্ড রেভেন্যু দপ্তরে। জমির মাপজোক করে বেড়াবার কাজ।

চাকরিতে ঢোকবার পর চা, ভাত আর অম্বলের ত্র্যহস্পর্শ জীবন থেকে বিদেয় হতে বছরখানেক সময় লেগে গিয়েছিল। তারপর জীবনটাই বদলে গেল একেবারে। উঝাবর সিং বলে চেনম্যান ছোকরার কাছে সেই প্রথম মোম দিয়ে গোঁফ পালিশ করতে শিখেছিলাম। অভ্যেসটা আজও বজায় আছে। বাজরার রুটি আর খাঁটি দুধ-ঘি খেয়ে চেহারাটাও খোলতাই হয়েছিল বেশ। মাথায় চওড়া বারান্দাওয়ালা টুপি, ছ পকেটওয়ালা খাকি জামা আর হাফপ্যান্টে আমায় হঠাৎ দেখলে তখন ইছাপুর কলোনির নগেন বলে চিনবে কার সাধ্য!

পোস্টিং পেয়েছিলাম ঝালাবার জেলার ল্যান্ড রেভেন্যু দফতরে। সেখানে তখন সব মিলিয়ে আমরা চারজন রেভেন্যু অফিসার। তার মধ্যে দুজন বুড়ো মানুষ। খাতায় কলমে বয়স পঞ্চাশ আর বাহান্ন। আসল বয়সের অবশ্য গাছপাথর নেই। একজন আধপাগলা। তাকে দিয়ে কোনও কাজ হয় না। অফিসেও আসত না বিশেষ। আমাদের কোয়ার্টারের দেখভাল, রান্নাবান্না, এইসব কাজে লাগানো হয়েছিল তাকে। তার কাজকম্ম আমরাই ভাগ করে সামলাতাম। আর দু নম্বর বুড়োটি ছিল যাকে বলে একটি হর্তেল ঘুঘু। চেনম্যান থেকে প্রমোশন হয়ে হয়ে এই অবধি উঠেছে। ডিপার্টমেন্টের হাড়হদ্দের খবর রাখে। ঘাঁতঘোঁত বুঝে বেশ দুপয়সা উপরিও জোগাড় করে ফাঁকে-ফোকরে। আর ফিল্ডে যাবার নাম হলেই বাতের ব্যথার ওজর দেখায়। আমি আর সুগণ সিং যখন জয়েন করলাম, প্রথম প্রথম তো আমাদের ওপর মহা খাপ্পাই ছিল সে। টেরিয়ে টেরিয়ে দেখে আর কাঁচা তামাকপাতার খৈনি ডলতে ডলতে বাঁকা কথার তুবড়ি ছোটায়। সরকারের নাকি ভীমরতি ধরেছে; নইলে দুধ-পীতা বাচ্চা ধরে ধরে অফসর বানিয়ে পাঠিয়ে দেয়?

আমি সচরাচর ঝগড়ার মধ্যে যেতাম না, তবে সুগণ মাঝেমাঝেই ঘুঘুবুড়োকে বেশ দু কথা শুনিয়ে দিত। সে নাকি জাতে সোলাংকি। শিশোদিয়া বুড়োর মুখঝামটা সইলে তার জাতের ইজ্জত যাবার ভয় রয়েছে।

মাসছয়েক যেতে না যেতে অবশ্য ঝগড়াঝাঁটি সব মিটে গেল। শিশোদিয়া বুড়োর আর দশটা বদগুণের সঙ্গে একটা সদগুণও ছিল। খাসা গল্প বলত। তারই মৌতাতে মজিয়েছিল সে আমাদের। তীব্র গরমের দুপুরগুলো ফাইলের ধুলো ঘেঁটে কাটাবার পর বিকেলে যখন হালকা গরম কিন্তু ফুরফুরে হাওয়া ছাড়ত; তখন লস্যির গেলাস হাতে করে কোয়ার্টারের সামনে দড়ির খাটিয়ায় বসে সে গল্প শুনতে খাসা লাগত। সেসব শুনলে মনে হবে, বিংশ শতাব্দীটা বোধ হয় ভুল করেই এই ঝালাবার শহরটাতে এসে জুড়ে বসেছে। শহরের চৌহদ্দি ছাড়ালেই একেবারে সেই গল্পকথার হুরি,পরি,রাজপুত্রদের দেশ।

আমাদের কোয়ার্টারগুলো একেবারে শহরের পশ্চিম ধারে। পাশাপাশি দুটো বাড়ির একটাতে আমি আর সুগণ সিং থাকতাম। আর অন্যটাতে দুই বুড়োর ডেরা। বাড়ির সীমানা ছাড়ালেই পাথর বালি মেশা রুক্ষ জমি ঢেউ খেলিয়ে চলে গেছে যতদূর চোখ চলে। মাঝে মাঝে ফণীমনসা আর বাবলার ঝোপ ছাড়া সবুজের আর কোনও চিহ্ন নেই সেখানে। বুড়োর মুখে গল্প শুনতে শুনতে সূর্যটা মিলিয়ে যেত, পশ্চিমের আকাশ লাল থেকে ঘন বেগুনি হয়ে আসত আস্তে আস্তে, গাছপালার রঙ গাঢ় হতে হতে অবশেষে অন্ধকারের মধ্যে মিশে যেত একেবারে। সেই অন্ধকারের মধ্যে বুড়োর পাঁচমেশালি ঠেঁট ভাষার গল্প শুনতে শুনতে অবিশ্বাস করবার শক্তি কমে আসত আমাদের। মনে হত, কে জানে, ঐ অন্ধকারের মধ্যে কোথাও হয়তো রাজারানিরা আজও বেঁচে আছে। আছে সত্যিকারের নাগিনীকন্যারা, কিংবা সেই মানুষগুলো, ইচ্ছেমত যে কোনও জীবের চেহারা ধরে যারা ঘুরে বেড়াতে পারে দিন ও রাতের সন্ধিক্ষণদুটিতে। সে সময়টা প্রকৃতির নিয়মকানুনে নাকি বেশ ঢিলে পড়ে। বুড়ো বলত, ভোর আর সন্ধেতে, আলো আর অন্ধকার যখন হাতবদল করে সেই সময়টা এখানকার গাঁ-গঞ্জের অনেক মানুষ নাকি আজও অমনটা করবার শক্তি ধরে।

সুগণ অবশ্য অতটা মুগ্ধ-টুগ্ধ হত না। তার্কিক ছেলে। জুলজির গ্র্যাজুয়েট। গল্প চলতে চলতে মাঝেমাঝেই মূর্তিমান ছন্দপতনের মতো ঠা ঠা করে হেসে উঠত আর বলত, “ওসব জাদুটোনার জারিজুরি আমার কাছে খাটবে না দাদাজি। অ্যায়সা-ওয়সা কিছু চোখে পড়লে রাইফেলের নিশানা লাগাব আর দমাদ্দম দুটো টোটা… ব্যাস! সব মন্তরটন্তর আর ভোজবাজির পর্দা ফাঁস হয়ে যাবে।” বুড়ো রাগ করত না। শুধু মাথা নেড়ে বলত, “সে করলে সব্বনাশ হবে রে! ভগবানের দেওয়া শক্তি। আংরেজের বানানো যন্তর দিয়ে তার মোকাবেলা করতে গেলে ফল ভালো হয় না। সাহাবলোগ এতদিন ধরে তো এদেশে রাজত্ব করে গেল। কামান বন্দুক তো তাদের অনেক ছিল। তবু বদলাতে পারল এদের কিছু?”

এর ওপর আর কথা চলে না। যুক্তি, যুক্তির সঙ্গে লড়াই করতে পারে। কিন্তু অন্ধ বিশ্বাসের সামনে তার শক্তি থাকে না।

।।২।।

বর্ষার মুখ-মুখ ওপরমহল থেকে অর্ডার এল, কুঁঅরখেরা তহশিলে সেটলমেন্টের কাজ শুরু হবে। খবর আসবার সঙ্গে সঙ্গে শিশোদিয়া বুড়োর বাতের ব্যথা ফের চাগিয়ে উঠল। দিনরাত হাঁটু ধরে বসে কোঁ কোঁ করে চলেছে। অবশ্য অতটা কাতর তার না হলেও চলত। ঐ তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকা বুড়োকে সাহেব এমনিতেই ও জায়গায় পাঠাতেন না। জেলার একেবারে দক্ষিণ পশ্চিম কোণে একটা অখাদ্য এলাকা। ভালো রাস্তা পেলে সদর থেকে বড়জোর আধবেলার ড্রাইভ। কিন্তু ও এলাকায় রাস্তাঘাটের যা অবস্থা তাতে সময় তো অনেক বেশি লাগেই, তার ওপর ঝাঁকুনির চোটে জোয়ান মানুষকেও কাহিল করে ছাড়ে। ঠিক হল, আমি আর সুগণ সিং প্রথমে যাব। আমিন হরিদেও সিং যাবে সঙ্গে। ভদ্রলোকের ড্রাইভিংয়ের হাত বেশ ভালো। ফলে আলাদা করে ড্রাইভার আর নিতে হবে না। হপ্তা তিনেক ওখানে থেকে মোটামুটি মাপজোকের কাজ এগিয়ে নিয়ে গেলে পরে সাহেব আসবেন দিনকয়েকের জন্য দলবল নিয়ে, বাকি সমস্ত আইনি কাজকর্ম সামলাতে। একমাসের প্রোজেক্ট। তাতে কাজ যতটুকু এগোয় এগোবে, তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।

জুনের মাঝামাঝি সবকিছু গুছিয়ে গাছিয়ে রওনা দেওয়া গেল। সুগণ দেখি মালপত্রের মধ্যে ওর পাখিমারা বন্দুকটাও নিয়েছে। সঙ্গে একগাদা টোটা। বুঝলাম, এ যাত্রা মাংসের অভাব হবে না। নিজে বন্দুক চালাইনি কখনও। সময় সুযোগ মিললে সে বিদ্যেটাও এ যাত্রা শিখে নেওয়া যেতে পারে। ছোকরা শাহেনশা ছেলে। পড়াশোনায়, অফিসের কাজে, বন্দুকের নিশানায়, সবটাতেই মাথা আর নজর বেজায় সাফ।

*****

ম্যাপে দেখেছিলাম, পাহাড়পুরা থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে ছেড়ে বাঁদিকের কাঁচা রাস্তায় ঢুকতে হবে। ম্যাপের গায়ে কাঁচা রাস্তার চিহ্নটা সাপের মতই এঁকেবেঁকে গিয়ে পৌঁছেছে লাল মার্কা দেওয়া গন্তব্যটিতে। মোটামুটি তিরিশ মাইল মতো হবে। সদর থেকে পাহাড়পুরা ষাট মাইল মতো পথ। দুয়ে মিলে নব্বই মাইল রাস্তা। গোঁফ চুমরে সুগণ বলেছিল, “সিমপল অ্যাসাইনমেন্ট। ভোর ভোর বেরিয়ে দুপুরের মধ্যে পৌঁছে যাব, কী বলো দাদা?”

রওনা হবার পর অবশ্য বোঝা গেল ব্যাপারটা তত সহজ নয়। হরিদেও আমিন স্টিয়ারিঙয়ে বসে একগাল হেসে জানাল, কুঁঅরখেরার নাম অবধি সে কখনও শোনেনি, যাওয়া তো দূরস্থান। দ্বিতীয়ত, পাহাড়পুরা জায়াগাটা বেশ অনেকটা এলাকা জুড়ে। তার ঠিক কোনখান থেকে যে রাস্তাটা পাওয়া যাবে তার কোনও ঠিক নেই। সকাল আটটা নাগাদ বাড়ি থেকে রওনা দিয়ে পাহাড়পুরা লেভেল ক্রসিংয়ে গিয়ে পৌছুতে পৌছুতে বেলা প্রায় একটা বাজল। পুরোনো গাড়ি। তার গিয়ার বক্সে কী এক দোষ হয়েছে। হরিদেও গিয়ারের ডাণ্ডাটাকে পা দিয়ে চেপে ধরে গাড়ি চালাচ্ছিল। নইলে বারবার পিছলে নিউট্রালে চলে আসছে। নিট ফল, ষাট মাইল যেতে পাক্কা পাঁচ ঘণ্টা। লেভেল ক্রসিংয়ের পাশে একটা ছোট ঝুপড়িমার্কা দোকানে বসে পুরি, আরভির সবজি আর পোড়া মকাই দিয়ে লাঞ্চ সারলাম। হরিদেও গিয়েছিল মেকানিকের খোঁজে। খাওয়া শেষ হতে হতে সে ফিরে এল। খবর ভাল নয়। এ চত্বরে নাকি একটাই গাড়ি সারাইয়ের ঝুপড়ি, সে-ও বন্ধ। মেকানিক গাঁয়ে গেছে ক্ষেতের কাজ সামলাতে। বর্ষার মুখে এখন বীজ বোনবার সময়।

আকাশ মেঘলা করে আসছিল। দোকানদারকে কুঁঅরখেরার পথ জিগ্যেস করতে সে জানাল, আরও মাইলদুইটাক এগিয়ে গেলে হাতের বাঁয়ে নাকি রাস্তা। অগত্যা দুগগা বলে সেই মুখেই রওনা দেওয়া গেল।

*****

রাস্তাটাকে ঠিক রাস্তা বলা যাবে না। নুড়ি বিছানো খাড়াই ঢাল বেয়ে হাইওয়ে থেকে নেমে এসে দুপাশের একমানুষ পাথুরে দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে একটা পায়ে চলা পথ এগিয়ে গেছে সামনে। দূর অতীতে কোনও ভূমিকম্পে হয়তো সামান্য একটা চিড় ধরেছিল পৃথিবীর পাথুরে ত্বকে। সেটাই এখন যাতায়াতের পথ হয়েছে। কখনও কখনও এ পথে আজও যে জল বয়ে যায় তার নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল দুপাশের পাথুরে দেওয়ালের গায়ে লেগে থাকা শ্যাওলার দাগ থেকে। যতদূর চোখ চলে ছোট বড় পাথর আর নুড়ি ছড়িয়ে আছে পথ জুড়ে।

হাইওয়ে থেকে গড়গড়িয়ে নেমে এসে রাস্তায় পড়েই জিপটা একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিল। তারপর বিচিত্র সব শব্দ করতে করতে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে চলল অসমান রাস্তা ধরে। দুপাশের উঁচু জমিতে সবুজের অভাব নেই। বড় বড় ঘাসের গোছা দুপাশ থেকে ঝুঁকে পড়েছে রাস্তার ওপর। তার মধ্যে বাবলার ঝোপের ভেজালও আছে। ফলে খানিক বাদে বাদেই জিপের খোলা চারপাশ দিয়ে কাঁটার খোঁচা টের পাওয়া যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে আখ, বাদাম কিংবা জনারের ক্ষেত। সম্ভবত এই এককালের নদীর কল্যাণে তার ধারে ধারে মাটির নিচে জলের জোগান রয়ে গিয়েছে এখনও। গাছেদের তাই এত বাড়বাড়ন্ত। সুগণও ঝাঁকুনি খেতে খেতে গাছপালা ঝোপঝাড়ের দিকে চেয়ে দেখছিল। তবে গাছের বদলে তাদের ডালপালার আড়ালে বসা পাখিদের খোঁজেই যে তার এই প্রকৃতিপ্রীতি সেটা বুঝতে জ্যোতিষ জানবার দরকার ছিল না। মাঝেমাঝেই “উওহ রহা হরিয়াল কা ঝুন্ড” কিংবা, “মোর ভী দিখতা হৈ য়ার” ইত্যাদি হাঁকডাকে কান ঝালাপালা হবার জোগাড়। আমার অবশ্য তখন পাখি, গাছপালা সব মাথায় উঠেছে। রাস্তায় গোটাচারেক বাঁক নেবার পর সামনে পেছনে শুধু একইরকম চেহারার জঙ্গল চলেছে বহুক্ষণ ধরে। বন্ধুর পথ আর ঝুঁকে পড়া ঝোপঝাড়, দুয়ে মিলে যেন ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছে আমাদের পথ আটকাবার জন্য। ওদিকে আকাশ কালো হয়ে আসছিল। ঘড়িতে দেখলাম প্রায় ছটা বাজে। দূরে কোথাও বৃষ্টি নেমেছে। ঠান্ডা, ভেজা হাওয়া এসে লাগছিল গায়ে মাথায়। প্রায় শামুকের মতন হামাগুড়ি দিয়ে গাড়ি এগোচ্ছে সামনে। কতটা দূর যে এসেছি আর কতটা পথ যে বাকি তার হদিশ পাবার জো নেই। খানিক পরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নামল, আর হরিদেও-ও হঠাৎ ব্রেক মেরে গাড়ি নিউট্রালে করে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলে, “অব রাস্তা বতাইয়ে হুকম্‌।”

সমস্যাটা বেশ জটিল। এই অবধি, ভালো হোক মন্দ হোক, রাস্তা একটাই ছিল। এইখানটাতে এসে পথটা সাপের জিভের মতো দুটো ফালি হয়ে দুদিকে চলে গেছে। কিংবা বলা যায়, মূল খাতটার সঙ্গে আরও একটা সরু নদীখাত এসে মিশেছে পূর্বদিক থেকে।

হরিদেওয়ের অনুরোধ রক্ষা করা মুশকিল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে একে অন্যের মুখ চাইছি, এমন সময় বাঁদিকের জঙ্গল থেকে তীক্ষ্ণ কর্কশ একটা শব্দ ভেসে এল। ডাকটা আমার চেনা নয়। আওয়াজটা কানে যেতেই সুগণ সিং নিচু হয়ে গাড়ির মেঝেতে রাখা ছররা বন্দুকটা তুলে নিয়েছে হাতে। বললাম, “ও কীসের শব্দ সুগণ?”

বন্দুকের মাথা ভাঁজ করে তার ভেতরে টোটা পুরতে পুরতে সুগণ জবাব দিল, “ভয় নেই দাদা। চুপ করে বোসো। ভালো মাংস খাওয়াব আজ।” হরিদেও-ও দেখি, ঘাড় টান করে বাঁদিকের অন্ধকার জঙ্গুলে প্রান্তরটার দিকে তাকিয়ে আছে। বন্দুক নিয়ে লাফিয়ে গাড়ি থেকে নামতে নামতে সুগণ সিং ইশারায় হাতঘড়িটা দেখিয়ে বলে গেল, “আধ ঘণ্টার ভেতর কাজ শেষ করে ফিরে আসব দাদা। রাস্তার খোঁজও করে আসব। ময়ূরের মাংস আগে কখনও খাওনি নিশ্চয়? কপাল ভালো থাকলে আজ রাতে খেতে পাবে। একবার খেলে আর ভুলবে না দেখো।”

বুঝলাম, মহা পাগলের পাল্লায় পড়েছি। রাতের মুখ-মুখ একটা ভাঙা গাড়ি নিয়ে অচেনা জায়গায় রাস্তা গুলিয়েছি, আর তার ভেতর উনি চললেন ময়ূর শিকার করতে। যেতে যেতে হাত বাড়িয়ে সবেধন চার ব্যাটারির ফ্ল্যাশলাইটটাও হাতে করে নিয়ে গেছে।

একটা অদ্ভুত নৈঃশব্দ ছেয়ে ছিল আমাদের চারদিকে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিটা থেমে গেছে। সন্ধ্যা ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছিল। নিউট্রালে রাখা ইঞ্জিনের মৃদু গরগর শব্দ, শিস দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়া আর ক্রমশ তীব্র হয়ে ওঠা ঝিঁঝিঁর ডাক, এই তিনে মিলে দিন ও রাতের এই সন্ধিক্ষণে নৈঃশব্দের এক অপরূপ কনসার্ট গড়ে তুলছিল আমাদের চারপাশে। তাকে ভাঙবার সাধ্য আমার ছিল না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে ছিলাম চুপচাপ, আর, প্রায় নিজেরই অজ্ঞাতে কান পেতে ছিলাম, সুগণ সিংয়ের বন্দুকের আওয়াজের জন্য। হোক না মৃত্যুমুখী, তবু আমার চেনা দুনিয়ার শব্দ তো!

খানিক বাদে, কান খাড়া করে কিছু একটা শুনে হরিদেও বলে, “সাহেব ফিরছেন।”

“সে কী! বন্দুকের আওয়াজ পেলাম না যে! তার মানে…”

কথাটা শেষ করবার আগেই একটা অপ্রত্যাশিত শব্দ কানে আসতে থেমে গিয়ে কান খাড়া করলাম। দুটো মানুষের গলার শব্দ। তার মধ্যে একটা যে সুগণের সেটা পরিষ্কার টের পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু অন্যটা একটা মেয়ের গলার আওয়াজ। এই ভর সন্ধেবেলা, নির্জন মাঠে বনে একা একটা মেয়ে কোথা থেকে এল!

মিনিট কয়েকের মধ্যেই চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হল অবশ্য। বন্দুকটা ঘাড়ে করে আগে আগে সুগণ এসে নামল গাড়ির কাছে, আর তার পেছন পেছন বছর সতেরো-আঠারোর একটা মেয়ে। অতি সাধারণ ঘাগরা চোলি পরনে, পায়ে খাড়ু, নাকে নথ। মাথায় চুন্নিটা আছে, তবে ঐটুকুই। তাই দিয়ে ঘোমটা দেবার কোনও চেষ্টা নেই। উজ্জ্বল, বড় বড় চোখ দুটি দিয়ে জিপগাড়িটাকে দেখছিল। খানিক পরে বলল, “বিশ্রী গন্ধ।”

সুগণ হাসল, “পেট্রলের গন্ধ আগে কখনও শুঁকিস নি, নারে মুন্নিবাই?”

মেয়েটা তার দিকে ঘুরে বলে, “সেটা আবার কী জিনিস?”

একটু মজাই পাচ্ছিলাম। সুগণের দিকে চেয়ে বললাম, “কী হে শিকারি? বন্দুক নিয়ে জঙ্গলে গেলে শিকার করতে, আর ফিরে এলে, শিকারের বদলে একটা জ্যান্ত মানুষ সঙ্গে করে। আমাদের ময়ূরের মাংস যে খাওয়াবে বললে তার কী হবে?”

মেয়েটা হঠাৎ শিউরে উঠে আমাদের দিকে তাকাল। মুখের খুশি খুশি ভাবটা একেবারে উধাও। কাঁপা কাঁপা গলায় শুধু একবার বলে উঠল, “মৎ মারো সাহাব।”

সুগণ ভেংচি কেটে বলে, “মৎ মারো সাহাব! ঐ করেই তো আমার শিওর শটটা বানচাল করে দিলি। উঃ!”

জানা গেল, ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে খানিক এগিয়ে ময়ূরটাকে দেখতে পেয়েছিল সুগণ। শেষ বিকেলের মরে আসা আলোয়, পশ্চিম আকাশে জমে ওঠা মেঘের দিকে মুখ করে পেখম ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে। মাত্র কুড়ি গজ দূর থেকে নিশানা লাগিয়েছিল সুগণ। ভুল হবার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। ঘোড়া টিপতে যাবে এমন সময় হঠাৎ করে এই মেয়েটা কোত্থেকে উদয় হয়ে বন্দুকের নলটা ধাক্কা মেরে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়। সেইসঙ্গে প্রাণপণে চিৎকার, “মৎ মারো সাহাব।” বন্দুক ছাড়িয়ে নিতে-নিতেই ময়ূর উধাও। আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও আর তার টিকির নাগাল পাওয়া যায়নি নাকি।

ময়ূর হারিয়ে সুগণ রাগ করে থাকলেও আমাদের উল্লসিত হবার যথেষ্ট কারণ ছিল। ততক্ষণে অন্ধকার নেমে গেছে। হাওয়া আর বৃষ্টির জোরও বেড়েছে বেশ। সেই অবস্থায় যখন জানা গেল মুন্নি কুঁঅরখেরার তহশিলের রিলায়তি গ্রামের মেয়ে, আর পুবের রাস্তাটা দিয়ে বড়জোর আধমাইলটাক গেলেই তাদের গ্রাম, তখন সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

মেয়েটাকে বললাম, “গাড়িতে ওঠ। তোদের গ্রামের দিকেই যাব। রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাবি।” সে একগাল হেসে মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু। আমি আগে আগে যাচ্ছি। জঙ্গল ছাড়িয়ে গ্রামের প্রথম বাড়িটাই আমাদের। আজ তোমরা আমার বাড়িতে অতিথি হবে। রাস্তার যা হাল তাতে ঐ গাড়ি নিয়ে তোমাদের আসতে অনেক সময় লাগবে। আমি ততক্ষণে বাড়ির লোককে সব কথা বলে আটা-দাল বের করতে থাকি গিয়ে। তোমরা পিছে পিছে এসো।” বলতে বলতে পেছন ঘুরে লাফাতে লাফাতে অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেল মুন্নি। হরিদেও সেইদিকে চেয়ে চেয়ে হাসছিল। এই বয়সি একটা মেয়ে আছে তার। শুনেছি ক’দিন আগে তার বিয়ে দিয়েছে। হাসতে হাসতে নিজের মনেই বলে, “বচপনা আভিতক গঈ নহি বিটিয়াকি!”

*****

মুন্নিদের বাড়িটা ওদের গ্রামের একেবারে একটেরেতে। প্রায় একমানুষ উঁচু দাওয়ার ওপর একটা বারান্দাকে ঘিরে চারপাঁচটা বড় বড় ঘর। সবে কিছুদিন হল বিয়ে হয়েছে তার। একটা ঘরে বৃদ্ধা শাশুড়ি থাকেন। তার পাশেরটা মুন্নিদের শোবার ঘর। বাকি ঘরগুলো এমনিতে খালিই পড়ে থাকে। সেদিন রাতের খাওয়াদাওয়ার পর মুন্নির বর রামপ্রতাপের সঙ্গে কথা বলে হরিদেও দুটো ঘর ভাড়া নেবার বন্দোবস্ত করে নিল। যে ক’দিন এ তহশিলে থাকব, এখানেই থেকে যাওয়া ঠিক করে নিলাম আমরা। খাওয়াদাওয়াও এখানেই। পেয়িং গেস্ট জাতীয় ব্যাপার। টাকাপয়সার ব্যাপারে রামপ্রতাপ প্রথমে একটু তা না-না করেছিল। বয়স এখনও কম। কথায় কথায় চোখে মুখে হাসে। দুনিয়াদারির কায়দাকানুন এখনও ভালো করে রক্তে বসেনি তার। মুন্নিও সেই একই গোঁ ধরেছিল। শেষমেশ হরিদেও বকাঝকা করে ভাড়া নিতে রাজি করায় দুজনকে। দৈনিক পঞ্চাশ টাকা। ওতেই নাকি থাকা, খাওয়া দুটোই কুলিয়ে যাবে।

পরদিন সকালে উঠে তহশিলদারের অফিসে গিয়ে দেখা করে, চেন ফেলবার জন্য মজুরের বন্দোবস্ত থেকে শুরু করে এলাকায় সেটলমেন্টের ঢোল দেওয়া অবধি সব ঠিকঠাক করতে করতেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তার পরদিন সেটলমেন্টের টেবিল পড়বে কুঁঅরখেরার পুবপাশে। ওখান থেকে আস্তে আস্তে পশ্চিমদিকে এগোব এই প্ল্যান ছিল। বিকেল নাগাদ অফিসের কাজকর্ম সেরে পরদিনের স্পটটা একবার দেখেশুনে নিয়ে ফিরতে ফিরে সন্ধে পেরিয়ে গেল। ক্লান্ত ছিলাম খুব। ডাল, রুটি আর আলুর সবজি দিয়ে ডিনারের শেষ পাতে লোটাভরা ভাপ ওঠা কাঁচা দুধ এনে দিল মুন্নি। ভারী মিষ্টি। খেয়েদেয়ে বিছানায় মাথা ঠেকাতে না ঠেকাতেই ঘুম।

ভোরবেলা ঘুম ভাঙল সুগণের ধাক্কাধাক্কিতে। চোখ খুলতেই জিজ্ঞাসা করল, “আমার টোটার বাক্সটা দেখেছ?” রেগে গিয়ে বললাম, “কোথায় না কোথায় ফেলেছো, এখন খোঁজবার জন্য আমার কাঁচা ঘুমটা ভাঙাও কেন বলো তো?”

“তুমি তো ঘুমিয়েই খুশ। ওদিকে গত দুটো দিন যে রুটি আর সবজিতে চালাচ্ছি, তার কী হবে? ভাবলাম, ভোর ভোর বন্দুকটা নিয়ে চুপচাপ বার হয়ে চিড়িয়া মেরে আনব কটা। বন্দুক আর টোটার বাক্স দুটোই শিয়রের কাছে রেখে শুয়েছিলাম কাল রাতে, আমার স্পষ্ট মনে আছে। সকালে উঠে দেখি টোটার বাক্স নেই।”

“নেই তো নেই। বন্দুক দিয়ে পিটিয়ে পাখি মারো গে যাও।” বলে আমি পাশ ফিরে শুলাম। খানিক পরে চ্যাঁচামেচির শব্দে ঘুম ভাঙতে বেরিয়ে এসে দেখি মহা হল্লা বেধেছে। রসুইঘরের সামনে টোটার বাক্স হাতে সুগণ দাঁড়িয়ে। বারান্দায় বসে বসে রামপ্রতাপ আর তার বুড়ি মা দুজনে মিলে মুন্নিকে বেজায় বকছে। আর রসুইঘরের ভেতর আটা ঠাসতে ঠাসতে ফুলে ফুলে কাঁদছে মুন্নি। নাকি তার রসুইঘরের চ্যালাকাঠের গাদার মধ্যে টোটার বাক্স লুকোনো ছিল। চুলোর জন্য কাঠ নামিয়ে দিতে গিয়ে রামপ্রতাপ সেটা খুঁজে পেয়েছে।

অবশ্য অত বকুনি খেলেও দোষ অস্বীকার করবার কোনও চেষ্টাই তার মধ্যে দেখা যাচ্ছিল না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে আর বলে, “বেশ করেছি। আবার লুকোব। ছুঁড়ে ফেলে দেব একেবারে জাহান্নুমের মুল্লুকে। নইলে ঐ দিয়ে সাহাবজি…”

বাক্যটা পুরো করবার আগেই রামপ্রতাপ একটা চ্যালাকাঠ হাতে তেড়ে গেল রসুইঘরের দিকে। একে তো অতিথির জিনিস চুরি, তার ওপর ধরা পরেও লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে বলে বেশ করেছি? বউয়ের এত বড় অন্যায় সে মোটেই সহ্য করতে রাজি নয়। তখন তার রাগ ঠেকাতেই সুগণ সিংয়ের জেরবার অবস্থা। টোটা চুরির দুঃখ আর তার মাথায় নেই।

।।৩।।

সেটলমেন্টের ফিল্ডওয়ার্ক বেশ পরিশ্রমের কাজ। আমাদের অবশ্য হাতে করে চেনটা টানতে হয় না। সেজন্য ভাড়া করা লোক আছে। তবে তাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকতে হয়। রোদে-জলে মাঠের ওপর টেবিল পেতে ‘খাকা’ তৈরি করা থেকে শুরু করে কথায় কথায় জমিওয়ালাদের মধ্যে ঝগড়া মেটানো অব্দি সব কাজই করতে হয়। দুপুরে, যে এলাকায় কাজ করছি তার আশেপাশে কারও বাড়িতে কিছু খেয়ে নিই। এরা অতিথির যত্ন করে খুব, তবে বড় গরিব। যে যা পারে, দেয়। শুকনো পুরি বা বাজরির রুটি, একটু শাক, আচার, কপাল ভালো থাকলে ডাল বা একটু দইও জুটে যায় কোনও কোনও দিন। সন্ধেবেলা গ্রামের সরপঞ্চের বাড়ির দাওয়াতে সারাদিনের কাজের কাগজপত্র ঘাঁটতে বসা। তখন আবার হাজারো লোকের কাজিয়া ঝগড়ার আইনি মীমাংসা করতে হয় বসে বসে। শিষ ওঠা লম্ফের দপদপে আলোয় বড় বড় পাগড়ি ঘেরা মাথাগুলো ঘিরে বসে থাকে আমাদের। একটা ছোট সিগরি জ্বালিয়ে তাইতে বাদাম সেঁকে ছাড়িয়ে দিতে থাকে একজন, আর বাড়ির ভেতর থেকে মাঝে মাঝেই পাথরের গ্লাসে করে ফেনাভর্তি কাঁচা দুধ আসে।

সব সারতে সারতে রাত হয়ে যায় প্রায়ই। বাড়িতে যখন ফিরি তখন দূর থেকেই দেখা যায় একটা লন্ঠন জ্বেলে বারান্দার খুঁটির গায়ে ঝুলিয়ে রেখে রামপ্রতাপ বসে আছে বারান্দায়। মাঝে মাঝে দরাজ গলায় গানেরও আওয়াজ ওঠে। সরল দেহাতি সুর। রামপ্রতাপের গলাটাও ভালো। দিব্যি লাগে শুনতে। তার মুখের একটা পাশ রান্নাঘর থেকে আসা দপদপে আগুনের আভায় উজ্জ্বল হয়ে থাকে। বুঝতে পারি, গানের অন্য শ্রোতাটিও রসুইঘরে বসে আছেন অতিথিদের ফেরবার পথ চেয়ে। তখন মাঝেমাঝেই নিজের বাড়ির কথা মনে হয়। মন খারাপ হয়, আবার ভালোও লাগে।

মুন্নিদের গ্রামটা তহশিলের একেবারে পশ্চিমপ্রান্তে। জমি মাপতে মাপতে আস্তে আস্তে আমরা সেইদিকেই এগোচ্ছিলাম। সপ্তাহদুয়েক পরে মোটামুটি কাছাকাছি চলে আসতে একটু সুবিধে হল। ঘর থেকে ফিল্ডে হেঁটেই যাতায়াত করা যায়। এ তহশিলে রাস্তা বলতে বিশেষ কিছু নেই। উঁচু-নিচু মাঠঘাট বেয়ে গাড়িতে চড়ে যাতায়াত করতে বেশ কষ্টই হচ্ছিল এতদিন।

রামপ্রতাপ আর মুন্নির সঙ্গেও বেশ ভাব হয়ে গেছে এই ক’দিনে। ছেলেমেয়ে দুটো বড় ভালো। নিজেদের নিয়ে মহা খুশিতে আছে দুজনে। বাকি দুনিয়ার খবর রাখে না কোনও। সে ইচ্ছেও নেই তাদের। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঝগড়া যেমন বাঁধে, ভাবও তেমনই। সারাটা দিন সেই মেঘ-রোদ্দুরের খেলা চলে দুজনের মধ্যে। সেদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি দুটোতে মিলে ঝগড়া করতে করতে ফিরছে কোত্থেকে। এগিয়ে গিয়ে বললাম, “কী হল রে মুন্নি, রাগ কেন?” সে মুখটা গোমড়া করে রামপ্রতাপের পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বলল, “দেখো না ভাইয়া, জঙ্গলে একটা এত বড় হিংগোঠিয়ার গাছ দেখলাম। কতবার বললাম, কটা ফল পেড়ে এনে দাও; তা বলে, ‘ওতে হবে কী? তোকে হাট থেকে শুক্কুরবারে বিলাইতি সাবুন এনে দেবখন।’ আচ্ছা বলো দেখি, ভগবানের দেওয়া এত ভালো জিনিস থাকতে শুধুমুদু পয়সা খরচ করবার শখ কেন?”

জানা গেল, হিংগোঠিয়ার ফল থেঁতলে ভালো সাবানের কাজ হয়। এ গাছের নাম জানি না শুনে ওরা একটু অবাকই হল। বলে, সীতাজি, শকুন্তলাজী সবাই নাকি ঐ গাছের ফলের মন্ড মেখে চান করত। ঐ ফলের তেল মাখত। রামায়ণ, মহাভারত সবেতেই নাকি ওর নাম আছে।

আমার ভ্যাবাচ্যাকা দশা দেখে সুগণ এসে শেষমেশ রহস্য উদ্ধার করল। বলে, “ও হল ইঙ্গুদির গাছ। গাঁয়ের লোকের মুখে হিংগোঠিয়ার গাছ হয়ে গেছে।”

রামপ্রতাপ রেগেমেগে আমায় সালিশ মানছিল। বলে, “সাহেব, ছ-সাত মানুষ উঁচু গাছ। তাইতে বেয়ে উঠে ওনার জন্য ফল পেড়ে আনতে হবে। আমি মোটে গাছে চড়তে জানি না, উঠব কেমন করে?” মুন্নি ফের রেগে উঠে বলে, “উঁচা তো ক্যা হুয়া। উড়কে পঁহুচ যাতে। ইসমে তকলিফ…” বলতে বলতে নিজের রসিকতায় নিজেই মজা পেয়ে হেসে অস্থির। শেষমেশ বললাম, “ঠিক আছে। যেখানে টেবিল পড়েছে তার কাছেই জঙ্গল আছে। সেখানে তোর হিংগোঠিয়ার গাছ পেলে কাউকে দিয়ে পাড়িয়ে এনে দেবখন আজ।” মুন্নি ভারী খুশি হল শুনে। চোখ পাকিয়ে রামপ্রতাপকে বলে, “যাও জি, তুমি না দিলে আমার ভাইয়া আমাকে এনে দেবে ঠিক।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ হয়েছে। এবারে যা। ভাইসাবদের পুরি সবজি তৈরি কর গে। ওনাদের কাজকাম তো আছে, নাকি সারাদিন তোর মতো ঘরে বসে হিংগোঠিয়া মাখলেই চলবে?” বলতে বলতে রামপ্রতাপ গোয়ালের দিকে চলে গেল। মনে একটু ব্যথা লেগেছে বোধ হয় বউয়ের কথায়। তাই দু কথা শুনিয়ে দিল তাকে। একেবারে ছেলেমানুষ!

*****

সেদিন আর কাজকর্মের ঠেলায় মুন্নির ফলের কথা মনে ছিল না। তবে লোক দিয়ে খোঁজ করিয়ে পরের দিন বিকেলবেলা মাঠের কাজকর্মের পরে গিয়েছিলাম ইঙ্গুদি ফল আনতে। কাঁটাঝোপের জঙ্গল ঠেলে বনের খানিক ভেতরে ঢুকে একটা ছায়াছায়া ফাঁকা মতো জায়গায় গাছটা। চেন ফেলবার ছোকরাটা কাঠবেড়ালির মতো তড়তড় করে গাছ বেয়ে উঠে গিয়ে একগাদা ফল পেড়ে নিয়ে এল নিচে। খানিক নিজে নিল, আর একরাশ ফল আমাদের জন্য রেখে দিয়ে ফিরে গেল সে।

পড়ন্ত বিকেলের আবছায়া আলোয় জায়গাটা ভারী সুন্দর দেখাচ্ছিল। ক্লান্তও ছিলাম। ভাবলাম একটু বসে নিয়ে তারপর সন্ধের কাজের জন্য রওনা দেওয়া যাবে।

সন্ধে এগিয়ে আসছিল দ্রুত। মেঘে ভরা থমথমে আকাশ থেকে দিনের আলোর শেষ রেশটুকু তখন মুছে যাচ্ছে। গাছতলায় বসে বিশ্রাম নিতে নিতে হঠাৎ সুগণ সিং কান খাড়া করে উঠে বসল। আওয়াজটা আমার কানেও এসেছিল। ময়ূর ডাকছে জঙ্গলের ভেতর। ‘ক্যাঁও ক্যাঁও’ করে কর্কশ ডাকটা এখানকার পরিবেশের সঙ্গে আশ্চর্যরকম খাপ খেয়ে গিয়েছে। বন্দুক সঙ্গে আনেনি বলে আফশোস করছিল সুগণ। খানিক বাদে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “চলো দাদা, ফিরি। খালি হাতে বসে বসে ময়ূরের ডাক শুনতে মোটেই ভালো লাগছে না।”

বললাম, “কাল বরং বন্দুকটা নিয়েই সন্ধেবেলা এদিকে আসা যাবে একবার। ময়ূর আর পালাবে কোথায়? এই তো ওর বাড়িঘর!”

“না, কাল নয়। পরশু।”

“কেন?”

“পরশু দুপুরে সায়েবের আসবার কথা না? ওদিন রাতে ময়ূরের মাংস দিয়ে ওয়েলকাম করব ভাবছি।”

মন্দ বুদ্ধি নয়। বললাম, “চলো তবে, হাঁটা লাগাই।”

উঠে দাঁড়িয়ে এগোতে যাব, এমন সময় একদম মাথার পেছনে ময়ূরের ডাকটা আবার শোনা গেল। চমকে উঠে ঘুরে তাকাতেই সাঁই সাঁই শব্দ তুলে ডানা ঝাপটে পাশ দিয়ে উড়াল দিয়ে গেল দুটো ময়ূর। আমাদের নাগালের ঠিক বাইরে ইঙ্গুদি গাছটার একটা নিচুমতো ডালে গিয়ে বসল ডানা মুড়ে। সুগণের চোখদুটো দিয়ে লোভ ঝরে পড়ছিল। সেটা টের পেয়েই কিনা জানি না, পেখমওয়ালা ময়ূরটা আরেকটা ছোট্ট উড়ানে অপেক্ষাকৃত উঁচু একটা ডালে গিয়ে বসল। তারপর আরও খানিকটা উঁচুতে উঠে একদম গাছটার পাতাভরা মাথাটার ভেতর ঢুকে পড়ল গিয়ে। সম্ভবত ওখানেই রাত কাটায় এই দুটিতে।

সুগণের হাত ধরে টান দিলাম। এবার আর দেরি করা ঠিক হবে না। বৃষ্টি আসছে। জঙ্গল থেকে বেরোতে দেখি গোপাল যাদব টেবিলের কাছে অপেক্ষা করে বসে আছে। তিন শতক জমি নিয়ে একটা পুরোনো ঝামেলা। ক্ষত্রিয় বনাম যাদবে লেগেছে। লাঠিসোঁটা নিয়ে দু দলই তৈরি হচ্ছে নাকি। জমির পরিমাণটা বড় কথা নয়। ইজ্জত কা সওয়ালই আসল কথা। আজকের মধ্যে আমাদের সিদ্ধান্ত না দিলে দু একটা লাশ পড়ে যেতে পারে রাতের ভেতর। অতএব ক্লান্ত শরীরে ফের গিয়ে খাতাপত্র খুলে বসা। কাজটা শেষ হল যখন, ঘড়িতে দেখি রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে।

বাড়ি ফিরতে, খুঁটি থেকে হ্যারিকেনটা তুলে নিয়ে নেমে এসে রামপ্রতাপ বলে, “আজ এত দেরি যে সাহেব?”

ফলের পুঁটুলিটা তার হাতে তুলে দিতে দিতেই বললাম, “আর বোলো না। সন্ধের মুখে তোমাদের সুরজ সিং আর শ্যামলাল যাদবের মামলা এল। দুটোই মহা কুচুটে সে তো জানোই। সেই বখেরা মিটিয়ে আসছি। নাও ধরো এটা এবারে।”

পুঁটুলিটা আমার হাত থেকে নিতে নিতে সে বলে, “এত হিংগোঠিয়া! এতে তো সারা বছরের কাজ চলে যাবে! কেন আপনি শুধুমুদু…”

“আহা, ভাইয়া বলে ডেকে আবদার করেছে… কিন্তু তুমি জানলে কী করে, এতে কী আছে?”

রামপ্রতাপ একটু চমকে উঠল যেন। তারপর মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “আপনার বহেন তো আজ সারাদিন ঐ একই কথা বলে চলেছে। আজ ভাইয়া হিংগোঠিয়া এনে দেবে। তাই মনে হল আর কি!”

“সে কী? সারাদিন তোমায় বিরক্ত করেছে বুঝি?”

“হাঁ সাহেব। ঐ এক বড় দোষ এ মেয়ের। বড় আবদেরে। বাপের এক মেয়ে কিনা! যখন যা চাইবে, মুখ থেকে কথাটি খসবার আগেই সেটি চাই। আর আজকে তো দুনো লাভ হয়েছে। কদিন ধরে ঘ্যানঘ্যান করে আমাকে দিয়ে তো আনিয়েছেই, আজ আপনাদেরও বোঝা টানিয়ে ছেড়েছে।”

“তুমিও এনে দিয়েছ আজ? ফল পাড়লে কেমন করে?”

“ঐ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যে দু-একটা নিচে ফেলতে পেড়েছিলাম তাই কুড়িয়ে নিয়ে এসেছে খুশি হয়ে। এবারে এই একঝুড়ি ফল পেলে তো আরও খুশি হবে। বদমাশ কাঁহিকি!”

তার দুচোখ দিয়ে স্নেহ ঝরে পড়ছিল। পুঁটুলিটা নিয়ে বারান্দায় উঠে রসুইঘরের দোরে সেটা নামিয়ে রেখে বলে, “এই নে, ভাইয়ার আবদেরে বোন, তোর সারা বছরের হিংগোঠিয়া পাড়িয়ে নিয়ে এসেছেন ভাইয়াজি।”

*****

ঠিক করেছিলাম ময়ূর শিকারের পরিকল্পনাটা মুন্নিদের কাছে ফাঁস করা হবে না। যা পাগলি মেয়ে! জানতে পেলে এবারে হয়তো বন্দুকটাই লুকিয়ে ফেলবে, কিংবা কেঁদেকেটে আবদার করে একশা করবে। তার চেয়ে পরশু বিকেল নাগাদ জঙ্গলে গিয়ে একটা ময়ূর মেরে, কেটেকুটে মাংসটা বাড়িতে নিয়ে এলেই হবেখন। শুনেছি এরা জল ছাড়া শুধু নুন, লংকার গুঁড়ো দিয়ে ঘিয়ে সেদ্ধ করে দুর্দান্ত শুকনো মাংস রাঁধে এই এলাকায়। সেভাবেই রাঁধতে বলা যাবে।

রাতে খেতে বসে রামপ্রতাপকে বললাম, “পরশু সাহেব আসছেন। বড় অফসর। ওনাকে তো আর দালরুটি দিলে চলবে না! একটু মাংসের ব্যবস্থা করব ভাবছি। তোমাদের বাড়িতে মাংস ঢোকে তো?” সে একটু অপ্রস্তুত মুখ করে বলল, “না, মানে সাহেব, আমরা তো শাকাহারী, নিজেরা ওসব খাই না। তবে অতিথির তৃপ্তি না হলে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়। মাংস আমিই হাট থেকে আনিয়ে দেব। আলাদা একটা চুলহাও বানিয়ে দেব। মুন্নি ওতে রান্নাবান্নাও করে দেবে। তবে আমরা খাব না।” এই অবধি বলে সে মুনির দিকে চোখ তুলে বলে, “কী রে মুন্নি। রেঁধে দিবি তো?”

হাতে ডালের হাতাটা নিয়ে আমাদের সামনে মাথা নিচু করে বসে ছিল মুন্নি। ঐ অবস্থাতেই আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। রামপ্রতাপ অবশ্য অত সহজে বিশ্বাস করবার পাত্র নয়। বউকে হাড়ে হাড়ে চেনে, অতএব আবার বলল, “দেখ মুন্নি, অতিথ নারায়ণ। তাঁর সেবার জন্য ধরম তো ধরম, নিজের জান দিলেও মহাপুণ্য হয়। সেই নারায়ণের সেবার জন্য কথা দিলি কিন্তু। কোন শরারতি করিস না যেন আবার।”

মেয়েটার সম্ভবত জীবহত্যার ব্যাপারে একটি নিউরোসিস মতো আছে। হঠাৎ চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকাল সে। সে চোখে তীব্র বেদনা আর ভয়ের ছাপ। রামপ্রতাপ তার দিকে চেয়ে হাসছিল। ভারী সংকটে ফেলে দিয়েছে সে তার বউকে। দুয়েকটি মুহূর্তমাত্র। তারপর মাথা নামিয়ে নিল মুন্নি। ডালের বাটিটা হাতে করে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে প্রায় ফিসফিস করে রামপ্রতাপকে উদ্দেশ্য করে বলল, “মেহমানদের কোনও অসুবিধে হবে না। আমি সব ঠিকঠাক করে দেব। শুধু মাংসটা তুমি একটু দেখেশুনে এনে দিও।”

আমি বললাম, “উঁহু। রামপ্রতাপ শাকাহারী মানুষ। মাংসের ভালোমন্দ ও কিছুই বুঝবে না। শেষে বাজে মাংস গছিয়ে দিলে সাহেবের সামনে বেইজ্জত হতে হবে। তার চেয়ে, মাংস আমরাই দেখেশুনে এনে দেব।”

মুন্নি চমকে উঠে বলল, “শিকার খেলবেন?”

আমি হাসলাম, “শিকার করা তো আর তোর জ্বালায় হবে না রে মুন্নিবাই। তাহলে তুই কি আর রক্ষে রাখবি? মাংস আমাদের কিনেই আনতে হবে। পরশু তো শুক্রবার। হাটবার তোদের এখানে। আমি সব খবর নিয়ে নিয়েছি। সন্ধেবেলা হাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মুর্গা কাটিয়ে নিয়ে আসব।”

ঘর থেকে বের হয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ে ঘুরে দাঁড়াল মেয়েটা। মুখের মেঘ হঠাৎ করেই উধাও। একগাল হেসে বলল, “তা হলে তো খুব ভালো হয় ভাইয়া! নইলে এ লোকের ওপর ভরসা করা যায় না। যে ভুলো মানুষ…”

বুঝলাম, শিকার যে করব না, সেই খবরটা শুনে প্রাণ ঠান্ডা হয়েছে। কত সহজে এদের ভোলানো যায়। আমাদের কথায় যে কোন মিথ্যে থাকতে পারে, সে সন্দেহ ঘুণাক্ষরেও জাগেনি মেয়েটার মধ্যে।

সন্দেহ তার জাগল না পরদিন সন্ধেবেলাও, সুগণ যখন তার বন্দুকটাকে সাফ করতে বসল। সরু লোহার কাঠির আগায় প্যাঁচানো ন্যাকড়া গান অয়েলে চুবিয়ে নলদুটির ভেতর ঘসে ঘসে পরিষ্কার করছে, এমন সময় মুন্নি একবার এসেছিল এ ঘরে। সুগণের দিকে চোখ পড়তে জিগ্যেস করেছিল, “এ কী করছ ভাইজি?” সুগণ বলেছিল, “বন্দুকটা কোনও কাজে না লেগে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, তাই তেল মাখিয়ে তুলে রাখছি।”

শুক্রবার সকালে উঠে জিপ নিয়ে হরিদেও চলে গেল পাহাড়পুরা, সাহেবের গাড়িকে পথ দেখিয়ে আনতে। ভোর ভোর উঠে আমরা দুজনও ফিল্ডে চলে গিয়েছিলাম। সাহেব আসার আগে অনেক কাজ গুছোবার আছে। মুন্নিরা তখনও ওঠেনি সম্ভবত। কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না।

জঙ্গলের একেবারে কাছাকাছি টেবিল পড়েছিল সেদিন। চারটে খুঁটি পুঁতে তার ওপরে এক টুকরো ত্রিপল বেঁধে নিয়েছিলাম। সেই ছাউনির তলায় বড় বড় জলচৌকি পেতে বসে কাজ করতে করতেই চোখে পড়ছিল, পুঞ্জ পুঞ্জ নীল মেঘ দিগন্ত থেকে উঠে এসে আকাশের দখল নিচ্ছে। জমি মাপজোকের কাজ এদিনের মতো মুলতুবি করে দিয়েছিলাম দুপুরবেলাতেই। তারপর সাহেবের জন্য ফাইলপত্র ঠিকঠাক করে সাজাতে সাজাতে আরও অনেকটা সময় গেল। সে কাজ যখন গুছিয়ে এল, তখন চেয়ে দেখি, পুবের আকাশে স্তূপ স্তূপ মেঘ, দিগন্তের মাটি ছুঁয়ে স্থির হয়ে আছে। আর, একেবারে সেই স্পর্শরেখা থেকেই তার গায়ে উঠে এসেছে রামধনুর একটা সুবিশাল অর্ধবৃত্ত।

সাহেবের সটান মাঠের আসবার প্ল্যান ছিল যদিও, কিন্তু হরিদেওকে আমরা বলেই পাঠিয়েছিলাম, কোনও কারণে যদি পৌঁছতে বিকেল পড়ে আসে তবে আর এদিকে না এসে একেবারে রামপ্রতাপের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলতে। এখনও আসেনি, তার মানে সাহেবের আর আজকে মাঠে আসবার কোনও সম্ভাবনাই নেই। তার মানে, কালকের আগে আর ফাইল-টাইলের কাজ হবে না কোনও। কথাটা ভাবতেই মনটা বেশ খুশি খুশি হয়ে উঠল। সুগণকে ঠেলা দিয়ে বললাম, “দেখো, কী সুন্দর রামধনু উঠেছে।” সুগণ মুখ বেঁকিয়ে বলল, “ঐ রামধনুই দেখ তবে। বিকেলটা এখানে বসে বসেই কাটিয়ে দিয়ে তারপর সন্ধেবেলা ময়ূরের বদলে মুরগির মাংস কিনে নিয়ে সাহেবকে দিও, দেখো তোমার ওপর কেমন খুশি হয়। সন্ধেবেলা পাখি দুটো একবার যদি বাসায় ঢুকে পড়ে তবে অন্ধকারে আর খুঁজে পাবে?”

এই কথার ওপরে কথা চলে না। সাহেবের জ্বালা বড় জ্বালা। চেনম্যান ছোকরাদুটো একপাশে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে ছিল। তাদের জাগিয়ে, কাগজপত্রের বান্ডিল দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। তারপর বন্দুক নিয়ে দুজন মিলে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম পশ্চিমদিকের জঙ্গলটার দিকে। ইঙ্গুদি গাছটার কাছে গিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে পজিশান নিল সুগণ। আমার কাছে একটা কুকরি থাকে সবসময়। সেটা নিয়ে আমিও উলটোদিকের একটা ঝোপে গিয়ে লুকোলাম। গুলিতে যদি শুধু চোট হয়ে তবে পালাবার আগেই গিয়ে ছুরি দিয়ে নিকেশ করে দেওয়া যাবে। ময়ূর আজকে যেনতেনপ্রকারেণ নিয়ে যেতে হবেই। হরিদেও নিশ্চয় পথে আসতে আসতে সাহেবকে সাতকাহন করে ময়ূরের গাওনা গেয়ে শুনিয়েছে। এরপর খালি হাতে ফিরলে আজ রাতে লজ্জার একশেষ।

এ অঞ্চলে জঙ্গল তুলনায় ফাঁকা ফাঁকা। মাথার ওপর গাছের ছাতায় আকাশ ঢেকে দেয় না। বসে বসে দেখছিলাম, জলভরা মেঘ পুবদিক থেকে এগিয়ে এসে আস্তে আস্তে উপুড় হয়ে পড়েছে বনের আকাশে। সবুজ আর কালোর ঠাসবুনোট নকশার ঘেরাটোপে গাছতলার ফাঁকা জমিটাকে একটা ছোট মঞ্চের মতো লাগে। যেন এখনই অভিনয় শুরু হবে সেখানে। ঝিঁঝিঁর ডাক, আর এলোমেলো হাওয়ায় গাছের পাতার দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই চারপাশে।

তারপর হঠাৎ সেই শব্দকে ছাপিয়ে বনের ভেতর অনেক দূর থেকে ভেসে এল ময়ূরের ডাক। আস্তে আস্তে শব্দটা এগিয়ে আসছিল কাছে। মিনিটকয়েক পড়ে হঠাৎ-ই খানিক দূরের একটা ঝোপের ভেতর থেকে লম্বা লম্বা পদক্ষেপে বার হয়ে এল আগের দিনের সেই ময়ূর দম্পতি। সেই মেঘলা আকাশের নিচে ফাঁকা জায়গাটার ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়াল ময়ূরীটি। ময়ূরটি তার পেখম মেলে ধরেছে। উজ্জ্বল বর্ণচ্ছটায় চোখ ঝলসে যায়। ধীর পদক্ষেপে সে তার ময়ূরীকে ঘিরে পাক খায়। তারপর, আস্তে আস্তে তার নাচের গতি বেড়ে উঠল…

সাধারণ মানুষ আমি। ইস্কুল-কলেজের পড়াশোনা বাদে আর কিছু শিখিনি কখনও। সুর-তাল-ছন্দের জগতটার সঙ্গে আমার বিশেষ আলাপ কোনওদিনই হয়নি। তবু, ক্রমাগত ঘুরে চলা সেই বর্ণঝলকের যাওয়া-আসা, সেই ছন্দোবদ্ধ পদক্ষেপ, আমায় মুগ্ধ করে রেখেছিল অনেকক্ষণ। খেয়াল করিনি সন্ধ্যা কখন দিনের সীমানা ছাড়িয়ে রাতের দুনিয়ার দিকে পা বাড়িয়েছে।

হঠাৎ বাজ পড়ার মতো শব্দ করে জেগে উঠল বন্দুকের আওয়াজ। আগুনের ঝলক, বারুদের গন্ধ, নাচতে নাচতেই হঠাৎ লুটিয়ে পড়া ময়ূরটা… তার দেহ থেকে ফিনকি দিয়ে বার হয়ে আসা রক্তের ধারা…

ময়ূরীটি মুহূর্তের জন্য কেমন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল এক জায়গায়। তারপর হঠাৎ এক ছুটে পালাতে গেল আমার পাশ দিয়ে। সুগণ ততক্ষণে দ্বিতীয় গুলিটা ছুঁড়েছে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সেটা গিয়ে ইঙ্গুদি গাছটার গায়ে বিঁধে গেল। প্রায় প্রতিবর্ত ক্রিয়াতেই ছুরিটা চালিয়ে দিয়েছিলাম। ময়ূরীটার ডানদিকের ডানায় গিয়ে লাগল তা। রক্তের একটা ক্ষীণ ধারা ছড়াতে ছড়াতে জঙ্গলের মধ্যে উধাও হয়ে গেল সে। চুপ করে তাকিয়ে ছিলাম সেইদিকে। চমক ভাঙল সুগণের ডাকে। কুকরিটা চাইছে। ময়ূরের ছাল ছাড়াবে।

*****

বেশ কিছুক্ষণ পরে, সদ্য ছাড়ানো তাজা মাংসের টুকরোগুলো একটা বড়  প্লাস্টিকে ভরে নিয়ে বাড়িতে ফিরলাম দুজনে। রাত হয়ে গেছে ততক্ষণে। টুকরোগুলো তখনও গরম। মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। পেশিগুলো এখনও মৃত্যুকে পুরোপুরি মেনে নিতে পারেনি।

বাড়ির সামনে দুটো জিপ দাঁড়িয়ে ছিল। হরিদেও দেখি এক বালতি জল নিয়ে গাড়ির কাদা ধুচ্ছে। বলল, মিনিট পনেরো আগে এসে পৌঁছেছে। বার দুয়েক টায়ার ফেঁসেছিল রাস্তায়। তাই দেরি। বন্দুকটা গাড়ির মধ্যে রেখে দিয়ে দুজনে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম এসে। বাড়িটা আজ আশ্চর্যরকম নিস্তব্ধ। বারান্দায় রামপ্রতাপ বসে নেই। হ্যারিকেনটাও লটকানো নেই রোজকার মতো। দাওয়ার নিচে এসে দাঁড়িয়ে ডাক দিলাম, “রামপ্রতাপ। কাঁহা হো?”

উত্তরে রামপ্রতাপের বদলে মুন্নি বার হয়ে এল ভেতর থেকে। হাতে ধরা হ্যারিকেনের অনুজ্জ্বল আলোতেও তার চোখে একটা গভীর বিষণ্ণতার ছাপ ধরা পড়ছিল। মাংসের পুঁটলিটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সুগণ বলল, “এই নে। তোদের হাটে মুরগি তো বেশ সস্তা রে! আমাদের ওখানকার থেকে অর্ধেক দাম। কাটিয়ে কুটিয়েই নিয়ে এসেছি একেবারে।”

মুন্নি কোন প্রশ্ন করল না। শুধু পুঁটলিটা হাতে নিয়ে কেমন যেন শিউরে উঠল একবার। বললাম, “কী হল রে? মাংস রাঁধতে হবে বলে মন খারাপ? কথা দিয়েছিস কিন্তু। মনে আছে তো, অতিথ নারায়ণ!” চুপ করে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল মুন্নি। তারপর দ্বিতীয় কোনও শব্দ উচ্চারণ না করে মাংসের পুঁটলিটা হাতে নিয়ে ভেতরে চলে গেল।

সাহেব ঘুমিয়ে নিচ্ছিলেন একটু। ক্লান্ত ছিলেন। সারাটা দিন রাস্তায় কেটেছে। এ বয়সে এতটা ধকল শরীরে সয় না। রাত দশটা নাগাদ হরিদেও এসে ডাকল। খাবার জায়গা হয়েছে। জিগ্যেস করে জানলাম, রামপ্রতাপ তখনও ফেরেনি। মুন্নিকে নাকি হরিদেও একবার জিজ্ঞাসাও করেছিল। জবাব দেয়নি কোনও।

চারজনে মিলে খেতে বসলাম গিয়ে। ঘি মাখানো গরম চাপাটির গোছা একটা গামলায় সাজানো। পাশে, বিরাট একটা পেতলের ডেচকিতে ঘিয়ে সেদ্ধ করা, শুকনো লংকার গুঁড়ো ছড়ানো ময়ূরের মাংসের স্তূপ। সাহেব একটা বড় টুকরো তুলে নিয়ে কামড় বসালেন। আরামে চোখ বুজে এসেছে প্রায়। সুগণ সিং একরাশ মাংস তুলে নিয়েছে নিজের পাতে। আমার পাতেও একগাদা তুলে দিতে যাচ্ছিল। বারণ করেছি। মাংস আমি ভালোবাসি। কিন্তু ঐ দু-এক টুকরোর বেশি নয়।

সুগণ, হরিদেও আর সাহেব গল্প করতে করতে খাচ্ছিল। বাইরে তুমুল বৃষ্টি নেমেছে। সারাদিন ধরে জমে ওঠা মেঘ এইবারে তার সমস্ত সঞ্চয় ঢেলে দিচ্ছে এই গ্রামটার মাটিতে। আকাশচেরা লকলকে বিদ্যুতের আভায় মাঝেমাঝেই একটা নেশা ধরানো শব্দ তুলছিল। আমার খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল অনেকক্ষণ। খানিকক্ষণ এঁটো হাতে বসে থেকে উঠে পড়লাম। ওরা খেতে থাক। আমি বাইরে থেকে হাতটা ধুয়ে আসি।

ছাঁচতলার বৃষ্টির জলে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে ধুচ্ছি, তখন হঠাৎ কানে এল, জল, হাওয়ার শব্দের মধ্যে প্রায় মিশে থাকা আর একটা আওয়াজ… মুন্নির গলার শব্দ। বারান্দার খুঁটির হুক থেকে খুলে এনে হ্যারিকেনটা বাড়িয়ে ধরলাম বাইরের দিকে। নিচের উঠোনে, বৃষ্টির মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে চিৎকার করে কাঁদছিল মুন্নি। অন্ধকার আর বৃষ্টির শব্দের আড়ালটুকু সম্বল করে আছাড়ি পিছাড়ি করে কাঁদছিল মেয়েটা।

বাতিটা হাতে করে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে গেলাম। তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, “পাগলি, এমনভাবে কাঁদছিস কেন রে? কী হয়েছে, আমায় বল। রামপ্রতাপের সঙ্গে ঝগড়া করেছিস? সে কিছু বলেছে তোকে? নাকি রাগ করে বাড়ি ছেড়ে…”

আমার গলা পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল সে। ভয়ার্ত চোখে একঝলক আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, “মৎ মারো সাব… মৎ মারো মুঝে…” তারপর পাগলের মতো হাঁচড়পাঁচোড় করে উঠে গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। শব্দ পেয়ে বুঝলাম, ভেতর থেকে হুড়কো আটকে দিয়েছে। মাথার ব্যামো আছে নাকি মেয়েটার? আচরণটা একটু অদ্ভুত ঠেকল বটে, তবে দুদিনের অতিথি হয়ে এসে অন্যের পরিবারের ব্যাপারে বেশি কৌতূহল না দেখানোই উচিৎ মনে হল আমার। হাতটা ধুয়ে ঘরে ফিরে এলাম। সেখানে তখন জোরদার গল্প চলছে শিকারের। ময়ূরের মাংস খেয়ে সাহেব বেজায় খুশি। সুগণ সিংকে বেশ খাতির-টাতির করে কথা বলছে দেখা গেল।

পরদিন আমাদের ডেরা-ডাণ্ডা গোটানোর পালা। ভোর ভোর মালপত্র বেঁধে-ছেঁদে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবার কথা। সারাদিন মাঠে কাজ করে বিকেল বিকেল সদরের পথ ধরব এই ঠিক হয়েছিল। সকালে উঠে দেখি মুন্নিদের ঘরের দরজা তখনও বন্ধ। হরিদেও গিয়ে দুয়েকবার শেকল নেড়ে দেখল। কোনও সাড়াশব্দ নেই। একবার ভাবলাম, রামপ্রতাপের মা বুড়ির হাতে ভাড়ার টাকা কটা দিয়ে দায় চুকিয়ে বেরোই। কিন্তু সাহেব আপত্তি করলেন। হিসেবি মানুষ। বলেন, “নিরক্ষর অন্ধ বুড়ি। কী বুঝতে কী বুঝবে; পরে ওর ছেলে-বউ মিলে কমপ্লেন না করে দেয়, গবমেন্টের চাকুরে এসে থেকে খেয়ে পয়সা দেয়নি। এই দেহাতিদের বিশ্বাস নেই।”

হক কথা। অতএব ঠিক হল, মাঠের কাজেরই এক ফাঁকে দুপুরবেলা নাগাদ আমি গাড়ি নিয়ে এসে মুন্নি বা রামপ্রতাপ যেই বাড়ি থাক তার হাতে টাকা দিয়ে একটা রসিদে টিপছাপ দিইয়ে নিয়ে যাব। টি এ ক্লেইমের কাজে আসবে।

মাঠে কাজ ছিল অনেক। দু সপ্তাহের সমস্ত মাপজোকের হিসেবনিকেশ। কম নয়। দুপুরে বাড়ি আসা দূরস্থান, শ্বাস পর্যন্ত ফেলবার ফুরসত পাওয়া যায়নি। শেষমেশ বিকেল পড়ে আসতে সব যখন বাঁধাছাঁদা চলছে, তখন সাহেবকে বলে একবার চলে এলাম মুন্নিদের বাড়িতে। রামপ্রতাপ আর মুন্নিকে দেবার জন্য সামান্য কিছু উপহার কিনে রেখেছিলাম কদিন আগে হাট থেকে। হাড়ের চিরুনি একটা, একটা গন্ধ সাবান, কাঁচা চামড়ার জুতি একজোড়া। ভাড়ার টাকার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোও একেবারে দিয়ে যাওয়া যাবে।

বাড়িতে ঢুকলাম যখন এসে তখন আলো একেবারে কমে এসেছে। রামপ্রতাপের মা দাওয়ায় বসেছিল। চোখে একেবারেই দেখতে পায় না বুড়ি। আমার আওয়াজ পেয়ে জিগ্যেস করল, “কওন, রামু? কহাঁ গায়ব থে কাল শাম সে? বদমাশ লড়কা, যা কে দেখ তো জরা, তেরা মুন্নি কেয়া হাল বনাকে বৈঁঠি হৈ তেরে নিয়ে?”

একটা অজানা আশংকার হিমস্রোত বয়ে গেল আমার মেরুদণ্ড দিয়ে। মুন্নি কাল রাতে কাঁদছিল কেন অমন করে? কোথায় চলে গেছে রামপ্রতাপ? মুন্নিরই বা হঠাৎ করে কী এমন হল? দিব্যি সুস্থসবল মেয়েটা! কালকেই তো রান্নাবান্না করে খাওয়ালও আমাদের।

দাওয়ার ওপর উঠে নিঃশব্দে বুড়ির পাশ কাটিয়ে মুন্নির ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দরজাটা এখন আর ভেতর থেকে খিল দেওয়া নয়। কপাটদুটো ভেজানো রয়েছে শুধু। আস্তে আস্তে ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালাম। মেঝেতে একটা শিষ ওঠা হ্যারিকেন জ্বলছিল। চৌকির ওপর অজ্ঞানের মতো পড়ে ছিল মুন্নি। বিড়বিড় করে কী যেন বলছিল। এগিয়ে গিয়ে তার কপালে হাত ছোঁয়ালাম। হাতটায় ছ্যাঁকা লাগল যেন। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে মেয়েটার। আমার হাতের ঠান্ডা ছোঁয়া পেয়ে হঠাৎ লাল টকটকে চোখদুটো খুলে, বোধহীন দৃষ্টিতে ঘুরে তাকাল আমার দিকে। অস্ফুট স্বরে বলল, “রামপ্রতাপ? চলো জি, শাম হো রহা হৈ। জঙ্গল মে নহি যাওগে? আজ ম্যায় ভি নাচুঙ্গী তুমহারে সাথ। লেকিন তুম য্যায়সা খুবসুরত পুছ…” বলতে বলতে হঠাৎ চোখদুটো প্রাণপণে বুঁজে তীব্র গলায় চিৎকার করে উঠল মেয়েটা, “উড়ান ভরো রামপ্রতাপ… উওহ বন্দুক লে কে আ রহা হৈ… পেড় কে উপর চলো… জলদি… অওর উপর… ওহ মা… কিৎনা খুন! হায় রে মেরি রামপ্রতাপ!”

মূক হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম তার বিছানার পাশে। কী বলছে মেয়েটা? জ্বরতপ্ত মস্তিষ্ক নিয়ে কোন রহস্যের ইঙ্গিত দিতে চাইছে ও? ঠিক তখনই চোখ দুটো আবার খুলে গেল তার। আমার দিকে ফিরে একেবারেই স্বাভাবিক গলায় বলল, “অতিথি নারায়ণ, খানা তৈয়ার হৈ জি। ঘিউ ডালা, লাল মির্চি ছড়কায়া আচ্ছা সে। খাওগে নহি? আও না। কাম নিপটাকে মুঝে জানা ভি তো হৈ উনকে পাস। শাম যো হো রহা হৈ…”

কোনও মতে ডান হাতটা তুলে ধরে আমায় ডাকছিল সে। হ্যারিকেনের আলোয় দেখলাম, কলাগাছের মতো ফুলে উঠেছে তা। কনুইয়ের কাছ থেকে প্রায় কাঁধের কাছ অবধি লম্বালম্বি একটা ছুরির কোপের দাগ। তার ধারে ধারে শুকিয়ে ওঠা রক্তের ছোপের নিচে নিচে হালকা হালকা বেগনি রঙয়ের পচনের চিহ্ন। ভগবান দয়া করেছেন ওকে। ক্ষতটা বিষিয়ে উঠেছে। ভালোবাসার মানুষটিকে সদ্য হারিয়ে এই মুহূর্তে তার সবচেয়ে কামনার বস্তু যেটি, সেই মৃত্যু এগিয়ে আসছে দ্রুত… চোখদুটি আবার ধীরে ধীরে বুজে আসছিল তার। রোগের যন্ত্রণাকে অগ্রাহ্য করে ঠোঁটদুটিতে কী অমল হাসিটি ফুটেছে। তাদের স্বপ্নের অরণ্যে ময়ূর-ময়ূরী হয়ে তার দুজনে ঘুরে বেড়াবে এবার। আকাশে জমে উঠবে ইস্পাতনীল মেঘ… তার নিচে একটি নীলবর্ণ ময়ূরী, আর তাকে ঘিরে সুবিশাল মনোহর পেখমটি মেলে নেচে চলবে তার সঙ্গী। চিরদিন…


‘ফিরে পড়া গল্প’ বিভাগে প্রকাশিত গল্প সংকলন থেকে গল্প তুলে আনছি আমরা। সম্পাদকের পছন্দ অনুসারে সৃষ্টি-র এই সংখ্যায় রইল দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য-র ‘ঈশ্বরী’ গল্প সংকলন থেকে একটি গল্প। বইটি অনলাইন অর্ডার করা যাবে এখানে।

লেটারবক্স

দেবাশিস সেনগুপ্ত

দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল পৃথা। খয়েরি আঁচলটা দিয়ে ঘাম মুছছিল কপালের। স্টেশন থেকে প্রায় দশ মিনিটের হাঁটাপথ। আজ গুমোটটাও বড্ড বেশি। তা সেই আঁচল হাতে ধরা রইল। ভ্রূ কুঁচকে রইল কিছুক্ষণ। লেটারবক্সটা তেরছা হয়ে ঝুলছে পেন্ডুলামের মতো। গত শীতে বাড়ি রং করার সময় এটার উপরেও মেহগনি পোচ পড়েছিল। সদর দরজার রঙের সঙ্গে ম্যাচিং করে।
এখন আর লেটারবক্সের দরকার পড়ে না তেমন। কালেভদ্রে দু-চারটে কেজো অকেজো চিঠি আসে যদিও। পৃথা দেখেও দ্যাখে না। রোদ, জল, ধুলোময়লা খেয়ে মুড়মুড়ে হয়ে ওঠে। হঠাৎ কোনোদিন বাড়ি ঢোকার মুহূর্তে খেয়াল হলে বের করে চোখ বুলিয়ে আড়াআড়ি ছিঁড়ে রান্নাঘরের বিনে গুঁজে দেয়।
তবু লেটারবক্সটা আছে, সদর দরজার শো-পিস হয়েই আছে। বারদুয়েক সোজা করার চেষ্টা করেও লাভ হল না। ডানদিকের পেরেকটা খুলে পড়ে গেছে নিচে। আধোঅন্ধকারে এদিক-ওদিক খুঁজে নজরে এল না।

নেহাত কম বয়স হল না! সংক্রান্তির মেলা থেকে কিনে এনেছিল মা। পৃথা তখন ক্লাস ফাইভ বা সিক্স।

– কী মজা! আমাদের দরজায় লাগাবে এটা? পাল্লাটা বারবার খোলাবন্ধ করছিল সে।

– করিস না! কমজোরি কবজা, খুলে যাবে কিন্তু! ভাত মাখতে মাখতে চেঁচিয়ে উঠেছিল মা।
পৃথার বেশ একটা উত্তেজনা হচ্ছিল। পাড়ায় সবার বাড়ির দরজায় লেটারবক্স আছে। শুধু ওদেরটাই কেমন ন্যাড়া!
পরদিন মিহিরদা এসে লাগিয়ে দিয়ে গেছিল। ফ্যান, লাইট, ছাদের কাপড় টাঙানোর দড়ি, এককথায় যে-কোনো প্রয়োজনে মুশকিল আসান মিহিরদা। কাজ সেরে এককাপ চা খেয়ে দু-চারটে কথা বলেই বেরিয়ে যেত। দরজা বন্ধ করতে গিয়ে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকত মা। বেশ কিছুক্ষণ ধরে মায়ের গলায় অচেনা গুনগুন কানে আসত পৃথার। সাহস করে পায়ে পায়ে কাছে গিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়াত। হেসে মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিত মা তখন।

– আমার সোনা মা! বলেই জড়িয়ে ধরত পৃথা। বুকের ভেতর জমাট অভিমানগুলো গলে গলে পড়ত তখন। সে ছাড়া কেউ তার খবরও রাখত না।

এবার কি পিয়নকাকু আমাদের চিঠিগুলো এটাতে ফেলে দিয়েই চলে যাবে? কড়া নাড়বে না? ছোট্ট পৃথা খুশি হবে না দুঃখ পাবে ভেবে পাচ্ছিল না।

স্কুল থেকে ফিরে নিজের মনে খেলত পৃথা। মা ফিরত বিকেল পার করে। গারমেন্ট ফ্যাক্টরিতে ছুটি হত পাঁচটায়। বাড়ি ফিরে এলিয়ে পড়ত, মরা মানুষের মতো ঘুমোত। বইখাতাগুলো নিয়ে মায়ের গা ঘেঁষে বসত পৃথা। শরীরের সবটুকু ওম শুষে নিত ওই সময়টায়। সমস্ত ভয় আর মনকেমন পালিয়ে যেত তখন।
– কার চিঠি গো মা? বাবার? একদিন, শুধু একদিনই প্রশ্নটা করেছিল সে। ডিউটি থেকে ফিরে বিছানায় শুয়ে কারও একটা চিঠি পড়ছিল মা। উত্তর না পেয়ে সন্দেহটা দৃঢ় হয়েছিল আরও।

– আমার কথা কী লিখেছে মা? কবে আসবে গো আমাদের কাছে? ওমা! বলো না!
ঠাস করে একটা চড় আছড়ে পড়েছিল গালে। ঘটনার আকস্মিকতায় থমকে গেছিল পৃথা!

– লজ্জা করে না? ফেলে চলে গেছে তবু সারাক্ষণ বাবা বাবা করিস! মা কেউ নয় তোর? যা না! যা তোর বাপের কাছে! কেমন রাখে দেখব!
আর কখনও বাবার প্রসঙ্গ তোলেনি পৃথা। কোনোদিন ভুলেও জিজ্ঞেস করেনি— এত যত্ন করে সিঁদুর কেন পরো মা? কার জন্য?
বড় হতে হতে জেনেছে সবটুকু। একটা প্রশ্ন অবচেতন মনে পাক খেয়েছে কখনো-সখনো, নিজের মেয়েকে একবারও দেখতে ইচ্ছে করে না? একবারও মনে পড়ে না? একটা দু-লাইনের চিঠিও কি লেখা যায় না?

হেলে পড়া লেটারবক্সটার গায়ে অকারণেই হাত বোলায় পৃথা। পঁচিশ বছর বয়স হল প্রায়। আচ্ছা, একটা লেটারবক্সের আয়ু কতদিন? তার নিজেরও তো ছত্রিশ পেরোল। জোরে হাঁটলে হাঁফ ধরে আজকাল, কুলকুল করে ঘাম হয়। শিয়ালদা স্টেশনের বাইরে সেদিন আচমকা দেখা অনিন্দ্যর সঙ্গে।

– এরকম চেহারা হয়েছে কেন? চেকআপ করাও একবার!

– তোমারও তো ভুঁড়ি হয়েছে বেশ! ছেলের কোন ক্লাস হল যেন? ম্লান হেসে কথা ঘুরিয়েছিল পৃথা। অনিন্দ্য হাসেনি, সেই অদ্ভুত ভিতরছোঁয়া দৃষ্টিতে এঁফোড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছিল প্রায়।

– যেটা বললাম, শোনো। একটু তাকাও নিজের দিকে। স্কুল থেকে ছুটি নাও কদিন।
একরকম পালিয়েই এসেছিল পৃথা সামনে থেকে। বাড়ি ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়েই ছিল। চোখের নিচে কালি, মুখভর্তি অসংখ্য দাগ, সামনের কয়েকগাছি রুপোলি চুল সুযোগ পেয়ে প্রাইমারির বাচ্চাগুলোর মতো সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠেছিল— ভালো নেই! আমরা ভালো নেই কেউ!
আচ্ছা, অনিন্দ্য তো অপেক্ষা করতে চেয়েছিল সারাজীবন! আজ সে থাকলে কি আর-একটু ভালো থাকত পৃথা?

ছোটবেলার মতোই পাল্লাটা খোলাবন্ধ করছিল পৃথা। এখন ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ হয় একটা। হঠাৎ চোখে পড়ল, ভেতরে একটা পোস্টকার্ড, দু-ভাঁজ করা! কতদিন পর একটা পোস্টকার্ড দেখল সে! তার মানে চিঠি, কারও লেখা চিঠি! মুঠোর ভেতর নিয়ে বেল বাজাল দ্রুত। মিনুদি খুলল দরজা, রোজকার মতো। সাত বছর ধরে খুলছে। সেই যবে থেকে বিছানায় পড়ে গেল মা, বেঁকে গেল মুখ, বন্ধ হয়ে গেল কথা!
এবার এককাপ চা করে দিয়ে বেরিয়ে যাবে। দৌড়ে ঘরে গেল পৃথা। ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে দিয়ে একনিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল পোস্টকার্ডটা।
তারপর ধীর শান্ত পায়ে ঢুকল মায়ের ঘরে। চোখ বন্ধ, ঘুমোচ্ছে কি না বোঝার উপায় নেই। কপালে হাত রাখল মায়ের। সিঁথিতে সিঁদুর কেন দেয়, জানা হল না আর। কত কিছুই যে জানা হল না! মিনুদি চলে যাচ্ছে।

– আমি বেরোলাম। দরজাটা দিয়ে দিয়ো। আর হ্যাঁ, লেটারবক্সটা হেলে গেছে, দেখেছ?

– ওটার আর প্রয়োজন নেই। খুলে নিয়ো কাল। অস্ফুটে বলল পৃথা, আর-একজনের কান বাঁচিয়ে।


‘ফিরে পড়া গল্প’ বিভাগে প্রকাশিত গল্প সংকলন থেকে গল্প তুলে আনছি আমরা। সম্পাদকের পছন্দ অনুসারে সৃষ্টি-র এই সংখ্যায় রইল দেবাশিস সেনগুপ্ত-র ‘লেটারবক্স’ গল্প সংকলন থেকে একটি গল্প। বইটি অনলাইন অর্ডার করা যাবে এখানে।

ঠাউরুণ

কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়

আমাদের উত্তরদিকের প্রতিবেশী পাড়ার গুন্ডার নাম রেগুলারলি খবরের কাগজে বেরোত, দক্ষিণের পাড়ার তেইশ হাত জগদ্ধাত্রী মূর্তি দেখতে ট্রেনে চড়ে লোক আসত, পশ্চিমদিকের পাড়ার একটা ছেলে একবার মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করেছিল বলে কাগজে তার নাম বেরিয়েছিল। উত্তরের পাড়ার গুন্ডার খবরের পাশের খোপেই।

আমাদের গর্ব করার মতো একমাত্র ছিলেন ঠাউরুন। আমাদের পাড়ার, উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম, সব পাড়ার, গোটা মিউনিসিপ্যালিটির প্রাচীনতম বাসিন্দা। ঠাউরুনের বয়স কত কেউ জানত না। ঠাউরুনকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন, সেই যে বছর মারাত্মক বন্যা হয়েছিল, সে বছর তিনি জন্মেছিলেন। কবেকার বন্যা, কোথাকার বন্যা, এসব ঠাউরুন বলেননি কখনও। সবাই ইচ্ছেমতো ঠাউরুনের একটা বয়স ঠাউরে নিয়েছিল। যুক্তিবাদীরা বলত, কত আর হবে, মেরেকেটে আশি। রোম্যান্টিকেরা বলত, “আশি! হেসেখেলে নিরানব্বই।” আর খবরের কাগজে কিংবা টিভি রেডিওতে চিন বা জাপানের কোনও দীর্ঘজীবী মানুষের প্রাচীনত্ব নিয়ে হইচই হতে শুনলে দু-দলই বলত, “একশো দুই? ফুঃ। আমাদের পাড়ায় একজন আছেন, গত বছর একশ পাঁচ পার করেছেন।”

একটা বিষয়ে সবাই একমত ছিল, ঠাউরুনের আগে আমাদের পাড়াটা ছিল না। বাঁশবাগান ছিল। আর সূর্য ডুবলে শেয়ালের ডাক। তারপর এলেন ঠাউরুন, সঙ্গে একখানা পিঁড়ি আর একখানা কাস্তে। দু-হাত বাই দেড় হাত কাঁঠালকাঠের পিঁড়ি। আমরা যখন ঠাউরুনকে দেখেছি, তখন তাঁকে ভাঁজ করে ওই পিঁড়ির মধ্যে দিব্যি আঁটিয়ে দেওয়া যায়। এক কাঠের তৈরি পিঁড়ি, কোথাও কোনও জোড়াতাড়া নেই।

ঠাউরুনের পরে এসেছিল রিকশাস্ট্যান্ডের মোড়ের মাথার ঘোষেরা। তারা এসেছিল দলবল নিয়ে। কর্তা-গিন্নি, চার ছেলে, চারটে ছেলের বউ, পুজোপার্বণে তিন মেয়ে, মেয়ের জামাই আর আরও খানপাঁচেক কাচ্চাবাচ্চা।

যে সময়ের কথা, ততদিনে কর্তাগিন্নি মরে ভূত, সাত ভাইবোনের মধ্যে চারজন অকালপ্রয়াত, তাদের ঘরের তেরোজন নাতিনাতনি এদিক-সেদিক। অরিজিন্যাল ঘোষকর্তার সেজোছেলে সাতাত্তর ছুঁইছুঁই, বাড়িতে থাকলে বকে বকে সবার মাথা ধরিয়ে দেন আর দেখ না দেখ মিটসেফে রাখা মিষ্টি চুরি করে খান বলে বিকেলবেলা ঘুম থেকে ওঠামাত্র পায়ে মোজা, মাথায় মাংকিক্যাপ আর হাতে লাঠি ধরিয়ে বাড়ির লোক বুড়োকে রাস্তায় বার করে দিত। তরফদারের কাঠের গোলা ছিল মোড়ের মাথায়। গোলার বেঞ্চিতে বসে সেজো ঘোষ লোক ডেকে ডেকে গল্প করতেন। তাঁর কাছেই সবাই শুনেছিল, তিনি নাকি জন্মে ঠাউরুনের বর-টর ছেলেপুলে দেখেননি। এসে থেকে ওই থান শাড়ি, আর হাতের কাস্তে নিয়ে “মাগি বাঁশ কাটছে।”

রোদে-পাতা পিঁড়ির ওপর হাঁটু মুড়ে, হাঁটুর ওপর শিরাসর্বস্ব দুই হাতের পাতা রেখে বসে থাকতেন ঠাউরুন। পিঁড়ির পাশে ঠাউরুনের কাস্তে শুয়ে থাকত। বাঁশঝাড় কেটে আমাদের পাড়ার জন্ম দেওয়া সেই ঐতিহাসিক কাস্তে। এইরকম ঐতিহাসিক কাস্তের বিনয় দেখে আমরা মুগ্ধ হতাম, একেবারেই সাধারণ দেখতে। তবে ভারী কাস্তেটা ঠাউরুন অবলীলায় তুলতে পারতেন। মাঝে মাঝে কাস্তেখানা তুলে পিঠ চুলকোতেন। প্রথম প্রথম সবাই শিউরে উঠত, তারপর বোঝা গেল কাস্তের ধার-টার বিশেষ বাকি নেই। “এত ভারী তোলো কী করে ঠাউরুন?” জানতে চাইলে ঠাউরুন হাসতেন। চোখ দুটো সুতোর মতো সরু হয়ে যেত, ঠোঁটজোড়া চাঁদের মতো বেঁকে যেত আর ভেতরের গোলাপি মাড়ির ভেতর খয়েররঙা জিভ নড়ে নড়ে হাসত। “তোদের ভারী লাগে, আমার লাগে না, কাস্তে আমার হাতে পোষ মেনে গেছে।”

দরমার বাড়িতে ঠাউরুন একাই থাকতেন। কিন্তু শীতের দুপুরে আর হেমন্তের সন্ধেয়, বর্ষার বিকেলে আর গরমের রাতে ঠাউরুনের তকতকে উঠোনে মাদুর পেতে আড্ডা বসত। মূলত মহিলাদের, কিন্তু ঠাউরুন প্রগতিশীল ছিলেন, পুরুষেরা আড্ডায় যোগ দিতে এলে ফেরাতেন না। একটাই রুগ্ন চেয়ার ছিল, সে চেয়ারে কোনও মেয়ে বসে থাকলে তাকে নামিয়ে আগত পুরুষটিকে বসতে দিতেন।

জটলার মাঝখানে পিঁড়িতে স্থির হয়ে বসে থাকতেন ঠাউরুন, পাতলা সাদা চুলের ফাঁক দিয়ে দুপুরবিকেলের সূর্যের আলো মাথার ফর্সা চামড়ায় চিকচিক করত। পাখির মতো দেহটাকে জড়িয়ে থাকত সাদা থান। শীতের ক-মাস তার ওপর একটা ভুষি রঙের চাদর।
ঠাউরুন উবু হয়ে বসে থাকতেন, তাঁর চারপাশ দিয়ে গল্পেরা বইত। কখনও সোজা পথে, কখনও ঘুরে, এর-ওর শোবার ঘর রান্নাঘর পেরিয়ে, হাঁড়ির ঢাকনা তুলে, উঁকিঝুঁকি দিতে দিতে। ঠাউরুন শুনছেন কি না বোঝা যেত না। হাঁটু প্রায় ছুঁয়ে ফেলা চিবুক দেখে মাঝে মাঝে সন্দেহ হত হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু সন্দেহ ভুল প্রমাণ হত যখনই গল্পে ভাটা পড়ত। গল্পে যোগ দেয় বলেই তো গল্প করার ক্ষমতা সবার সমান থাকে না, কেউ কেউ গল্প প্যাঁচে ফেলে দিয়ে আর বার করতে পারত না, তখন ঠাউরুন মাথা অল্প তুলে ছোট্ট একটুখানি ফোড়ন কাটতেন কিংবা সামান্য একটু পাদপূরণ করতেন, অমনি গল্প আবার গড়গড়িয়ে চলতে শুরু করত।

ঠাউরুন নিজেও মাঝে মাঝে গল্পের সুতো হাতে নিতেন, তবে তা সকলের সামনে, সবসময় নয়। বিকেল ফুরোলে ঠাউরুনের চাতাল ফাঁকা হয়ে যেত। উলের বলে কাঁটা গুঁজে, “চলি গো ঠাউরুন, কাল আসব” বলে আড্ডা যে যার বাড়ি ফিরে যেত, তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বেলে শাঁখ বাজিয়ে ছিটকিনি খুলে রান্নাঘরে ঢুকত। পাড়ার ভালো ছেলেরা ততক্ষণে হাত-পা ধুয়ে মায়ের আঁচলের তলায় বসে দুধমুড়ি খেয়ে পড়া শুরু করেছে। বখাটেরা তখনও কাদামাখা বল বগলে বাড়ি ফিরছে হেলেদুলে। ঠাউরুনের জমির কিনারায় আশশ্যাওড়ার ছায়ায় দাঁড়িয়ে চুপিচুপি বিড়ি টানার সময় কোনও কোনও দিন তারা গুনগুন শুনতে পেত। বিড়ির আলো পায়ে পিষে শ্যাওড়ার ছায়া থেকে উঁকি মেরে দেখত বারান্দায় পিঁড়ি পেতে বসে শাড়ির আঁচল নয়তো ভুষি চাদর নেড়ে মশা তাড়াচ্ছেন আর গান গাইছেন ঠাউরুন। পাশে নিচু সলতের হলুদ লন্ঠন।

বখাটেদের বাড়ি যাওয়ার তাড়া নেই, তারা মাঝে মাঝে ঠাউরুনের পাশে গিয়ে বসত। কোনও কোনও দিন, ইচ্ছে হলে, ঠাউরুন নিজের ছোটবেলার কথা বলতেন। বাড়ির পাশে পুকুরের কথা, পুকুরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়া তালগাছ, যেটা ধরে হেঁটে যাওয়া যায় পুকুরের প্রায় মাঝখান পর্যন্ত, তারপর গাছ আঁকড়ে শুয়ে থাকা যায় জলের দিকে চেয়ে।

গল্পের মাঝখানে কবে, কোথায়, প্রশ্ন করলে ঠাউরুন উত্তর দিতেন না। ক্বচিৎ কদাচিৎ হয়তো বললেন, “সে অনেক দূর।” বা “বন্যার তিন বছর আগে” নয়তো “পাঁচ বছর পর।” রাত ঘন হত, লন্ঠনের চিমনির মুখে কালি জমত, বখাটেরা প্যান্টের ধুলো ঝেড়ে, “আসি ঠাউরুন” বলে উঠে পড়ত। ঠাউরুন “যা” বা “আবার আসিস” কিছুই বলতেন না। গুনগুন করে আবার গান শুরু করতেন, নয়তো আঁচল নাড়াতে নাড়াতে উলটোদিকের বাড়ির ছাদের মাথায় চাঁদের দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকতেন। কী ভাবতেন কে জানে। হয়তো সেই বন্যার কথা।

মোট কথা, এ পাড়ার সবার নাড়িনক্ষত্র ঠাউরুনের কণ্ঠস্থ থাকলেও ঠাউরুন সম্পর্কে পাড়ার লোকে জানত খালি পিঁড়ি, কাস্তে আর বন্যা।

যতদিন না সেজো ঘোষের নাতি বুবকা বিলেত থেকে ডিগ্রি নিয়ে ফিরল।

* * *

বিলেত গেছিল যখন লিকপিকে রোগা, সাত চড়ে রা কাড়ে না। সারাদিন বন্ধ ঘরে বই মুখে করে বসে থেকে থেকে গায়ের রং ফ্যাটফেটে ফ্যাকাশে। স্পোর্টসের মাঠে, ডিফেন্স পার্টির টহলে, পুজোর চাঁদা তোলায় ও ছেলের কোনোদিনও টিকি দেখা যায়নি। বুবকার মা-জেঠিরা বলতেন, “আহা, ছেলের স্বাস্থ্য খারাপ।” পুরোটাই অজুহাত নাও হতে পারে। কারণ কাজের জায়গায় বুবকাকে দেখা না গেলেও সপ্তাহের এ মাথায় ও মাথায় বাপিদের বাড়ির লাগোয়া চিলতে ডিসপেনসারিতে মাথায় মাফলার জড়িয়ে বাড়ির কারও সঙ্গে বসে থাকতে দেখা যেত। সবাই ‘আহা উহু’ করত। বংশের একমাত্র ছেলে, সেও রোগাভোগা হল।

বিলেত থেকে ফেরার পর সেই বুবকাকে কেউ চিনতেই পারল না। একখানা লাল রঙের গাড়ি চলতে চলতে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল কাঠগোলার সামনে। গাড়ি তখন আমাদের ওদিকে আর অত দুর্লভ নয়, মাঝে মাঝে হুসহাস করে যায়, কিন্তু সেসব গাড়ি থেকে কেউ নেমে গোলার সরু বেঞ্চিতে বসে থাকা জনতার দিকে হাসিমুখে হাত নাড়েনি কখনও।

কাঠগোলার লোকজন হাঁ করে চোখে সানগ্লাস, মাথায় শার্লক টুপি, হাত নাড়া চেহারাটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সে লোকটা এগিয়ে এসে কালো চশমা খুলে বেঞ্চিতে বসে থাকা একজন বয়স্ক লোককে অতিকষ্টে ঝুঁকে প্রণামের ভঙ্গি করে জিজ্ঞাসা করল, “চিনতে পারছ না? আমি বুবকা।”

নাম শুনে যদি বা কিছু সন্দেহ বাকি ছিল, গলা শুনে মিটে গেল। চোদ্দো বছর বয়সে সেই যে বুবকার গলা ভেঙেছিল, আর জোড়া লাগেনি। তার আগে বুবকা ইন্দ্রাণীদির বাবার কাছে গান শিখতে যেত। ইন্দ্রাণীদির বাবা বলেছিলেন, “এখন ক-দিন থাক, জোড়া লাগলে আবার শুরু করা যাবেখন।” এই বলে ইমন না ভৈরব কী একটা রাগ অর্ধেক শিখিয়ে শেখানো বন্ধ করেছিলেন। তারপর বোঝা গেল, বুবকার গলা ভাঙাটা পার্মানেন্ট, ইমন না ভৈরব হাফ শেখা হয়েই রইল।

বাড়ি ফেরার তৃতীয় দিন সকালেবেলা রুটি খেতে খেতে মিহি গলায় বুবকা বলল, “বাই দ্য ওয়ে বাবা, থিংকিং অফ আস্কিং ইউ ওয়ান থিং বাট ফরগেটিং, আমাদের পাড়ায় মনোমোহিনী দেবী বলে কেউ আছে?”

“মনোমোহিনী দেবী?”
বুবকার বাবা, সেজো ঘোষের ছেলে মুখের ওপর থেকে খবরের কাগজ সরিয়ে ভুরু কুঁচকোলেন।
“আমাদের ফ্যামিলিতে তো…”
“না না ফ্যামিলিতে না। পাড়ায়। আশেপাশের পাড়াতেও হতে পারে।”

সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ ভাবলেন বুবকার বাবা। ততক্ষণে বুবকার মা স্বামীর জলখাবার নিয়ে ঘরে ঢুকেছেন। তিনিও বলতে পারলেন না।

“কুণ্ডুদের মায়ের নাম কী যেন একটা ম দিয়ে ছিল না? শ্রাদ্ধের কার্ডে লেখা ছিল?”

বুবকা আর্তনাদ করে উঠল, “ডেড?”

বুবকার মা কুণ্ডুবাড়িতে জিজ্ঞাসা করে জানলেন, ওঁদের মায়ের নাম ম দিয়েই ছিল বটে কিন্তু মনোমোহিনী নয়, মনোহরা। কুণ্ডুবাড়ির লোক দাশগুপ্তদের জিজ্ঞাসা করল, দাশগুপ্তরা মাইতিদের, মাইতিদের নাতি মহা পাকা, বারান্দার রেলিং ধরে ঝুলতে ঝুলতে পুকুরঘাটে স্নানরত লোকদের উদ্দেশে চেঁচাল, “তোমাদের বাড়িতে মনোমোহিনী দেবী বলে কেউ থাকে গো?” ঘাট থেকে খবর গেল শর্মার কাঠের গোলায়। গোলায় বসেছিলেন সেজো ঘোষ স্বয়ং। বিলেতফেরত নাতিকে একটা উচ্চারণের অযোগ্য গালি দিয়ে বুড়ো বললেন, “ছ্যামড়ার বুদ্ধিও যেমন, জানতে গেছে ওই ঢ্যামনাটার কাছে।” বলে নিজের ছেলের ঢ্যামনাত্ব নিয়ে হোহো করে হাসলেন, তারপর গলায় উঠে আসা শ্লেষ্মা থু থু করে ফেলে পাঞ্জাবির হাতায় ঠোঁট মুছে বললেন, “এত হল্লাহাটির কী আছে, মাগিকে জিজ্ঞাসা করলেই হয়। এ পাড়ার গোড়া থেকে যত লোকের যত হাঁড়ির খবর মাগির কাছে আছে।” বলে হাতের ছড়ি তুলে ঠাউরুনের বাড়ির দিকে নির্দেশ করলেন।

মাঘের রোদের আঁচে তখন পরচর্চা জমে উঠেছে। একটু আগে খাওয়া কমলালেবুর গন্ধ হাওয়ায়। এমন সময় লম্বা ছায়া পড়ল মাদুরের ওপর। কাঁপা কাঁপা হাতে চোখ আড়াল করে ঠাউরুন মুখ তুললেন। মিহি গলা বলে উঠল, “কী ঠাউরুন, কেমন আছ?”

“কে? ঘোষেদের নাতি নাকি? কবে এলি?”

বিলিতি জুতোয় ভাঁজ ফেলে দু-পায়ের দশ আঙুলের ওপর ভর দিয়ে বসল বুবকা। দুই হাত আড়াআড়ি রাখল হাঁটুর ওপর।

“ঠাউরুন, মনোমোহিনী দেবী বলে এ তল্লাটে কখনও কেউ ছিল নাকি গো? জানো?”

এরপর এক-একজন এক-একরকম বলে। মিত্রপিসিমা, যিনি নিজের পায়ের কড়াকে ক্যান্সার বলে চালিয়েছিলেন তিনি বলেন, বুবকার কথা শুনে ঠাউরুনের শ্বাস উঠল, বুক চেপে ধরে তিনি গোঁ গোঁ করলেন। ঘোষদের ছাগল ফলন্ত কলাগাছ মুড়িয়ে খেয়ে গেছে বলে ঘোষেদের প্রতি যাদের জাতক্রোধ, সেই মজুমদারদের পুত্রবধূর মতে, ঠাউরুন মুখঝামটা দিয়ে বলেছিলেন, “তাতে তোর কী ডেঁপো ছেলে?” কিন্তু ঠাউরুনকে যারা চিনত, তারা জানত এগুলোর কোনোটাই সত্যি নয়। তারা জানত বুবকার প্রশ্ন শুনে ঠাউরুনের কী প্রতিক্রিয়া হওয়া সম্ভব।

ঠাউরুন দু-এক মুহূর্ত চুপ করে থেকেছিলেন। তারপর হেসেছিলেন। যে হাসি আনন্দেরও হতে পারে, দুঃখেরও।

* * *

পিঁড়ি আর কাস্তে ছাড়া ঠাউরুনের যে একটা নামও আছে, এ খবরটা হজম করতেই লোকের সব বিস্ময় খরচ হয়ে গেল। তাই বুবকা যখন মনোমোহিনী দেবী ওরফে ঠাউরুনের ইতিহাস সাতকাহন করে বলল অত ধাক্কা লাগল না।
ক্লাবঘরে জটলা বসল সেদিন রাতেই। সিলিং থেকে ঝোলানো টিনের ঢাকনা দেওয়া বাল্বের হলুদ আলো-পড়া ক্যারামবোর্ডের চারপাশের আবছায়ায় চাদরমুড়ি দেওয়া ছায়া ছায়া শরীর। পুকুরের ঠান্ডা হাওয়া থেকে বাঁচার জন্য ক্লাবঘরের দরজায় ছিটকিনি তুলে দেওয়া হল, হাওয়ার ধাক্কায় সে দরজা মাঝে মাঝেই খটখট করে উঠতে লাগল।

বুবকা বলে চলল। গবেষণার কাজে বাংলাদেশের পুরোনো মামলা মোকদ্দমার নথিপত্র ঘাঁটতে গিয়ে প্রথম মনোমোহিনী দেবীর খোঁজ পেয়েছে বুবকা। অধুনা বরিশালের কলসকাঠি গ্রামে নিশিকমল ভট্টাচার্য নামে পূজারী ব্রাহ্মণের মা-মরা মেয়ে ছিল মনোমোহিনী। সে আমলের নিয়ম মেনে রেখে তার আরও কয়েক গণ্ডা ভাইবোন ছিল, কিন্তু মনোমোহিনীর গল্পের জন্য তারা জরুরি নয়। জরুরি হল মনোমোহিনীর ছোট বোন সৌদামিনী। দু-বোনের বয়সের তফাত ছিল প্রায় চোদ্দো বছর। কলকাতা শহরের সফল এবং ব্যস্ত উকিল শ্রী তারকনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয়ে মনোমোহিনী যখন গ্রাম ছেড়ে কলকাতা চলে এল, তখন সৌদামিনী টলমলিয়ে হাঁটে, আধো আধো কথা কয়। বাপের বাড়িতে থাকতে মনোমোহিনীর ইশকুলে-টিশকুলে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনি, দাদাদের পাশে বসে অক্ষরপরিচয় হয়েছিল কোনোমতে। তারকনাথ প্রচুর বই পড়তেন, স্ত্রীকে পড়তে উৎসাহ দিতেন, অ্যাংলো মেম রেখে দিলেন ইংরিজি শেখানোর জন্য। মনোমোহিনীর গেঁয়ো লজ্জা ভাঙিয়ে জুড়িগাড়িতে তাঁকে পাশে বসিয়ে গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে বেরোতেন। এমন সময় খবর এল কলসকাঠিতে নিশিকমল দেহরক্ষা করেছেন। বাবার কাজে গ্রামে ফিরে গিয়ে মনোমোহিনী দেখল সৌদামিনী, সেই ছোট্ট সদুকে। সে তখন আর ছোট নেই, হাতেপায়ে চাউনিতে যৌবন মুচকি হাসছে। পিতৃমাতৃহীন বোনটির প্রতি গ্রামের মোড়ল-মোড়লীদের দৃষ্টি মনোমোহিনীর ভালো লাগল না। তার নিজের ছেলেমেয়ে নেই, হওয়ার আশাও নেই, “চল আমার সঙ্গে,” বলে সদুকে নিয়ে মনোমোহিনী চলে এল কলকাতা।

তারকনাথ মনোমোহিনীর সংসারে নতুন হাওয়া বইল। দুজনের মধ্যে ভাব কম ছিল না, কিন্তু অভ্যেসের শ্যাওলা তো পড়েই। সদু এসে সেসব ভাসিয়ে দিল। তারকনাথ তাকে কলেজে ভরতি করে দিলেন। স্বামী বোন সকালে খেয়েদেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর মনোমোহিনী সারাদিন টুকটাক ঘরের কাজ করত, না করলেও কিছু আসত যেত না, দাসদাসী ছিল। দুপুরে খেয়ে উঠে খাটের ওপর উবু হয়ে শুয়ে শুয়ে নাটক-নভেল পড়ত। বিকেলে মেমসাহেব আসতেন। মনোমোহিনীকে তিনি ভালোবাসতেন, প্রতিদিনই হাতে বানানো কেক, বিলিতি পিঠে নিয়ে আসতেন। কখনও কখনও পড়া চলাকালীন সৌদামিনী ফিরে আসত, তখন দুই বোনে মেমসাহেবের গলা জড়িয়ে ধরে বিলেতের মেমের ছোটবেলার গল্প শুনতে শুনতে কেক খেত। সৌদামিনী কলেজের বন্ধুদের কাছ থেকে নিত্যনতুন খোঁপার কায়দা শিখে আসত, দিদির চুল বেঁধে নিজের চুল বাঁধত। সৌদামিনী বোনকে বাহারি কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরিয়ে দিত, তারপর দুই বোনে তারকনাথের অপেক্ষা করত। তারকনাথ ফিরলে তিনজন গাড়ি চেপে বেড়াতে বেরোত। তিনজনের সংসারে সুখ অঢেল ছিল, দুই বোনে সদ্ভাব ছিল, তারকনাথের চরিত্রদোষ ছিল না। অন্তত পাড়াপড়শির জবানবন্দিতে তেমন কিছু জানা যায়নি।

গোলযোগের প্রথম আঁচ পাওয়া গেল যে দিন সকালে প্রতিবেশীর হাফপ্যান্ট পরা ছেলে দৌড়তে দৌড়তে থানায় এসে খবর দিল, তারকনাথ উকিলের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। পুলিশ গিয়ে দেখল বাড়ি বিধ্বস্ত, ঘরের ভেতর রক্তের সমুদ্রে ভাসন্ত তিনটি দেহ, পুরুষটির বুকে ধারালো অস্ত্রের অগুনতি কোপ, একটি নারীর মুণ্ড ধড় থেকে প্রায় আলাদা, অন্য নারীটির মাথা ফাটা, কানের লতি ছিঁড়ে গয়না নিয়ে গেছে ডাকাতে। প্রথম দর্শনে তিনটিকেই মৃতদেহ মনে হয়েছিল, নাড়াচাড়া করতে গিয়ে একটি দেহ কঁকিয়ে উঠল।

আছে আছে, প্রাণ আছে!

মৃতদেহ দুটো ডোমের কাঁধের লাঠি থেকে বস্তার দোলনায় দুলতে দুলতে মর্গে গেল, প্রাণওয়ালা দেহটা পুলিশের অ্যাম্বুলেন্সে চেপে হাসপাতালে। সেখানে বিলেতফেরত ডাক্তার মনোমোহিনীর ছেঁড়া লতি, ফাটা মাথা সেলাই করে দিলেন। কড়া ঘুমের ওষুধের ডোজ দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখলেন। পুলিশকে বললেন, এখন অপেক্ষা করতে হবে, তোমাদের তদন্তের জন্য আমি আমার পেশেন্টের প্রাণসংশয় হতে দিতে পারি না। প্রায় বারো-চোদ্দো ঘণ্টা পর গাঢ় ঘুম থেকে জেগে, শ্রীমতী মনোমোহিনী দেবী, হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে প্রায় অশ্রুত কিন্তু স্পষ্ট জবানিতে গত রাতের ঘটনাক্রমের বর্ণনা দিলেন।

* * *

আত্মীয়ের বাড়িতে পুজোয় গিয়েছিলেন মনোমোহিনী। রাত হলে আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে যাওয়ার কথা ছিল, রাত হয়েওছিল, কিন্তু মনোমোহিনীর অচেনা বিছানায় ঘুম হয় না। বাড়ির সামনে তাঁকে নামিয়ে দিয়ে আত্মীয়ের গাড়ি চলে গেল। ল্যাম্পপোস্টের ধোঁয়া ধোঁয়া আলোয় বাগান পেরিয়ে দরজার সামনে পৌঁছলেন মনোমোহিনী। চাবি বার করার আগেই সন্দেহ হয়েছিল। দরজা খোলা, চিলতে ফাঁক দিয়ে বাড়ির ভেতর প্রাণের সাড়া স্পষ্ট পাওয়া যাচ্ছে। কে জেগে এত রাতে? সদু রাত ন-টা বাজতে না বাজতে ঢুলতে থাকে, তারকনাথ আর্লি টু বেড আর্লি টু রাইজ। কোনও আচম্বিত অতিথি?

হাসপাতালের বেডে শোয়া মনোমোহিনী চোখ বুজলেন। কপালের শিরা দপদপ করছে। মনোমোহিনী দাঁড়িয়ে আছেন দরজার সামনে, মকরমুখো বালা ছুঁয়ে আছে পালিশ-করা সেগুনকাঠের পোক্ত পাল্লা। অল্প ঠেলতে পাল্লা ফাঁক হল। এক পা সদর দরজার চৌকাঠে রেখে কয়েক মুহূর্ত থমকালেন মনোমোহিনী। এ অন্ধকারটা যেন কেমন, অন্যদিনের মতো নয়। এ যেন কিছু একটা লুকোতে চাইছে, কী যেন একটা চাপা দিয়ে রাখতে চেয়েও পারছে না। মনোমোহিনীকে বলছে, পালাও পালাও, আর এক পা-ও বাড়িয়ো না।

সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করে পা বাড়ালেন মনোমোহিনী। আর দরজার আড়াল থেকে একটা হাত বেরিয়ে এসে তাঁর মুখ চেপে ধরল। শরীরের পেছনে সেঁটে গেল একটা পুরুষের শরীর, তারকনাথ নয়, এর সারা শরীরে ঘাম আর দিশি মদের গন্ধ। মরা গাছের ছালের মতো রুক্ষ, ফাটা চামড়া চেপে বসল মনোমোহিনীর নাকমুখের ওপর, তীক্ষ্ণ নখ গালের চামড়ায় বিঁধে গেল, পাঁজরের খাঁচা থেকে হুহু করে বাতাস বেরিয়ে যেতে লাগল। মনোমোহিনী হাতটা সরানোর চেষ্টা করলেন, লোকটা মনোমোহিনীর হাত মুচড়ে নিয়ে গেল শরীরের পেছন দিকে, মনোমোহিনীর গোঙানি থাবার আড়ালে চাপা পড়ে রইল।

ফুসফুস যখন পাঁজর ফাটিয়ে বেরিয়ে পড়ার উপক্রম, মুখের ওপর থেকে হাতটা সরে গেল। ঝড়ের মতো অনেকটা হাওয়া একধাক্কায় ঢুকে পড়ে জ্বালিয়ে দিল বুক। কাশিতে ভেঙে যেতে যেতে মনোমোহিনী চিনতে পারলেন, তাঁর শোবার ঘর। বিছানা উলটোনো, স্বামীর পড়ার টেবিলের লন্ঠনের কাচ চূর্ণবিচূর্ণ, আলমারির দরজা হাট করে খোলা। ওই আলমারির ভেতর তাঁর বাপের বাড়ি থেকে আনা যৎসামান্য আর স্বামীর দেওয়া প্রচুর গয়না। সব মিলিয়ে চল্লিশ ভরি।

চুলের গোছায় হ্যাঁচকা টানে গয়না থেকে মন উঠে এল মনোমোহিনীর। টানের চোটে টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে উলটে পড়লেন আর সেই অবস্থাতেই মেঝের ওপর দিয়ে ঘষটাতে ঘষটাতে কেউ টানতে টানতে নিয়ে চলল ঘরের কোণে। জলের ওপার থেকে ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখলেন আরও একজোড়া লোমশ পা ঘরের অন্য কোণে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের সরে যাওয়া আঁচলের প্রতি সচেতন হলেন মনোমোহিনী। মাথা থেকে সরে হাত নেমে এল বুকের ওপর। হা হা করে হাসল কেউ।

ঘরের কোণে ছেঁড়া পুতুলের মতো মনোমোহিনী আছড়ে পড়লেন, কিন্তু শক্ত মেঝেতে নয়, মনোমোহিনীর শরীরের নিচে আরও একটা শরীর। তখনও উষ্ণ। থাবা টান মেরে খুলে নিল সাতলহরী হার, কানের লতি ছিঁড়ে নিল কানপাশা। ব্যথায় চিৎকার করে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অশ্রাব্য গালির সঙ্গে প্রচণ্ড আঘাত নেমে এল কপালের বাঁদিকে।

আলো নিভে গেল।

* * *

এতক্ষণ ধরে গল্প বলে বুবকার গলা শুকনো, শ্রোতাদেরও গলা খটখটে। ক্লাবের কোণে স্টিলের গ্লাস চাপা দেওয়া কুঁজো রাখা ছিল, কেউ কেউ উঠে গিয়ে জল খেল।

তারপর?

বুবকা বলল, “তারপর আবার কী। পরদিন সকালে প্রতিবেশীদের কেউ একটা গোটা ঘটনাটা আবিষ্কার করে পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ এসে দেখে সারা ঘরের মেঝেতে, দেওয়ালে রক্ত শুকিয়ে বাদামি, তিনটে বডির দুটো অলরেডি শক্ত কাঠ, একটা মিরাকুলাসলি তখনও অ্যালাইভ।”

তারপর?

তারপর হাসপাতাল, মর্গ, থানাপুলিশ। মনোমোহিনী দেবীর জবানি অনুসারে প্রায় চল্লিশ ভরি গয়না লুঠ হয়েছিল সে রাতে। সেসব আর পাওয়া যায়নি। আলমারিতে শুধু রাখা ছিল একটা দলিল, রিটায়ার করে শহরে থাকবেন না বলে ধ্যাদ্ধেড়ে বাঁশবনের মধ্যে একফালি জমি কিনে রেখেছিলেন তারকনাথ। পুলিশের হাঙ্গামা শেষ হলে সেই দলিলখানা নিয়ে শহর ছাড়লেন মনোমোহিনী দেবী।

দলিলে পাড়ার নাম লেখা ছিল না, খালি একটা জেনারেল লোকেশন, গঙ্গার পশ্চিম পার, বাঁশবন আর পানের বরজের কথা লেখা ছিল। “অ্যান্ড আই রিমেম্বারড দাদু টেলিং মি আমাদের প্লটটা ওয়ান্স আপঅন আ টাইম পানের বরজ ছিল, সো…” গাট ফিলিং-এর ওপর ভরসা করে বুবকা খোঁজ শুরু করল। আর পৌঁছল এসে ঠাউরুনে।

* * *

বুবকার গল্প শোনার পর থেকে সবাই ঠাউরুনকে অন্য দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করল। রোজকার গল্পের আসর আগের মতোই বসল, কিন্তু কার বর বাইরে সংসার করে, কে শাশুড়িকে দু-চক্ষে দেখতে পারে না, ডাকাতের হাতে মাথা ফাটানো আর স্বামীবোনকে হারানোর পাশে মারাত্মক জোলো ঠেকতে লাগল।

লোকের একটু অভিমানও হল। আমরা কি তোমার পর, ঠাউরুন? এতবড় একটা ট্র্যাজেডির হিরোইন যে তুমি নিজে, সেটা তুমি আমাদের কাছে লুকিয়ে রেখেছ? যারা সদ্য সাইকোলজি পড়েছিল তারা বলল, আহা, ঠাউরুনকে দোষ দিয়ো না। হয়তো উনি নিজেই ভুলে গিয়েছিলেন। মানবমনের জটিলতার তল তো জানো না, ‘কোপিং মেকানিজম’ হিসেবে গোটা পর্বটার ওপর ঠাউরুনের মন হয়তো পর্দা টেনে দিয়েছিল।

এই যুক্তিটার মধ্যে খানিকটা সত্যতা থাকলেও থাকতে পারে। সত্যিই ঠাউরুন তাঁর জীবনের ওই পর্বটার কথা মনে করেননি বহুদিন। আজকাল কত কিছু মনে থাকে না। ঘোষেদের নাতিকেও তো তিনি চিনতে পারেননি। তার ওপর রোদ এসে চোখে পড়েছিল। ঠাউরুন? ঠাউরুন? ফালি বাঁশের মতো চেরা গলা শুনেও বুঝতে পারেননি, হাতের পাতা দিয়ে চোখের ওপর ছায়া তৈরি করে চোখ সরু করতে প্রথমেই নজরে পড়ল নাকখানা। সরু হয়ে শুরু হয়ে মাঝখানটা ফুলে উঠে আবার শেষে সরু হয়ে গেছে। ঘোষেদের গোটা বংশের নাক ওরকম। তারপর চেরা গলা আর ফোলা নাক, দুই আর দুইয়ে যোগ করে চার হল। কতদিন দেখেননি ছেলেটাকে, কোথায় গেছিলা, কোথায় গেছিলা বারবার জিজ্ঞাসা করছিলেন, ছেলেটাও কী যেন জিজ্ঞাসা করছিল, দুদিকের প্রশ্ন ধাক্কা খেয়ে কারোরই আর উত্তর দেওয়া হচ্ছিল না। অবশেষে ঠাউরুন ক্ষান্ত দিলেন আর ছেলেটার প্রশ্নটা তাঁর কানে ঢুকল।

মনোমোহিনী দেবী কে?
একমুহূর্তের জন্য ঠাউরুনও ভেবেছিলেন, মনোমোহিনী দেবী কে? নামটা শোনা শোনা লাগে যেন?

তারপরই সব ফিরে এল। যুগযুগান্ত পার করে ঠাউরুন নিজেকে আবার আবিষ্কার করলেন বন্ধ দরজার সামনে, মকরমুখো বালা ছুঁয়ে আছে চকচকে কালো পালিশের সেগুনকাঠের পোক্ত পাল্লা। রাস্তায় গাড়ির চাকার আওয়াজ মিলিয়ে যাওয়ার পর চারদিক আবার নিস্তব্ধ। দরজাটা খোলা। ভেতরের অন্ধকারটা যেন কেমন, অন্যদিনের মতো নয়। যেন তাঁকে সাবধান করছে, আর এগিয়ো না। ফিরে যাও ভালো চাও তো।

মনোমোহিনী চৌকাঠ পেরোলেন। সদর ঘর অন্ধকার। কিন্তু তাঁদের শোওয়ার ঘরের আধভেজানো পাল্লার ওপাশে মৃদু আলোর আভাস। একবার যেন গলার আওয়াজ এল? তাঁর আর্লি টু বেড আর্লি টু রাইজ স্বামী, এখনও জেগে? নাকি…

ঘরের কোণে কী চিকচিক করছে? জানালা দিয়ে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোয় শুয়ে থাকা কাস্তেটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল। মালি এসেছিল বাগানের কাজ করতে, ঠিক জায়গায় না রেখে চলে গেছে।

কাস্তে আঁকড়ে মনোমোহিনী শোবার ঘরের দিকে। গলার স্বর এখন স্পষ্ট, চাপা হাসিও নির্ভুল। দম বন্ধ করে দরজা ঠেললেন মনোমোহিনী।

দৃশ্যটার মানে বুঝতেই সময় লেগে গেল খানিকক্ষণ। ততক্ষণে তাঁর বিছানার ওপরের ছায়া ভেঙে আলাদা আলাদা দুটো মানুষের অবয়ব নিয়েছে।

মনোমোহিনীর চেনা মানুষ।

হাতের কাস্তেটা ভীষণ ভারী লেগেছিল মনোমোহিনীর।

* * *

কেউ কি ‘মনো!’ বলে ডেকেছিল? ‘দিদি!’ বলে কেঁদেছিল? কাঁদলেও মনোমোহিনী শুনতে পাননি। যখন চেতনা ফিরেছিল, সারা ঘরে রক্ত, বিছানায় রক্ত, তাঁর হাতে, মুখে, চুলে রক্ত। কাস্তে থেকে টপটপ রক্ত ঝরছে। খালি মনোমোহিনীর মাথার ভেতরটা খটখটে শুকনো। ঠান্ডা।

ঘুরে ঘুরে সারাবাড়ি লন্ডভন্ড করতে, আসবাবপত্র টেনে টেনে ফেলতে রাত প্রায় ভোর হয়ে গিয়েছিল। বাকি ছিল শুধু আলমারি খুলে গয়না ছুড়ে ফেলা বাড়ির পেছনের আধবোজা জলায়, আর ছ-মাসের মধ্যে যেখানে তিনমহলা বাড়ি উঠবে। নিজের গায়ের গয়নার কথাও ভোলেননি মনোমোহিনী। গলার হার ফেলেছিলেন, টান মেরে ছিঁড়েছিলেন কানপাশা।

তারপর মন শক্ত করে দাঁড়িয়ে, কাস্তের ফলাটা দু-হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে সর্বশক্তি দিয়ে হাতলের দিকটা দিয়ে নিজের কপাল ফাটিয়ে অজ্ঞান হয়ে এলিয়ে পড়েছিলেন স্বামী আর সৌদামিনীর মৃতদেহের ওপর।

* * *

ভয় কি একেবারে পাননি ঠাউরুন? পেয়েছিলেন, কিন্তু অনেক পরে। যখন তাঁর কোলে বাচ্চা ছেড়ে মায়েরা নিশ্চিন্তে চলে যেত, নিজেদের গভীরগোপন দুঃখের কথা মন খুলে বলে হালকা হত, শুভকাজে ডাকত। ঠাউরুন রুদ্ধশ্বাস হয়ে থাকতেন, এই বুঝি তাঁর খোলস ছিঁড়ে মনোমোহিনী এসে সামনে দাঁড়ায়।

দাঁড়ায়নি। অপেক্ষা করে করে ঠাউরুনের নিজের মন থেকেও ভয় কেটে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন, সেই একরাতে তাঁর ভেতরের সমস্ত বিষ বেরিয়ে গেছে।

* * *

বুবকা যখন ক্লাবঘরে পাড়ার লোকদের মনোমোহিনী দেবীর রোমহর্ষক আখ্যান শোনাচ্ছিল, ঠাউরুন বাড়ির দাওয়ায় বসে সামনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। লন্ঠন নিভে গেছে অনেকক্ষণ। অনেক রাতে গাঙ্গুলিদের ছাদের রেলিং-এর ওপর চাঁদ উঠল। চাঁদের দিকে তাকিয়ে ঠাউরুন অনেক চেষ্টা করলেন, স্বামীর মুখ, সদুর টলটলে মুখখানাও স্পষ্ট মনে পড়ল না।

* * *

আরও বছর দু-এক বাদে, সেই ভীষণ বন্যার কে জানে কত বছর পর, ঠাউরুন মারা গেলেন। বন্যা না হলেও সে বছর রেকর্ড বর্ষা হয়েছিল। কাগজে, রেডিওতে দূরদূরান্তের বন্যার খবর আসছিল সকালবিকেল। বৃষ্টির চোটে বাসট্রেন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ঠাউরুন যেদিন মারা গেলেন, টানা তিনদিন বর্ষার পর রোদ উঠেছিল সকালে। ঠাউরুনের পিঁড়ি ফের দেখা গেল চাতালে। পিঁড়ির ওপরে ঠাউরুন বসে আছেন। মাথা বুকের ওপর ঝোঁকা। পাশের বাড়ির বারান্দা থেকে সেনকাকিমা, “কী ঠাউরুন, কেমন বৃষ্টি হল?” হেঁকে সাড়া না পেয়ে ভাবলেন, বুড়ির কানটা গেছে। কাকুকে অফিসে, মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে আবার যখন বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন কাকিমা, তখনও ঠাউরুন একইভাবে পিঁড়ির ওপর বসে আছেন। একটা বিশ্রী চিন্তা বুকের ভেতর ধাক্কা মারল, কাকিমা মুহূর্তে সেটাকে বিদায় করলেন। গলায় ভরপুর সাহস নিয়ে ‘ঠাউরুন’, ‘ঠাউরুন’ ডাকতে ডাকতে এগোলেন, ঠাউরুন মাথা তুললেন না। “ঠাউরুন?” হাত বাড়িয়ে কাকিমা ছুঁলেন ঠাউরুনের কাঁধ, ঠাউরুন টলে পিঁড়ির ওপর পড়ে গেলেন।

পুকুরধারের বটগাছের তলায় চাঁদা তোলা খাটে ঠাউরুনকে শোয়ানো হয়েছিল। মিউনিসিপ্যালিটির প্রাচীনতম বাসিন্দার দেহাবসানে এমএলএ এসেছিলেন ঠাউরুনের পায়ে মালা দিতে। মাঠের প্রান্তে দূরে ভিড় করেছিল আশেপাশের পাড়ার লোক। ঠাউরুনের পায়ে ফুলের মালা পরিয়ে এমএলএ স্যালুট করে দাঁড়ালেন। পুকুরের হাওয়ায় তাঁর সাদা ধপধপে ধুতির প্রান্ত অল্প অল্প উড়তে লাগল। পুকুরঘাটের জল স্থির হয়ে রইল, টুপটাপ বটের পাতা ঝরে পড়ল ঠাউরুনের চাদরঢাকা শরীরের ওপর, চোখের জলের মতো।

আমাদের অনেকেরই সেই প্রথম শ্মশানদর্শন। আমাদের মধ্যে সাহসী যারা, তারা চিতা সাজাল, লাঠি উঁচিয়ে পাশে দাঁড়াল, অনেক সময় পুড়তে পুড়তে মড়া স্প্রিং-এর মতো ছিটকে উঠে বসে, ঠাউরুনও যদি বসেন, তখন বাড়ি মেরে শোয়াবে বলে। ঠাউরুন ওসব কিছুই করলেন না, লক্ষ্মী মেয়ের মতো চুপচাপ পুড়লেন। অভিজ্ঞ লোকেরা বলল, তাড়াতাড়িই মিটে গেল, অবশ্য বুড়ির শরীরে হাড় ছাড়া তো কিছু ছিল না।

ঠাউরুন তাঁর বাড়িখানা দিয়ে গিয়েছিলেন পাড়ার লাইব্রেরিকে। সে বছরই সরকারি অনুদান পাশ হল, ঠাউরুনের দরমার বাড়ির জায়গায় লাইব্রেরির নতুন ঘর উঠল, নতুন শেলফে, নতুন বই সাজল সারি সারি। লাইব্রেরির দরজার ওপর সাদা বর্ডার দেওয়া কালো বোর্ডে সোনালি রঙে লেখা হল ‘ঠাউরুন স্মৃতি পাঠাগার’। দু-একজন বলেছিল, ‘মনোমোহিনী স্মৃতি পাঠাগার লিখলে..’ বাকিদের দৃষ্টির সামনে তাদের বাক্য আর শেষ হল না। নামের পাশে ব্র্যাকেটে ঠাউরুনের জন্ম মৃত্যুর সাল লেখার আইডিয়াটা মন্দ ছিল না, কিন্তু বন্যার সালটা কারও জানা ছিল না বলে সেটা লেখা গেল না।


‘ফিরে পড়া গল্প’ বিভাগে প্রকাশিত গল্প সংকলন থেকে গল্প তুলে আনছি আমরা। সম্পাদকের পছন্দ অনুসারে সৃষ্টি-র এই সংখ্যায় রইল কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ‘নয়’ গল্প সংকলন থেকে একটি গল্প। বইটি অনলাইন অর্ডার করা যাবে এখানে

প্রথম অক্ষর ‘ম’

সঙ্গীতা দাশগুপ্তরায়

সাদা কালো খোপের ঠিক সাদাটিতে গা এলিয়ে শুয়ে লাজুকলতা। নেহাত ফুরফুরে চামরপানা লেজটি কালো খোপটিতে নেতিয়ে আছে, তাই ঠাহর হল পরেশনাথের। লাজুক এখানে শুয়ে মানে কর্তামা সবে জলখাবারটি খেয়ে হাতে সেলাইটি নিয়ে বসেছেন তাঁর আরামচেয়ারটিতে। নিভাননী মাঠার গেলাসটি পাশের ছোট টিপয়টির ওপর রেখে ভিতরে গেছে। এইটিই মোক্ষম সময় বটে।
পরেশনাথ ঘোষ লাজুকলতার পাশাপাশিই দাঁড়ান।
সেলাইতে ফোঁড় তুলতে তুলতে ওপরদিকে না তাকিয়েই কর্তামা হাঁক দিলেন, “নিভাননী, ঘোষমশাইকে একখানা মোড়া দিয়ে যা।”
“এ কী, আপনি চোখ না তুলেই কী করে বুঝলেন যে আমিই এসেছি?”
এবার চোখ তোলেন কর্তামা। “তামাকের গন্ধে বাবা। আপনি ছাড়া অন্দরে পুরুষ বলতে আসতে পারেন পুরুতমশাই। তা তিনি পুজুরি মানুষ, ধুনো চন্দন ছাড়া সুবাস জানেন না। এ বাড়ির ছেলেরা তো কেউ তামাকে আসক্ত নন। তাই আপনিই যে এসেছেন তা আমি আর আমার আগেও আমার লাজুকই টের পেয়েছে, নাকি রে লাজুক?”
উত্তরে লাজুকলতা কেবল লেজটুকু সরিয়ে পরেশনাথকে আরও একছটাক জায়গা করে দেয়।

নিভাননীর রেখে যাওয়া মোড়ায় বেশ গুছিয়ে বসেন পরেশনাথ। “এবার যে সম্বন্ধ এনেছি কর্তামা, আপনি না বলার ফাঁকটি পাবেন না। এক্কেবারে অক্ষয় সিঁদুরের অধিকারিণী এ মেয়ে।”
কিন্তু পরেশনাথের উৎসাহের ঝরনা মিনিটখানেক ঝরতে না ঝরতেই কর্তামার মুখের রেখা কঠিন হতে থাকে— “আপনার কি মতিভ্রম হল ঘোষমশাই! কোথাকার কোন বিধবার রজঃস্বলা মেয়েকে আমি নাতির বউ করে নিয়ে আসব!”
হাঁ হাঁ করে ওঠেন পরেশনাথ। “কর্তামা, আগে সম্পূর্ণ কাহিনি তো শুনুন। এ মেয়ের সঙ্গে যে থাকবে তারই অখণ্ড পরমায়ু। আমি নিজে কোষ্ঠী বিচার করিনি শুধু, তর্কালঙ্কারমশাইকে দিয়েও করিয়েছি। মেয়েটি বিবাহোত্তর রাজরানির ললাট নিয়ে জন্মেছে মা। মৃত্যুযোগ মেয়ের নিজেরই প্রায় বার্ধক্যে, তাও সধবা। স্বামী-পুত্রযোগে রাজটিকা জ্বলজ্বল করছে।”
“বাপ খেয়েছে ছোট বয়সে, তার ভাগ্য কী করে ভালো হয়!” কর্তামা একেবারেই বিশ্বাস করতে চান না।
“সেও এক কাহিনি কর্তামা… বাপ-মা মেয়েটিকে বোনের কাছে রেখে সাকিন গাঁয়ে যাচ্ছিলেন। পথে লেঠেল ডাকাত চড়াও হয়ে যথাসর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। বাপটি ছিলেন সাহসী মানুষ। লেঠেলদের সঙ্গে মুখোমুখি লড়তে গিয়ে মাথায় লাঠির ঘা খান। তবে মা মানুষটি বড় ভালো কর্তামা। একা মেয়েমানুষ স্বামীর শোক সামলাতে সামলাতে মেয়েটি যে বেড়ে উঠছে বুঝেও কিছুই করতে পারেননি এতকাল। গ্রামে তাঁদের খাওয়া জুটত না দু-বেলা। স্বামী হারানোর সঙ্গে সঙ্গেই শরিকেরা জমি থেকে বাস্তু সবই নিজেদের করে নিয়েছে। শেষে বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। আমি সেইখানেই মেয়েটিকে দেখলাম। ছোটখাটো গড়ন। যেন আমাদের কোজাগরীর লক্ষ্মী ঠাকরুনটি। দেখলে বুঝতেও পারবেন না মা যে রজঃদর্শন হয়েছে তার।”
মাঠার গেলাসটির গায়ে বিন্দু বিন্দু জল জমছে। কর্তামার মুখের বিরক্তিও এক দাগ নামেনি। “না না, চৌধুরীবাড়ির নাতির বউ হবে কুমারী, বড় বংশের কন্যা। এ কোন বুড়োধাড়ি মেয়ে, মাসির ভাতে মানুষ। তাকে আমার নয়নরাজের বউ করে আনার কথা ভাবতেও পারব না আমি।”

দরজার আড়ালে একটি ডুরে শাড়ির আভাস দেখা দিয়েই সরে যায়। কর্তামার নাতি, যার বিয়ের কথা চলছে, তার মায়ের শাড়িটির কোনা নজরে আসে পরেশনাথের।
“আপনি তো জানেন কর্তামা, নয়নরাজের আয়ুরেখাটি বড় ভঙ্গুর। মারণ ফাঁড়া নিয়ে জন্মেছে নাতিরাজা। এদিকে আপনাদের পালটিঘরে সম্বন্ধ চালাতে গেলেই তাঁরা ঠিকুজি চান। গতমাসে আমি ধাত্রীগ্রামের জমিদার বংশের সীতেশ রায় মশায়ের নাতনিটির সঙ্গে সম্বন্ধ প্রায় গড়েই এনেছিলুম, কিন্তু তাঁরা নয়নরাজের ঠিকুজি বিচার করিয়েছেন কুলপুরোহিত দিয়ে। তারপর আমাকে জানিয়েছেন জেনেশুনে তাঁরা বাড়ির মেয়েকে বৈধব্যের দিকে…”
“চুপ! চুপ করুন আপনি।” ছিটকে ওঠেন কর্তামা। মাথা থেকে ঘোমটাটি খসে পড়ে বিরক্তিতে। “যা মনে আসে বলছেন! ফাঁড়া আর মৃত্যু এক হল!”
“ফাঁড়া তো যেমন তেমন নয় মা, একেবারে মৃত্যুযোগই আছে যে।” পরেশনাথের ধীর স্বরটি শুনে দরজার আড়ালের ডুরে শাড়িটির আঁচল চমকে ওঠে, ফলত কিছু চুড়ির রিনিক ঠিনিক শোনা যায়।
“আমাকে একটু ভাবতে দিন পরেশবাবু, ছেলেদের সঙ্গে পরামর্শ করে আপনাকে খবর দেব-খন… নিভা, পরেশবাবুকে জল-মিষ্টি দিতে কি বলে দিতে হবে?” বলতে বলতে নিজের কেদারাটি ছেড়ে উঠে দাঁড়ান কর্তামা।
সন্ধেবেলায় চণ্ডীমন্ডপে রামনাথ শাস্ত্রী মশাই আসবেন। তাঁর গলায় কিছুটা কথকতা শুনলে মনটি যদি স্থির হয়। শাস্ত্রীমশাই বলেছিলেন পাঠশালের একটি ব্রাহ্মণ পোড়োকে পাঠাবেন দুপুরের দিকে। রামায়ণ মহাভারত পড়ে শোনাবে সে। দিনের হিসেবে সিদে সাজিয়ে দিলেই হবে তাকে। সে কথাটিও তাঁকে মনে করিয়ে দিতে হবে।

“মা যা ভালো বুঝবেন, তাই তো করবেন। তুমি এর মধ্যে মাথা গলাচ্চই বা কেন?” বউয়ের সাজা পানটি গালে ফেলে পাশবালিশটি কোলের কাছে টেনে আড় হন শঙ্করপ্রসাদ।
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর পানটি মুখে নিয়ে গিন্নির সঙ্গে মিনিট দুয়েক কথা হতে না হতেই চোখ লেগে আসে। ওই দু-মিনিটই সময় ইরাবতীর হাতে।
“তুমি শুধু একবারটি মাকে রাজি করাও মেয়েটিকে দেখতে যাওয়ার জন্য। ছোটঠাকুরপো আর পুরোহিত মশাইকে নিয়ে যেও। পায়ে পড়ি তোমার। এই মেয়েই আমি বউ করতে চাই।”
গিন্নির দিকে তাকিয়ে হাসেন শঙ্করপ্রসাদ। “মা-র কথার উপর কথা বলতে বলছ!”
“হ্যাঁ, বলছি। মা-র আপত্তির কোনও কারণ তো পাইনে। মেয়েটি জন্ম এয়োস্ত্রির কপাল নিয়ে এসেছে। পরেশবাবু ঠিকুজি মিলিয়ে দেখেছেন এই মেয়ে আমার নয়নের রক্ষাকবচ হবে।”
“আচ্ছা আচ্ছা, কান্নাকাটি কেন আবার? আহা, আমায় একটু শুতে দাও। চারটেতে আবার কাছারিতে গিয়ে বসতে হবে।” বলতে বলতেই শঙ্করপ্রসাদের নাকের বাদ্যি শোনা যায়। হালকা বালাপোষখানা স্বামীর গায়ে ছড়িয়ে দিয়ে মেঘলা মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ইরাবতী।

ইরাবতী নয়নরাজের মা, কর্তামার বড় পুত্রবধূ। আজ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সে পরেশবাবুর সব কথাই শুনেছে। এমনিতে এ বাড়িতে বউদের পর্দা প্রথা থাকলেও পরেশবাবু আর পুরোহিত মশাইয়ের ক্ষেত্রে ছাড় আছে কিছু। কর্তামা উঠে যাওয়ার পর ইরাবতীই নিভার কাছ থেকে জলখাবারের থালাটি নিয়ে পরেশবাবুর কাছে গিয়েছিল। থালাটি নামানোর সময় খুব নিচু গলায় বলে এসেছে পরশু যেন তিনি আর একবার আসেন। ইরাবতীর আশা কর্তাকে সে রাজি করাতে পারবে। মেয়ের বয়স নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। নয়নরাজের এখন সতেরো চলছে। উনিশে একটি মারাত্মক ফাঁড়া আছে তার। সেটি কাটানোর জন্য বহু যাগযজ্ঞ, মহামৃত্যুঞ্জয় কবচ সবই হয়েছে, তবু কোথায় যেন ভয়ের কাঁটা খচখচ করে।

দুপুরে কর্তামার খাওয়ার সময়ে তিন পুত্রবধূই কাছে থাকে। বাড়িতে দাসদাসী চাকরবাকরের ছড়াছড়ি। হেঁসেলে দুজন ঠাকুর। তবু কর্তামার খাবারের জোগাড় কেবল বউরাই করতে পারে। তিনজনেই ভয়ে ভয়ে লক্ষ করে খেতে খেতে শাশুড়ির মুখের ভাবখানি কেমন। কোনোদিন বেশি গম্ভীর লাগলে ছোট বিভাবরীকে বড় ইরাবতী ঠেলা দেয়— “তুই নিশ্চয় লাউশুক্তোতে আজ নুন দিসনি বিভা।”
কোনোদিন প্রসন্ন দেখালে মেজ শৈলরানি বড় ইরাবতীকে বলে—“আজ তোমার ছানাপটলে নিয্যেস সোয়াদ বেশি হয়েছে দিদি।”
তিনটি বউই কর্তামার প্রিয়। অনেক সময় কাজে-অকাজে ভিতরবাড়িতে বসে তিনিও শুনে ফেলেন তিন জায়ের খুনসুটি। আহা সেই কোন ছোটবেলায় তিনটিকে নিজে বেছে বউ করে এনেছিলেন কর্তা। আজও খেতে বসে তিনজনের দিকেই একবার করে চাইলেন কর্তামা। তাঁর ছেলের বউরা ঘরে এসে ঘর আলো করেছে। এখন এদের ছেলেগুলি বড় হচ্ছে। তাদের জন্যও একেবারে ফুটফুটে কুমারীপূজার আসন থেকে উঠে আসা বউ আনবেন ভেবে রেখেছেন। পরেশবাবুর মতিভ্রংশ হয়েছে নির্ঘাত।

মতিভ্রংশ তো শুধু পরেশবাবুরই হয়নি। বড় বউমারও হয়েছে বটে। দুপুরে হেঁশেলে বসে তিন জায়ে পরামর্শ চলে। ছোট বিভাবরী একটু ডাকাবুকো। সে বুদ্ধি দেয়— “তুমি ভাশুর ঠাকুরকে রাজি করাও দিদি। তোমার দেওরকে আমি বলব-খন আজই। দুই ভায়ে মিলে মেয়ে দেখে মত দিয়ে দেবে। ও মেজদি, তুমি কী বলো?”
মেজ শৈলরানি যখন বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে পা দেয়, তখন ইরাবতী সাত মাসের পোয়াতি। বলতে গেলে আঁতুড়ের নিয়ম চোকার পর থেকেই সে নয়নকে কোলে পিঠে মানুষ করেছে। ওই মহামৃত্যুঞ্জয় কবচের পুজোর উপোস সেও করেছিল বড় জায়ের সঙ্গে। নয়নের ফাঁড়ার কথা শুনলেই তার চোখে জল আসে। এখনও সে আমড়াখানা গালের পাশে ঠেলে বাঁ হাতে আঁচল তুলে চোখটি মুছে ঘাড় নাড়ে, “হ্যাঁ দিদি। মাকে বোঝাতে যদি কেউ পারে তো ভাশুরঠাকুরই পারবেন। তুমি আজ রাতে কেঁদেকেটে পায়ে পড়েও মত করাও। আমার নয়নের কিছু হয়ে গেলে আমি গলায় দড়ি দেব,” বলতে বলতে আমড়ার আঁটিটাই গলায় আটকে যায় প্রায়।

দুপুরটি গড়িয়ে উঠোন পেরোয় প্রায় দেখে নিভাননী অল্প গোলাপজল মেশানো খাঁটি নারকোল তেলটি কর্তামার পায়ে মাখাতে মাখাতে গুনগুন করে তিন বউয়ের শলা পরামর্শর কথাটি ফাঁদল। মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই এই লাগানি ভাঙানিতে গিন্নি খুশি হলেন, না ব্যাজার। শুধু পা-টি টেনে নিয়ে বললেন, “যাওয়ার সময় দরজাখানা টেনে দিয়ে যাস।”

কাঁদাকাটায় নাকি ছলাকলায় তা কেবল ইরাবতীই জানে, পরের দিন কাছারি থেকে শঙ্করপ্রসাদ সকালের লুচির থালাটি ফিরিয়ে পাঠালেন।
“ভেতরে মা-র কাছেই খাব। জলখাবার ওখানে দিতে বল, আসছি…” এটুকু শুনেই কর্তামা আঁচ করেছিলেন।
কর্তা গিয়ে ইস্তক বড় শঙ্করই হাল ধরেছে চতুর্দিকে। বাকি দুই ছেলেও বড় ভাইয়ের কথা বেদবাক্য মানে। শঙ্কর নিজে সাধারণত অন্দরের কোনও ব্যাপারে কথা কইতে আসে না। বরং এস্টেটের কাজে বা সংসারের ভালোমন্দ নিয়ে পরামর্শ করার থাকলে কর্তামাই ডেকে পাঠান তাকে।
সারারাত কর্তামাও অনেক ভেবেছেন। ষেটের কোলে তাঁর নিজেরও পাঁচটি ছেলে তিনটি মেয়ে। প্রথম দুটি ছেলেই অকালে কোল খালি করে গিয়েছিল। সন্তানের মৃত্যু দু-দুবার দেখেছেন তিনি। তাছাড়া নয়নরাজ তাঁর নয়নের মণি, বংশের প্রথম নাতি। পরেশবাবুকে তিনি বলেছিলেন অষ্টমীর কুমারীপূজার আসনের কোনও যোগ্য মেয়ের সম্বন্ধ আনার কথা। এ মেয়েটির বয়স বারো, তায় মাসির ঘরে আশ্রিত। এমন ধিঙ্গি মেয়ে বউ করে এনে সমাজে মুখ দেখাবেন কী করে!
শঙ্করপ্রসাদ কিন্তু মায়ের কাছে খুব অল্প কথায় কাজ সারেন।
“মেয়েটিকে দেখলেই যে পছন্দ হয়ে যাবে এমন তো না মা! তাছাড়া শুধুই একটু বেশি বয়সের জন্য মেয়েটিকে আপনি নাকচ করলে ভবিষ্যতে যদি নয়নের কিছু হয়, তখন আপনি নিজেও কি নিজেকে দোষী ভাববেন না?”
কেঁপে ওঠেন কর্তামা। রজঃস্বলা মেয়ে বউ করে এনে কতটা পাতকী হতে হবে, তা পুরোহিত মশাই-ই জানবেন। কিন্তু এরপর যদি এমন সুলক্ষণা মেয়ে না পাওয়া যায়! নয়নরাজের পরেও আরও তিনটি নাতি আছে। ভাগ্যে থাকলে কুমারী বউ আসবে নিশ্চয়। মন ঠিক করে নেন কর্তামা— “বেশ, পরেশবাবুকে খবর দিও একবার যেন আসেন।”

“ও স্বর্ণ, মাথার কাপড় সরে যাচ্ছে যে! ভালো করে কাপড়টা টেনে তবে থালা হাতে নে।” মেজবউ শৈলই এই দুরূহ কাজখানা নিজের কাঁধে নিয়েছে, “এ মেয়ের নাম বুঝলে দিদি, হরিণী হওয়ার কথা। এত হাতে পায়ে ছটফটে মেয়ে তো দুটো দেখিনি…”
এ যদিও খুড়িশাশুড়ির স্নেহের কথা, নইলে স্বর্ণলতা মোটেই ছটফটে নয়। কেবল ঘোমটাটিই তার মাথা থেকে মাঝেমাঝে সরে যেতে চায়। বিয়েবাড়ির কুটুম স্বজন থাকাকালীন তো সে ঘর থেকেই বেরোয়নি। এখন ক-দিন পর বাড়ি একটু খালি হতে সে মাঝেমাঝে এদিক ওদিক ঘোরে, শাশুড়িদের হুকুম তামিল করে।

ইরাবতী নিরামিষ হেঁসেলের নারকোলটি কুরিয়ে নিতে নিতে হাসে— “তুই-ই বোঝ! গড়ে পিটে মানুষ তো তুই-ই করবি!”
এ দায়িত্ব আসলে সে নিজেই শৈলকে দিয়েছে। এই মেয়েটি তার নয়নরাজের রক্ষেকবচ। তাকে বকাবকি করে শাসন করে এ বাড়ির উপযুক্ত বউ করে তোলে এমন সাধ্য নেই ইরাবতীর। এক দু-বার কোনও কারণে বকতে গিয়েও আটকে যায়। কেবল মনে হয় এই মেয়েটির কারণেই হয়তো তার শিবরাত্তিরের সলতেটি ফাঁড়া কাটিয়ে উঠবে। একরাশ স্নেহ নাকি কৃতজ্ঞতায় গলার স্বর এমনিতেই নরম হয়ে যায়।

মাথার কাপড়টি গুছিয়ে রুনুঝুনু নূপুরের শব্দ তুলে এক হাতে মিষ্টির রেকাবি, অন্যহাতে ডাবের জলটি নিয়ে স্বর্ণলতা কর্তামার পাশটিতে গিয়ে দাঁড়ায়।
কর্তামা নিভাকে দিয়ে নতুন কম্বল আর চাদর জোড়ায় জোড়ায় গুছিয়ে তোলাচ্ছিলেন। অঘ্রাণে নাতির বিয়ে দিয়ে বউ আনলেন। পৌষের আগেই মহালে লোক পাঠিয়ে গরিবদের মধ্যে কম্বল আর চাদর বিতরণ করবেন।
নূপুরের শব্দ শুনে পাশে তাকালেন কর্তামা। নাতবউ বলে কথা। কত আদরেরই জিনিস। কিন্তু কোথা থেকে একটা বিরাগ বারবার কর্তামার মুখে ছায়া ফেলে। সেটুকু জোর করে মুছে ফেলার চেষ্টাতেই গলায় স্নেহ আনেন কর্তামা— “তুমি কিছু খেয়েছ স্বর্ণ!”
টুকটুক করে মাথা নাড়ে নতুন বউ। ঘোমটা সরে যাবার ভয়ে কোণটি হাতে ধরে থাকে।
“সে কী! জল খাওনি সকালে?”
“মা-র সঙ্গে খাব।” ধীর গলায় কথা ক-টি বলে স্বর্ণ। নাতবউয়ের গলা এই প্রথম স্পষ্ট শুনলেন কর্তামা। তিনি আর পাঁচটি শাশুড়ি-দিদিশাশুড়ির মতো নন। ছেলের বউদের গলাও দিনে ক-বার শোনেন গুনে বলা যায়।
“আচ্ছা, যাও… বড়বউমাকে বোলো আমি ডেকেছি।”

স্বর্ণ ধীর পায়ে ভিতরবাড়িতে এসে খবরটি দিয়ে হেঁসেলের জানলা দিয়ে কালো হয়ে আসা আকাশ দেখে। এত বড় আকাশ! মাসি বলত তেপান্তরের মাঠ এর থেকেও বড়। মাসির বাড়ির ছাদেও কি এমন মেঘ করেছে? মা কী করছে কে জানে!
এখানে মেজমা রোজ পাঁচ গুছি ছ-গুছির বিনুনি করে দেন। নাপিত বউ আসে সবাইকে আলতা পরিয়ে চুল বেঁধে দিতে। তবু মেজমা নিজেই স্বর্ণর চুল বাঁধেন। নিভাননী দুধের সরে কাঁচা হলুদ বাটা মিশিয়ে দেয়। ছোটমা স্নান করতে যাওয়ার আগে সেটি হাতে দিয়ে বলেন, “ও স্বর্ণ, এটা মেখে একটুক্ষণ বোস, তারপর নাইতে যাবি।” স্বর্ণ তাই করে। তবে এখানে নাইতে যাওয়াটা কেমন যেন! শিরকাগঞ্জে মাসির ওখানে বাড়ির পুকুরে নাইতে নামার সুখ এখানে নেই। অন্দরে বড় উঠোনের একদিকে ঘেরা অনেকটা জায়গা। সেখানে চৌবাচ্চায় জল ধরে রাখা হয়। বড় বড় জালাতেও জল থাকে। ওই জলেই চান সারতে হয়।
হঠাৎ যেন স্বর্ণকে চমকে দিয়েই ভীষণ জোরে ঝড় ওঠে। মা! ও মা! তুমি ঝড়ে কাঁচা আম তুলে আনতে যে বাগান থেকে! ভাবতে ভাবতে স্বর্ণর দু-চোখ ভাসিয়ে জল উপচে পড়ে।

নয়নরাজের বেশ মজা যা হোক। একটা সাজুগুজু করা ঘোমটা টানা মেয়ে একেবারে তার নিজস্ব। ইচ্ছা করলেই তাকে দিয়ে পা টেপাতে পারে, মাথা টেপাতে পারে, হুকুম করতে পারে যা মন চায়। স্বর্ণ এমনিতে চুপচাপ ঘরে আসে। জলটা মৌরিটা এগিয়ে দেয়। কখনও মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে আলোটা কমিয়ে দেবে কি না। দুপুরে পড়াশুনোর টেবিল গুছিয়ে রাখে। তবে কখন যে ঘুম থেকে উঠে চলে যায় তা নয়নরাজ জানতে পারে না।
সেটা জানতে পারেন কর্তামা। দোতলায় পুবমুখো ঘরের সামনের ঘেরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সূর্যপ্রণাম আর পিতৃপুরুষদের প্রণাম সেরে কর্তামা নিচে নামেন। ইদানীং বেশ কিছুদিন ধরেই দেখছেন ভোরের শিশিরে পা ফেলে ফেলে বাগানটিতে ঘুরছে নাতবউ। বাগানটি কর্তামার বড় প্রিয়। দু-জন মালি চৌপর দিন খাটে বাগানের পিছনে। ইদানীং তারা বাগানে আসার আগেই নাতবউ ঘুরে ঘুরে শুকনো পাতা তুলে জড়ো করে। কর্তামা ঠাহর করে দেখেছেন ফুলে হাত দেয় না মোটে। একটানা সারি দিয়ে লাগানো রংবেরঙের গোলাপ শীতের মুখে সেজে উঠছে। স্বর্ণ কখনও একটু নিচু হয়ে গোলাপের সুবাস নেয়, কখনও লতানে জুঁইয়ের শেষ রেশের।
কর্তামা দূর থেকে দেখেন। পরেশবাবু ঠিকই দেখেছিলেন। মেয়েটি লক্ষ্মীস্বভাবা। এখন নাতির ফাঁড়াটি যদি কাটে এই মেয়ের পয়ে তো গোটা মহালকে তিনদিনের ভোজ খাওয়াবেন কর্তামা, বেনারসে পুজো পাঠাবেন সোনার থালায়, গৃহদেবতা অনন্তনারায়ণের সোনার পৈতে গড়িয়ে দেবেন, ভাবতে ভাবতে আরও কত কথাই যে মনে হয়! কর্তা বড় তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। একা হাতে কর্তামা দশদিক সামলান। সারাটি দিন কেটে যায় কাজে কম্মে। শুধু বড় কোনও বিষয়ে মতামত নিতে ছেলেরা যখন কাছটিতে এসে বসে, তখন বুকের ভিতরটা হু হু করে ওঠে। কর্তার অভাবটা যেন বড় বেশি টের পান তখন।
পুজোর ঘর থেকে বেরোতেই নিভাননী এসে খবর দিল— “পরেশবাবু এয়েচেন।”
“পরেশবাবু? কাছারিঘরে তো নামেনি এখনও বড়খোকা! তাও ওখানেই বসতে বল।”
“উনি আপনার কাচেই এয়েচেন কর্তামা।”
“আমার কাছে? আচ্ছা ওঁকে ভেতরে পাঠিয়ে দে আর বড়বউমাকে বল ওনার জলমিষ্টির বন্দোবস্ত করতে।” কর্তামা তাঁর আরামকেদারায় এসে বসেন।

পরেশবাবু ভোর-ভোর স্নান সেরে বেরিয়েছেন বোঝা যায়। মহালের কিছু শরিকি সমস্যার খবর দিতে এসেছেন। এখান থেকে আরও কোথাও যাওয়ার আছে।
নয়নরাজের জন্য ভাগ্যবতী বউ খুঁজে দিয়েছেন কত কষ্ট করে মানুষটা! ইরাবতী পরম কৃতজ্ঞতায় লুচি, তরকারি, পাঁচরকম মিষ্টি— সব সাজিয়ে নিভার হাতে দিয়ে পায়ে পায়ে নতুনবউকে সঙ্গে নিয়ে ভেতর বারান্দা অবধি আসে। তারপর স্বর্ণর ঘোমটাটি আরও একটু টেনে দিয়ে বলে, “যাও, প্রণাম করে এসো ওঁকে।”
পরেশবাবু বিয়ের পর এই প্রথম স্বর্ণকে দেখলেন। শিরকাগঞ্জের সেই খুকিটি এই ক-দিনেই কেমন বউ হয়ে উঠেছে! স্বর্ণ পায়ে হাত দিতে প্রাণভরে আশীর্বাদ করেন পরেশবাবু। তারপর সঙ্গের ঝোলাটি থেকে একখানি ভাঁজ করা কাগজ স্বর্ণের হাতে দেন— “এই নাও মা, তোমার মা চিঠি লিখেছিলেন তোমাকে। আমি গিয়েছিলুম কিছুদিন আগে। এখানে আসব শুনে আমার হাত দিয়েই পাঠিয়েছেন।”
“ও পত্তর আপনিই পড়ে দিন। নয়ন আজ দু-দিন হল মেজখোকার সঙ্গে কোর্টের কিছু মামলা নিস্পত্তি করাতে গেছে। ফিরবে সেই পরশু। নাতবউ তো আর শ্বশুরকে দিয়ে পত্তর পড়াতে পারবে না! আপনিই পড়ে দিন না হয়!”
“আমি পারব।” মিহি গলায় স্বর্ণ কথা ক-টা বললেও ঘরে যেন বাজ পড়ে।
“কী পারবে নাতবউ?”
“আমি পত্তরটা পড়তে পারব।” স্বর্ণ আবার নরম গলায় বাজ ফেলে।
বউয়ের কথা শুনে দরজার আড়ালে ইরাবতীর হাত থেকে ঝনঝনিয়ে কাঁসার গেলাসটি পড়ে গোটা মেঝে জলে জলাক্কার।
“তুমি? তুমি পড়তে পারো?” কর্তামার গলায় হুংকার বেজে ওঠে যেন…
“হ্যাঁ, আমি দেশের বাড়িতে পাঠশালে গিয়েছিলাম। পড়তাম, লিখতামও।”
“আর তোমার মা? তিনিও লিখতে পড়তে পারেন?”
“না।” আলতো ঘাড় নাড়ে স্বর্ণ। “মা বোধ হয় বেণুদাদাকে দিয়ে লিখিয়েছেন।”
বাসনের আওয়াজেই হোক বা নিভাননীর উচ্চৈঃস্বরে ‘মা গো, এ কী সব্বনেশে কতা গো!’ বলে চিৎকারেই হোক শৈলরানি আর বিভাবরীও কপাটের আড়ালে এসে দাঁড়ায়। কর্তামা পিছন ফিরে বসে আছেন। রাগে কাঁপছেন না আচমকা আঘাতে অবশ হয়ে গেছেন বোঝার উপায় নেই। পরেশবাবু মাথাটি নিচু করে বসে আছেন, হাতের লুচি ঠান্ডা হয়ে গেছে বোধ হয়। শুধু স্বর্ণ নির্বিকার মুখে কাগজটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন কর্তামার হুকুম পেলেই পড়ে শোনায়।

কিছু পরে পরেশবাবু আধখালি রেকাবিটি নামিয়ে দূর থেকে প্রণাম সেরে বিদায় নেন। ইরাবতী, শৈলরানি আর বিভাবরী তিনজনে মিলে নিরামিষ হেঁসেলের সব রান্নাই হয় আলুনি, নয় নুনে পোড়া করে সারে। রসুইঘরে দুই ঠাকুর আর খেমি ঝি মিলে নতুন বউয়ের লেখাপড়া জানার পাপ খণ্ডাতে মুড়িঘণ্টতে মাত্র একটি মাছের মাথা দিয়ে বাকি মাথাগুলি লাজুকলতাকে খাইয়ে দেয়। শুধু এই প্রবল হাঙ্গামার মাঝে কেউই স্বর্ণর খোঁজ নেয় না।
স্বর্ণ তখন নয়নরাজের পড়ার টেবিলের নিচে বসে একমনে মা-র লেখা ছ-লাইনের চিঠিখানি একবার মুখে বোলাচ্ছে একবার খুলে পড়ছে একবার অক্ষরগুলোকে নাকের সামনে এনে মায়ের আঁচলের গন্ধটি নেওয়ার চেষ্টা করছে।
দুপুরে ছেলেরা কর্তামার সামনেই খেতে বসেন, তেমনই নিয়ম। আজ কেবল বড়ছেলেই বাড়িতে আছে। কর্তামা শান্তমুখে ছেলের খাওয়ার তদারকি করেন। পরেশবাবু মহালের যে খবরটি দিতে এসেছিলেন সেটি শোনান, নাতবউয়ের বাপের বাড়ি থেকে চিঠি এসেছে সেটিও জানাতে ভোলেন না। শুধু নাতবউ যে পড়াশুনো জানা বিদ্যেধরী সেটুকু আর বলেন না কেন কে জানে!
ছেলের খাওয়া হলে নিজের পাটটুকু সেরে ঘরে গিয়ে দোর এঁটে দেরাজটি খোলেন কর্তামা। কর্তা গেছেন তা প্রায় বাইশ না তেইশ বছর হল। তাঁর শালটি, বিয়ের জোড়টি, আরও কিছু ধুতি-চাদর এখনও দেরাজে সাজানো। জোড়ের চাদরটি সযত্নে বার করে আনেন কর্তামা, বিছানায় রেখে ভাঁজ খোলেন; ভেতরে প্রায় হলদে হয়ে আসা ক-টি কাগজ, তাতে নীল রং দিয়ে কিছু লেখা।

তখন গোটা পরিবার দেশের বাড়িতেই ছিল। প্রথমবার সন্তানসম্ভবা বউকে পাশের গ্রামে তাঁর কবিরাজ বাপের কাছে পাঠিয়েছিলেন কর্তামার শাশুড়ি। টানা ছ-টি মাস বাপের বাড়িতে থাকার কালে কর্তা বড় মন খারাপ করে চিঠি লিখে পাঠাতেন তাঁর পেয়ারের চাকর ভীমের হাতে। বউয়ের অক্ষরজ্ঞান নেই জেনেই লিখতেন। বাড়িতে ভাইয়ের তো অভাব ছিল না। কাউকে এক আনার লোভ দেখিয়ে পড়িয়ে নিলেই হত। তখন বয়সই বা কী! বড়জোর চোদ্দো।
প্রথম চিঠিটি আজ আর নেই। ছোট ভাইটিকে পড়ে দেওয়ার জন্য ধরেছিলেন। সে সেটা পড়েও দিয়েছিল, কিন্তু তারপর বাকি ভাইবোনদের দেখিয়ে ঠাট্টা তামাশায় দিদিটির প্রাণ অতিষ্ঠ করে দিতে দিতে ছিঁড়েও ফেলেছিল। সেই থেকে ভীম লুকিয়ে এসে চিঠিটি দিলেই তিনি সেটি আঁচলে বেঁধে ঘরে এসে তোরঙ্গের নিচে রেখে দিতেন। ছেলেকে কোলে নিয়ে বাড়ি ফিরে প্রথম রাত্রেই চিঠিগুলো বার করে কর্তাকে দিয়েই পড়িয়ে নিয়েছিলেন।
পরে কর্তা সেই নিয়ে কত ঠাট্টাই যে করতেন। বলতেন, “আমাকে ছেড়ে কখনও যেও না কোথাও। চিঠি লিখলেও তো আমাকেই গিয়ে পড়ে দিয়ে আসতে হবে!”
সেই কর্তাই চলে গেলেন চিঠিপত্তরের সীমার বাইরে। আজ এতদিন পরে এই চিঠিগুলোতে কী লেখা আছে, তা নতুন করে জানতে ইচ্ছে করে খুব।

সন্ধেবেলায় পুরোহিতমশাই নারায়ণের শয়ান দিয়ে গেলে কর্তামা নিভাননীকে বলেন ঠাকুরদালানের লন্ঠনটা উসকে দিতে আর নতুন বউকে পাঠিয়ে দিতে একবার।

স্বর্ণ ভয়ে ভয়ে এসে দাঁড়ায়। আজ আর শাশুড়িরা কেউ ওকে কাছে ডাকেনি। চুলের গুছি যেমন-তেমন ঘাড়ের কাছে জড়ো করে তার ওপর দিয়েই ঘোমটাটা কপাল অবধি টেনে রেখেছে। নূপুরের রুনুঝুনুর অস্বস্তিটাও বেচারি ঢাকতে পারছে না। পড়তে জানার অপরাধটা যে কত গুরুতর তা বোধ করি এখনই বোঝা যাবে। নয়নরাজ ফিরলেই হয়তো কর্তামা তাকে দিয়ে ওকে শিরকাগঞ্জেই পাঠিয়ে দেবেন। হেঁশেলে ঠাকুরদের নিভাননী এমন কিছুই তো বলছিল।
“এসো, চুল বাঁধোনি আজ?” কর্তামার চোখ কিছুই এড়ায় না।
মাথা নিচু করে ঘাড় নাড়ে স্বর্ণ।
“বোসো আমার কাছে। কেমন আছেন তোমার মা?”
সারাদিনে সবার চোখে রাগ আর ভয় দেখে যা হয়নি, কর্তামার এই একটি কথায় তাই হয়। ঝরঝরিয়ে দু-গাল বেয়ে নদী নামে স্বর্ণলতার। কোনোরকমে ঘাড় হেলিয়ে উত্তর দেয়— “ভালো আছেন, আপনাকে প্রণাম জানিয়েছেন।”
“আর তোমাকে?” কর্তামার মুখে অল্প মায়া-মায়া হাসি বুঝি।
“স্নেহাশিস পাঠিয়েছেন।” এটুকু বলতেই গলা কেঁপে যায় বেচারির।
“বেশ যাও, গিয়ে বড় বউমাকে বলো চুলটা বেঁধে দিতে। আর কাল দুপুরে খাওয়াদাওয়া হলে আমার ঘরে এসো একবার।” এটুকু বলেই কর্তামা ছুটি দেন স্বর্ণকে।
সারারাত পাশবালিশটি নিয়ে বিছানায় এপাশ ওপাশ করে স্বর্ণ। আজ তো শাস্তি দেননি! তবে কি কাল সবার সামনেই?
মেঝেয় শীতলপাটিতে শুয়ে নিভাননী বারবার বলে, “মাথার কাছের জানলাটা খুলে দিই? গরম লাগছে বুঝি!”

পরেরদিন ইরাবতী কাঁপা হাতে স্বর্ণকে ভাত বেড়ে দেয়। শৈল চোখের জল মুছতে মুছতে মাছের পেটিদুটি পাতে ফেলে দেয়। না জানি কী শাস্তি পেতে চলেছে এইটুকু দুধের মেয়ে। তিন শাশুড়ির সঙ্গে খেতে বসে পাতের খাবার পাতেই পড়ে থাকে। হাত ধুয়ে স্বর্ণ পায়ে পায়ে কর্তামার ঘরে গিয়ে দাঁড়ায়।
কর্তামা উঠে গিয়ে দরজাটি বন্ধ করে দেন। তারপর দোয়াত কলম আর বালির কাগজটি মাটিতে বিছিয়ে বসেন। পাশে বসান নতুন নাতবউকে।
কর্তার নাম ছিল স্বর্গীয় মৃগাঙ্কশেখর চৌধুরী। নাতবউয়ের হাতে কলমটি দিয়ে কর্তামা বলেন, “প্রথমে আমাকে ‘ম’ লেখা শেখাও দেখি নাতবউ!”

সারা দুপুর ধরে স্বর্ণর লেখা অক্ষরগুলির ওপর কলম বুলিয়ে অভ্যাস করেন ষাটোর্ধ্ব কর্তামা। মাঝে মাঝে ভুল করেন। স্বর্ণলতা তার ছাত্রীটির পদমর্যাদা ভুলে খিলখিলিয়ে হাসে। হাসেন কর্তামাও। স্বর্ণ তো জানে না কীসের টানে এই বুড়ো বয়সে এসে হঠাৎ এমন অক্ষর পরিচয়ের ঝোঁক! ভাগ্যিস চিঠিগুলো এত বছর ধরে যত্নে রেখেছেন। আর মাত্র ক-টা দিন, তারপর আবার নতুন করে কর্তাকে কাছে পাবেন এত বছর পর।


‘ফিরে পড়া গল্প’ বিভাগে প্রকাশিত গল্প সংকলন থেকে গল্প তুলে আনছি আমরা। সম্পাদকের পছন্দ অনুসারে সৃষ্টি-র এই সংখ্যায় রইল সঙ্গীতা দাশগুপ্তরায়-এর ‘অপার বসন্ত’ গল্প সংকলন থেকে একটি গল্প। বইটি অনলাইন অর্ডার করা যাবে এখানে