পরিপূরক

সরিতা আহমেদ

(১)

ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল। এই নিয়ে তিন বার চেষ্টা করলাম। তাহলে কি, ওরা ও বাড়িতে থাকে না আর! কিন্তু আজ যে ভীষণ কথা বলতে ইচ্ছে করছে, বারবার মনে হচ্ছে ও বাড়ির একজন কেউ জানুক, আমি পেরেছি।
বিকেলের এই সময়টায় যখন কমলা রঙের সূর্য ব্যালকনির এই অংশে পড়ে তখন আবাসনের গেটের দু-পাশের বোগেনভ্যালিয়াগুলো অদ্ভুত সেজে ওঠে। ওদের দিকে চাইলেই কেন জানি না বাবার কথা মনে পড়ে খুব। আমাদের বাড়ির দু-পাশেও ঠিক এমনই দুটো গাছ ছিল। ঋদ্ধি আর আমি ছোটবেলায় ওর তলায় কত খেলেছি, ফুল কুড়িয়েছি। বাবার হিরো সাইকেলটা ওই গাছদুটোর নিচেই দাঁড় করানো থাকত। কতবার ঋদ্ধিকে পেছনে বসিয়ে সেই সাইকেল নিয়ে এদিক ওদিক বেরিয়ে পড়েছি প্রায় দুপুরেই। মা যখন বকুনি দিত, তখনও কতবার যে ওটার তলায় গিয়ে চুপ করে বসে থেকেছি, টুপটাপ গোলাপি কাগজের মতো ফুলগুলো ঝরে পড়লে মনে হত আমার চাপা কষ্টগুলো ওদের সাথেই ঝরছে। নাহ, কান্না ব্যাপারটা আমার ছোট থেকেই আসে না তেমন। ওসব ঋদ্ধির ঘন ঘন হত। আমার যখন খুব মন খারাপ হয়, তখন চুপ করে বসে থাকি। এই যেমন এখন।
বরানগরের আমার এক কামরার এই ভাড়া ফ্ল্যাটে ওরা সাতজন হই হই করছে ওপাশে। আজ আমি নতুন চাকরিতে জয়েন করলাম। একটা স্পেশাল চাইল্ডদের স্কুল। ভেবেছিলাম মানবাধিকারের পরাকাষ্ঠাধারী পাশ্চাত্যের আদবকায়দা মাখা এই স্কুলে হয়তো আধুনিক উদারনৈতিক মানদণ্ড থাকবে। ভুল ভেঙেছিল ইন্টারভিউয়ের দিন। বিগত ইন্টারভিউ বোর্ডের মতো অত কদর্যভাবে না হলেও ‘জেন্ডার’ কলামে ‘আদারস্‌’ লেখা নিয়ে শ্লেষাত্মক দাঁতনখগুলোর শান পরীক্ষা হয়েছিল তির্যকভাবেই। ভেবেছিলাম এবারেরটাও হবে না। কিন্তু কীভাবে যেন উতরে গেলাম। আজ পড়ানোর প্রথম দিনে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই গিয়েছিলাম। যতই হোক বয়সে কাঁচা হলেও একঘর মানবসম্পদ নিয়েই তো দিনভর কাজ। কিন্তু নাহ, আমায় ভুল প্রমাণ করে কিশলয় কুঞ্জের নবমুকুলেরা দিব্যি ফুল-চকলেটে মেনে নিল আমায়। নিমেষে বুকের ভেতরের জগদ্দল অন্ধকার টুপ করে খসে পড়ল ওদের কলকাকলিতে। হয়তো ওদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হওয়াটাই স্বাভাবিক নিয়তি ছিল। এসব কথাই বড় বলতে ইচ্ছে করছে বাবাকে। মায়ের কাছে কত কী যে বলার আছে বনি, সুমি, লিলিদের গল্প!
ও ঘরে গ্লাসের টুংটাং শব্দ আর নানা স্বরে গান-বাজনার হুল্লোড়ের মধ্যে মন বসাতে পারছিলাম না, ঘিনঘিনে মাছির মতো মগজের খাঁজে খাঁজে অস্বস্তিকরভাবে বাড়ির কথা মনে পড়ছিল খুব। কত বছর হয়ে গেল বাড়ির রাস্তায় যাইনি, তবু কেন জানি না ফোন বাজলেই আজ মনে হচ্ছে ঋদ্ধির গলা শুনব, অথবা বাবার, অথবা মায়ের। অপেক্ষা জিনিসটা বড্ড একপেশে, অন্তহীন! আজকের দিনটাই বোধ হয় এমন ঘোলাটে। তার উপর ওই বিশ্রী ঘটনাটা! মন খারাপ করা ঘটনা আজও আমায় ওদের কথা মনে করায়— সেই কাগজ ফুলের ঝোপ, সেই স্টিকার লাগানো সাইকেল, সেই বড় পুকুরের ধারে ছিপ ফেলে অনন্ত অপেক্ষার দিনগুলো এলমেলো করে দেয় গোছানো ভাবনাদের।
সাত বছর… হ্যাঁ, দীর্ঘ সাত-সাতটা বছর হল ওদের দেখিনি। ঋদ্ধিটার পড়াশুনা কদ্দূর হল, কে জানে। আজও তো কেউ ফোন তুলল না। আচ্ছা, তবে কি ওরা ধরেই নিয়েছে ও বাড়ির বড় মেয়ে মৃত!
ও ঘরে তখন মাউথ অরগ্যানের সুর থেমে গেছে। উচ্চস্বরে সবাই হাততালি দিচ্ছে, টের পেলাম।

– কী ব্যাপার শাওন, এখানে একলা দাঁড়িয়ে যে বড়?
শুভর গলা পেয়ে চটক কেটে গেল। একহাতে ওর প্রিয় মাউথঅরগ্যান আর অন্য হাতে একটা নরম পানীয়ের গ্লাস হাতে এসে দাঁড়িয়েছে পাশে।

– এই আর কী… তা ভালোই তো বাজাচ্ছিলে, উঠলে কেন? আমি এখানে এমনিই, একটু একলা হতে ইচ্ছে হল। তাই…
চোখ থেকে কালো চশমাটা খুলে শার্টের খুঁটে মুছতে মুছতে নরম স্বরে ও বলল, “কিন্তু আজকের দিনে কি একলা থাকা মানায় ম্যাডাম! আর তুমি যেখানে নেই, সেখানে আমার সুর কেটে যাবে সেটা কি খুব অবিশ্বাস্য কিছু?”

– ধ্যাত! কী যে বলো!
আলগোছে চোখের কোনাটা মুছে বললাম।

– শোনো, যা তুমি পারো না, সেটা দেখানোর চেষ্টা কোরো না! আমি দেখতে পাই না বলে ভেব না বুঝতে পারি না। আমি জানি, মিথ্যে বলাটা তোমার আসে না, শাওন। তাই সত্যিটাই বলো, বাড়ির কথা মনে পড়ছিল?
শুভর এই কথাগুলো আমায় স্তব্ধ করে দেয়। মানুষ খোলা চোখেও যা দেখে না, আমার শুভ ওর ওই কালো চশমার পেছন থেকেই কেমন করে যে মনের ভেতর অবধি পড়ে ফেলে, আমি বাক্যহারা হয়ে যাই।

– জানো, এই সময় মা থাকলে নিশ্চয় পায়েস করে খাওয়াত। আর ঋদ্ধিটা তো কত কী কিনে দেওয়ার বায়না করত… ভাবলেই… আচ্ছা, কেন এগুলো বাস্তব হতে পারে না শুভ? এত দিন হয়ে গেল, এখনও ওরা আমায় চায় না! কী এমন দোষ আমার? সত্যি কথা বলাটা? আমার ভেতরের আমিকে মুক্তকণ্ঠে সেদিন বলেছিলাম বলে ওরা আমায় অ্যাসাইলামে পাঠাল। আমি কি সত্যিই অ্যাবনরম্যাল?

– শাওন, শাওন… প্লিজ শান্ত হও। আজ এরকম কথা একদম মানাচ্ছে না তোমার মুখে। ইউ হ্যাভ রিচড ইয়োর ড্রিম। নতুন চাকরিতে জয়েন করলে আজ, সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। সো চিয়ার আপ, ডিয়ার!

– না, শুভ প্লিজ তুমি সত্যিটা বলো। আমি কি সত্যিই অ্যাবনরম্যাল? আচ্ছা, কোনটা আনন্যাচারাল— বয়েজ কাট চুল রাখা, শাড়ি গয়নার দিকে আগ্রহ না রাখা, জিন্স-শার্ট পরা, নাকি আমার ভয়েস! আমি কেন কিছুতেই বোঝাতে পারি না, এটাই আমি। দ্য রিয়েল মি, ড্যাম ইট!

– আমি জানি শাওন। জানি বলেই তো তোমায় তোমার মতো করে চেয়েছি। সমাজ, পরিবার অনেক কিছুই বলবে। কিন্তু যে সত্যিটা তুমি জানো, আমি জানি সেটা তো অন্যদের জন্য বদলে যাবে না। তাই না!
খুব নরম স্বরে ও বলল। ওর এই গলার স্বর আমায় যেন এক সমুদ্র শান্তি এনে দেয়।

– বাট… বাট দে সে ইটস্‌ আনন্যাচারাল। নইলে আজ এতবছর বাদেও ও বাড়ির কেউ আমার ফোন তোলে না! আজকের দিনেও আমায় নোংরা শুনতে হয় বন্ধুর মুখে!

– মানে? কী হয়েছে আজ? প্লিজ টেল মি।
আমি জানি, না শুনে ও ছাড়বে না। বরাবরই শুভ আমার প্রতি এমনই প্রটেক্টিভ। মাঝে মাঝে ভাবি আমায় না দেখেই ও এত জড়িয়ে পড়েছে, দেখতে পেলে কি সত্যি ও এতটা জড়াতে চাইত। তখন হয়তো ‘ন্যাচারাল’ লোকের ভিড়ে শুভও মিশে যেত।

– আই অ্যাম ওয়েটিং শাওন, প্লিজ টেল মি।
ওর ঠেলায় বলতেই হল রায়ানের বিশ্রী আচরণের কথা।
এ নতুন কিছু না আমার কাছে; কিন্তু কাছের মানুষ বা বন্ধুদের খারাপ আচরণে বড্ড অসহায় লাগে। একটু আগেই শুভর বন্ধু রায়ান ও ঘরের হইচই থেকে উঠে এসেছিল আমার কাছে। আমি ফোন হাতে অন্যমনস্ক ছিলাম ঠিকই, তবে রায়ানের যে নেশার মাত্রা একটু বেশিই হয়ে গেছে তা বোঝা গেল ওর অসংলগ্ন কথায়— “কনগ্র্যাটস্‌ ফর ইয়োর অ্যাচিভমেন্ট, ম্যাম! উপস্‌! স্যরি স্যরি, ম্যাম তো বলা যাবে না! সো হোয়াটস ইয়োর জেন্ডার ফ্রেন্ডলি প্রনাউন? হি অর শি? টেল মি, টেল মি প্লিজ।”
ওর কুশব্দের সাথে ভক ভক করে ওর কু-ইঙ্গিতও ঝরে পড়ছিল নেশাতুর গলায়। আমি ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে দিলাম— “গেট লস্ট, ইউ মোরোন!”
বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল এই রায়ান একদিন আমাদের দুজনকে কত উৎসাহ দিয়েছিল, এগিয়ে চলার, পাশে থাকার কথা বলেছিল।

– হোয়াট! রায়ান বলতে পারল? দাঁড়াও দেখছি।
শুভর গলায় স্পষ্ট ক্ষোভ।

– না, প্লিজ শুভ। ওর সাথে ঝামেলায় যেও না। কতজনের মুখে হাত চাপা দেব আমরা! বাদ দাও।
শুভর এই শক্ত চোয়াল আমায় সত্যি চিন্তিত করে। নিজের এত প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও ও আমার হয়ে লড়ে যাচ্ছে। আর কত!
সন্ধে নামছে একটু একটু করে। ওপাশে হইচইও স্তিমিত প্রায়। সবাই উঠছে একে একে। বিশেষত যারা স্বামী-স্ত্রী এসেছে। যে যার মতো ‘বাই’ জানিয়ে চলে গেল। ব্যালকনিতে এখন আমরা দুজন। লক্ষ করলাম শুভ কাউকে প্রত্যুত্তর দিল না। ওর চোখে এখনও রাগ, রায়ানের ব্যাপারটা ও ভুলতে পারছে না। ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে আলতো স্বরে বললাম, “অ্যাই, আজ একটা নতুন টিউন আমার জন্য বাজাবে… প্লিজ!”

(২)

প্রায় একঘণ্টা হল অপেক্ষা করছি। হল কী ছেলেটার? এতক্ষণে তো চলে আসার কথা। কাল রাতে তো এই রেস্টুরেন্টেই দেখা করার কথা হয়েছে আমাদের। আজ ওর সত্যি একটা বড় দিন। ওর প্রথম রেকর্ডিং। আমি যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ও-ই জোর করে স্কুলে যেতে বলল। “সবে জয়েন করেছ, এত ঘন ঘন ছুটি নিলে চলবে কেন ডিয়ার! আর তাছাড়া তুমি সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে আমার নার্ভাস লাগবে। যখন তোমার জন্য বাজাই তখন আলাদা, কিন্তু এটায়…” বলেছিল শুভ।
অ্যাসাইলাম থেকে আমাদের যখন এক অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেদিন ওর সাথে আমার আলাপ। আমি কিন্তু সেদিন ওর মিউজিক শুনেই বুঝেছিলাম মাউথ অরগ্যান ওর প্যাশানের জায়গা। এটাকে সিরিয়াসলি নিলে শুভ অনেক দূর যাবে। তারপর কত শো, কত চেষ্টা চলল। ওই দিনগুলোয়, যখন বাড়ি থেকে কেউ আসুক এমনটা খুব চাইতাম, তখন শুভ প্রায় রোববারই আসত ওদের ছোট গ্রুপের সঙ্গে আমাদের অ্যাসাইলামে। তারপর একা আসা শুরু করল। প্রথম প্রথম একটু অস্বস্তিই হত আমার— কে না কে, হয়তো আমাকে ‘অদ্ভুত জীব’ ভেবেই দেখতে আসে! কিন্তু নাহ, বেশিদিন সময় লাগল না ধারণাটা পালটাতে। প্রতি রোববার ও আসত নতুন নতুন টিউন নিয়ে— স্পেশালি আমার জন্য কম্পোজ করা। কখন যে ওর জন্য অপেক্ষা করাটা আমার অভ্যেসে দাঁড়াল, বুঝতেই পারিনি। একটা সময় তো সবাই ভেবেই নিয়েছিল ও আমার বাড়ির লোক। গেস্টরুমে ও একমনে বাজাত আর আমি ওর মুখের প্রতিটা ভাঁজে লুকানো এক শুভবোধকে দেখতাম দু-চোখ ভরে।

– অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম, তাই না! স্যরি শাওন।
শুভর গলা পেয়ে সম্বিৎ ফিরল। কিন্তু স্বরটা আজ একটু কেমন যেন শোনাচ্ছে না!

– তা একটু বেশিই। তবু… এই তারপর বলো, কেমন কাটল আজকের দিন? রেকর্ডিং কেমন হল?

– হুম, তা হল ভালোই।
চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল শুভ।

– অ্যাই, কী হয়েছে গো তোমার? আজকে এত স্পেশাল একটা দিন। আর তুমি এমনভাবে বলছ যেন…

– তা নয় শাওন। মিউজিক সত্যিই ভালো হয়েছে। কিন্তু সকালে একটা বিশ্রী ব্যপার ঘটে গেল যে, আই স্টিল ফিল সাফোকেটিং!

– কী হয়েছে, প্লিজ বলো আমায়। মা কি আবার কিছু…

– আমি বুঝতে পারি না শাওন, কেন কেউ বুঝতে চায় না, আমি দুর্বল নই। আমার একটা জীবন আছে, কিছু স্বপ্ন আছে নিজের মতো। প্রতিবন্ধী কোটায় নিজেকে ফেলে সেই স্বপ্নগুলোকে আমি মারতে পারব না। আই হ্যাভ টু লিভ মাই ওন লাইফ, ইন মাই ওন ওয়ে! সেই জীবনে, সেই স্বপ্নে আমি কাকে জড়িয়ে বাঁচব সেটা বেছে নেওয়ার কী স্বাধীনতা থাকতে নেই?
শুভ মাথা নিচু করে একটা টিস্যু পেপারকে দোলামোচা করছে। ওর এই ভঙ্গিটা আমার খুব চেনা। কান্না আটকানোর তীব্র প্রচেষ্টা। কিছু না বলে আমি ওর হাতে হাত রাখলাম।
আমার হাতটাকে শক্ত করে ধরে ও আবার বলল, “দু-বছর হয়ে গেল, শাওন। দু-বছর। আর কবে বুঝবে মা? আমি দৃষ্টিহীন বলে কি বোধবুদ্ধিহীন নাকি? তোমার কথা যখনই বলি, মা অদ্ভুতভাবে রিঅ্যাক্ট করে, হয় চুপ হয়ে যায়, নয় প্রসঙ্গ পালটায়। কী অদ্ভুত সব কথা বলে, তোমায় বিয়ে করলে আমার ভবিষ্যৎ নাকি আরও অন্ধকার হবে। আমাদের সন্তান যদি তোমার মতো হয়, এটা ভেবেই নাকি মায়ের প্রেসার হাই হয়ে যাচ্ছে! কোনও মানে হয়? আচ্ছা, সবাই কি একসাথে থাকে বাচ্চা মানুষ করার জন্য, ডিসগাস্টিং! আর যদি সেই বাচ্চা আমার মতো অন্ধ হয়, তবে!”

– আহ, শুভ! কী যা-তা বলছ।

– না না, যা-তা কেন! বলোই না, আমার মতো সেও তো একটা অ্যাক্সিডেন্টে অন্ধ হয়ে যেতে পারে। পারে না? মা কেন বুঝছে না, আমি অসহায় নই। আমার একজন আপনজন আছে, যে আমায় কমপ্লিট করে…
শুভকে এত অস্থির, এত ক্ষুব্ধ আমি আগে কখনও দেখিনি। চেয়ার থেকে উঠে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “শশহহ… শান্ত হও, প্লিজ… হুম, আমি বুঝতে পারছি তোমার প্রতিটা শব্দ। কিন্তু মায়ের দিক থেকে যদি দেখো, দেখবে এটা ওনার কোনও দোষ না। উনি একা নন যিনি এ ধরনের কথা ভাবেন আমায় নিয়ে। আমাদের সমাজে ক-জন এমন উদার মানুষ আছেন, যিনি আমার মতো একজনকে পুত্রবধূ করে ঘরে তুলবেন? এতদিনের লড়াইয়ে আমি বুঝেছি, আমাদের মতো মানুষদের যেমন কঠিন পরিস্থিতির সামনে পড়তে হচ্ছে, ওনারও তাই। ইটস্‌ নট ইজি ফর হার টু! একটু বোঝার চেষ্টা করো শুভ।”
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ও বলে উঠল, “মানে, কী বলতে চাইছ তুমি! মায়ের কথামতো আমি সবকিছু শেষ করে দিই?”

– মোটেই না, আমাদের ওনাকে বোঝাতে হবে ওনাদের মতো করে। আচ্ছা, আমি কি একবার ওনার সাথে কথা বলব?
শুভ কিছু বলল না, শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে আমার হাত দুটো আরও শক্ত করে ধরল। ইতিমধ্যে কফি চলে এসেছে। পরিবেশ হালকা করতে আমি গলা ঝেড়ে বললাম, “আচ্ছা, আজ কিন্তু একবার মেডিকেয়ারে যেতে হবে। ডক্টর রায়ের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে ঠিক সাতটায়। মনে আছে তো?”
শুভ শান্ত বালকের মতো মাথা নাড়ল। কাপ থেকে মুখ তুলতেই দেখি ওর ঠোঁটের ওপরে কফির রেখা গোঁফের মতো ফুটে উঠেছে। হেসে ফেললাম। ওর রাগ, ওর হাসি, ওর উদ্দাম সুরে মিনিটের পর মিনিট ধরে মাউথ অরগ্যান বাজানো, ওর ছেলেমানুষি— সবটাই এত মনকাড়া যে, কেউই বোধ হয় বেশিক্ষণ ওর প্রতি অনুযোগ করতে পারে না। টিস্যু দিয়ে মুখটা মুছিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “থ্যাঙ্কু, মাই সুইটহার্ট!”

(৩)

আজ ২২শে শ্রাবণ। আকাশের মুখ ভার, এমন ‘ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে’ শুভদের বাড়িতে মুখোমুখি বসে আছি আমরা তিনজন। উঁহু, ঠিক তিনজন নয়। চারজন। টেবিলের উপর ওই যে ছবিতে উনিও রয়েছেন হাসিমুখে। আজ শুধু রবি ঠাকুরের নয়, শুভর বাবা শ্যামল সাহারও প্রয়াণ দিবস। আজ ওঁর বার্ষিকী। অতিথি অভ্যাগতরা চলে গেছেন অনেকক্ষণ। আমি আজ শাড়ি পরতে চেয়েছিলাম, কিন্তু শুভ বলল, “তা কেন, তুমি যেমন তেমন ভাবেই এসো। তোমায় কাউকে কিছু প্রমাণ দিতে হবে কেন?” অগত্যা কুর্তি–জিন্সেই আসতে হল, সাথে ছোট একটা টিপ।
কাকিমা ওপাশের সোফায় বসে আছেন, হাতে একতাড়া কাগজ। পাতা উলটাতে উলটাতে বারবার উনি তাকাচ্ছেন আমাদের দিকে। বেশ বুঝছি, কিছু একটা বলতে চাইছেন, কিন্তু শুভর মুখ চেয়ে পারছেন না। আমি ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে ওঁর পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম, “কিছু বলবে কাকিমা? প্রেশক্রিপশানগুলো দেখে কী মনে হচ্ছে?” প্রশ্ন শুনে ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকালেন অশীতিপর মহিলা।
তারপর আস্তে আস্তে বললেন, “কী বলব, কিছুই যে বুঝতে পারছি না। তুমি… তোমরা… কতদিন ধরে এসব… এ-ও কি সম্ভব!”
আস্তে করে ওঁর হাতখানা ধরে আমি বললাম, “কেন সম্ভব নয় বলো। চিকিৎসাবিজ্ঞান কত এগিয়ে গেছে, জানো? সেই কবে কোন ডাক্তার জবাব দিয়েছিল বলে সেটাই তো ফাইনাল কিছু নয় বলো। আমার স্কুলে একজন কলিগের মুখে ডক্টর রায়ের কথা শুনেছিলাম। বিখ্যাত আই স্পেশালিস্ট। প্রচুর জটিল কেসে উনি ধন্বন্তরির মতো সাফল্য পেয়েছেন। গত তিনমাস ধরে আমরা ওনাকে ট্রাই করেছি, কিন্তু উনি ছিলেন বিদেশে। আমাদের পাঠানো মেইলে শুভর কেস হিস্ট্রি সবটাই উনি জানতেন। পরশু ওনার ডেট পেয়েই চেম্বারে গিয়েছিলাম। যাই হোক, আই ডোনার পাওয়া গেছে যখন, তখন আর চিন্তা নেই— এটা আমার কথা না, খোদ ডাক্তারের কথা।” শুনতে শুনতে লক্ষ করলাম ওঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
আমার হাতখানি চেপে ধরে বললেন, “আমার শুভ আবার দেখতে পাবে? অ্যাঁ! সত্যি বলছ তুমি? কিন্তু… সে তো প্রচুর খরচ। অত টাকা…”

– খরচ যে হবে সেটা তো জানা কথাই। তবে এ নিয়ে অযথা তুমি চিন্তা কোরো না। তোমার পক্ষে যেটুকু সম্ভব দিও। বাকিটা না হয় আমি লোন নিয়ে নেব। আফটার অল তোমার ছেলেকে যে কথা দিয়েছি পাশে থাকার। ওহ, আরেকটা খবর, ওর লাস্ট কনসার্টের ভিডিও দেখে একজন বিখ্যাত মিউজিশিয়ান অফার লেটার পাঠিয়েছে, জানো! দু-মাস বাদেই ওকে ব্যাঙ্গালোর যেতে হবে। আমরা চাই তার আগেই ওর দৃষ্টি ফিরুক। কত ভালো ব্যাপার হবে বলো তো।
কথা শেষ হতেই দেখি কাকিমার চোখে জল, আঁচলের খুঁটে চোখ মুছছেন। শুভ সেটা বুঝতে পেরে, উঠে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “একটা ভালো খবর, তাও তুমি কাঁদছ মা…”
মুখের কথা শেষ হতে না হতেই বৃদ্ধা জড়িয়ে ধরলেন ছেলেকে। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, “তোমায় কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই, মা। অনেক কটু কথা বলেছি তোমায় নিয়ে। শুভ আঘাত পেয়েছে। আমি… ঠিক জানি না কেন… আসলে তোমাদের নিয়ে বাইরের সমাজ…”

– আমি সবটা বুঝি কাকিমা। তুমি, তোমার দুশ্চিন্তা সবটা তাদের নিজেদের জায়গায় হয়তো ঠিক। তবে কী জানো, আমাদের জানার বাইরেও এক পৃথিবী মানুষ বাঁচে তাদের নিজ নিজ দোষ-গুণ নিয়ে। লড়াই তো তুমিও করেছ, শুভও করছে, আমরা সবাই করি নিজের মতো করে। তবে কিছুজনের প্রতি সমাজ একটু বেশিই কৃপা করে। তাদের লড়াইটা তাই আরও কঠিন হয়ে যায়। এই যেমন আমি। আমাকে তোমার মনের মতো করে গ্রহণযোগ্য করার জন্য কী করতে হবে তা আমার জানা নেই। শুধু এটুকু বলব, তোমার ছেলের পাশ থেকে সরে যেতে পারব না কোনোদিন।”
উলটো দিকের সোফায় তাকিয়ে দেখি শুভ নেই। বারান্দায় ওর অস্পষ্ট অস্থির অবয়বটার দিকে চেয়েছিলাম, হঠাৎ স্পর্শে চমকে উঠে দেখি কাকিমা আমার হাতে তাঁর নিজের বালাজোড়া পরিয়ে দিচ্ছেন। এটার জন্য একদম প্রস্তুত ছিলাম না, তাই মুখ দিয়ে বেরিয়েই গেল— “এম্মা! এসব কী করছ…”

– আজ আমায় বাধা দিও না, মা। আশীর্বাদ করি, তোমার সুখী হও।

আমি শ্রাবণী মিত্র, যে হাজার লড়াই দাঁতে দাঁত চেপে সয়েছে, কিন্তু কোনোদিন প্রকাশ্যে কাঁদেনি, টের পেলাম নোনা জলের স্রোত নামছে গাল বেয়ে। আমার হাতে বালা-চুড়ি বা গয়না— সত্যি বড্ড বেমানান, তবু আজ ভেতরটা কেন যেন বড্ড হালকা লাগছে। মায়ের কথা আবারও মনে পড়ল।
কিছু পরে বারান্দায় গিয়ে দেখি শুভ আপন মনে সুর তুলেছে— ‘তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্ত রাতে/ আমার ভাঙল যা তা ধন্য হল চরণপাতে।’ চোখ বন্ধ করে ও যখন বাজায়, তখন মনে হয় পৃথিবীতে অসুন্দর বলে যেন কিছু থাকতে পারে না। বাজানো শেষ হলে, ধীরে ধীরে ওর হাতটা তুলে আমার হাতের বালাজোড়ার উপর রাখলাম। প্রথমে ও বেশ চমকে গেল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওগুলো স্পর্শ করে আমায় বুকে টেনে নিয়ে কোনোক্রমে ও বলল, “আমরা তাহলে পেরেছি শাওন।” ওর বুকে মাথা রেখে বললাম, “হুম, কিছুটা পেরেছি। এখনও অনেক পথ হাঁটা বাকি। আমাদের যে পারতেই হবে শুভ। সামনে একটা নতুন সূর্যোদয় দেখতে হবে না!”
বাইরে তখন বৃষ্টি থেমে আকাশ ফরসা হচ্ছে ধীরে ধীরে।

একটি বাসি এবং বাজে ঘটনা

কিশোর ঘোষাল

হাওড়া দু-নম্বর প্ল্যাটফর্ম এখন যুদ্ধক্ষেত্র। ট্রেন ঢুকলেই যেমন হয়, গেটের সামনে তুমুল ধস্তাধস্তি। একদল “আরে, নামতে দিন, নামতে দিন, কী সব লোক রে, বাবা? নামতে দেবেন না নাকি?” বলে নামার জন্যে হাঁকপাঁক করছে। আরেকদল “একপাশ দিয়ে নামুন না, কত জায়গা লাগে নামতে?” বলে কনুইয়ের গুঁতো মেরে ঠেলে উঠছে। তাদের সঙ্গে আমরাও উঠে পড়লাম। আমি, আমার বন্ধু অভ্রময়। ভেতরে ঢুকে দুটো সিট দখল করতে যাব, ফুটবলের মতো গোল বয়স্কা এক মহিলা আমাকে ধাক্কা দিয়ে বেদখল করে নিলেন সিটদুটো। একটায় নিজে বসে, অন্য সিটে ব্যাগ চেপে, চেঁচাতে লাগলেন, “ভালো, অ্যাই ভালো, বাসি, অ্যাই বাসি।”
হাতের সিটটা ফস্কে গেল, কিন্তু বয়স্কা মহিলার সঙ্গে বিবাদ করাও চলে না। আমরা গোমড়া মুখে দাঁড়িয়েই রইলাম সামনে। এখন মহিলার ওই ডাক শুনে, আমি অভ্রকে বললাম, “এই বয়সেও ভালোবাসার খোঁজ করছেন!” অভ্র খুকখুক হাসল।
ভদ্রমহিলার কানে কথাগুলো না যাওয়ার কথা নয়, তিনি মুখ তুলে ভুরু কুঁচকে আমাদের দুজনকে নিরীক্ষণ করলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। ওঠা-নামার ধস্তাধস্তি এখন আর নেই, একটি মেয়ে মহিলার সামনে এসে দাঁড়াতে, হাতের ব্যাগ সরিয়ে মহিলা মেয়েটিকে বসতে দিলেন, আর জিগ্যেস করলেন, “ভালো কোথায়? উঠেছে?”
মেয়েটি ঘাড় নাড়ল, মৃদুস্বরে উত্তর দিল, “উঠেছে, ওই তো দাঁড়িয়ে আছে।”
“দঁড়িয়ে কেন? কোথাও একটু বসার জায়গা করতে পারল না?”
“আহ মা, এইটুকু তো যাব, তার জন্যে…”
“চুকঃ, তোদের শুধু আলসেমি, একটু উয্‌যোগ নিলেই সিট পাওয়া যায়। বললাম, আমার সঙ্গে উটে আয়, তা না, তোরা সেই উটের মতো দাঁড়িয়েই রইলি।”
“ও, আর দশ মিনিটের জন্যে এই বসাটা আলসেমি নয়?”
“চুকঃ, মুকেমুকে তক্কো করিস না।” মা আর মেয়ে সিটে গুছিয়ে বসল। তারপর মেয়েটি আমার দিকে তাকাল। আর সেই দৃষ্টিপাতে আমার যে অনুভূতি হল, সেটা বাসি নয়, যথেষ্ট টাটকা। বাসি মুচকি হেসে লাজুক চোখ নামাল, কিন্তু বাসির মা আমার দিকে এবার মুখ তুলে তাকালেন, বললেন, “এই বয়েসে আমি ভালোবাসা খুঁজিনি, বুঝেছ ডেঁপো ছোকরা? আমার ছেলের নাম ভালো, আর এই মেয়ের নাম বাসি। মা-কাকিমাদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটাও শেখোনি? যাবে তো অনেকদূর, নাকি?” অভ্র কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমি ওর হাত চেপে ইশারা করে বললাম, “হ্যাঁ, অনেকটাই দূর।”
মহিলা একটু ব্যাঁকা হেসে বললেন, “সে আমি দেখেই বুঝেছি। আমরা নামব এই উত্তরপাড়ায়, তখন আরাম করে বসে যেও।”
মাকে কনুইয়ের ঠেলা দিয়ে, মেয়ে মৃদু স্বরে বলল, “মা, চুপ করো না।”
“চুকঃ, চুপ করে থাকলে সবাই মাথায় চড়ে যায়।” এই সময় ভোঁ শব্দ করে ট্রেনটা ছাড়ল। বাসির মা জিগ্যেস করলেন, “লেট করল না? ক মিনিট দেখ তো।”
বাসি ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখে বলল, “ন-টা বাইশ।”
“তার মানে, পাঁচ মিনিট লেট! হ্যাঁ রে বাসি, সাড়ে দশটার মধ্যে পৌঁছতে পারব তো?”
“আরামসে পৌঁছে যাব, মা। টেনসান কোরো না তো।”
“চুকঃ। টেনসান করব না? তোদের কালকে সন্ধেতেই চলে আসতে বললাম, শুনলি না। জানতাম এটাই হবে। সকালে তোদের ঘুম ভাঙাতে ছেনি-হাতুড়ি ঠোকার অবস্থা!”
“মা? কী হচ্ছে কী? এটা ট্রেন!”
“চুকঃ, ট্রেন তো কী হয়েছে? আমি কখন বললাম যে এটা বাস?”
বাসির অস্বস্তি অনুভব করে, আমি কথা ঘোরানোর জন্যে বললাম, “কাকিমা, আমাদের কী দেখে বুঝলেন, আমরা অনেক দূরের যাত্রী?”
আমার এই আচমকা প্রশ্নে মহিলা একটু থতমত খেলেন, বললেন, “ইয়ে, মানে, ও আমি তোমাদের চেহারা, আচার-ব্যাভার দেখেই বুঝে গেছি। ডেঁপো আর ফক্কর।” হালুয়ার রেললাইনের জটিলজট ছাড়িয়ে ট্রেনের সবে একটু স্পিড উঠেছিল, আবার কমতে লাগল, লিলুয়া আসছে। আমি খুব নিরীহ মুখ করে জিগ্যেস করলাম, “দূরের ছেলেরা ডেঁপো আর এদিককার, মানে উত্তরপাড়ার ছেলেরা খুব লালু হয় বুঝি?”
“লালু মানে?”
“ডেঁপোর উলটো। ব্যাকরণে যাকে বিপরীতার্থক শব্দ বলে।”
মহিলা রাগ-রাগ গলায় বললেন, “মোটেও তা নয়, লালু মানে নিশ্চয়ই খারাপ কিছু।”
ভিজে বেড়ালের মতো আমি বললাম, “না, কাকিমা, লালু মানে ভালো।”
মহিলা এবার সত্যি রেগে গেলেন, বললেন, “আমার ছেলে ভালো, তুমি তাকে বলছ?”
উত্তরে আমি বললাম, “ভালো ভালোই তো, ভালো নয়?”
লিলুয়া পার হয়ে ট্রেন আবার দৌড়তে শুরু করল, মহিলা বললেন, “ভালো ভালো তো বটেই, ওর মতো ভালো আর হয় না।”
বাসি বলল, “মা, বাজে না বকে, একটু থামো না।”
“চুকঃ, বাজে বকছি মানে? আমার বাপু পেটে-মুখে এক কথা, যা বলার মুখের ওপর বলে দিই। সত্যি বলব তাতে ভয় কী?”
“ঠিকই বলেছেন। দূরের স্টেশনের ছেলেরা ডেঁপো আর বাজে। ট্রেনের গার্ডবাবুর ঘণ্টাটাও বাজে। ট্রেন যত দূরদূর যায়, ঘণ্টাটাও ততবার বাজে। এই বেলুড় ছাড়ার সময় দেখবেন, উনি ঘণ্টা বাজিয়ে দেবেন।”
মহিলা চোখ সরু করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
বললেন, “তার মানে? ঘণ্টা বাজার সঙ্গে বাজে ছেলের কী সম্পর্ক?”
বাসি ছোট্ট রুমালে হাসি মুছল। আমি বললাম, “সম্পর্ক নেই কাকিমা? দুটোই তো বাজে। ঘণ্টাটা আর দূরের ছেলেগুলোও…” আমার কথা শেষ হবার আগেই ঝালমুড়ির টিন নিয়ে ‘ঝালমুড়ি-ই-ই-ই’ এলেন। আমি কথা না বাড়িয়ে বললাম, “কাকিমা, ঝালমুড়ি খাবেন? বাসি নয়, টাটকা, বেশ ভালো ঝালমুড়ি। পাঁচটা দিন তো, দাদা।”
শেষ কথাটা আমি মুড়িওয়ালাকে বললাম। মহিলা খুব অবাক হলেন, আমার সাহস দেখে; রেগেও গেলেন খুব, বললেন, “ঝালমুড়ি বাসি কী ভালো সে আমি খুব জানি। তোমাকে আর ডেঁপোমি করতে হবে না।”
বাসি এবার হাসতে হাসতে বলল, “আমি কিন্তু ঝালমুড়ি খাব, মা। সকালে তাড়াহুড়ো করে বের করে আনলে, খিদে পেয়েছে।”
বাসির সমর্থন পেয়ে ঝালমুড়িওয়ালা নারকেল তেলের সাজানো ডাব্বাগুলো থেকে, দড়িতে বাঁধা ঢাকনাগুলো খুলে ফেলল চটপট। তারপর মাঝের বড় টিনের ডাব্বার ঢাকনা খুলে, স্টেনলেস স্টিলের মুড়িমাখা ডাব্বার মধ্যে মুঠো মুঠো মুড়ি তুলতে লাগল। এর পর শুরু হল, নানান ডাব্বা আর চামচের জলতরঙ্গ, তার সঙ্গে লাগাতার প্রশ্নমালা! পেঁয়াজ দেব? হুঁ। ধনেপাতা? হুঁ। শসাকুচি? না। কাঁচালংকা? কম। আচারতেল? হুঁ। ঝালমুড়িওয়ালা আর বাসির এই আলাপ আমি মন দিয়েই শুনছিলাম, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। সব বক্কাল দেওয়ার পর, মুড়িমাখা ডাব্বার মধ্যে চামচ আর হাতের বিপুল ঠনঠন মিশ্রণের আওয়াজ যখন চলতে লাগল, আমি অভ্রকে বলতে বাধ্য হলাম, “মুড়িমাখার এই ডাব্বাটা আর চামচেটাও তো দেখছি বাজে!”
পকেট থেকে পঞ্চাশটাকা বের করতেই, মহিলা বলে উঠলেন, “অ্যাই, তুমি টাকা দেবে না!”
“কাকিমা, আমরা বাজে, কিন্তু আমাদের নোট কাগজের, ওগুলো বাজে না। ঝালমুড়ির কথা আমি বলেছিলাম, দাম আমিই দেব।”

উত্তরপাড়া অব্দি আর কথা হল না, মুড়ির ঠোঙা শেষ হল। মহিলা ভালোছেলে এবং বাসিমেয়েকে নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমরাও। মহিলা মেয়েকে বললেন, “বাসি, ব্যাগট্যাগ সব নিয়েছিস তো?”
“নিয়েছি মা।”
“ক-টা বাজছে রে?”
“নটা বিয়াল্লিশ।”
“সাড়ে দশটার মধ্যে পৌঁছে যাব, বল? এখন একটা রিকশা পেলে হয়!”
“উত্তরপাড়ায় রিকশা পাওয়া যাবে না, মা? স্টেশনের বাইরে গেলেই দেখবে কয়েকশ রিকশ। তুমি এমন কথা বলো না!”
“বলা যায় না রে। কপাল মন্দ হলে… এ কী! তোমরাও উত্তরপাড়ায় নাকি? দূরে নামবে বললে?” হঠাৎ পিছন ফিরে আমাদের দেখতে পেয়ে মহিলা জিগ্যেস করলেন। আমি একটু হাসলাম, কোনও উত্তর দিলাম না। উত্তরপাড়ায় সবই তো উত্তর, কিছু প্রশ্ন আপাতত নিরুত্তরই থাক!

ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে, স্পিড কমে আসছে। বাসিমেয়ে আমার পাশে। সামনে কাকিমা আর ভালোছেলে। আমার পিছনে অভ্র। বাসি মুখ তুলে খুব মৃদুস্বরে যা বলল, শুনে আমি মৃদু হাসলাম। আমি বাসির ব্যাগ ধরা হাতটা আলতো ধরে, একটু চাপ দিলাম। বাসি মুখ তুলে তাকিয়ে, মুচকি হাসল।

ট্রেন থেকে নামা-ওঠার ভিড়ে আমি আর অভ্র প্ল্যাটফর্মে নেমেই, প্রায় দৌড়ে রিকশাস্ট্যান্ডে চলে এলাম। রিকশায় উঠে বিধানজেঠুর বাড়ির ঠিকানা বলতেই, রিকশা ভেঁপু হাঁকিয়ে দৌড়ে চলল। অভ্র এতক্ষণে কথা বলার সুযোগ পেল, বলল, “তুই যে এত ধুরন্ধর জানতাম না, শালা। এই ক-মিনিটের মধ্যে মেয়েটাকে পটিয়ে ফেললি? তাও শুধু ঝালমুড়ি খাইয়ে?”
আমি মুচকি হেসে বললাম, “দেখিস, জেঠু যেন জানতে না পারেন!”
“সে ঠিক আছে, জানতে পারবেন না। কিন্তু তুই তো শুধু নামটাই জানলি, ফোন নম্বর, ঠিকানা কিছুই জানলি না!”
“সে হবে-খন, ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? দাঁড়া, জেঠুর বাড়ি খালি হাতে যাব নাকি? ভাই, ভালো মিষ্টির দোকান দেখে একটু দাঁড়াবেন তো, মিষ্টি কিনব!” শেষ কথাটা রিকশওয়ালাকে বললাম।
রিকশওয়ালা প্যাডেল করতে করতে বলল, “সামনেই রাধাগোবিন্দ সুইটস পড়বে। ওতোরপাড়ায় ওরাই নাম করা মিষ্টি বানায়।”
“সেই ভালো, কিন্তু বাসি হবে না নিশ্চয়ই।”

জেঠুর বাড়িতে ঘণ্টাখানেক বসলাম। চা জলখাবার আর কিছু কথাবার্তার পর জেঠু বললেন, “চল তাহলে, ব্যাপারটা মিটিয়েই আসি। বাকি কথা দুপুরে খাওয়ার সময়ও সেরে ফেলা যাবে।”
বেরোনোর সময় জেঠিমাকে আরেকবার প্রণাম করলাম, আমার চিবুক ছুঁয়ে চুমো খেয়ে জ্যেঠিমা বললেন, “আমাদের ছেলেকে যে মেয়ে অপছন্দ করবে, তার কপালে অনেক দুঃখ আছে। তবে নবস্মিতাও খুব ভালো মেয়ে, বাবা। আমি বলছি দেখিস, তোদের জুড়ি খুব মানাবে!” আমি লজ্জা লজ্জা মুখে হাসলাম।

বড়রাস্তা পার হয়ে, গলিতে ঢুকে প্রথমবার বাঁদিকে, তারপর একটু এগিয়ে ডানদিকে ভাঁজ নিয়ে, বেশ খানিকটা গিয়ে জেঠু একটা বাড়ির দরজায় বেল টিপলেন। দরজায় নেমপ্লেট সাঁটানো, অমিয় চট্টোপাধ্যায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এক ভদ্রলোক দরজা খুললেন। বললেন, “আরে আসুন, আসুন বিধানদা। এসো বাবা, ভেতরে এসো। শুনছ, ওঁরা সব এসে গেছেন।” শেষের কথাটা উনি চেঁচিয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে বললেন।
আমরা তিনজন বাইরের ঘরের বড় সোফাটায় বসলাম। ভদ্রলোক বসলেন উলটোদিকের সোফায়। অমায়িক হেসে জিগ্যেস করলেন, “আসতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো, বাবা?”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “জেঠুর বাড়ি থেকে আপনাদের বাড়ি তো হাঁটা পথে দশ মিনিট, জেঠুর সঙ্গেই এলাম, অসুবিধে হবে কেন?”
“না না, তা নয়। আমি বলছিলাম কলকাতা থেকে আসার কথা। অনেকটাই তো দূর।” এই সময়েই ট্রেনের সেই মহিলা আর ভালোছেলে ঢুকল। আমি অবাক হইনি, কিন্তু ওঁরা হলেন, আর আমার পাশে বসা অভ্রও। অভ্র সোফা ছেড়ে লাফিয়ে উঠল, “আপনি?”
কাকিমা বললেন, “তোমরা? এই অব্দি হানা দিয়েছ? বিধানদা ওরা আপনার সঙ্গে এসেছে?”
জেঠু বললেন, “হ্যাঁ। কথাই তো ছিল, ওরা তোমাদের সঙ্গে, নবস্মিতার সঙ্গে আলাপ করতে আসবে! তুমি চিনতে পারোনি?”
কাকিমা বললেন, “না। ইয়ে হ্যাঁ, চিনি মানে… কলকাতা থেকে সকালে আমরা একই সঙ্গে এলাম। কিন্তু ছবিতে তো অন্যরকম দেখতে ছিল।”
জেঠু হো হো করে হেসে উঠে বললেন, “ছবিতে ওর গালে দাড়িগোঁফের জঙ্গল ছিল, এখন মরুভূমি। বাজের ওইরকমই আজে বাজে কাণ্ডকারখানা।”
“বাজে? এই ছোঁড়া আমাকে সারা রাস্তা বাজে কথা শুনিয়ে এসেছে, এখন আপনিও বাজে বলছেন?”
“আরে ওর নাম বজ্রপাণি, আমরা বাজে বলে ডাকি।” জেঠু বললেন।
আমিও চুপ করে থাকতে পারলাম না, বললাম, “নবস্মিতা যদি বাসি হতে পারে, তাহলে আমি বাজে হতে পারি না, কাকিমা?”
এই কথায় কাকিমা হইহই করে হেসে উঠলেন, সঙ্গে বাকি সবাই, আর তখনই বাসি চায়ের ট্রে আর বিস্কিট নিয়ে ঢুকল। সকলকে চা দিয়ে বাসি বসল উলটোদিকে, বাবার সোফার হাতলে।
কাকিমা বললেন, “তুই কি ওকে চিনতে পেরেছিলি, বাসি?”
বাসি লাজুক মুখে ঘাড় নেড়ে সায় দিল।
“আমাকে বললি না কেন?”
উত্তরটা আমিই দিলাম, “আপনি বলতে দিলে তো? আপনার চুকঃ-র ঠেলায় সুযোগ পেল কখন?”
“ও বাবা, এখন থেকেই এত আন্ডারস্ট্যান্ডিং?” কাকিমা মুচকি হাসলেন।
অভ্র এবার মুখ খুলল, “তাই তোদের দুজনের মধ্যে এত চোখাচোখি… ইশারা?”
আমি বললাম, “চুকঃ, হাটে হাঁড়ি ভাঙছিস! তোর আর বুদ্ধিশুদ্ধি হল না।”
এতক্ষণ খেয়াল করিনি, এখন করলাম, চুকঃ কথাটা মন্দ না, বেশ পাওয়ারফুল এবং এফেক্টিভ!
আমি বাইরে থাকি, দুদিন হল বাড়ি এসেছি। জেঠিমার ঘটকালিতে আমাদের বিয়েটা মোটামুটি পাকা। কিন্তু আমার মা-জেঠিমার নির্দেশ, বিয়ের আগে পাত্রপাত্রীর নিজেদের মধ্যেও চাক্ষুষ পরিচয়টা জরুরি। আর সেই উদ্দেশেই আজ আমাদের উত্তরপাড়ায় আসা।
আমাদের ট্রেনযাত্রার সব কথা শুনে জেঠু হাসতে হাসতে বললেন, “আমদের বাজেটা আসার পথেই বাসি আর বাজে একটা ব্যাপার ঘটিয়ে ফেলেছে দেখছি। মনে হচ্ছে এ একেবারে প্রজাপতির নির্বন্ধ। কী বলো অমিয়?”
“এই বাজে ঘটনাটা যাতে কিছুতেই বাসি না হয়ে যায়, সেটা দেখা এখন আমাদের কর্তব্য। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা, আমি কিন্তু আপনাকে আর কোনোমতেই বিধানদা বলতে পারব না… সে আপনি যাই মনে করুন।”
জেঠু অবাক হয়ে বললেন, “সে কী! কেন?”
অমিয়বাবু গম্ভীরভাবে আমাদের এবং জেঠুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, কোনও উত্তর দিলেন না। একটু পরে আমাদের আশ্চর্য হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন, “আপনাকে আর রেহাই দেব না, বিধানদা, আপনাকে এখন থেকে বেহাইদা বলব!”
জেঠু স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললেন, “তাই বলো, আমি ভাবছি কী না কী!” তারপর তিনজনেই খুব হাসতে লাগলেন।
আমি বাসির দিকে তাকালাম, ও আমার দিকেই তাকিয়েছিল, চোখাচোখি হতে লাজুক চোখ নামাল।

তিনশ ষাট ডিগ্রি

অগ্রদীপ দত্ত

আজ একটু বেশিই ভিড়। ভিড় হওয়াটাই অবশ্য স্বাভাবিক। আজ মেলার শেষ দিন। সার্কাস, মওত কা কুয়া, চিত্রহার, নাগরদোলাসহ মেলার সমস্ত স্টলগুলো চুটিয়ে ব্যবসা করছে। এই ব্যবসা চলবে রাত দুটো-আড়াইটা অবধি। ঘড়িতে এখন সাড়ে এগারো। চারিদিকের মাইকিং ও লোকজনের আওয়াজে মাথার ভেতরটা ভোঁ ভোঁ করছে। একটা চরম অস্বস্তি নেমে আসছে মাথা থেকে পা। এই অস্বস্তিটা তিনদিন আগে থেকে শুরু হয়েছে। শরীরের ঠিক কোন জায়গাতে যে অসুবিধা, বোঝা যাচ্ছে না। তার জন্য পারফরম্যান্সেও গন্ডগোল হচ্ছে। কাল রাতে বড়সড় দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচার পর আজ আবার একই ভুল। তাই শো শেষের আগেই ইয়ামাহা আর এক্স হান্ড্রেড বাইকটা নিয়ে নিচে নেমে আসে বিকাশ। অমিত, ফিরোজরা তখনও উপরে। সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স আর ঘর্ষণকে ব্যবহার করে ফুল স্পিডে ঘুরছে কুয়োর ভেতর। শো শেষ না হতেই কাঠের কব্জা টেনে বাইরে বেরিয়ে এল সে।
কিছুক্ষণ ধরে একটা সরু লিকলিকে নালার পাশে উবু হয়ে বসে আছে বিকাশ। এখনও আরও দুটো শো বাকি। তাকে না পেয়ে অমিতরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে খিস্তিখেউড়ের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। খোঁজাখুঁজিও করছে বোধ হয়। যা-ই হয়ে যাক বিকাশ কোনোভাবেই আজ আর শো তে নামবে না। মাথাটা পুরো ঘেঁটে আছে। দু-তিনবার গলায় আঙুল দিয়ে বমির চেষ্টা করাতেও লাভ হয়নি। ‘ওয়াক’ আর লালা ছাড়া কিছুই বের হয়নি। বের হওয়ার কথাও নয়। বমি হতে গেলে পেটে কিছু থাকা দরকার। সকাল থেকে জল ছাড়া ভেতরে আর কিছু ঢোকেনি। বিকাশ ইচ্ছাকৃতভাবেই ঢোকায়নি।
মেলার মাঠের পেছনে রাস্তার দু-ধার দিয়ে পরপর অনেকগুলো হোটেল। বাইরে লেখা ‘মহাদেবের হোটেল— ডাল ভাত ৩০, মাছ ভাত ৫০’। ভেতরে ভাত কম, মাল বেচে বেশি। নিকৃষ্ট মানের মদ। এখানে সব চলে। মাল পেলেই তাল হারায় পাবলিক। এই ‘হোটেল’গুলো সারা বছর গান্ধিজির মুখ দর্শন পায় না বললেই চলে। মেলার দিনগুলোতেই রমরমিয়ে ব্যবসা। লেবার ও স্টলের লোকজন রাতে তাঁবু খাটিয়ে ঘুমোয়, আর সকালে এসে চায়ের বদলে মাল খেয়ে যায়।
দুপুরে অমিত, ফিরোজ, নায়ার আর বিকাশ এসেছিল এখানে। এরা সবাই মওত কা কুয়ায় গাড়ি চালিয়ে খেলা দেখায়। অমিত, ফিরোজ, বিকাশ বাইক আর নায়ার মারুতি এইট হান্ড্রেড। কাঠের কব্জা দিয়ে ঘেরা ষাট ফুট গভীর চোঙাকৃতি কুয়োর গায়ে বীভৎস গতিতে গাড়ি চালিয়ে চোখ ধাঁধানো সব খেলা। কখনও দু-পায়ের ফাঁকে বাইক রেখে হাত ছেড়ে দাঁড়িয়ে গোল করে ঘুরছে, তো কখনও কাত হয়ে থাকা মারুতির জানালার বাইরে বেরিয়ে আসছে ড্রাইভারের দেহের অর্ধেক অংশ, কখনও বা তিনটে বাইক ও একটা মারুতির ড্রাইভার ঘুরন্ত অবস্থাতেই একে অপরের হাত ধরাধরি করে স্টান্ট দেখাচ্ছে।
কুয়োর উপরের দিকে গোল করে রেলিং ঘেরা দুটো সারি আছে— একটার ওপর আরেকটা। পাবলিক সেই সারিগুলোতে দাঁড়িয়েই মজা নেয় জীবন-মৃত্যুর এই অসাধারণ খেলার।
খেলার সময় তাদের কনসেনট্রেশন ব্রেক করার উপায়ও পাবলিকের জানা আছে। রেলিং থেকে হাত বাড়িয়ে দশ-বিশ টাকার নোট দেখায় উন্মত্ত জনতা। আর বিকাশরা ফুল ফোর্সে ঘুরতে ঘুরতেই টাকাগুলো ছোঁ মেরে নেয়। আবার কিছু খচ্চর লোক হাত বাড়িয়ে টাকা দেখায় ঠিকই, কিন্তু ছোঁ মারার আগ মুহূর্তে নোট ধরা হাতটা ঝড়ের গতিতে পেছনের দিকে সরিয়ে আনে। এতে ডিস্ট্রাকশন আরও বেশি। এভাবে টাকা নিতে গিয়ে বেশ কয়েকবার দুর্ঘটনার খপ্পরেও পড়তে হয়েছে। আর দর্শকরা সেখানেই খুঁজে পেয়েছে বিনোদনের মুখ্য খোরাক। তবে তিনদিন ধরে বিকাশের কনসেন্ট্রেশন অন্য কারণে ভেঙে যাচ্ছে।
দুপুরে খেতে এসে অনেকক্ষণ ধরে ডালমাখা মোটা চালের ভাতগুলো একমনে টিপে যাচ্ছিল বিকাশ। তাকে অন্যমনস্ক দেখে নায়ার কারণ জানতে চেয়ে বলল, “তেরেকো কুছ হুয়া হ্যায় কিয়া?”
কী বলবে ভেবে না পেয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে ‘না’ বলল বিকাশ। নায়ার আর কথা বাড়াল না। কিন্তু পাশ থেকে অমিতের ঝাঁঝালো গলা— “তোর ইরাদাটা কী বে? শো কেন খারাপ করছিস?”
অমিতের দিকে মুখ তুলে তাকাল বিকাশ। একুশ-বাইশের টিঙটিঙে চুনোপুঁটি, তার আবার এত্ত গরম! কয়েকটা কাঁচা খিস্তি মুখ থেকে লাফিয়ে বের হতে যাবে, তখনই অমিত বলল, “সন্তোষ বলেছে আজ গড়বড় হলে এখান থেকে ফুটে যেতে। লাইনে অনেক ছেলে আছে।”
শেষ কথাটায় মাথাটা চড়াৎ করে গরম হয়ে গেল বিকাশের। ইচ্ছে করছিল এঁটো হাতে তখনই উঠে গিয়ে সন্তোষের গালে কষিয়ে এক চড় মারতে। মালিক না হলে অনেকদিন আগেই মেরে দিত। বিকাশ এই লাইনে আছে বারো বছর। বহু মেলায় ঘুরে ঘুরে শো দেখিয়েছে। বহু মালিকের দাপট দেখেছে। কিন্তু এই সন্তোষ মালটা অ্যান্টিক পিস।
বিকাশ আগে যখন শো করতে যেত, সঙ্গে থাকত সামিনা— বিকাশের বউ। ফর্সা পাতলা চেহারার সেই বউকে সঙ্গে নিয়ে মেলায় মেলায় ঘোরাটা যে মোটেও নিরাপদ নয়, তা ভালো করেই জানত বিকাশ। কিন্তু বউ বলত, “তুই গাড়ি চালাবি, আমি মুড়ি-টুড়ি বেচব। কিছু তো কামাই হবে।” সেবার সারা মেলায় ঘুরে ঝালমুড়ি বিক্রি করছিল সামিনা। পয়সাও আসছিল ভালোই। কিন্তু মুড়ির সঙ্গে অন্য কিছুও বিক্রি চলছিল…
বিকাশ জানতে পেরেছিল দিন কয়েক পর। ফিরোজই খবরটা দিয়েছিল। গভীর রাতে নদীর পাশে ঝোপে হালকা হয়ে ফিরে আসছিল ফিরোজ। হঠাৎ চোখ যায় সন্তোষের ত্রিপাল খাটানো তাঁবুর ভেতর। অন্ধকারে সামিনার মুখটা অপষ্ট দেখা গেলেও দুদিন পর তাদের হাতেনাতে ধরে ফেলে ফিরোজ।
খবরটা শুনে বিকাশ ভেবেছিল সন্তোষকে খুনই করে ফেলবে। কিন্তু তারপরই কানে ভেসে এসেছিল আরও একটা খবর।
“এই বেটি নাকি বেশ্যা।” কথাটা বলে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিল অমিত।
সন্তোষকে আর চড় মারা হয়নি। লাথিঝাঁটা মেরে জীবন থেকে বিদায় করেছিল সামিনাকে। শালিটার নাম মাথায় আসলেই গা ঘিনঘিন করে।
ডানদিকের নালাটা তাক করে এক খাবলা থুতু ছেটাল বিকাশ। থুতুটা শুকনো নালাটার গায়ে লেপটে গেল।
এখানে আলো খুব একটা আসছে না। এটা মাঠের একেবারে কোনার দিক। বাঁদিকে ঝোপঝাড় ভর্তি। সামনে কয়েকটা গাছ মাথা এলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই গাছগুলোর ফাঁকফোকর দিয়েই দেখা যাচ্ছে সার্কাসের ভিড়। অন্যান্য দিন রাতে দুটোর বেশি শো হয় না, লোক আসে না। আজ মাঠটা গিজগিজ করছে। পাঁচ নম্বর শো চলছে। ছ-নম্বরও হতে পারে। অত খেয়াল থাকে নাকি। তাছাড়া ওই সার্কাসের শোয়ের খবর রেখেই বা কী লাভ? তারা কি বিকাশকে টাকা দেবে? নাকি এক গ্লাস মদ এনে বলবে, “নে ভাই, এটা তোর খাটনির ইনাম…”
জন্তুজানোয়ার নিয়ে নাচানাচি ছাড়া আর পারেই বা কী ওরা? আর ওই লিলিপুট জোকারগুলো তো আরও বেয়াদপ। শুয়ে, গড়িয়ে, লাফালাফি করে মানুষের পেটে সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানোর চেষ্টা করে। দম থাকলে জীবন নিয়ে খেলুক। মওত কা কুয়ায় এসে বাইক-গাড়ি চালাক। গাড়ি চালাবে? গিয়ারে পা-ই পৌঁছবে না শাল্লাহ।
বিকাশের ডানদিকে কাপড় দিয়ে উঁচু করে ঘেরা দেওয়া। ঘেরার ওই পারেই চিত্রহার। ওপাশ থেকে ভেসে আসছে ঝিংচ্যাক গান আর মাইকিং-এর আওয়াজ। “আইয়ে আইয়ে ভাই অওর বেহেনো, দেখকে যাইয়ে…” বিকাশ পেছনে তাকাল। বিশাল লাইন। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকের চোখের খিদেও বেড়েছে মনে হয়। মেলার শেষদিনে প্রতিটা ব্যাটাছেলে নিজের চোখ সেঁকেই বাড়ি যেতে চায়। গানের তালে আন্দোলিত মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ লাইভ দেখার মজাই আলাদা। বিকাশের হঠাৎ মনে পড়ল ওই মেয়েটার কথা। বুকে ঠাসা নীল রঙের একটা টাইট ব্লাউজ আর হাঁটুর অনেকটা উপরে শেষ হওয়া স্কার্ট পরে নাচছিল। কী যেন নাম… রূপালি। অমিতের কাছ থেকেই নামটা জেনেছিল। রূপালিও তাহলে নাচছে এখন। ফর্সা পেট, নাভি, পাগুলো দেখে সবাই নিশ্চয়ই চোখ সেঁকে নিচ্ছে। যেমনটা বিকাশ, ফিরোজরা নিয়েছিল।
মেলার প্রথম দিন শুধু দুটো শো করিয়েছিল সন্তোষ। লোকজন আসছে না দেখে কাউন্টার বন্ধ করে পাশের চিত্রহারে মস্তি করতে ঢুকেছিল। দুটো শোয়ে কামানো টাকা দিয়ে বিকাশরাও গিয়েছিল একটু ফূর্তি করতে। ঢুকেই ওদের চোখে আগুন। স্টেজের উপর হিন্দি আইটেম গানের তালে পাঁচ-ছ-টা মেয়ে নেচে যাচ্ছে উদ্দাম। বিটের সাথে সাথে কেঁপে উঠছে তাদের ব্লাউজ ঠাসা বুক। কেউ কেউ আবার সামনে ঝুঁকে খাঁজ দেখাচ্ছে। যত ঝুঁকছে তত সিটি, হাততালি। সব ক-টা মেয়ের মধ্যে যার স্কার্টটা সবচেয়ে ছোট, পাবলিক তার দিকেই বাড়িয়ে দিচ্ছে নোট। মেয়েটা ঝুঁকে টাকাটা বুকের মাঝে গুঁজে নিয়ে আবার নাচ শুরু। ছোট্ট স্কার্টটাকে একটু উপর-নিচ করতেই আরও সিটি… টাকা। এতদিন ধরে মেলায় মেলায় ঘুরলেও এরকম দুর্ধর্ষ চিত্রহার নজরে পড়েনি তেত্রিশ বছর বয়সি বিকাশের। খালি মনে হচ্ছিল ওই ছোট্ট স্কার্ট পরা ফর্সা মেয়েটাকে যদি একটু ছোঁয়া যেত।
বিকাশের ছোঁয়া হয়নি। কিন্তু এর মধ্যেই অমিতের ছোঁয়াছানি সব শেষ। সেদিন নাচ দেখতে গিয়ে অমিত মেয়েটার চোখে কী যেন দেখেছিল। তারপর শো শেষে নাম জানাজানি, দুদিন একসঙ্গে এক হোটেলে খাওয়া, হাত ধরাধরি… প্রেম। মেলার শেষে তারা নাকি বিয়েও করবে অমিত জানিয়েছে। অমিত মওত কা কুয়ায়, রূপালি চিত্রহারে শো করবে। পয়সা ভালোই আসবে। মাখন সংসার… শাল্‌লাহ! মালটার ভাগ্য… মাথাটা আবার চড়াৎ করে গরম হয়ে গেল বিকাশের।
আরও কিছুক্ষণ এলোমেলো ভাবার পর আচমকাই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল বিকাশ। কাল সকালেই সন্তোষের কাছ থেকে পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে পক্সের স্পট বসানো রোগা কালো দেহটা নিয়ে বেরিয়ে পড়বে অন্য কোনও কাজের খোঁজে। “আমি আর কাজ করছি না” কথাটার উত্তরে সন্তোষ কী বলবে? কুকুর-বেড়ালকে বেশিদিন পুষলে মায়া পড়ে যায়, ছাড়তে ইচ্ছে করে না। ওর কি মায়া পড়েছে? যদি বলে “গিয়ে কী করবি, থেকে যা। পরের মেলায় আসল খেলা দেখিয়ে দিস…” তারপরেও কি মুখের ওপর ‘না’ বলে বেরিয়ে আসতে পারবে? শেষের কথাটা যদিও ফালতু স্বপ্ন। এসব জানোয়ার লোকের আবার মায়াদয়া হয় নাকি! তাছাড়া সন্তোষ নিজেই বলেছে খেলায় গন্ডগোল হলে ফুটে যেতে। তাই ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করার আগে নিজে থেকেই বেরিয়ে আসবে বিকাশ। আর কোনোদিনও ঢুকবে না মৃত্যু লেখা কুয়োর ভেতর।
এ সমস্ত ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়াল বিকাশ। ডানহাত দিয়ে ফুলশার্টের হাতাটা খানিকটা উঠিয়ে সস্তা রিস্ট ওয়াচের কাচের ওপর চোখ বোলাল। টাইম অনুযায়ী চললে এখন আর একটা শো বাকি। লাস্ট শো।
অস্বস্তিটা আজকে আর কমবে বলে মনে হয় না। বিকাশ তাঁবুর দিকে পা বাড়াল। তাঁবুটা মওত কা কুয়ার পাশেই। এক চিলতে ছোট্ট জায়গায় চারজনের মাথা ঢোকানোর ব্যবস্থা। এখন গিয়ে টেনে এক ঘুম লাগাবে। তারপর কাল সকাল সকাল…

দুই

কোনোরকম ভুল হচ্ছে না। নব্বই ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে দুর্দান্ত গতিতে ঘুরে যাচ্ছে ইয়ামাহা আর এক্স হান্ড্রেড। জীবনের সেরা পারফরম্যান্স দিয়ে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিয়েছে তা টের পাচ্ছে বিকাশ। কাঠের কব্জাগুলোর ওপর দিয়ে বাইকের চাকা নিয়ে যেতে যেতে বিকাশ খেয়াল করল ফার্স্ট আর সেকেন্ড দুটো রোতেই উপচে পড়া ভিড়। কানে ভেসে আসছে উত্তেজিত দর্শকদের সিটি, হাততালি, কলরব। আজ আর ছোঁ মেরে টাকা নিতে হচ্ছে না। পাবলিক খুশি হয়েই উড়িয়ে দিচ্ছে দশ-বিশ-পঞ্চাশের নোট। নোটগুলো উড়তে উড়তে কুয়োর নিচে এসে পড়ছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। নতুন একটা স্টান্ট দেখাবে এই ভেবেই কুয়োর গায়ে বাইক উঠিয়েছিল। মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েই স্টান্টটা করবে। ঘুরন্ত অবস্থাতেই বাইকের ওপর শুয়ে পড়বে। যেভাবে সামিনার ওপর সন্তোষ… বিকাশ এক্সেলারেটরে চাপ বাড়াল।

খাঁ খাঁ ফাঁকা দর্শকাসনের ফার্স্ট রো-তে দাঁড়িয়ে অমিত আর নায়ার অবাক হয়ে দেখে যাচ্ছে বিস্ময়কর স্টান্ট। গভীর রাতে বাইকের জোরালো আওয়াজ শুনেই ওরা বেরিয়ে এসেছিল তাঁবুর ভেতর থেকে। ঘুমন্ত মেলার বুকে মৃত্যুকূপের দেওয়ালে তেত্রিশ বছরের একটা জ্যান্ত মানুষ বৃত্তাকারে ঘুরে যাচ্ছে যন্ত্রের মতো অবিরাম। দেখামাত্রই সন্তোষকে ডাকতে বেরিয়ে গেছে ফিরোজ।
বাইকের এরকম অবিশ্বাস্য কায়দার খেলা দেখে পাথরের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল অমিত। ফার্স্ট রো-এর রেলিংটা শক্ত করে চেপে কুয়োর ভেতর বিকাশের চোখে চোখ পড়তেই বুক মুচড়ে উঠল তার। আচমকা মনে হল সন্তোষ এখনও এল না কেন? রূপালি কি এখন নিজের তাঁবুতেই ঘুমোচ্ছে?

প্রথম প্রকাশ – ১৮ মার্চ, ২০১৮ উত্তরবঙ্গ সংবাদ

ডানা

মাধুরী সেনগুপ্ত

ফড়িংটা কেমন যেন গোল গোল করে ঘুরছে! নাকি অর্ধবৃত্ত? আরও মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে পূর্ণিমা। এত দূর থেকে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না যদিও, কিন্তু ঘুরপাকটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে ও। ‘চোখ আর মন দুটোকে মিলিয়ে ফেলতে পারলেই কেল্লা ফতেহ!’ একদিন বলেছিলেন বাংলার শিশির দিদিমণি। একটু আগেই টিফিনের পরে অঙ্ক ক্লাসে মায়া দিদিমণি অর্ধবৃত্ত আঁকা শেখাচ্ছিলেন। বৃত্ত আঁকা অনেক সোজা, একটা গোল্লা। স্কুলের মাঠে রঙ্গন ফুলের গাছটার সামনে যে ফাঁকা জায়গাটা আছে ওখানে ওরা প্রায়ই কাঠি দিয়ে গোল আঁকত, অঙ্ক ক্লাসে মায়াদি বল্লেন সেটাই নাকি বৃত্ত! পূর্ণিমার আবার দুপুরের মিড ডে মিলের ডিমটাকেও ওই গোল মতো লাগত এতদিন। এখন বোঝে ওটা ঠিক গোল নয়। তবে একটা জিনিস ওর খুব মজা লেগেছে, ডিমেরও পেট কেটে দিলে যেমন আধা হয়ে যায় বৃত্তেরও তাই! ভাবতে ভাবতেই ফড়িংটাকে আর দেখতে পেল না পূর্ণিমা। ভয়টা যেন হুট করেই ফিরে এল।

সেই ভয়টা নিয়েই বাকি ক্লাসগুলো শেষ করল পূর্ণিমা। বারবার বাঁ’দিকের জানালাটা দিয়ে বাইরে তাকালেও আর খুঁজে পেল না কোথাও ফড়িংটাকে। তবে কি?

“পূর্ণিমা, হোমওয়ার্ক?”

হুঁশ ফিরল ইংরেজি দিদিমণির গলার আওয়াজে। কিন্তু উত্তর তো জানে না। গতকাল রাতে যখন অঙ্কের ঐকিক নিয়মের অনুশীলনী শেষ হল, তারপরেই বাবা এসে গেল, তারপর তো আর আলো পাওয়ার ব্যাপার নেই। কুপির শিশিটায় কালি পড়ে পড়ে কালো হয়ে গেছে এতটাই যে কুপির নিজের আলোতেও মাঝে মাঝে শিশিটা দেখা যায় না। দাদা আসে আরও কিছুটা পরে। তারপর দুপুরের জল ঢেলে রাখা ভাত, পেঁয়াজ আর নুন এই হল ওদের রাতের খাবার। কোনোদিন কপাল ভালো থাকলে আলুভর্তা অথবা আরও ভালো থাকলে কুচো মাছের ঝাল। ভাবা শেষ হওয়ার আগেই আবার প্রশ্ন, “হোমওয়ার্ক করে আসোনি?”

কী উত্তর দেবে বুঝে ওঠার আগেই ক্লাসের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার নিদান পায় সে। এই একটা ব্যাপারে ওর মহা সমস্যা। ক্লাসের বাইরে মানে ঠিক ওর বেঞ্চের উলটো দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াতে হবে। বারান্দায় দাঁড়ালে দুটো সমস্যা। পাশের ক্লাসের রুমকি বাড়ি গিয়েই ওর মাকে বলে দেবে পূর্ণিমা আজ পড়া পারেনি; আর দুই এই বারান্দা থেকে ওই গাছটা দেখা যায় না। পূর্ণিমা যেদিন প্রথম স্কুলে এসেছিল তখন জানত না গাছটার নাম। পরে জেনেছে গাছটার নাম রঙ্গন। গত বছরগুলোয় গাছটাও বেশ বেড়েছে তরতরিয়ে। হঠাৎ দেখলে বোঝা যায় না। কিন্তু পূর্ণিমা বুঝতে পারে, সেই গতবার স্কুলে পুজোর ছুটির আগে কোণের ডালটা থেকে ফুল পেড়ে নিয়ে গেছিল ও। একমাস পর স্কুল খোলার পর ও দেখেছিল, ডালটার পাশেই আরেকটা ছোট্ট ডাল। এখন তো গাছটা এতটাই বড় হয়ে গেছে, ক্লাসে ওর বেঞ্চের জানালাটা দিয়ে গোটা গাছটা দেখাই যায় না। আর এই ক্লাসের বাইরে থাকলে তো একটুও না। এমনি এই বারান্দা থেকে ওই গাছের পাশেই যে ঘাসের ঝোপটা আছে সেটাও দেখতে পাওয়া দুষ্কর। কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যাওয়া চিন্তাটা আবার ফেরত এল, “ফড়িংটা গেল কই?” চিন্তাটা আবার ঘুরপাক খেতে লাগল ওর মাথায়।

ক্লাস শেষে আবার ক্লাসে ঢুকল ও। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। পূর্ণিমার এই ক্লাসে একজনই বন্ধু আছে, নতুন ভর্তি হয়েছে মেয়েটি, বাবার চাকরিতে বদলির সুবাদে। ক্লাসের অন্য মেয়েদের মুখে শুনেছে মেঘসারির বাবা নাকি মস্ত সরকারি অফিসে কাজ করেন। তা সত্ত্বেও মেঘসারি যখন তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হল, শিক্ষিকা থেকে ছাত্রীকুল সবাই একটু অবাকই হয়েছিল। তা সেই মেয়ে ভর্তি হওয়া ইস্তক সবাইকে অবাকই করে চলেছে। পড়াশুনো থেকে আবৃত্তি, স্কুল ম্যাগাজিনে কবিতা লেখা থেকে কার্টুন আঁকা মেঘসারি মানেই স্কুলের শিক্ষিকাদের নয়নের মণি আর পূর্ণিমার প্রাণের সই।

অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না, মেঘসারি আসার আগে অব্দি পূর্ণিমাই ছিল এই সব সেরার সেরা। তারপর হুট করেই পিছিয়ে পড়তে লাগল ও। প্রথম প্রথম শিক্ষিকারা অবাক হতেন, বকাঝকাও করতেন তারপর বয়ঃসন্ধির বিভ্রাট ভেবে প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছেন। আর পূর্ণিমাও আজকাল স্কুলে আসে, ওই রঙ্গন ফুলের গাছটার তলায় বসে থাকে প্রায়ই, থোক থোক ফুলগুলো যেগুলো পড়ে গেছে সেগুলো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে, নয়তো পাশের ঝোপেই নজর। এমনকী ক্লাস থেকেও৷ ফড়িং খোঁজে খালি! আর সবাই না জানলেও প্রাণের বন্ধু মেঘসারিকে বলেছিল একদিন, ও নাকি ফড়িং চিনতে পারে! একেকটা ফড়িং একেক রকম। একটা ফড়িং-এর সবুজ রঙ নাকি অন্যটার থেকে আলাদা। আবার কেউ বেশি ওপরে উড়তে পারে, কেউ অর্ধবৃত্তে ঘুরতে পারে। এই কথাগুলো যতবার মেঘসারিকে বলেছে, হো হো করে হেসে উঠেছে মেয়েটা! পূর্ণিমার আগে ভীষণ অস্বস্তি হত, আজকাল বিরক্তি লাগে, তারপর ধীরে ধীরে ভয়ের অনুভূতিটা জাঁকিয়ে বসে। পূর্ণিমার মনে হয় হাসলেই সবচে বীভৎস লাগে মেঘসারিকে।

প্রথম যেদিন দেখেছিল, হাসিটা মন্দ লাগেনি। ওরা দুই বন্ধুতে মিড ডে মিলের পরে বসেছিল রঙ্গন গাছটার তলায়। আকাশে সাদা মেঘ আর কালো মেঘ তুমুল চু কিতকিত খেলছিল তখন। এই মনে হচ্ছিল সাদা আকাশ, পরমুহূর্তেই আকাশ পাড়ায় লোডশেডিং! হালকা হালকা হাওয়াও শুরু হয়ে গেছিল তখন। তুমুল গল্পের মাঝেই হঠাৎ করে পূর্ণিমা বলে উঠেছিল, “চল, টিফিন তো শেষের মুখে, ক্লাসে ফিরি। বৃষ্টি হবে মনে হয়।” মেঘ ওর কথা কানেই তুলল না, চুপটি করে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। ঠিক সেই সময় পূর্ণিমার চোখ পড়েছিল ঘাসের আগায়। আর দেখতে পেয়েছিল ফড়িংটাকে। ও স্পষ্ট চিনতে পেরেছিল, একটু আগে যখন ওরা গল্প করছিল দু-বন্ধুতে, যেই ফড়িংটাকে দেখেছিল, এটা সেই ফড়িংটা নয়! সেকথা মেঘকে বলতেই প্রথম হেসেছিল ও, আর অবাক হয়ে পূর্ণিমা ভেবেছিল, মেঘসারির হাসিটাও এত সুন্দর! কিন্তু অবাক হওয়ার ঘোর কাটতে না কাটতেই উঠে গেছিল মেঘ, আর চোখের নিমেষে ফড়িংটাকে ধরে দু-আঙুলের চাপে পিষে মেরে ফেলেছিল! হাসতে হাসতেই! সেই প্রথম ভয় পাওয়া।

তারপর থেকে প্রায়ই এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। পূর্ণিমা আজকাল ভুল করেও মেঘের সামনে ফড়িং-এর কথা তোলে না, ক্লাসের অন্য অনেকেই যখন মেঘকে হিংসে করে ওর নানাবিধ প্রতিভার জন্য, পূর্ণিমা তখন ভয় পায় ওর প্রিয় সইকে! বাকি সমস্তটা সময় একদম স্বাভাবিক; মেয়েটা ফড়িং দেখলেই ওরকম হয়ে যায় কেন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না ও।

ঠিক যেমন বুঝে উঠতে পারে না, ওদের বাড়ির লাইটই বা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল কেন! বাবার জুটমিল বন্ধের কারণ বোঝার মতো বয়স ওর হয়নি এখনও, এমনকী দাদার হঠাৎ পড়া ছেড়ে দেওয়ার কারণও না। তবু এতদিন ওর মনখারাপ করত আগের দিন স্কুলের হোমওয়ার্ক করে নিয়ে যেতে না পারার জন্য। এক তো কুপির আলোয় পড়ার অভ্যেস নেই, তারপর আবার একটা মোটে আলো। বাবা সেই কোন ভোরে বেরিয়ে যায়, ফেরার পর সেই আলোতেই খাওয়াদাওয়া। তারপর মায়ের বাকি কাজকম্ম, যা শেষ হতে হতে ওরা সবাই ঘুমের দেশে। এমনি করেই চলছিল। হঠাৎ ঝামেলাটা হল সেদিন বিকাশ কাকা আসায়। কী নাকি এক ভালো সম্বন্ধ আছে, পূর্ণিমার সাথে নাকি খুব মানাবে। প্রথমটায় মা তুমুল আপত্তি করলেও বাবার চোখ আর দাদার ভাতের হাঁড়ির খোঁটায় চুপ করে গেছে। ঠিক সেইদিন থেকে পূর্ণিমার ভয় পাওয়ার শুরু!

আজকেও স্কুল থেকে ফিরে এইসবই ভাবছিল পূর্ণিমা। সামনে ইতিহাস বইটা খোলা থাকলেও ফড়িং-এর মতোই ঘুরপাক খাচ্ছিল ভাবনাগুলো। সেইদিন রাতেও সব পড়া শেষ করতে পারল না ও। মনের আকাশে একরাশি অন্ধকার মেঘ নিয়ে খেতে গেল। খেতে বসেও সেই এক আলোচনা। আগামীকাল নাকি বাবা আর দাদা যাবে ছেলেটির বাড়িতে কথা বলতে। তারপর নাকি ওঁরাও আসবেন পূর্ণিমাকে দেখতে। পূর্ণিমা যথারীতি সবটা বুঝতে পারছে না, কিন্তু আবার কিছু একটা ফিরে ফিরে আসছে৷ শেষ হওয়া ভাতের থালা থেকে চুমুক দিয়ে পান্তার জলটুকু গিলে নেয় ও। তারপর সেই খালি পাতে আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি কাটতে থাকে। ঠিক সেই মুহূর্তে মনে পড়ে যায় স্কুলের মাঠটা, রঙ্গন গাছটা, মাটিতে কাঠি দিয়ে করা আঁকিবুঁকি, পাশের সবুজ ঘাসের ঝোপ। আর ফড়িংগুলো। এতক্ষণে পূর্ণিমা বুঝতে পারে আসলে ভয়টা আবার ফিরে আসছে। ঢোক গিলে মায়ের দিকে তাকায় ও। অনেকদিন পর মায়ের মুখটার দিকে ভালো করে তাকায়, কুপির আলো মায়ের মুখে কেমন একটা মাকড়সার জাল তৈরি করেছে যেন! বলিরেখার বয়স মায়ের হয়নি আর বলিরেখা বোঝার বয়স পূর্ণিমার হয়নি। ভয়ের ধুকপুকানিটা নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পূর্ণিমা দেখতে পায় মায়ের চোয়ালটা। কেবলমাত্র গোটা মুখের ওই অংশটাই বড় স্পষ্ট, ক্রমশ ওঠানামা করছে, মা খাচ্ছে। অথচ তা সত্ত্বেও পূর্ণিমার যেন মনে হয় মায়ের চোয়ালটা প্রত্যেক ওঠানামায় যেন শক্ত হয়ে যাচ্ছে। পূর্ণিমার মন শক্ত না, ও ভীতু। ও মনে ভয় আর হাতে এঁটো নিয়েই টিউবওয়েলের কাছে যায় হাত ধুতে।

আজ সকাল সকাল স্কুলে চলে এসেছে পূর্ণিমা, অন্যদিনের থেকে বেশ কিছুটা আগেই। চোখে মুখে আগের রাতের জেগে থাকার ক্লান্তিটা আছে। এসে ও ক্লাসে যায়নি। বসে আছে ওর সবচে প্রিয় জায়গাটায়। রঙ্গন গাছের তলায়, পাশের ঝোপটায় আজ একটাও ফড়িং নেই, তবু পূর্ণিমার গতকাল রাতের ভয়ভাবটা অনেকটাই কেটে গেছে। কাল সারারাত প্রায় জেগেই ছিল ও, রান্নাঘরে মায়ের খুটখাট আওয়াজ শুনলেও চরম অভিমানে মায়ের কাছে যায়নি ও। তারপর কখন চোখটা লেগে গেছে খেয়াল করেনি। হঠাৎ ঘুমটা ভাঙল যখন তখুনি দেখেছিল জোনাকিটাকে, সারা ঘরময় উড়ে বেড়াচ্ছিল আলো হয়ে। পূর্ণিমা ততক্ষণে জানে ওকে কী করতে হবে। একটু আগে দেখা স্বপ্নটাকেই তখন জোনাকি মনে হচ্ছিল ওর। জোনাকির কথা ভাবতে ভাবতেই স্কুলের সাইকেল স্ট্যান্ডটার দিকে চোখ পড়ে ওর। নাহ, মেঘের লেডিবার্ড এখনও আসেনি। প্রার্থনার ঘণ্টা পড়ার প্রায় মুখে মুখে ঝড়ের গতিতে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে ঢোকে মেঘ। দুই বন্ধু অন্য দিনের মতোই একসাথে প্রার্থনার লাইনে দাঁড়িয়ে চোখ বোজে। পূর্ণিমার মনে এখন আর ভয়টা নেই।

প্রথম পাঁচটা ক্লাস যেন আর শেষই হতে চায় না। সেই কখন প্রথম পিরিয়ডের ফাঁকে মেঘকে বলেছিল ও, “তোর সাথে জরুরি কথা আছে।” তারপর থেকে দুই বন্ধুই উতলা হয়ে আছে, কিন্তু পূর্ণিমার এক গোঁ, টিফিনের আগে কিছুতেই সব কথা খুলে বলবে না সে। এর মাঝে বেশ কয়েকবার বাঁদিকের জানলা দিয়ে রঙ্গন গাছ আর পাশের ঝোপটা দেখে নিয়েছে ও। আজ ঝোপে ক-টা নতুন ফড়িংও দেখেছে, তবে সে কথা মেঘকে বলেনি। কোনোমতে পাঁচটা ক্লাস শেষ হতেই ওরা ছুট লাগাল খাওয়ার জায়গায়, কিন্তু খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই কীসের যেন আওয়াজ! হাত ধুয়ে একচ্ছুটে স্কুলের গেটের কাছে গিয়ে দেখে একটা অদ্ভুত গাড়ি ঢুকছে স্কুলের গেট দিয়ে। এরকম গাড়ি ওরা আগে দেখেনি, স্কুলের দিদিদের কাছেই শুনল ওদের স্কুল চত্বরের বাউন্ডারি ঘেঁষা বেশ কয়েকটা বড় গাছ আর রঙ্গন গাছটাও নাকি কেটে ফেলা হবে, আর ওই জায়গাটায় নাকি প্রাথমিক বিভাগের নতুন ভবন তৈরি হবে এমনটাই নির্দেশিকা। পূর্ণিমার মনে হল রাতের জোনাকিটা ভোরবেলায় হারিয়ে গেল! ওর চারপাশটা হু হু করতে লাগল। মেঘের বহু সাধাসাধিতেও কিছুতেই জরুরি কথাকটা আর বলতে পারল না ও। ভয়টা আবার ফিরে আসতে লাগল।

সপ্তম পিরিয়ড যখন প্রায় শেষের মুখে পূর্ণিমা ঠিক করল ওকে আজ কথাগুলো বলতেই হবে মেঘকে। যে করেই হোক। ছুটির পর মেঘকে বলতেই সে মেয়েও রাজি। পূর্ণিমাকে বলল, “শোন তুই নাবালিকা, তুই না চাইলে কেউ তোকে জোর করে বিয়ে দিতে পারেন না। কাকুও না। আমি বাবাকে বলব, বাবা বুঝিয়ে দেবেন কাকুকে।”

এই ক-টা কথা বলেই লেডিবার্ডের প্যাডেলে চাপ দিল মেঘ। পূর্ণিমা পিছন ফিরে ওই অদ্ভুত গাড়িটার দিকে তাকিয়ে হাঁটা লাগাল বাড়ির দিকে। ভয়টা নেই এখন আর। তবু রঙ্গন গাছটা কাটা যাবে ভাবলেই চোখে জল এসে যাচ্ছে ওর।

ঠিক যেমন এই মুহূর্তে একচোখ জল নিয়ে বসে আছে ও। মেঘ চলে গেছে মিনিট কুড়ি হল, বাবাও বেরিয়ে গেছে মিনিট দশেক আগে। কিন্তু পূর্ণিমা বসে আছে চারপাশে অমাবস্যার তুমুল অন্ধকার নিয়ে। মা যথারীতি রান্নাঘরে, কুপিটাও এই ঘরে নেই। আকাশে চাঁদটাও ভগ্নাংশ হয়ে আছে। পূর্ণিমার নিজেকে ওই ডানা পিষে মেরে দেওয়া ফড়িংটার মতো লাগছে! মেঘ যখন একটু আগে প্রথমবারের মতো এল বাড়িতে, ও ভীষণ আনন্দ পেয়েছিল। ওর প্রাণের সই, কেবলমাত্র ওর জন্য এসেছে ওদের বাড়িতে ভাবলেই বুকের ভেতর ফড়িং এর ছটফটানিটা টের পাচ্ছিল ও। কিন্তু মেঘের সঙ্গে আরও কাউকে আশা করেছিল পূর্ণিমা, “কাকু কই?”

ওর প্রশ্নের উত্তর দেয়নি মেঘ। পালটা প্রশ্ন করেছিল, “আমার কাকু কই?”

পূর্ণিমার বাবা তখন সবে হাতমুখ ধুয়ে বসেছেন, পূর্ণিমা জানত বাবা আজ কাজে যাবেন না, ওঁদের বাড়ি যাবেন। তাই তাড়াতাড়ি ফেরার কথা। সেই কারণেই এত পড়িমরি করে মেঘকে জানানো। কিন্তু বাবার মুখ দেখে মনে হল না খুব একটা খুশি হয়েছেন, হাজার হোক আতিথেয়তারও একটা বাজারদর আছে! কিন্তু বাবাকে অবাক করে ঢিপ করে একটা প্রণাম করল মেঘ। মানুষটা খানিক অপ্রস্তুত হয়েই বললেন, “ঘরে এসো।”

ঘরেই এসেছিল মেঘ। তারপর পূর্ণিমার যাবতীয় স্বপ্নে বৃষ্টি নামিয়ে চলেও গেছে। পূর্ণিমা অবাক হয়ে শুনছিল মেঘ আর বাবার কথোপকথন। কী অবলীলায় মিথ্যে বলে মেয়েটা। হাসতে হাসতে। উফ্ সেই বীভৎস হাসি! ঠিক যখন মেঘ বাবাকে বলল, পূর্ণিমা নাকি বাড়ি থেকে পালাবে বলে আজ স্কুলে তার কাছে সাহায্য চেয়েছে আর তাই পূর্ণিমার পরিবারকে সতর্ক করতেই মেঘের এই বাড়িতে আসা, তখন মেঘ হাসছিল। ওই কুপির আলোতেও পূর্ণিমা স্পষ্ট দেখেছে গজদাঁতে পড়ে আলোগুলো ছিটকে যাচ্ছে। ঠিক যেভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছিল পূর্ণিমার স্বপ্নগুলো, আরও পড়ার, বড় হওয়ার, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। মেঘ চলে যাওয়ার পর বাবা নিদান দিয়েছে বিয়ে পর্যন্ত পূর্ণিমার বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ, স্কুল বন্ধ। তারপর বাবাও বেরিয়ে গেছে। মা যথারীতি রান্নাঘরে। পূর্ণিমা বসে আছে। আজ আর ওর ভয় লাগছে না, তবে নিজেকে মৃত ফড়িংটার থেকে আলাদাও করতে পারছে না। পূর্ণিমা হঠাৎ অঙ্ক খাতাটা খুঁজতে লাগল, অন্ধকারে পাওয়া সমস্যা। তবু বড়রাস্তায় কেন যেন অনেক আলো দিয়ে সাজিয়েছে, সেই আলো আজ ঘরে ঢুকছে। খাতা বের করে ঐকিক নিয়মের অনুশীলনী কষতে থাকে ও। অন্ধকারে প্রায় কিছুই দেখা যায় না, ও দেখতেও পায় না কখন যেন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে মা। চোখের ওপর চাপ দিয়ে জোর করে অঙ্ক কষতে গিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে থাকে। বেশ খানিকক্ষণ পর পূর্ণিমা বোঝে ঐকিক নিয়ম আজও মেঘসারির থেকে পূর্ণিমা ভালো করে, বোঝে ফড়িং-এর মতোই ওর সব ইচ্ছেকে ডানা চেপে মেরে দিল ওর প্রিয় সই, তার অনেক পরে পূর্ণিমা বোঝে ও আসলে কাঁদছে। ওর জামা ভিজে গেছে, ক্যালেন্ডারের উল্টো সাদা পিঠ ওর অঙ্ক খাতা সব ভিজে গেছে! ভেজা খাতা নিয়েই কখন ঘুমিয়ে গেছে ও জানে না, কেউ ডাকেনি ওকে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই ও দেখল সেই রঙ্গন গাছটা, আর ঠিক তখনই ঘুমটা ভেঙে গেল একটা আওয়াজে।

অনেকক্ষণ এপাশ করে চোখটা অন্ধকারে খানিক সইয়ে আসার পরেও ও ঠাওর করতে পারল না কত রাত হল। কিন্তু পাশে মা-ও নেই। খানিক ভয় করলেও আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে বুঝতে পারল না ও। তবু খাট থেমে নামতে গিয়েও ঠান্ডা মেঝেতে পায়ের পাতাটুকু লাগতেই কেমন শিউরে উঠল ও। মনে পড়ল এবার কালীপুজোর পর থেকেই ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়তে আরম্ভ করেছে। ক-দিন আগের বৃষ্টিটা আরও ঠান্ডা বাড়িয়েছে। তারপরেই মনে পড়ল পরশু ওকে দেখতে আসার কথা, পাত্রপক্ষের পছন্দ হয়ে গেলে হয়তো ডিসেম্বরেই… অথচ ডিসেম্বরে ওর বার্ষিক পরীক্ষা। ভাবনাটা শেষ হওয়ার আগেই আবার আওয়াজটা। এবার খানিক ঠাওর করতে পারল ও। মনে হচ্ছে রান্নাঘরের দিক থেকেই! পা টিপে রান্নাঘরের দিকে এগোয় ও, দরজা বন্ধ। জানালা দিয়ে হৈমন্তী হাওয়া একটা ভয়ের ঝাপ্টা মেরে যায়, তবু চোখ বন্ধ করে রান্নাঘরের দরজায় ধাক্কা দেয় পূর্ণিমা।

ভেজানো দরজা সহজেই খুলে যায়, আর পূর্ণিমা দেখতে পায় চোয়ালটা। যথারীতি সেই চেনা ভঙ্গী, সেই তেরছা আলো, সেই শক্ত চোয়াল। তফাত শুধু এটুকুই, অন্যদিন ভাত চেবানোর সময় মায়ের চোয়ালটা ওঠানামা করে, আজ স্থির। আলোছায়ায় স্পষ্ট বোঝা না গেলেও পূর্ণিমা দেখে ওর মা কিছু লিখছে, যে মা প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়েছে কোনোমতে, সে এই মাঝরাত্তিরে কী করছে? আরও দু-পা টিপে মায়ের দিকে এগিয়ে যায় ও, মায়ের চারপাশে ছড়ানো ছিটানো সব বই, ভীষণ চেনা, এইসব ওর নিজের বই, গতবছরের। আর মা অঙ্ক করছে। এতদিন ও জানত ওর পুরনো বই সব মা জমিয়ে রাখে স্মৃতি হিসাবে। বাবা বহুবার কিলোদরে কাগজ বিক্রি করে দিতে চাইলেও মায়ের তুমুল জেদেই এতদিন পারেনি। কিন্তু সেইগুলো যে এইকাজে লাগে বুঝতেও পারেনি পূর্ণিমা। মা টের পায়নি ও এসে দাঁড়িয়েছে। দূর থেকে মা আর চারপাশে ছড়ানো ছিটানো বইগুলোকে হঠাৎ করেই রঙ্গন গাছটার মতো লাগতে লাগল ওর, আর চারপাশের বইগুলোকে থোকা ফুলগুলোর মতো।

“এদিকে আয়।” ঘাড় না ঘুরিয়েই মা ডাকল ওকে।

তুমুল চমকের ঘোর কাটিয়ে পূর্ণিমা এখন দাঁড়িয়ে আছে ওর প্রধান শিক্ষিকার ঘরে। দিদিমণি মোবাইলে কাকে যেন ফোন করছেন, আর মুখে হাসি। কিন্তু এ কী! আরও চমক বাকি ছিল?! পরদা সরিয়ে কারা ঢুকছে ঘরে? বাবা আর দাদা না? ও কী! সঙ্গে পুলিশ কেন? তারপরের ঘটনা ঘটল খুব দ্রুত। বড়দিদিমণির মৃদু কিন্তু স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া কিশোরী পূর্ণিমার কিছুতেই এখন বিয়ে দেওয়া চলবে না। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত ও যতদিন চায় ওকে পড়তে দিতে হবে। পুলিশকাকুর কড়া চাহনির সামনে বাবা, দাদার পালটে যাওয়া মুখ চোখ আর মুচলেকায় সই! সবটাই ঘটল হু হু করে। সব মিটে যাওয়ার পর বড়দি আলাদা করে ধন্যবাদ দিলেন ওর মাকে। চুড়ি, টিপ কিনতে যাওয়ার নাম করে মা যদি না আজ ওকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসতেন, পূর্ণিমা এতক্ষণে শাড়ি পরে পাত্রপক্ষের সামনে বসে থাকত। হুঁশ ফিরল মায়ের গলার আওয়াজে, “দিদি, খুব অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় পড়াশুনা শেষ করতে পারিনি। মেয়েটার স্বপ্নের ডানা ছাঁটি কী করে?”

এই প্রথম পূর্ণিমা দেখল ওর মায়ের শক্ত চোয়ালটা ছাড়াও আরও একটা জিনিস এতদিন ও খেয়াল করেনি। কথাগুলো বলার সময় মায়ের চোখ দুটো তিরতির করে কাঁপছে।

পূর্ণিমার হঠাৎ মনে হল মায়ের চোখ দুটো যেন দুটো ফড়িং… একটু আগের চোখের সঙ্গে এই চোখের কোনও মিল নেই। সে ফড়িংচোখ আর এই চোখে বিস্তর ফারাক। কাল রাতে কুপির আলোয় দেখা চোখ আর এই চোখ একদম এক। হুবহু একই রকম।

বড়দির ঘর থেকে বেরোনোর সময় আবার মায়ের চোখের দিকে তাকাল ও। তারপর সেই রঙ্গন গাছটার দিকে। অবাক কাণ্ড গাছটা কাটা হয়নি। পাশেই ঘাসের ঝোপে আবার অনেকগুলো ফড়িং উড়ছে।

মায়ের হাতটা শক্ত করে ধরে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসার সময় ওর মনে হল, ফড়িংগুলো থেকেই যাবে, ডানাসমেত… অন্তত যতদিন রঙ্গন গাছটা রয়েছে।

বেহুলা আর সরল বেদের গল্প

শ্রীময়ী চক্রবর্ত্তী

বেহুলার যখন বিয়ে হল, তখন তার বয়স বড়জোর ছয় বা সাত। ভালো করে মনেই পড়ে না ছাই… যেন পুতুল খেলার বিয়ে। সবই কেমন আবছা আবছা। ঘুম পাচ্ছিল বেজায়, খিদেতে পেটে পাক দিতে দিতে কখন যেন খিদে তেষ্টা বোধটুকু অব্দি চলে গিয়েছিল। পাশ থেকে কাকিমা ঠেলা মেরে মেরে সজাগ করার চেষ্টা করছিল আর বেহুলা একবার কাকিমার ঘাড়ে একবার পাশে বসা বরের ঘাড়ে ঢলে ঢলে পড়ছিল। সেদিন একদম লজ্জা-টজ্জা করছিল না তার। আজ তেরো বছরের সদ্য ঋতুমতী বেহুলার সে কথা ভাবতেও গালে গোলাপের ছোপ লাগে। আজ সে তো আর বাচ্চাটি নেই, দিদি-বউদিরা কানে কানে বেশ প্রাঞ্জলভাবে তাকে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটুকু বুঝিয়ে দিয়েছে। গতবার শ্বশুরবাড়িতে ফুলশয্যার দিন অনেক রাতে ঘুমন্ত ছেলের বউকে দাসীর কোলে কোলে পালঙ্কে শুইয়ে দিয়ে গিয়েছিল লখিন্দরের মা সনকা, তার শাশুড়ি মা। দেখো দেখি, ছি ছি! স্বামীর নাম মুখে আনল বেহুলা। পরক্ষণেই ফিক করে হেসে ফেলল সে।
নাহ, মনে মনে নাম নিলে দোষ লাগে না। বেশ করবে নাম নেবে সে।
“লখিন্দর, লখিন্দর, লখিন্দর কই কিছু হল? মা-ঠাকুমার সবটাতেই বড় বাড়াবাড়ি।”
তার শ্বশুরবাড়িতে কী যেন একটা অভিশাপ আছে। তার ছয় ভাসুরই সন্তানহীন অবস্থায় স্বর্গে গেছেন, সবাইকে নাকি সাপে কেটেছিল। বেঁচে আছে শুধু শিবরাত্রির সলতে তার স্বামী। ঠাকুমা তো কথায় কথায় বলেন, “তোর শ্বশুরের সপ্তডিঙা দেশ-বিদেশে কারবার আর তোদের বাপের মুদিখানার দোকান। যদিও চাঁদ সদাগরের অবস্থা এখন অনেক পড়ে গেছে, তবু এ ঘরের বর কি তোর পাওয়ার কথা? নেহাত তোর কুষ্ঠিতে স্বামীর অমৃত যোগ আছে, শাঁখা সিঁদুর তোর অক্ষয় হবে, তাই বিনি পণে এমন রাজপুত্তুর জামাই পেলাম।”
একটানা বকে যায় বুড়ি।
তাই বলে কি সাবধানতার ঘাটতি ছিল? সারাবছর তাকে দিয়ে স্বামীর কল্যাণে বারো ব্রত করাত ঠাকুমা। পুজোআচ্চা লক্ষণ-অলক্ষণের জ্ঞান এই ক-বছরে টনটনে হয়েছে কিশোরী বধূটির।
পালকিতে করে ঘরবসত করতে যাওয়া বেহুলা কত কথাই না ভাবছিল। সিঁথিমূল থেকে সিঁদুর নাকে ঝরে পড়েছে, ফর্সা মুখে পাতলা ঠোঁট দুটি পানের রসে লাল, চোখের কোণের শুকনো জলের দাগ, পালকির ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের রশ্মি কানের দুলে প্রতিফলিত হয়ে মাথার পেছনে আলোর বলয় সৃষ্টি করেছে। ঠাকুমা প্রাণ ভরে কাঁদতে অব্দি দিল না, তাতে নাকি স্বামীর অকল্যাণ হবে। শ্বশুরবাড়ি আর কি তাকে কোনোদিন গরিব বাপের বাড়ি আসতে দেবে? আর কি সে তার পোষা মেনিটাকে আদর করতে পারবে? আবার চোখ উপচিয়ে জল আসে বেহুলার। রেশমি শাড়িটায় ছাই চোখের জল অবদি মোছে না। সত্যি সত্যি অভিশাপ কিছু আছে নাকি? ভয়-ভয় করতে থাকে তার।
বেহুলার যখন বিয়ে হয়, তখনই তার দুই ভাসুর মারা গেছেন। এই কয় বছরে মারা গেছেন আরও চারজন। তার শ্বশুর নাকি কবে গর্ভবতী সর্পিনীকে লাঠির ঘায়ে মেরে ফেলেছিলেন, তারপর থেকে বংশে অভিশাপ লেগেছে। বাকি আছে শুধু আঠারো বছরের লখিন্দর। কী আশ্চর্য সব ক-টি মৃত্যুই সর্পদংশনের কারণে। পরিবারে যেন মড়ক লেগেছে। বেঁচে আছেন কেবল প্রৌঢ় চাঁদ সদাগর, তাঁর স্ত্রী সনকা, বেহুলার স্বামী লখিন্দর, ছয় ছেলের ছয় বিধবা বধূ, চাঁদ সদাগরের একমাত্র কন্যা চিত্রা, ঘরজামাই স্বামী গদাধর এবং তাদের দুই পুত্র জয় এবং বিজয়। জয় বিজয়ের জন্য বাড়িতে তবু যেটুকু শব্দ আলো হাসি। তা নইলে এ যেন মৃত্যুপুরী, দরজার আনাচেকানাচে ঘাপটি মেরে আছে মরণ। কাজের লোকও খুব বেশি নেই অন্দরমহলে, সনকার খাসদাসী পটলের মা এবং চিত্রার খাসদাসী মুখি। বাকি কাজ ছয় বিধবা বউতে ভাগাভাগি করে করে। আঁকাড়া গতর নিয়ে পতিপুত্রহীনা নারী করেই বা কী?
বেহুলার পালকি এসে অন্দরমহলের উঠোনে দাঁড়াল। বেহারারা চলে যেতে মাত্র দুটি নারী এল তাকে বরণ করে ঘরে তুলতে, চাঁদ সদাগরের অন্দরমহলের আব্রু বড় কড়া। বাড়িতে মাত্র দুটি এয়ো— সনকা আর চিত্রা, পাড়ার কোনও সধবা মহিলা তাদের বাড়ির কাজকর্মে আর পা রাখেন না অভিশাপের ছোঁয়াচ লাগার ভয়ে। বেহুলা পালকি থেকে নামার সময় তার ডান চোখ নেচে উঠল। অমঙ্গলের ভয়ে শিউরে ওঠে বালিকা।
প্রথম ক-টা দিন কেটে গেল, পাঁজি পুঁথি দেখে, বেহুলার গর্ভাধানের সময় বিচার করে, নিশ্চিত পুত্রসন্তানলাভের সময় গুণে বেহুলা লখিন্দরের বাসর সাজাতে। বেশ উঁচু শুকনো জায়গায় ঘর। ঘরে দরজা ভিন্ন কোনও ছিদ্রপথ নেই। ঘরে বেশ গরম, তবু কোনও উপায় নেই। বিধবা জায়েরা বাসরঘরে গেলে অকল্যাণ হবে, শাশুড়িকে ছেলের বাসরে যেতে নেই, তাই বেহুলার ননদ চিত্রা আর তার দাসী মুখি বেহুলাকে শোয়ার ঘরে পৌঁছে দিতে এল। ঘরে তখনও লখিন্দর আসেনি, বেহুলাকে পালঙ্কে বসিয়ে দু-চারটে দরকারি কর্তব্যের কথা বুঝিয়ে দিয়ে দরজা ভেজিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল চিত্রা আর মুখি। বেহুলার মনে হল মুখি যেন লখিন্দরের বালিশটা গুছিয়ে দিতে একটু বেশি সময় লাগাচ্ছে। যাই হোক, বেহুলা একা বসে বসে এই ক-দিনে নাপতিনী বউয়ের শিক্ষা পুরুষকে আকর্ষণ করার ছলাকলা মনে মনে তোলাপড়া করছিল, ঘরে লখিন্দর এসে ঢুকল। বেহুলার লজ্জায় ভয়ে পেটের কাছটা কেমন করছিল, তবু সে সাহস করে লখিন্দরকে হাত ধরে খাটে বসিয়ে ঘরের কোণে রাখা বাটা থেকে পান সাজতে বসল। পুত্রজন্মের দায়িত্ব ও পদ্ধতি সম্পর্কে লখিন্দরকেও বিলক্ষণ শিক্ষা দিয়ে বাসরঘরে পাঠানো হয়েছে, কিন্তু এখন তারও বুক ধড়ফড় করছে। তবু লখিন্দর সহজ হওয়ার জন্য বালিশে হেলান দিয়ে বসল। তার একটা হাত বুঝি বালিশের তলায় ঢুকে গিয়েছিল। হঠাৎ হাতে তীব্র জ্বালায় ছটফট করে উঠল সে। মুহূর্তে হাত সরিয়ে এনে দেখল হাতে সাপে কাটার দুটি রক্ত বিন্দু ক্রমশ পরিস্ফুট হয়ে উঠছে। বেহুলা চিৎকার করে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল।
ঘরের ঠিক বাইরেই বোধ হয় চিত্রা আর মুখি অপেক্ষা করছিল। তারা হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে এল। ক্রমে ঘর ভরে গেল। কবিরাজ এলেন, নাড়ি ধরে ধ্যানস্থ হলেন। সবাই চুপ। ঘরে একটা সুচ পড়লে বুঝি শোনা যাবে। চিত্রা লক্ষ করল, ঘরের এক কোণে বেহুলা বসে আছে। একদৃষ্টে মুখিকে দেখছে বেহুলা, তার চোখে সন্দেহ আর অবিশ্বাস। চিত্রা একটা পিতলের ঘটিতে জল নিয়ে ভাইয়ের বউয়ের দিকে এগিয়ে গেল। বেহুলার বুক অব্দি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সে ঢকঢকিয়ে প্রায় আধঘটি জল খেয়ে ফেলল। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল ঘরের কোণে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে আছে নতুন বউ। তার দিকে কেউ ফিরেও তাকাল না। অনেকক্ষণ বাদে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন কবিরাজ। নাহ, আজ তাঁর ধন্বন্তরি অষুধও বুঝি ব্যর্থ হল। দীনু ওঝা এগিয়ে এসে অনেকক্ষণ কী সব ঝাড়ফুঁক করল। এমনকী কালসাপটাকে ধরে ক্ষিপ্ত আত্মীয়দের হাতে তুলে দিল সে। কিন্তু শেষ অবধি হাল ছেড়ে চাঁদ সদাগরের দিকে তাকিয়ে বলল, “সবই অদিষ্টের লিখন গো কত্তা, অভিশাপ কি কেউ খণ্ডাতে পারে?”
অন্দরমহলে কান্নার রোল উঠল। মহাশক্তিশালী চাঁদ সদাগর পাথরের মূর্তির মতো বসে আছেন। সনকা থেকে থেকে মূর্ছা যাচ্ছেন। লখিন্দরের অন্ত্যেষ্টির দায়িত্ব পড়ল গদাধর আর চিত্রার ওপর। সাপে কাটা মরার দাহ হয় না। লখিন্দরকে তার দাদাদের মতো কলার ভেলায় করতোয়া নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। চিত্রা পাড়া ঝেঁটিয়ে আসা স্ত্রীলোকেদের বলল, বেহুলা জ্ঞান হারানোর আগে তাকে জানিয়েছে সে স্বামীর সঙ্গে কলার ভেলায় স্বর্গে যেতে চায়… স্বর্গের দেবতাদের পায়ে ধরে সে স্বামীর আয়ু ফিরিয়ে নেবে। কে-ই বা একথায় ‘না’ করবে। সনকার পুত্রশোকে পাগলিনীপ্রায় দশা, চাঁদ সদাগর ঘরে খিল দিয়েছেন। জীবন্ত বেহুলার সশরীরে স্বর্গে যাওয়া দেখতে গ্রামের লোক ঘাটে ভেঙে পড়ল। এও তো একপ্রকার সতী হওয়াই বটে। বেহুলার শরীরভর্তি গয়না সব খুলে নিল চিত্রা। শুধু এয়োতের চিহ্ন আর নাকে সোনার নাকছাবিটুকু রেখে দিল। নইলে লোকের চোখ টাটাবে। সতীর মাথা ভরে সিঁদুর দিল মেয়েরা। তারপর প্রথম বর্ষার মেঘভাঙা রোদ গায়ে মেখে ফুলে ফুলে সাজানো কলার ভেলা ভেসে চলল স্বর্গের পথে। ভেলায় পাশাপাশি শুয়ে আছে এক জীবন্ত জ্ঞানহীন তরুণী আর এক মৃত তরুণ।

গভীর রাতে বেহুলার জ্ঞান ফিরলো। চোখ খুলেই চাঁদের উপর দিয়ে মেঘ ভেসে যেতে দেখল সে। তার মনে হল সে স্বপ্ন দেখছে! খানিকক্ষণ আবার চোখ বুজে শুয়ে থাকতে গিয়ে মাদকের প্রভাবে চোখ জুড়ে ঘুম এল তার। এবার যখন ঘুম ভাঙল, আকাশে তখন আলো ফুটি ফুটি করছে। এবার বেহুলা চোখ বুজেই অনুভব করল বিছানাটা দুলছে, নাকি মাথা ঘুরছে? চোখ খুলে তাকাল সে। আকাশের নিচে শুয়ে থাকার অভিজ্ঞতা তার আগে হয়নি। ধড়মড়িয়ে উঠে বসতে যেতেই খানিকটা জল চলকে উঠল ভেলায়। ঠান্ডায় ভয়ে থরথরিয়ে কেঁপে উঠল বেহুলা। ছিপছিপে বৃষ্টি হচ্ছে, পাশে স্বামীর মৃতদেহ। আস্তে আস্তে পুরো ব্যাপারটা খানিকটা পরিষ্কার হল তার কাছে। অভিশাপ নয়… অভিশাপ নয়… এ মৃত্যুস্রোত মানুষের চক্রান্ত। রাত্তির বেলা মুখির চালচলনে সন্দেহ হয়েছিল তার। লখিন্দরকে সাপে কাটতেই সে সন্দেহ তার চোখে ফুটে উঠেছিল, ফলে তাকে এই জীবন্ত সমাধি দেবার চেষ্টা।
নদীর দুই পাশে ঘন জঙ্গল, কোনও জনমানুষের দেখা নেই, ভয়ে বেহুলার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। কে জানে কোন বাঁকে চোরা ঘূর্ণির স্রোত, কোন জঙ্গলে বাঘ, কোথায় কাঠের টুকরোর মতো ভেসে আছে ধারালো দাঁতের কুমির। ভেলা কিন্তু আপনমনে স্রোতের টানে ভেসেই চলল।
বেলা প্রায় দ্বিপ্রহর। ক্রমে ঘন মেঘে আকাশ ছেয়ে যাচ্ছে, কলকলিয়ে তীব্র জল স্রোত ছুটছে। জঙ্গল ফাঁকা হয়ে এসেছে। একটা কাঁচা ঘাটে বসে কাপড় কাচছিল একটি কিশোরী মেয়ে, নাম তার দুলি। দুলি সাপুড়ে বেদে দলের মেয়ে। একটু দূরে ঝোপ ঝাড়ে কী সব ঔষধি লতা খুঁজছিল সর্দারের ছেলে সরল। দুলি হঠাৎই চিৎকার করে ডাক দিল, “এ সরল দেখে যা কেনে, ভেলায় কে ভেসে যায়।”
সরল আর দুলি দুজনেই জলে ঝাঁপ দিল। দুলি বেদের দলের মেয়ে, জলে জঙ্গলে সমান সাবলীল। খুব কষ্ট করে দুজনে ভেলা টেনে আনল পারে। ভেলায় সাপে কাটা মড়া তারা মেলা দেখেছে। কিন্তু জ্যান্ত মেয়েমানুষ কখনও দেখেনি। বেহুলার তখন তুমুল জ্বর এসে গেছে। সরল ভুরু কুঁচকে মড়াটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর চোখের পাতা টেনে, নাকের সামনে আঙুল নেড়ে কী যেন দেখল। তারপর দুলির দিকে চেয়ে বলল, “মনে লাগে ইয়ার শরীলে টুকু প্রাণ যেন একনও ধুকপুক করতিছে, এরে বিষহারীর কাছে লিয়ে যেতি লাগব।”
বেহুলা দুলির শরীরে ভর দিয়ে কোনোমতে ধুঁকতে ধুঁকতে আর সরল লখিন্দরকে ঘাড়ে নিয়ে চলল তাদের ডেরায়, তাদের সর্দারনি মনসার আস্তানায়।
বেদেদের আস্তানা বেশি দূরে নয়। এ সাপুড়েদের অস্থায়ী ঘর সংসার। পাতা, খড়, বাঁশ, কাঠকুঠো দিয়ে তৈরি ছোট-ছোট কুটির। মাঝখানে একটা বড় আটচালা গোছের ছাউনি। দুলি আর সরল বেহুলা লখিন্দরকে নিয়ে গিয়ে সেই আটচালায় শুইয়ে দিল। ডেরায় ঢুকতে না ঢুকতে ওদের চারপাশে ছেলে-বুড়োর ভিড় জমে যায়। মনসা এসে দাঁড়াতেই হইচই কিছুটা থিতিয়ে গেল। মনসার চেহারা অতি সাধারণ, গলায় কি যেন বীজের নীল একটা মালা। এই যৌবনোত্তীর্ণ নারীর চোখের দিকে তাকালে থমকে যেতে হয়। কঠিন চোখে বুদ্ধি, প্রজ্ঞা এবং প্রভুত্বের সঙ্গে আরও রহস্যময় কিছু মিশে আছে, যা অনুভব করা যায়, অথচ স্পর্শ করা যায় না। মনসা লখিন্দরের পাশে এসে বসল। হাতটা তুলে নাড়ির অতি ক্ষীণ গতি দেখল, হাতে সাপের কামড়ের দাগ, নাকের কাছে এনে গন্ধ শুঁকল। তারপর পাশে দাঁড়ানো দুই সহকারীকে কিছু গাছগাছড়া আনার আদেশ দিল। সাপে কাটা জায়গাটা ধুয়ে তীক্ষ্ণ সরু ছুরি দিয়ে চিরে দিল মনসা। খানিকটা রক্ত বেরিয়ে যেতে হলুদ রঙের কী যেন গুঁড়ো ভরে দিল ক্ষততে। দুলি ততক্ষণে বেহুলাকে সদ্য দোয়ানো কালি গাইয়ের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। বেহুলা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল, দুলি তাকে নিজের কুটিরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়ে এল।
পরের ছ-মাস মনসার আস্তানায় লখিন্দরের চিকিৎসা চলল। একটা কুটিরে সারাদিন কেউ না কেউ তার সারা শরীরে লেপ লাগায়। শরীরের বিভিন্ন জায়গা চিরে বিষ বের করে, জড়ি বুটি বেটে মাখিয়ে ক্ষতস্থান কলাপাতায় মুড়ে দেয়। লখিন্দরের গলার কাছে প্রাণটা ধুকপুক করে, জ্ঞান আর আসে না। মনসা নিজেই তার চিকিৎসা করে। অদ্ভুত সুগন্ধি ধুপ জ্বালিয়ে টানা টানা সুরে একঘেয়ে মন্ত্র পড়ে—
বিষহারী লো দয়া কর
নিথর দেহ জান দে
পাতার টোপ মাথায় মণি
অতল জল নিথর পানি

বেহুলার কিন্তু অদ্ভুত রূপান্তর ঘটে গেছে। সে দুলি আর মুনিরার সাথে একই কুটিরে থাকে। কখনও চৈ চৈ করে হাঁসের পাল নিয়ে পুকুরে যায়, কখনও খালবিল থেকে আঁচলে ছেঁকে চুনো মাছ ধরে। বেদেরা যখন সাপের খেলা দেখায়, বেহুলা আর ভয়ে সিঁটকে যায় না। সে চোখ বড় বড় করে দেখে, সাপ রাখার টুকরি এগিয়ে দেয়। বেহুলার রঙ পুড়ে গেছে, খোলা চুলের আগাগুলো তেলের অভাবে মুখের চারপাশে সাপের ফণার মতো দোলে। বেহুলার মুখে হাসি, গলায় ভাটিয়ালি গান। সরলের কাছ থেকে বেহুলা শজারু, বেজি ধরার ফাঁদ পাততে শিখেছে, দুলি আর মুনিরার কাছ থেকে শিখেছে মেটে ইঁদুরের মাংস রাঁধার পদ্ধতি। প্রথম দিকে বেহুলা নিজেই দুটো ভাতে ভাত ফুটিয়ে খেত। কিশোরীর স্বাভাবিক কৌতূহলে খাদ্যে, বস্ত্রে ক্রমশ বেদেনিদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে প্রতিদিন। সরলের বাঁশিতে সাপুড়ের সুরে মিশে যায় অনেকটা চাঁদের আলো, ফুলের ঘ্রাণ আর বুঝি বা চোখের জল। মনসার কপালে ভাঁজ গভীর হয়। এ মনসা বুঝি বেদের দলের সর্দারনি মনসা নয়। সরলের মা মনসা, ছেলের বুকের ঝড় তুফান সে বিলক্ষণ বুঝতে পারে। লখিন্দরের আস্তে আস্তে দেহে বল ফিরছে, কিন্তু এখনও তার মাথা কাজ করে না। সে বেহুলাকে চিনতে পারে না, মনে করতে পারে না নিজের পরিচয়। দলের অন্যান্য বয়স্ক বেদেরা এবার অন্য জায়গার জন্য রওনা হতে উৎসুক। যাযাবর রক্তে জোয়ারের টান লেগেছে। দলের সর্দারনি বিষবৈদ্য মনসার জেদ রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে ঘরে ফেরাবে, তবে নতুন জায়গায় আস্তানা গাড়বে তারা।

দিন যায় মাস যায়। প্রায় ছ-মাস কেটে গেছে। গঙ্গায় যত জল গড়িয়েছে, তার চেয়ে বুঝি বেশি জল গড়িয়েছে লখিন্দরের মা সনকার চোখে। এর মধ্যে চাঁদ সদাগরের ঘরে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। চিত্রার খাস দাসী মুখি জ্বরের ঘোরে সনকার দাসী পটলের মা-র কাছে কবুল করে বসে চাঁদ সদাগরের সাত ছেলের মৃত্য কোনও সাপ মারার অভিশাপের কারণে ঘটেনি। এ মৃত্যুস্রোত চাঁদ সদাগরের সম্পত্তি হাতাতে চিত্রা আর গদাধরের সংগঠিত হত্যালীলা। অর্থের লোভে মুখি এই পাপের ভাগীদার হয়েছে, তার পাপের কোনও শেষ নেই, সে আর প্রাণে বাঁচবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। পটলের মা সনকাকে গিয়ে এই ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের খবর দেয়। সনকার মুখে খবর পেয়ে চাঁদ সদাগর মেয়ে জামাইকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠান। বদ্ধ অর্গলের অন্তরালে কী কথা হয় কেউ জানে না। গদাধর, চিত্রা, জয়, বিজয় বজরায় করে বহুদূর ব্রহ্মদেশের পথে যাত্রা করে। জয় আর বিজয়— দুই বালকের জন্য বাড়িতে তবু যেটুকু আলো আর হাসি ছিল। এখন চাঁদ সদাগরের ঘর থেকে সেটুকুও গেছে। সনকা মৃতপ্রায় বিছানায় পড়ে থাকেন। ছয় বউ নীরবে ঘরের কাজ করে। চাঁদ সদাগর শুধু চিন্তা করেন কী উপায়? বংশরক্ষা করার জন্য শেষ চেষ্টা হিসেবে তিনি পুনর্বিবাহের সিদ্ধান্ত নেন। প্রৌঢ় পাত্রের জন্য দিকে দিকে ঘটক ছোটে, সুলক্ষণা পাত্রী চাই। সনকা অশ্রুহীন চোখে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকেন। চাঁদের বিবাহের কথায় তাঁর মনোভাব বোঝা যায় না।

একদিন খুব ভোরে লখিন্দরের স্মৃতি খানিকটা হলেও ফিরে এল। সে পাতার বিছানায় উঠে বসে পাশে বসে থাকা যুবককে জিজ্ঞাসা করল, “আমি কোথায়?”
মনসা খবর শুনে শয্যার পাশে এসে বসল এবং আরও কিছু শক্তিবর্ধক লতাপাতার নির্যাস তাকে খাইয়ে দিল। লখিন্দরের গ্রামের নাম, বাপের নাম সবই মনে পড়ে, শুধু মনে পড়ে না স্ত্রী বেহুলাকে। লখিন্দর বাড়ি ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়। মনসা তাকে ঘরে ফেরা অনুমতি দিয়ে বেহুলাকে নিজের কুটিরে ডেকে পাঠাল। বেহুলাকে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “হ্যাঁ লা মেয়ে, তোর সোয়ামি তো ঘরকে ফিরবে, তুর মনে কী আছে?”
বেহুলা এই প্রশ্নটা ঠিক আশা করেনি। সে অবাক বিস্ময়ে তার কাঁচের মতো চোখ তুলে মনসার দিকে তাকাল।
এবার বেহুলাকে বুঝিয়ে বলে, “দ্যাখ মেয়ে, আমরা খুব নিচু জাতের মানুষ। গত ছ-মাস তুই আমাদের ভাত-জল খেছিস, তোর স্বামী বেটাছেলে পুরুষমানুষ। অর কুনও দোষ লাগবে না। কিন্তু তুকে আর তোর শ্বশুরঘরে লিবে না। তোর স্বামী ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাক, তুই আমাদের সাথে থেকে চল কেনে।”
বেহুলা অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। একদিকে সরলের বাঁশিতে বাজা সহজিয়া গানের সুরের জাদুটান তার মনের মধ্যে নতুন স্বপ্নের জাল বুনে চলে। অন্যদিকে যুগযুগান্তর ধরে রক্তে মিশে থাকা স্বামী-শ্বশুরের ভিটের প্রতি আনুগত্য তাকে বড় নাজেহাল করে তোলে। কোথায় যেন একটা বউ কথা কও পাখি ডাকছে, বুনো ফুলের গন্ধ মিশে আছে হাওয়ায়। অনেকক্ষণ বসে থাকে বেহুলা, কাপড়ের খুঁটটা চেবায় অন্যমনস্কের মতো। তারপর নিশ্বাস ফেলে মন স্থির করে বলে, “আমাকে আমার শ্বশুরের ঘরেই পাঠিয়ে দাও মাসি, আমার কপালে যা আছে তা-ই হবে।”
মনসা উঠে দাঁড়াল। ওদের যাবার ব্যবস্থা করতে হবে। গম্ভীর গলায় বলল, “ঠিক আছে, তবে তাই হোক। কাল তুদের খুব ভোরে রওনা হতি হবে। তুরা গরুর গাড়িতে যাবি, পায়ে হেঁটে তুদের সাথে সরল, তারক আর ভীমা যাবে। স্বামীর অষুধগুলো বুঝে লে।”
পরের দিন একমাথা ঘোমটা টেনে বেহুলা, আর দুর্বল শরীর লখিন্দর গরুর গাড়িতে বেদেদের আস্তানা ছেড়ে ঘরের পথে রওনা হল। বেহুলার দু-চোখ বেয়ে জল নেমে এসে তার বুকের কাপড় ভিজিয়ে দিচ্ছে। বেদের দলের মেয়েদেরও চোখে জল।
গভীর রাতে লখিন্দরদের গরুর গাড়ি চাঁদ সদাগরের ফটক পার করল। কড়কড় করে লোহার সিংদরজা বন্ধ হয়ে গেল। বাইরে থেকে গেল সরল আর তার দুই সহচর। তারা কিন্তু ফিরে গেল না, গ্রামের ঠিক বাইরে মাঠের ধারে তারা তাঁবু খাটাল।

চাঁদের বাড়িতে তখন যথার্থই চাঁদের হাট। কোথায় গেল সনকার অচৈতন্য দশা, কোথায় গেল চাঁদ সদাগরের কপালে চিন্তার ভাঁজ। বাড়িতে সবাই খুশি, সবাই আনন্দের বানে ভাসছে। কবিরাজ বৈদ্যরাজ এসে লখিন্দরের ভগ্ন স্বাস্থ্যের চিকিৎসা শুশ্রূষা করছেন। ছয় বউদি ঘড়ি ঘড়ি পথ্য, লেপ, অনুপানের ব্যবস্থা করছে। বাড়িতে পুরোহিতরা যাগযজ্ঞ করছেন অষ্টপ্রহর। এর মধ্যে বেহুলা কেমন আছে? না, সে এখনও অন্দরমহলে জায়গা পায়নি। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের নির্দেশে অন্দরমহলের উঠোনে ছোট শিব মন্দিরটির গায়ে একটা খড়ের কুটিরে তার ঠাঁই হয়েছে। তার প্রায়শ্চিত্ত চলছে প্রতিদিন। বেহুলা মেয়েমানুষ হয়ে ঘরের বাইরে রাতের পর রাত কাটিয়েছে, নিচু জাতের হাতে খেয়েছে, তাকে ঘরে তোলায় মত নেই তার শ্বশুরের। খড়ের ঘরে প্রায়শ্চিত্তের দিন গুনছে বেহুলা, বাড়ির দেওয়ালের বাইরে ইতিউতি ঘুরছে সরল আর তার দুই সহচর। বড়বাড়ির ঠাকুর, চাকর, মালীদের সাথে ভাব জমাচ্ছে আর খবর সংগ্রহ করছে। লখিন্দরের কাছে মনসার কথা শুনে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ চাঁদ সদাগর গ্রামের হাটে মনসার নামে একটা অশ্বত্থ গাছের তলা বাঁধিয়ে দিয়েছেন। ক্রমে গ্রামের মেয়েরা সেই গাছের ডালে নুড়ি পাথর বেঁধে মনসার নামে মানত শুরু করল। বেহুলার কিন্তু পাপ আর কাটে না।
সে এক অমাবস্যার রাত। অন্ধকার রাতের সঙ্গে গা মিলিয়ে একটা লোক বেহুলার খড়ের ঘরে বাইরে থেকে চকমকি পাথর ঠুকে আগুন ধরিয়ে দিল। সাধারণ মানুষ বেহুলার যতই প্রশংসা করুক, তার কলঙ্ক ঘোচার নয়। চাঁদ সদাগর ছেলের আবার বিয়ে দেবেন, এই বউকে ঘরে তুলবেন না। দেখতে দেখতে দাউ দাউ করে খোড়ো ঘর জ্বলে উঠল। বেহুলা ঘুম ভেঙে জেগে বসেছে, ধোঁয়ায় তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। পাঁচিল সংলগ্ন দেওয়ালের নিচ থেকে সিঁধ কেটে উঠে এল সরল। প্রায় অচৈতন্য বেহুলাকে গর্ত দিয়ে টেনে সুড়ঙ্গপথে চাঁদের বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে নিয়ে আসে সে। বাইরে অপেক্ষা করছিল তার দুই সঙ্গী। বেহুলাকে পিঠে ফেলে ছুটতে ছুটতে তারা নদীর ধারে এসে পৌঁছয়। দ্রুতগামী ছিপ নৌকা আগে থেকেই ঘাটে বাঁধা ছিল। বেহুলাকে নিয়ে তারা রওনা হয় বেদেদের ডেরায়।
বহুদর্শী চাঁদ সদাগর পোড়া ঘরে সুড়ঙ্গপথ দেখে যা বোঝার বুঝে যান। বেহুলার আর খোঁজখবর করেন না তিনি। লোকে জানল বেহুলা মন্দিরে পুজো দিতে গিয়েছিল। প্রদীপের আগুনে থেকে আঁচলে আগুন লেগে পুড়ে মারা গেছে।
লোকের চোখে মৃতা বেহুলা মনসার ঘরে ধনেশ পাখির পালকের মালা পরে চিবুকে উল্কি কেটে সরল বেদের বউ হয়ে যাযাবর বেদের জীবনে মিশে যায় ক্রমে।
বেহুলা লখিন্দরের গল্প লোকের মুখে উপকথা ছাড়িয়ে ব্রত কথায় ঠাঁই পায়। ভাঙাচোরা কুঁড়ের ভাঙা চাল দিয়ে চাঁদের আলো এসে ঘুমন্ত সরল আর বেহুলার মুখে আলোর গল্প, সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার গল্প আঁকে।

রেডিও এবং বন্ধুর গল্প

যুগান্তর মিত্র

জুতো পরার জন্য বারান্দায় বেঞ্চে বসার পরেই দেখলাম দাদাই বসে আছেন। প্রতিদিন অফিসে বের হওয়ার সময় এখানে বসেই জুতোটা পরি। এই লম্বা বেঞ্চটার একপাশে কাঠের জুতোর র‍্যাকে সারি সারি সবার জুতো সাজানো থাকে। বেঞ্চের যেদিকে জুতোর র‍্যাক, ঠিক তার উলটোদিকে বসেছিলেন দাদাই। ঠাকুরদাকে আমি দাদাই বলে ডাকি। দেখলাম দাদাই আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। এইসময় আমার তাড়াহুড়ো থাকে। আটটা আটত্রিশের ট্রেনটা না পেলে সমস্যা হয়। একদল একসাথে ট্রেনে যাই। বসার জায়গা পালটাপালটি করি। তাছাড়া পরবর্তী ট্রেন বেশ খানিকটা পরে, এটা না পেলে তাই অফিসের খাতায় লেট মার্ক পড়ে। এইসব কারণেই দাদাইয়ের বসে থাকা নিয়ে মাথা ঘামাই না।

– আমার রেডিওটা চলছে না ছোট্টু। একবার কোনও দোকানে দেখাতে পারিস?
দাদাই বিড়বিড় করে বললেন। আমাকেই বলছেন কথাটা, কিন্তু অনেকটা স্বগতোক্তির মতো শোনাচ্ছে। এর আগে কোনোদিন রেডিওটা খারাপ হয়েছিল কিনা মনে পড়ে না। সেই ছোট্টবেলা থেকে দেখছি একভাবে রেডিও চলছে।

– এত ঢাউস রেডিও কোথায় দেখাব দাদাই? নিয়ে যাওয়াই তো ঝামেলার!

– অ। তাহলে কি একজন ভালো মেকানিককে ডেকে আনবি?

– রেডিও সারাইয়ের দোকানই বা কোথায় কে জানে! খোঁজ নিতে হবে।

– আচ্ছা, খোঁজ নিস। একটু তাড়াতড়ি দেখিস। রেডিওটাই তো আমার সম্বল। তোর ঠাকুমা চলে যাওয়ার পর…

– হ্যাঁ হ্যাঁ, খোঁজ নেব। এখন আমি আসি দাদাই। ট্রেনটা মিস হয়ে যাবে।

– আচ্ছা আয়।

ইতিমধ্যে প্রতিদিনকার মতো মা এসে দাঁড়িয়েছেন বারান্দায়। যথারীতি আমার ‘মা আসি’ আর মায়ের ‘দুগগা দুগগা’ পর্বও শেষ।
আমি ছুটলাম ট্রেন ধরতে। যেতে যেতে দাদাইয়ের কথাটা কানে বাজল। তোর ঠাকুমা চলে যাওয়ার পর… আরও কিছু বলতেন। আমিই থামিয়ে দিলাম। তাড়াহুড়োর সময় এত কথা শোনা যায় নাকি? কিন্তু ঠাকুমার চলে যাওয়ার সঙ্গে রেডিও সম্বল হওয়ার কোনও সম্পর্ক আছে নাকি?
দাদাই বরাবর নিজের মতো চলেছেন। ঠাকুমা সকাল থেকে অনেকক্ষণ পুজোর ঘরে কাটাতেন। কালেভদ্রে রান্নাঘরে যেতেন। অবসর সময়ে খবরের কাগজ আর বই পড়তেন। দুপুরে খাওয়াদাওয়া মিটতে আড়াইটে-তিনটে বেজে যায়। তারপরে খানিকক্ষণ যা অবসর পেতেন। দাদাইয়ের সারাক্ষণ এটা চাই, ওটা দিও, সেটা নেই কেন— এইসব ফাইফরমাশ সামাল দিতে দিতেই অনেক সময় চলে যেত। দাদাই শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা ভোরে উঠে স্নান সেরে আহ্নিক করেন, তারপর চা-বিস্কুট খেতে খেতে রেডিওতে খবর শোনেন। বোতাম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খবর, রবীন্দ্রসঙ্গীত, কৃষিসমাচার, মাঝে মাঝে নাটক শোনা— এসবই করেন সারাদিন। আর সকাল আটটায় টিফিন, বেলা একটার মধ্যে দুপুরের খাওয়া, বিকেল চারটেয় শুধু চা, এরপর দলবলের সঙ্গে একচিলতে মাঠে বসে তাস খেলা। সন্ধে ছ-টা সাড়ে ছ-টায় মুড়ি জাতীয় হালকা খাবার, রাত নটার মধ্যে রাতের খাবার খাওয়া। ঘড়ি ধরে এসব করেন। একসময় কর্পোরেশনের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। অবসর নিয়েছেন যখন, তখন আমি সদ্য জন্মেছি। এর মধ্যে ঠাকুমার থাকা না-থাকার কোনও সম্পর্ক নেই। ঠাকুমা বেঁচে থাকতে যা-যা করতেন, মানে ফাইফরমাশ জোগানো, মারা যাওয়ার পর মা বা শোভাপিসি সেসব করেন। শোভাপিসি আমাদের বাড়ির সর্বক্ষণের কাজের লোক। আমার বাবার ছোটবেলা থেকেই কাজ করেন। ব্রাহ্মণ, বাল্যবিধবা ও নিঃসন্তান বলে আমাদের ঘরের লোকের মতোই থাকেন। আসলে শোভাপিসির কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই। না বলে দিলে কেউ বুঝবেই না উনি আমাদের বাড়ির কাজের লোক। আমি, বাবা, মা কোনও কাজে ভুল করলে পিসি ধমকও দেন। আমার নিজের পিসি নেই। বাবাও আমার মতোই একমাত্র সন্তান। ছোট থেকেই দেখে আসছি বাবাকে ফোঁটা দেন আর বাবাও শোভাপিসিকে প্রণাম করেন। সেই পিসিও দাদাইয়ের দাপট সহ্য করেন বরাবর। ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর দাদাই কি স্ত্রীর অভাবটা বুঝতে পারছেন? কিংবা বলতে হয় বলেই বললেন ঠাকুমার চলে যাওয়ার কথা। যেন ঠাকুমা মারা যাওয়াতে খুব ভেঙে পড়েছেন। আমার ধারণা তা নয়। শুধু মৃতদেহটা ম্যাটাডোরে তোলার আগে দু-হাত দিয়ে গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন মনে আছে। তারপর নিঃশব্দে সোজা নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলেন। শ্মশান থেকে ফেরার পরও কোনও ভাবান্তর দেখিনি। এমনকী ঠাকুমার শ্রাদ্ধের দিন শ্রাদ্ধবাসর ও খাওয়াদাওয়ার দিকে হেঁটে চলে বেড়িয়েছেন নির্লিপ্তভাবে। তাঁর মুখে ঠাকুমার চলে যাওয়ার জন্য আক্ষেপটা কেমন যেন বেমানান ঠেকল। এইসব ভাবতে ভাবতেই দেখি ট্রেন ঢুকছে সামান্য লেটে। তাড়াতাড়ি ট্রেনে ওঠার দিকে মন দিই।

(২)

দুপুরে অফিসে টিফিনের সময় হঠাৎ মনে পড়ল দাদাইয়ের রেডিওর কথা। অফিসের বিশ্বাসদাকে জিজ্ঞাসা করলাম। কলকাতায় থাকেন। যদি ভালো কোনও রেডিও সারাইয়ের দোকানের ঠিকানা বলতে পারেন। আমাদের বাজারে যাদব রেডিও সার্ভিস নামে পুরনো একটা দোকান ছিল। সেটা উঠে গেছে। দোকানটা অন্য একজন কিনে কম্পিউটার সেন্টার করেছে। আর কোথায় দোকান আছে জানা নেই। বিশ্বাসদাকে দেখেছি খেলা-টেলা থাকলে পকেট রেডিও নিয়ে আসতেন আগে। ইদানীং অবশ্য মোবাইলেই খেলার আপডেট পেয়ে যান। খেলা দেখতেও পারেন।

– না রে ভাই, রেডিওর পাট কবেই উঠে গেছে আমাদের। তবে শ্যামবাজারের কাছে নাকি একটা ভালো দোকান আছে। আমার ভায়রাভাই গতবছর ওখান থেকে রেডিওটা সারিয়েছিল শুনেছি।
‘যেখানে দেখিবে ছাই’ মনে করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমি। কিছু একটা খোঁজ না নিয়ে বাড়ি ফিরলে দাদাই ঘ্যানঘ্যান করেই যাবেন।

– দোকানের ঠিকানাটা জোগাড় করে দেবেন দাদা? আর ফোন নম্বর থাকলেও দেবেন।

– দাঁড়া দেখি ফোন করে।

বিকেলের আগেই একটা চিরকুটে ঠিকানা আর ফোন নম্বর লিখে দিলেন বিশ্বাসদা। অফিস থেকে খুব দূরে নয়। বাসে দু-তিনটে স্টপেজ। একটু আগে অফিস থেকে বেরিয়ে সেই দোকানে গিয়ে পৌঁছলাম।
ছোট্ট দোকান। শোকেসে পরপর কয়েক রকম মডেলের রেডিও সাজানো। বয়স্ক একজন বসে আছেন। মাথাজোড়া টাক। তাঁর সামনে একটা রেডিও। ঝুঁকে পড়ে রেডিওর ভেতর কী যেন দেখছেন। আমার মনে পড়ে গেল, ছোটবেলায় আমিও অমন করে রেডিওর ভেতরে দেখতাম। যারা গান গায়, খবর পড়ে, নাটক করে, নানা কথা বলে, তারা এই বাক্সের মধ্যে থাকে কী করে? তাদের চেহারা কতটুকু? তারা কী খায়? কে-ই বা তাদের খেতে দেয়? নাকি তাদের খাওয়াদাওয়ার দরকার পড়ে না এই বাক্সে ঢুকলে? কে তাদের এই বাক্সের মধ্যে পুরে দিল? এইসব ভাবতাম আর আঁতিপাঁতি করে খুঁজতাম লোকগুলোকে। কাউকেই দেখতে পেতাম না। একবার ছোটমাসির বাড়ি গেলাম বাবা-মায়ের সঙ্গে। মেসোমশাই দেখলাম সন্ধ্যাবেলায় একটা কালো ছোট রেডিও নিয়ে বসেছেন। আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আমাদের রেডিওতে যেমন-যেমন গলা শুনি, এখানেও সেই চেনা গলা। দাদাইয়ের এত বড় রেডিওতে যারা ঢুকে বসে আছে, তারা এখানে এল কী করে? এখানে কি তাদের আরও ছোট ছোট করে ঢুকিয়ে দিয়েছে কেউ? এসব কথা কাউকে জিজ্ঞাসা করতাম না। কেন যেন ভয় হত। বাড়ি ফিরে ভয়ে ভয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসাই করে বসলাম। বাবা বড্ড রাগী। সবসময় মেজাজ তিরিক্ষি থাকে। তবু অদম্য কৌতূহল থামাতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। ও মা! বাবা দেখি হেসে ফেললেন। তারপর বললেন, ওখানে কেউ ঢুকে বসে নেই রে পাগলা। ইথার তরঙ্গে এইসব কথা, গান ভেসে ভেসে আসে। কলকাতায় একটা ঘরে ওরা বলে আর আমরা শুনতে পাই। আমার বিস্ময় আরও বেড়ে গেল। অত দূরে কথা বলে, গান গায় আর আমরা শুনতে পাই?

– হ্যাঁ রে ছোট্টু, বাতাসে ভেসে আসে।

– আমাদের কথাও বাতাসে ভাসে?

– ভাসে হয়তো। কিন্তু যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে বললে সেই কথা, গান সব বাতাসের ডানায় চড়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়।

– বাতাসের ডানা আছে বাবা? কই, দেখতে পাই না কেন?

– এটা একটা কথার কথা। বাতাসই দেখা যায় না তো তার ডানা দেখবি কেমন করে? অনুভব করতে হয়।

বাবা আরও নানাভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আমি কিছু বুঝেছি, বেশিরভাগই বুঝিনি। এই লোকটাকে দেখে সেইসব কথা মনে পড়ে গেল। লোকটা আসলে রেডিও সারাই করছেন। বিশ্বাসদা ঠিক ঠিকানাই দিয়েছেন। কিছুক্ষণ রেডিওটা ভালো করে দেখার পর আমার দিকে চোখ তুললেন। যেন এইমাত্র দেখলেন আমাকে। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। চোখে জিজ্ঞাসা।

– আমাদের একটা রেডিও আছে। হঠাৎই চলছে না, বন্ধ হয়ে গেছে। সেটা সারাই করতে হবে। সেইজন্যই আসা।

– কই দেখি?

– না, মানে, আনিনি। এত বড় রেডিও…
হাত দিয়ে আকার বোঝানোর চেষ্টা করি।

– ও, আনেননি। তা রেডিও না দেখলে সারাই হবে কী করে?
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন। গলার স্বরে কোনও ওঠানামা নেই। বিস্ময় বা কৌতুক নেই।

– আসলে ঢাউস রেডিও, আনাটা সমস্যার।
আবার দু-হাত দিয়ে আকার দেখাই।

– অনেক পুরানো রেডিও? এত বড় রেডিও তো আজকাল তৈরিই হয় না।
এমন কিছু মানুষ আছে, যাদের কথাবার্তা শুনলে রাগ, ক্ষোভ, কৌতুক, বিস্ময় কিছুই বোঝা যায় না। ইনি এই গোত্রের মানুষ। কথার মধ্যে কোনও তরঙ্গ নেই, ওঠানামা নেই, সোজা পথে কথাগুলো হাওয়ায় ভেসে আসে।

– নিয়ে এলে দেখে দিতে পারি।

– কোনও মেকানিককে পাঠানো যায় না? যা খরচ লাগে…

– মেকানিক আর কে আছে! আমিই দোকানদার, আমিই মেকানিক। কারও বাড়িতে যেতে গেলে তো দোকান বন্ধ রাখতে হয়। সেটা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।

– খুব দূরে নয়, ট্রেনে আধঘণ্টা মতো…

– বললাম তো।
বলেই বসে পড়লেন। বসার ভঙ্গি দেখে মনে হল চূড়ান্ত হতাশ হয়েছেন তিনি। চশমার মোটা কাচ ভেদ করে আমার মুখে দৃষ্টি পেতে দিয়ে বললেন, সময় করে রেডিওটা একটু কষ্ট করে নিয়ে আসুন, দেখে দেব। না হলে নতুন একটা কিনে নিন।
আবার ঝুঁকে পড়লেন সারাইয়ের কাজে। আমি ধীরে ধীরে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। বাড়ি ফিরে দেখি দাদাই বসে আছেন সেই বেঞ্চে। একই জায়গায়। যেন সকাল থেকে ওখানেই বসে আছেন। লুঙ্গির মতো করে ধুতি পরা। সকালে খালি গা ছিল, এখন হালকা নীল রঙের একটা ফতুয়া আছে গায়ে। এটুকুই যা পার্থক্য।

– কোনও খবর পেলি ছোট্টু?

– একটা দোকানে খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। বলল রেডিওটা দোকানে নিয়ে যেতে হবে। কোনও মেকানিক বাড়িতে আসবে না।

জুতো খুলতে খুলতে জবাব দিলাম।

– তাহলে কালই নিয়ে যাস। আমি ব্যাগে ভরে দেব সকালে।

– আমার কি মাথা খারাপ নাকি? অফিসে অতবড় ব্যাগ নিয়ে যাওয়া যায়? ভিড় থাকে না ট্রেনে? শনিবার নিতে পারি। আমার কলকাতায় একটু কাজ আছে। ট্রেনও হালকা থাকে। তখন নিয়ে যাব।

– আজ বিষ্যুদবার, কাল শুক্কুর, তারপর শনি। দিলেই তো আর ঠিক করে দেবে না। ক-দিন অপেক্ষা করতে হবে কে জানে!
দাদাইয়ের স্বগতোক্তি শুনতে শুনতে ঘরে চলে গেলাম।

– তোর দাদাইয়ের রেডিও ঠিক হয়ে গেছে। সন্ধ্যাবেলায় চা দিতে গিয়ে দেখলাম খবর শুনছেন।
পরদিন অফিস থেকে ফেরার পর মা বললেন।

– তাই নাকি? বাঁচা গেল। কী করে হল ঠিক?

– কী জানি। বললেন তোর বাবা নাকি ঠিক করে দিয়েছে।

– বাবা? বাবা আবার রেডিও মেকানিক হল কবে থেকে?
আমি হেসে বলি।

– জানি না। যা বললেন শুনলাম। একদিকে ভালোই হল। না হলে রোজ রোজ তোর কাছে ঘ্যানোর ঘ্যানোর করতেন। তোর বাবাকে তো আর কিছু বলেন না, যা বলার তোকে আর আমাকে…
একটু বাদে দাদাইয়ের ঘরে উঁকি মেরে দেখি চোখ বুজে বসে গান শুনছেন। শচীনদেব বর্মন গাইছেন, ‘তুমি এসেছিলে পরশু/ কাল কেন আসোনি…’ গানটা তখন শেষের দিকে। আমি ঘরে ঢুকে পড়লাম। সম্ভবত চটির শব্দে চোখ খুললেন। মুখে একঝলক হাসি ফুটে উঠল।

– কী করে ঠিক হল?

– তোর বাবা এসে ব্যাটারি নাড়াচাড়া দিল। তারপর রেডিওর ওপরে জোরে এক থাবড়া মারল। ব্যস, চালু হয়ে গেল।

– বাহ্, খুব ভালো। এবার থেকে রেডিও বন্ধ হয়ে গেলেই থাপ্পড় মারবে। তাহলেই ঠিক হয়ে যাবে।
দাদাইয়ের মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। আমি চলে আসার জন্য পিছন ফিরেছি সবে, শুনলাম দাদাই বলছেন, খবরে রায়টের কথা কিছু বলল না তো!

– রায়ট? মানে দাঙ্গা? কোথায়?

– কী জানি। মিত্তিরবাবু বলছিলেন। কোথায় যেন রায়ট হয়েছে আমাদের রাজ্যে।

– এমন খবর তো শুনিনি! আর মিডিয়ায় রায়টের খবর এভাবে দেয় না দাদাই। ওদের কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে।
দাদাই আমার কথা ঠিকমতো শুনলেন কিনা বোঝা গেল না। তাকিয়ে দেখি চোখ যেন ঝলসে যাচ্ছে।

– মোল্লারা বড্ড বাড় বেড়েছে। ওদের মেরে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত।

– কী বলছ দাদাই! তুমি না একসময় ১৫ই আগস্ট ক্লাবের পতাকা তুলতে আর বক্তৃতা দিতে? দেশের স্বাধীনতায় হিন্দু-মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে বলতে?

– হুঁহ্, জানা আছে কত লড়েছে! ওই ব্যাটা জিন্নাহ কম করেছে? দেশটার চোদ্দোটা বাজিয়ে দিল। এতই যখন তোদের আলাদা দেশ দরকার, তাহলে সব ব্যাটা মোল্লাকে নিয়ে গেলি না কেন পাকিস্তানে? রক্তবীজের ঝাড় রাখলি কেন এদেশে?
এতক্ষণে পরিষ্কার হল রেডিওর জন্য এত উতলা হয়েছিলেন কেন দাদাই। তাহলে ঠাকুমার না থাকার অসহায়তার কথাটা নেহাতই কথার কথা। এইসব দাঙ্গার খবরাখবর শুনতে চান রেডিওতে! চোখের দৃষ্টি কমে যাওয়ায় খবরের কাগজ পড়তে কষ্ট হয়। টিভিও দেখতে চান না। একসময় টিভিতে রামায়ণ সিরিয়াল হত। তখন কয়েকদিন নাকি দেখেছিলেন। পরে তাঁর মনে হল, এগুলো সব দামি দামি জামাকাপড় পরে নাটক করা। রামযাত্রায় প্রাণ ছিল, এসব কেমন বানানো মনে হয়। তাই সেই ধারাবাহিক দেখাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

– তোমাদের তাসের আড্ডায় বুঝি আজকাল এসব আলোচনা হয়?

– তাসের আড্ডায় কেন? সবাই জানে। সবাই বলাবলি করে। শুনতে পাস না?
দাদাই ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।

– বাবরি মসজিদ ভাঙা হল। তাও তোদের শিক্ষা হল না? হাতের কাছে কোনও মোসলমানকে পেলে কচুকাটা করতাম।
এসব কথা শুনতে ভালো লাগে না। তাছাড়া কথায় কথা বাড়ে। দাদাইকে অনেক যুক্তি দেওয়া যায়। কিন্তু উনি এখন কিছুতেই শুনবেন না, জানি। পরে বোঝাতে হবে।
সাম্প্রদায়িক মানসিকতা আমার কোনোদিনই ছিল না। মনে আছে, একবার নিজের অফিসের বসের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম বাবা। পার্কসার্কাস। তখন সদ্য গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি। যদি কোনও চাকরির সুযোগ করে দেন উনি এই আশায়। উনি কিছু করে দিতে পারেননি বা করেননি। আমি ইন্টারভিউ দিয়েই চাকরি পেয়ে গেছি বরাতজোরে। আমার অনেক ভালো নম্বর পাওয়া বন্ধুও সরকারি চাকরি পায়নি। তাই এই চাকরি পাওয়াটা বরাতই মনে হয় আমার।
বাবার সেই বস ছিলেন মুসলিম। দেখলাম বাবা চেয়ার-টেবিলে বসে দিব্যি পায়েস খেলেন। বামুনের ছেলে হয়ে, পৈতে গলায় বাবাকে পায়েস খেতে দেখে আমিও খেয়ে নিলাম। তারপর বসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রাম ডিপোর কাছে এসে বাবা বললেন, শিককাবাব খাবি ছোট্টু? এরা খুব ভালো বানায়। একটা দোকান দেখালেন আঙুল দিয়ে।

– এগুলো তো বিফ বাবা!

– তাতে কী? দারুণ বানায়। খেয়ে দেখ। বাড়িতে কিন্তু জানাস না!
আমি আর বাবা শিককাবাব খেয়ে ট্রাম ধরলাম। খুব যে আহামরি লেগেছিল আমার তা নয়, তবে মন্দও লাগেনি। মাঝে মাঝে রাগী বাবাকে অন্যরকম দেখি। তখন বুকের মধ্যে সরু একটা নদী কুলকুল করে বয়ে যায়।
দাদাইয়ের ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম।
বাড়ির বাজারহাট বাবা নিজের হাতে করেন। আমি ঠিকঠাক গুছিয়ে আনতে পারি না। কালেভদ্রে আমি বাজারে যাই। তখন আবার বাবা কাগজে লিস্ট করে দেন। সবজি কোনটার সঙ্গে কোনটা আনতেই হবে তাও বুঝিয়ে দেন। রবিবারের সকালে বাজার থেকে ফেরার সময় বাবার সঙ্গে দেখি একজন লোক। আমার থেকে খানিকটা বড়ই হবেন। সাদা চুড়িদার-পাঞ্জাবি পরা। চোখে গোল্ড ফ্রেমের শৌখিন চশমা। পায়ে চামড়ার চটি। গোঁফ নেই, কিন্তু থুতনিতে হালকা দাড়ি আছে। তার মধ্যে দু-একটা পাকাও। চোখ সরু করে আমি দেখি লোকটাকে।

– ছোট্টু, ওকে বসতে দে। আমি বাজারের ব্যাগটা রেখেই আসছি।
আমি সোফার মতো দেখতে ডাবল সিটেড চেয়ারটা দেখিয়ে দিলাম তাঁকে। বাবাও বাজারের ব্যাগ রেখে তাড়াতাড়ি এসে লোকটার পাশে বসলেন। চেয়ারের সামনে একটা সেন্টার টেবিল পাতা থাকে। তাতে খবরের কাগজ থাকে।
টেবিলটা সামনে রেখে বাবা আর ওই লোকটা খুব গল্পে মেতে আছেন দেখে কৌতূহল হল। টেবিলের উলটোদিকে পাতা লাল প্লাস্টিকের চেয়ারে গিয়ে বসলাম আমি। ব্যাপারটা কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে!
দেখলাম তাঁর সঙ্গে আনা চামড়ার কালো ব্যাগ থেকে একটা ডাইরি বের করলেন। সেই ডাইরির পাতা খুলে একটা খাম বাবার হাতে তুলে দিলেন। বাবাও যত্ন করে খামটা খুলে একটা সাদা-কালো ফটোগ্রাফির দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। লোকটা হাসি হাসি মুখে তর্জনি দিয়ে একজনকে দেখিয়ে বললেন, এই হল মন্টু চাচা। এই ছবিটার কোথাই বলছিলাম।
বাবার মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। টেবিলে ছবিটা রেখে আঙুল দিয়ে একজনের উপর নির্দেশ করে আমাকে বললেন, এই দেখ ছোট্টু, আমার বাবা। স্কুলে পড়তেন তখন। ইউনিফর্ম পরা আছে দেখ।
বহু পুরানো ছবি। স্কুলের ইউনিফর্ম পরা চারজন কিশোর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে। এর মধ্যে একজন নাকি আমার দাদাই। আমার তো বোঝার প্রশ্নই নেই, বাবাও চিনেছেন বলে মনে হয় না। তবু কেমন যেন উচ্ছ্বসিত দেখাচ্ছে বাবাকে।

– ওহ্ হো, তোকে তো বলাই হয়নি, এ হল বরকত চাচার ছোটো ছেলে বিলায়েত। ওরা এখন লখনউ থাকে। মেডিকেল কলেজে চাচার চিকিৎসার জন্য এনেছে। খুঁজে খুঁজে আমাদের বাড়িতে এসেছে। কী অদ্ভুত দেখ, আমাকেই জিজ্ঞাসা করছে আমাদের বাড়ির ঠিকানা। হা হা হা… ধরে নিয়ে এলাম ওকে।
বরকত নামটা বহু আগে দাদাইয়ের মুখে কয়েকবার শুনেছি। দাদাইয়ের ক্লাসমেট ছিলেন। খুব দোস্তি ছিল নাকি। বুঝলাম তাঁরই ছেলে এসেছে। সঙ্গে অভিজ্ঞানপত্রের মতো দাদাইয়ের কিশোরকালের ছবি। এই চিহ্ন দেখে বুঝে নাও আমি হলাম আসলি লোক। মনে মনে হাসি আমি। জোড়হাত করে নমস্কার করি। বিলায়েত নামের লোকটা উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়ান। আমি কিছু না বুঝেই উঠে দাঁড়াই। তারপর আমাকে দু-হাতে আঁকড়ে ধরেন বুকে। যেন কতদিন পরে দেখলেন। তাঁর উষ্ণতায় আমার শরীর গলে গলে যেতে লাগল।

– তোরা কথা বল। আমি বাবাকে নিয়ে আসি এখানে।
কথাটা বলেই বাবা ভেতরের ঘরে চলে যান। আমাদের পাশাপাশি তিনটে ঘর। একেবারে ধারের ঘরে আমি থাকি। মাঝের ঘরে বাবা আর মা, তারপরের ঘরে দাদাই থাকেন। তিনটে ঘর জুড়ে লম্বা বারান্দা। ডানদিকে এল প্যাটার্নের হয়ে বেঁকে গেছে বারান্দাটা। তার প্রান্তে রান্নাঘর। সেখান থেকে মাও তাকিয়ে আছেন এদিকে।
বিলায়েতের কথা বলায় টান আছে। বাংলা ভালো বলতে পারেন না। তবু চেষ্টা করে যাচ্ছেন বাংলাতেই কথা বলার। হিন্দি মিশে যাচ্ছে সেই কথায়। ওঁদের বাড়িঘর সম্পর্কে নানা কথা হল। আমার চাকরি নিয়েও কথা হল কিছুটা। তাঁর আব্বুর বুকে জল জমেছে। অন্য কোনও হাসপাতালে কিছুতেই ভর্তি হবেন না। কলকাতার হাসপাতালেই ভর্তি করতে হবে বলে গোঁ ধরে ছিলেন। তাই বাধ্য হয়ে এখানে আনা। জানালেন বিলায়েত।
এইসব গল্পের ফাঁকেই দাদাইয়ের কাঁধ ধরে ধরে বাবা নিয়ে আসছেন লম্বা বারান্দা দিয়ে। মুখে হাসি ঝুলে আছে দুজনেরই।
বিলায়েত প্রায় ছুটে গিয়ে দাদাইয়ের পায়ে হাত রাখলেন। দাদাই বিলায়েতের মাথায় দু-হাত রেখে বিড়বিড় করে কিছু একটা বললেন। তারপর জড়িয়ে ধরলেন বুকে। তাঁর চোখ চিকচিক করে উঠল।
আর একটা প্লাস্টিকের চেয়ার এনে বাবা বসলেন। দাদাই বসলেন বিলায়েতের পাশে। দাদাইয়ের হাতে পুরানো চশমা তুলে দিলেন বাবা। সেই চশমা পরে দাদাই ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।

আমরা চারজন খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। দুজন চলে গেছে ওপরে। আমরা দুই বুড়ো এখনও টিকে আছি।

– আর একটা জিনিস ভি আছে আমার কাছে।

বিলায়েতের কথা শুনে আমরা তাঁর দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। চামড়ার ব্যাগটা থেকে বিলায়েত একটা জুয়েলারি বক্স বের করলেন। দেখে মনে হল বড় আংটির বক্স। সেটা খুলে সোনালি রঙের একটা কী যেন তুলে দিলেন দাদাইয়ের হাতে। চশমার কাচ এফোঁড়-ওফোঁড় করে দাদাই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জিনিসটা দেখছিলেন।

– বিরানব্বইয়ের ঝামেলার সময় আমাদের নিয়ে আব্বু পালিয়ে গেলেন লখনউ। এর দু-চারদিন আগে আপনি আমাদের বাড়িতে এটা ফেলে এসেছিলেন। পালানোর সময় এটা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন আব্বু।

– হ্যাঁ হ্যাঁ, সেনকো জুয়েলারি থেকে সোনার গণেশ কিনেছিলাম আমি। তোমাদের বাড়িতে ফেলে এসেছিলাম ভুল করে। বাড়ি ফিরে তোমার বাবাকে ফোন করেছিলাম বুথ থেকে। আমার বন্ধুদের মধ্যে তোমাদের বাড়িতেই ফোন ছিল। বরকত বলল হপ্তাখানেক পর দিয়ে যাবে। তারপর থেকে আর যোগাযোগ নেই।

এরপর দাদাই কিশোরবেলার গল্প করলেন। লুচি-তরকারি, মিষ্টি খাওয়ার পর বিলায়েত যখন বিদায় নিচ্ছেন আমাদের সবার কাছ থেকে, তখন দাদাইয়ের দু-গাল বেয়ে জলের ধারা পড়ছে। বিলায়েতের শরীরটা দূরে মিলিয়ে যেতেই দাদাই বললেন, কাল একটা গাড়িভাড়া করিস ছোট্টু। আমি আর তোর বাবা বরকতকে দেখতে যাব মেডিকেল কলেজে। ভাড়ার টাকা কিন্তু আমিই দেব। যত লাগে লাগুক। কতদিন দেখা হয়নি! আর যদি দেখতে না পাই!

– হাতের কাছে পেলে মোল্লার বাচ্চাটাকে কচুকাটা করবে না তো?
নিজের ঘরে যেতে যেতে দাদাই থমকে দাঁড়ালেন। পিছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, কচুকাটাই করা উচিত ব্যাটাকে। এতদিন কোনও খোঁজ নিলি? বন্ধুর খোঁজখবর রাখতে নেই? ঠিকানা জানলে আমি ঠিক চলে যেতাম ওর কাছে।

ধীর পদক্ষেপে নিজের ঘরে পা বাড়ান দাদাই।

ক্লোজ শট ওয়াইড অ্যাঙ্গেল

মৃগাঙ্ক মজুমদার

ওপেনিং সিন

“আরে ধুর কোথায় গেল ওয়াইড লেন্সটা? মা, ও মা, মা-আ-আ। আরে সাড়া তো দাও। বলছি আমার ওয়াইড লেন্সটা গেল কই। ১০-২০-র নিকনের লেন্সটা? অ্যাই দিদি, দিদি অ্যাই, আরে ক্যানন ইএফ এস ১০-১৮-টাও কই গেল? আরে ফ্লাইটের দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!” ঘরের মধ্যে এদিক সেদিক তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে যাচ্ছে প্রিয়াঙ্কা। কাল রাতেই নতুন অ্যাসাইনমেন্টটা কনফার্মড হয়েছে, ইন্ট্যারন্যাশানাল ডকুমেন্টরি প্রজেক্ট। ফ্লাইটের টিকিটও ওরা কেটে পাঠিয়ে দিয়েছে। প্রথমে হিথরোতে নেমে লন্ডনে কিছুদিন। তার পরে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। এই প্রথম একটা এত বড় প্রোজেক্টের ও ডি ও পি, একবারে ড্রিম প্রোজেক্ট। এর জন্যই তো অনেক কিছু ছেড়ে থাকা। এই জন্যেই তো…

কাট টু

ময়দানে তখন বৃষ্টি নামব-নামব, অরিত্র নিজের ম্যানিবাগটা প্রাণপণে খুঁজছিল। দুটো আইসক্রিম কিনেছে, কিন্তু সিক্স পকেট আর হালকা ছ-পকেটের ছাই রঙের জ্যাকেটের চারটে পকেটের মাঝে কোথায় যে রেখেছে মনেই করতে পারছিল না। চুলটা একটু অগোছালো, দাড়িটা মুখের সঙ্গে মানিয়ে সুন্দর করে শেপ করা। সদ্য অপারেশন করিয়ে চশমাটা বিদায় দিয়েছে। যদিও ফিল্ম স্কুলের সবাই বলে যাচ্ছে এখনও ওকে চশমাতেই বেশি ভালো লাগে। দুটো সরকারি ফ্লিম স্কুলেই পড়াচ্ছে অরিত্র, ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ে ফার্স্টক্লাস পায়নি বলে চাকরির চেষ্টাই করেনি। ফিল্ম নিয়ে পড়তে ঢুকেছিল। তারপর একের পর স্কলারশিপ নিয়ে নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, বুদাপেস্ত আর চেক রিপাবলিকের স্কুলে এখন মাঝে মাঝে যায় ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি হিসাবে। মানিব্যাগটা হাঁটুর কাছে রাখা পকেট থেকে বের করে ইন্দ্রানীর দিকে এগিয়ে যায় আইসক্রিম দুটো নিয়ে।

একটু দূরে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিল প্রিয়াঙ্কা এগিয়ে কথা বলতে যাবে অরিত্রর সঙ্গে। এমন সময়ে ঝেঁপে বৃষ্টি এল। ঝাপসা হয়ে যাওয়া শহরে ইন্দ্রানীর সাথে মিলিয়ে যেত দেখল অরিত্র কে। আর ঠিক তখনই ভলভো বাসটা সামনে এসে দাঁড়াল দৃষ্টি আটকে।

কাট টু

প্নেনের বিজনেস ক্লাসে চড়া এই প্রথম প্রিয়াঙ্কার। মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনে বিজনেস ক্লাসে চড়ে একটু উঁচু লেভেলে উঠে যাওয়া সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়াররা বা অগাধ পৈত্রিক সম্পত্তির মালিকরা, যারা পয়সা কীভাবে খরচা করবে ভেবে পায় না। ক্যামেরাটা কোলের উপরে রেখে জানলা দিয়ে দেখতে থাকে আকাশ রাতটা কেটে ভোর-ভোর হচ্ছে, সকালের নরম আলোটা জানলায় একটু ট্যারাভাবে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চটক ভেঙে ক্যামেরা তুলে তাক করে বাইরের দিকে। একের পর এক ছবি তুলতে থাকে, বর্ষার কালো মেঘগুলো অনেক দূরে।

কাট টু

অরিত্র ক্লাসে পড়াচ্ছে, প্রিয়াঙ্কা শুনছে মন দিয়ে আইজেনস্টাইন, রেনোয়া, জিগা ভের্তভ, কুরোসাওয়া, ঋত্বিক, মৃণাল, সত্যজিৎ, পোলানস্কি, গোদার, ত্রুফো তারকোভস্কি, শট ডিভিশন আর ক্লোজ আপে অরিত্রর মুখ। অরিত্রর অনেক বান্ধবী, প্রিয়াঙ্কার কোনও চান্সই নেই। অরিত্র প্রজেক্টারের দিকে পিছন করে ক্লাসের দিকে ফিরে টেবিলে ভর দিয়ে দাঁড়ায়। একটা পা আর একটা পায়ের উপর ক্রস করে একটা হাত টেবিলে সাপোর্ট নেয়। প্রিয়াঙ্কাকে বলে, “ক্লোজ শট ভালো, রিয়াকশ্যান বোঝা যায়। কিন্তু ওয়াইড একটা ছবিতে অন্য মাত্রা আনে, ব্যাপ্তি বাড়ে, অনেক লেয়ার থাকে আর তুলনায় অনেক কঠিন কিন্তু।” প্রিয়াঙ্কা চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারে না, পা দুটো যেন গেঁথে দিয়েছে কে মাটির সঙ্গে। অরিত্র কাঁচাপাকা ঝাঁকড়া চুলটা কপাল থেকে সরিয়ে, মৃদু হাসে। প্রিয়াঙ্কার পাশ থেকে দেওয়ালগুলো সরতে থাকে, দৃশ্যপট বড় হতে থাকে, চওড়া হয়, ভিড় জমে চরিত্রের।
স্তরের পর স্তর জমতে থাকে, প্রিয়াঙ্কা ফোকাস করতে থাকে ক্যামেরার লেন্সটা।

ক্ল্যাইমাক্স

তিন বছর পর দেশে ফিরে, নিজের ঘরে ঢুকে হাঁফ ছাড়ে খানিক, নিজের ঘরটা যে কী, সেটাই ভুলতে বসেছিল। তিন বছরে সুযোগ পেলেই তার নিরীহ, বাঙালী মা বিয়ের কথা ইনিয়ে বিনিয়ে তুলেছে। মা তাকে জানে। সময় বদলেছে সেটাও বোঝে। তবে ৫০ বছরের শিক্ষা চট করে তো আর কেউ ভুলতে পারে না। এক-একটা প্রজন্ম এক-একটা শিক্ষার মধ্যে দিয়ে, পরিবেশের মধ্যে দিয়ে যায়, আগের বা পরের প্রজন্ম সেটা বুঝতে পারে না পুরোপুরি। কেউ সংঘাতে যায় আর কেউ গুটিয়ে নেয়। ইন্ট্যারনাশানাল সিমটা বের করে, লোকাল সিম ভরল। মেল চেক করতে হবে। অনেক মেসেজও জমেছে। হোয়াটসঅ্যাপ পারতপক্ষে করে না। ল্যাপটপ খুলতে ইচ্ছে করছে না। খাটে শুয়ে মেসেজ আর মেল পড়তে শুরু করল।

অরিত্রর একটা মেল, বাংলায় লিখেছে।


প্রিয়াঙ্কা,

সিনেমা জীবন থেকে আসে, না জীবন সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত হয়, এ কথা এখনও তর্কের মধ্যেই থাকবে। একটা অন্যের পরিপূরক বলে মেনে নিলে হয়।
গোদার বলেছিলেন–
“The cinema is not a craft. It is an art. It does not mean teamwork. One is always alone on the set as before the blank page. And to be alone… means to ask questions. And to make films means to answer them.

“Cinema is not a series of abstract ideas, but rather the phrasing of moments”

জীবনে সবাই একা, মাঝে মাঝে সেট বদলায়, দৃশ্যপট বদলায়, চরিত্র বদলায়, কিন্তু আমরা সবাই একা। ভালোলাগা ভালো, কিন্তু সময়ের সাথে বদলে যায় অনেক কিছু।
ক্লাসরুমে তোমার ভালোলাগা সবার সামনে প্রকট হয়ে আসছিল, অথচ তুমি মুখে কিছু বলতে পারছিলে না। যেটা পারবে না সেটা ছেড়ে দিলে ভালো হয়। আর যদি না-পারাটাকে পারবই বলে ধরে নাও, তাহলে সময়ের সাথে সাথে সেটাও আস্তে আস্তে কাছে আস্তে শুরু করে।

আমার খোঁজ করতে চাইলে, করতে পারো।

তবে এর পরে কোথায় আমাকে পাবে আমি জানি না।

শেষ অংক

৬ মাস ধরে দৌড়াদৌড়ি করে নিজের জমানো পয়সা প্রায় নিঃশেষ করে, ইউ এস-এর জেল থেকে প্রিয়াঙ্কা ছাড়িয়ে আনে অরিত্রকে। ছ-ফুটের চেহারাটা গুটিয়ে কালশিটে মেরে সাড়ে চার ফুটের মনে হচ্ছে। রেপ, ড্রাগ আরও চার-পাঁচটা কেসে জোর করে ফাঁসানো হয়েছিল। ফাঁসানোই, কারণ পরের দিকে ডিফেন্স কাউন্সিল যুক্তি তুলে ধরায় পালানোর পথ পায়নি শেয়ালের দল। অরিত্রর নাম, প্রতিপত্তি কিচ্ছু কাজে আসেনি। সবাই সরে গিয়েছে। ডাক্তার জানিয়েছেন আগামী ১০ বছর কাউন্সেলিং আর ওষুধ চলবে, সিভিয়ার, ডিপ্রেশন, ওসিডি আর স্কিজোফ্রেনিয়া। ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে মানুষটা। প্রিয়াঙ্কা প্লেনের জানলা দিয়ে তাকায়। বাইরে অন্ধকার আকাশে অনেক দূরে কিছু তারা দেখা যাচ্ছে জানলায় চোখ লাগিয়ে রাখলে। প্রিয়াঙ্কা পুরো আকাশটা দেখতে চাইছে ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে, খুব দরকার দেখাটা, খুব…

যখন জমল ধুলো তানপুরায়

অমিতাভ মৈত্র

শুদ্ধ দেখতে দেখতে চার বছর কাটিয়ে দিল শিলিগুড়িতে। চাকরির সুবাদে প্রথম পাঁচ বছর কেটেছিল মেদিনীপুর শহরে। কলকাতায় ট্রান্সফারের ক্ষীণ আশা যে তখন ছিল না তা নয়। কিন্তু হয়নি। মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় প্রতি সপ্তাহে ফেরা এবং সোমবারে আবার গিয়ে অফিস করা যতটা সহজ ছিল, শিলিগুড়ি থেকে এই কাজটা তত সহজ নয়। ফলে বাড়ির সঙ্গে সেই যোগাযোগটা শিলিগুড়িতে এসে কমেছে। শুদ্ধর একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। ছেলে আঠেরো আর মেয়ে চোদ্দো। কস্তুরীর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিল শুভ্র সেই কবে। তখন শুদ্ধ আঠাশ আর কস্তুরী ছাব্বিশ। ইউনিভার্সিটিতে আলাপ হয়েছিল দুজনের। একান্তই মামুলি আলাপ ছিল সেটা। মামুলি হলে কী হবে কস্তুরীর সরল সৌন্দর্য আর কণ্ঠস্বর শুদ্ধকে সামান্য চঞ্চল করে তুলেছিল সেইদিন থেকে। মেয়েদের সঙ্গে নিজে থেকে গিয়ে আলাপ জমানোর ব্যাপারে শুদ্ধর দক্ষতা প্রায় ছিল না বললেই হয়। এ ব্যাপারে দক্ষতা যদি কারুর ছিল তো, সে সুশান্তর। সুশান্তর বান্ধবীর সংখ্যাই ছিল বেশি। সুশান্ত রাজনীতি আর সাহিত্যচর্চার বাইরে যে কোনও বিষয়ে খুব গভীরে না গিয়েও কথা বলে যেতে পারত হালকা মেজাজে। পাছে পিছিয়ে পড়তে হয়, তাই বাংলা খবরের কাগজকে যে ভরসা করা যায়, তা সুশান্তর কাছে পরীক্ষিত সত্য। বড়লোক বাবার একমাত্র সন্তান সুশান্ত বান্ধবীদের এবং নিজেকে খুশি রাখতে বাবাকে যথেষ্ট অশান্তিতে ফেলে রাখত তার কলকাতার হোস্টেলে অর্থকষ্টের বিস্তারিত বিবরণ প্রতি সপ্তাহে জানিয়ে। সুশান্ত ছিল শুদ্ধর গায়ে সেঁটে থাকা সঙ্গী। এমন প্রাণখোলা, মনখোলা বন্ধু শুদ্ধ আগে কখনও পায়নি। কফি হাউসে বন্ধু আর বান্ধবী জড়ো করে আড্ডা হত প্রায়ই। কস্তুরী মাঝে মাঝে থাকত সেই আড্ডায়। অনেকদিনই অকারণে চোখে চোখ পড়ত দুজনের। কস্তুরী চোখ নামিয়ে নিত।
অঘটনটা ঘটেছিল মধ্যমগ্রামে এক বাগানবাড়ির পিকনিকে। সেটা ছিল পঁচিশে ডিসেম্বর। কস্তুরী পিকনিকে আসতে পারেনি সেদিন। শুদ্ধ মনে মনে আহত হলেও কাউকে আগ্রহ দেখিয়ে কস্তুরীর কথা জিজ্ঞেস করতে বাধো বাধো ঠেকছিল। দুপুরের খাওয়াদাওয়া দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হবে সবাই জানত। তাই গানের আসর বসেছিল। মেয়েদের মধ্যে অনেকেরই চর্চা করা গলা। কিন্তু ছেলেদের মধ্যে তেমন কেউ ছিল না। অবশেষে সুশান্ত অন্য এক পরিচয়ে পরিচিত করাল শুদ্ধকে। শুদ্ধ যে বাঁশি বাজায় এটা সবার কাছে ছিল গোপন। প্রচার করার কোনও কারণও আজ পর্যন্ত শুদ্ধ খুঁজে পায়নি। পিকনিকে বাঁশি সঙ্গে করে এনেছিল সুশান্তর একতরফা চাপে। শুদ্ধ পিকনিকে পরিচিত হল সখের বাঁশি বাজিয়ে হিসেবে। আড়বাঁশির সুরে সবাইকে হতবাক করে শুদ্ধ আসর শেষ করেছিল একঘণ্টা পরে। সুশান্ত বলেছিল, “বাড়িতে বসে কতবার তোর বাঁশি শুনেছি। কিন্তু আজকে শালা তোর ঠোঁটে কি মা সরস্বতী চুম্বন করেছিল? নইলে আজ এমন সুর বাজালি কী করে!”
ছাব্বিশ তারিখে সকালে পর পর দুটো ক্লাস সেরে শুদ্ধ যখন সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নিচে নামছিল, তখন একটা বেজে গেছে। নিচে অপেক্ষারত একপাল বন্ধু ও বান্ধবী, সঙ্গে আছে আড্ডাসহ সিগারেটের তৃষ্ণা। সিঁড়ির কোণ থেকে এক বামাকণ্ঠ ভেসে এল ক্ষীণ স্বরে, “সকালে ক্লাস করেননি নাকি?” শুদ্ধ থমকে দাঁড়িয়ে কণ্ঠস্বরের উৎপত্তিস্থলে কস্তুরীকে দেখতে পেল।
শু- আমাকে বলছেন?
ক- আর কাকে বলব? ক্লাস বাঙ্ক করে বন্ধু, আড্ডা আর পরোপকার নিয়ে তো একজনই থাকে।
শু- এটা আমার নামে একটা মিথ্যে অপবাদ। সকালে পর পর দুটো ক্লাস করে এই সবে নিচে নামছিলাম।
ক- সত্যি নাকি? তাই সকালে ক্যান্টিনের আড্ডায় দেখিনি।
শু- এতেই বোঝা গেল আসল সত্যিটা কী।
ক- কোন সত্যিটা বোঝা গেল?
শু- সক্কালবেলা ক্লাস কেটে ক্যান্টিনে আড্ডাটা কে মারছিল।
ক- আপনি তো বেশ ঝগড়ুটে। আমি মোটেও ক্যান্টিনে যাইনি। আপনার খুব সুখ্যাতি শুনে দেখতে গিয়েছিলাম ক্যান্টিনে সকালবেলার আড্ডায় আপনাকে দেখা যায় কিনা। সুশান্ত, আশীষ সবাই খুঁজছিল আপনাকে।
শু- তাহলে স্বীকার করছেন তো, সুখ্যাতি আছে… ঝগড়ুটে বলে বদনাম নেই।
ক- আপনি কি খুব ডিবেটে পার্টিসিপেট করেন?
শু- কীসে আপনার এ কথা মনে হল?
ক- ডিবেটে অপর পক্ষ যা বলে সব কিছু মনে রাখতে হয়, নোট নেওয়া তো যায় না। কথার পিঠে কখন ঝগড়ুটে বলেছি, ঠিক মনে রেখে দিয়েছেন, ঝগড়ায় যাতে কোনোভাবেই আপনার হার না হয়।
শু- আচ্ছা ঠিক আছে, আমি এই ডিবেটে হার মানছি, কিন্তু একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে।
ক- কী কথা?
শু- আমার কীসের এত সুখ্যাতি আপনি শুনলেন?
ক- ওমনি সুখ্যাতি শোনার জন্যে মন অস্থির হয়ে উঠলো। তাই হার মানতেও দেরি হল না।
কস্তুরীর মিষ্টি হাসি চোখ ভরে দেখছে শুদ্ধ। সময় কাটছে আনমনে।
ক- এ কী! হাঁ করে কী ভাবছেন?
এবার শুদ্ধর লজ্জা পাবার পালা।
শু- না… ভাবছিলাম… ও… হ্যাঁ, মনে পড়েছে।
খিল খিল করে হাসছে কস্তুরী, শুদ্ধর ভুলে যাওয়া বোকা চাহনির দিকে তাকিয়ে। ক- আজ ক্যান্টিনে আপনাকে নিয়ে কি সুখ্যাতি হচ্ছিল তা বলতে পারি, কিন্তু একটা ছোট্ট শর্ত আছে।
শু- কী সেই শর্ত?
ক- আপনি শর্ত মানবেন এই কথাটা আগে দিতে হবে মশাই।
শু- এ কী রকম শর্ত, না জেনেই মেনে নিতে হবে?
ক- তাহলে শুনে কাজ নেই, শর্ত মানা যখন এতই কঠিন।
শু- আচ্ছা ঠিক আছে, আমি শর্তে রাজি। এবার বলবেন তো কী শুনেছেন?
কস্তুরী হঠাৎ কেমন ইতস্ততঃ করছে। কী একটা বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। মাঝে মাঝে চুরি করে শুদ্ধর মুখের দিকে তাকিয়েই মুখ নামিয়ে নিচ্ছে। একগুচ্ছ বেহায়া চুল চুলের বাঁধন না মেনে বাঁধনছেঁড়া এলোমেলো উড়ছে কস্তুরীর কপালে।
শু- কী হল? কী এত ভাবছেন?
কস্তুরী মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কপালে ছিটেফোঁটা ঘাম জমছে।
শু- বলবেন না… কী শর্ত?
কস্তুরী নিস্তব্ধতা ভাঙল।
ক- না থাক।
শু- কী থাকবে? শর্তটা একবার শুনি।
ক- না… আমার খুব বাজে লাগছে। আগে পিছে কিছু না ভেবে আপনাকে হঠাৎ এই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ডেকে বসলাম। আপনি কী ভাবছেন কে জানে।
শু- এখানে দাঁড়িয়ে আর বেশিক্ষণ যদি নিচু গলায় এইভাবে কথা বলি, তাহলে আমি তো ছার, গোটা ইউনিভার্সিটি চোখ চাওয়াচাওয়ি করে ভাববে। প্রত্যেক বন্ধুবান্ধব, অফিস কর্মচারী, প্রফেসর, লেকচারার এমনকী মেথররাও একটা করে রগরগে প্রেমের উপন্যাস লিখে ফেলবে আর তাতে আমি নায়ক… আপনি নায়িকা।
ক- ইস! কী যে বলেন।
শু- আমি অন্যায়টা কী বললাম। ওদের জায়গায় আপনি-আমি থাকলেও হরেদরে একই কাজ করতাম। এই রকমটাই হয়ে আসছে ম্যাডাম। তার চেয়ে একটা আইডিয়া মাথায় আসছে। অভয় দেন তো বলে ফেলি।
ক- এমন কী আইডিয়া যে শোনার জন্যে অভয় দিতে হবে?
শু- ওই যে, যে কারণে শর্তের কথাটা আপনি বলতে এতবার কিন্তু, যদি, আজ্ঞে আরও কত কী করছেন, আমারও ওই একই কারণে একটু নির্ভেজাল অভয়ের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
ক- আচ্ছা, ঠিক আছে এক্কেবারে নির্ভেজাল অভয় না হয় দেওয়া গেল, এখন শুনি আইডিয়াটা কী।
শু- দাঁড়ান তাহলে একটু সাহস সঞ্চয় করে নিই। অনেকটা সাহস এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাজে খরচা হয়ে গেল তো।
ক- ও, তাহলে আমার সঙ্গে কথা বলে আপনার সময় বাজে নষ্ট হয়েছে? ঠিক আছে আমি তাহলে যাচ্ছি।
কস্তুরী মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছিল। শুদ্ধ অকস্মাৎ কস্তুরীর হাত টেনে ধরল।
ক- এ মা! কী করছেন। কেউ দেখলে কী ভাববে।
কস্তুরী কিন্তু হাত ছাড়াল না।
শু- আমি মাপ চাইছি। আমি আপনাকে আঘাত করার জন্যে এই কথা বলিনি। একটু মজা করেছি। বলুন মাপ করেছেন কিনা।
কস্তুরী একটা দুষ্টুমির হাসির রেখা মুখে এনে বলল, “মাপ করতে পারি যদি কোনও কথা না ঘুরিয়ে বলেন কী আইডিয়া আপনার মস্তিষ্কে ঘোরাফেরা করছিল।”
শু- এবারে আমি বেশ খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে ফেলেছি। ভেবে দেখলাম এই সাহসটুকুর সবটা এই বেলা কাজে লাগাতে না পারলে আবার বাজে খরচ হয়ে যাবে। এই বেলা কথাটা আমার বলে ফেলাই ভালো।
ক- আচ্ছা একটা কথা বলব?
শু- নির্দ্বিধায় বলে ফেলুন।
ক- আপনি কি বাড়িতেও সবার সঙ্গে এই রকম ফাজলামি করেই সারাদিন কথা বলেন?
শু- ক্ষেপেছেন নাকি। আমার বাবা ভীষণ রাশভারী টাইপের লোক। এখনও একটা হাঁক দিলে আমার হাত-পা সটান সাইবেরিয়ায় চলে যায়। মা-র সঙ্গে অবশ্য এইসব চলে। আর চলে আমার ছোট বোনের সঙ্গে। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি কিন্তু খুব গম্ভীর লোক। আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সব গাম্ভীর্য আজ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। এখন আমি কেমন যেন লাগামছাড়া। তাই বলছিলাম,
আজ জলাঞ্জলি যাক না যত ক্লাসগুলো,
আড্ডার ডাকে না হয় দিলাম কানে তুলো,
কেটে পড়ি ফেলে ক্যান্টিনের ফসিলাইজড কচুরি
এ কোন সুবাসে মেতেছে শুদ্ধ যেন হাতছানি দিল কস্তুরী

ক- বাবা! মুখে মুখে একটা ছড়া বানিয়ে ফেললেন আমাকে নিয়ে। আপনি তো সাংঘাতিক লোক। বুঝলাম আপনার আইডিয়াটা। মতলবটাও খুব একটা সুবিধের ঠেকছে না।
কথা বলতে বলতে ওরা দুজনে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। কস্তুরীর সঙ্গে চোখাচোখি হ কয়েকজন বন্ধুর। এই সময় তাদের না এড়িয়ে পারল না কস্তুরী। শুদ্ধ জানত বন্ধু-বান্ধবের চোখ এড়িয়ে ইউনিভার্সিটি চত্বর থেকে কীভাবে পালাতে হবে। বড় রাস্তায় নেমে চৌরঙ্গীগামী একটা বেশ খালি ট্রামে উঠে পড়ল দুজনে। সামনের দিকে পাশাপাশি বসার একটা সিটে গিয়ে বসল। এখন কস্তুরীর শরীরের কোমল উষ্ণতা অনুভব করছে শুদ্ধ। এই প্রথম এক প্রাপ্তবয়স্কা সুন্দরী নারীর শরীরের স্পর্শে রোমাঞ্চিত হওয়া সময়টাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করতে মন চাইছে শুদ্ধর। এই ব্যাপারে কলকাতার ট্রাম, কলকাতার ট্র্যাফিক সিগনাল, ঠ্যালা গাড়ি, রিক্সা আর গাড়ির রাস্তায় প্রতি মুহূর্তের বিপদকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মানুষের ঢলের দীর্ঘায়ু কামনা করল শুদ্ধ।
ক- আপনার সাহস প্রশংসনীয়।
শু- এতে আর সাহসের কী আছে, আমি তো আর খালি হাতে বাঘ মারতে যাচ্ছি না।
ক- কী করেন আপনি সারাদিন, ফাজলামি, আড্ডা আর পরোপকার বাদ দিয়ে?
শু- আর পড়াশুনো করি। আমার পরীক্ষার রেজাল্ট তার প্রমাণ।
ক- আর কিছু না?
শু- এই মরেছে! এখন তো আপনি আমাকে প্রায় কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন শুরু করলেন। বাবার নাম কী, মার গেঁটে বাত আছে কিনা, কটা নাতিপুতি, শ্বশুরের বয়েস কত ইত্যাদি ইত্যাদি।
কস্তুরী খিলখিল করে হাসছিল। ক- কথায় আপনার সঙ্গে পারা কঠিন।
শু- ওইটুকুই আছে। ক- আর একটা গুণ আছে, যেটা কেন জানিনা আপনি লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে ভালোবাসেন। আর সেই কথাটাই বলার জন্যে আজ গায়ে পড়ে অসভ্যের মতো আলাপ করলাম। শু- ভাগ্যি আজ এতটা বেপরোয়া অসভ্য হয়েছিলেন, তাই সারা জীবন মনে রাখার মতো এমন একটা মিষ্টি, অভাবনীয় দুপুর আমি উপহার পেলাম অকস্মাৎ।
ক- সত্যি বলছ, শুদ্ধ?
শু- এর চেয়ে বড় সত্যি আমি কখনও বলিনি।
ক- অসতর্ক হয়ে তুমি বলে ফেললাম, কিছু মনে করবেন না।
শু- যেটা স্বাভাবিকভাবে আসতে চাইছে, তাকে আসতে না দেয়াটা নিজেকে ঠকানো। তাছাড়া…
ক- তাছাড়া কী? থামলেন কেন?
শু- আপনিও তো আবার কয়েক যোজন পিছিয়ে গিয়ে আপনি, আজ্ঞে শুরু করলেন। তাছাড়া বলতে গিয়েও একটা কথা বলতে সংকোচ হচ্ছিল… নির্ভয়ে বলব?
ক- ওহ! শুদ্ধ তুমি বড্ড ইনিয়েবিনিয়ে কথা ঘোরাও। বলো না প্লিজ, কী বলছিলে।
শু- আপনার মুখে ‘তুমি’ সম্বোধন আজকের উপহারের সঙ্গে অনবদ্য একটি বোনাস।
ক- মেয়েরা ওই রকমই। কিন্তু এখনও তুমি সংকোচের খোলস ছেড়ে বেরোতে পারোনি।
শু- বুঝতে পেরেছি কস্তুরী, তুমি কোন সংকোচের কথা বলছ। তুমিই বের করে আনলে আমাকে সেই খোলস ছেড়ে। এখন আর কেউই আমরা আপনি, আজ্ঞে করব না, তাই তো?
মাথা নাড়িয়ে, একটু লজ্জা মাখানো মুখে, সম্মতি জানাল কস্তুরী।
বৌবাজারের মোড়ে ট্রামটা দাঁড়িয়ে আছে ট্র্যাফিক সিগনালে। শহরের অবিশ্রান্ত কোলাহলে কস্তুরীর কণ্ঠস্বর হারিয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। কস্তুরী ঘাড় ঘুরিয়ে শুদ্ধর কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে কথা বলছিল। কস্তুরীর শরীরের আবেশমাখানো গন্ধে বিভোর হয়ে উঠল শুদ্ধর মন।
শু- কই বললে না তো, কী সুখ্যাতি শুনে আজ তুমি বেপরোয়া হয়ে উঠলে?
ক- এখনও কিন্তু বলোনি আমাকে, তুমি এত সুন্দর বাঁশি বাজাও। সেদিন পিকনিকে তোমার বাঁশি শুনে অর্পিতা বলছিল তোমার বাঁশির ওপর দখল নাকি রীতিমতো প্রশংসা আদায় করার মতো।
শু- আমি অ্যামেচার আর যারা শুনছিল তারাও একই গোত্রের। অতএব এই কমেন্টগুলোকে নিয়ে এত হৈ হৈ করার কিছু আছে বলে আমি মনে করি না।
ক- মোটেই না মশাই। অন্যদের কথা জানি না, কিন্তু অর্পিতা ছ-বছর ধরে বড় ওস্তাদের কাছে ক্ল্যাসিকাল শেখে। ওর কান আর বাকিদের কান এক নয়। তাছাড়া মানুষ যখন কোনও সুরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়, তখন সেই সুর তার হৃদয়কে স্পর্শ না করলে নির্ভেজাল প্রশংসা কখনও এমন স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে আসে না।
শু- সত্যি বলছ?
ক- হ্যাঁ মশাই। তাই তোমার সঙ্গে আলাপ করতে দাঁড়িয়ে ছিলাম সিঁড়ির কোণে। এখন বলো, আমাকে বাঁশি কবে শোনাবে।
শু- এমন জানলে তো আজকেই সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম। কিন্তু বাঁশি তো গান নয়… শুধু সুর বাজে। তোমার কি ভাল লাগবে?
ক- আমাকে তুমি এতটা বেরসিক ভাবলে কেন? আচ্ছা ঠিক আছে। সত্যিই তো তুমি আমাকে আর কতটুকু চেনো। এই ভালো লাগা, না-লাগাগুলো বুঝতে আর একটু সময় দিতে হয়। জানি না, সেই সময় আমরা পাব কিনা।
শু- এ কথা বলছ কেন? পরস্পরকে জানতে বা সবটুকু বুঝতে অনেক সময় দিতে হয় এ কথা সত্যি, কিন্তু সময় পাব না কেন বলছ?
ক- এর উত্তর ভবিষ্যৎ দেবে। আজকে আমি এখন বাড়ি ফিরব।
কস্তুরীকে ট্যাক্সিতে ভবানীপুরে নামিয়ে শুদ্ধ বাড়ি ফিরল এক বাঁধনছেঁড়া মন নিয়ে। দোতলায় নিজের ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিতে দিতেই কস্তুরীকে ফোন করল।
শু- এই আমি শুদ্ধ বলছি। ক- বুঝতে পেরেছি মশাই। আশেপাশে মা, বাবা, বোন কেউই নেই মনে হচ্ছে?
শু- না, তেমন কেউ নেই। কিন্তু হঠাৎ কেউ উদয় হবেন না এমন গ্যারান্টি দেয়া যাচ্ছে না।
ক- উদয় হলে কী করবে?
শু- সমস্যা এলে তখন ভাবা যাবে।
ক- বাড়িতে ঢুকেই ফোন কেন সেটা শুনি।
শু- খুব ইচ্ছে করছিল তাই। অসুবিধে থাকলে কেটে দিতে পারি।
ক- এই না না, কেটে দিও না। মোবাইলে এই প্রথম তোমার গলা শুনছি। কেমন ভারী ভারী লাগছে গলাটা।
শু- আচ্ছা কস্তুরী, তুমি আবৃত্তি করেছ কখনও?
ক- হঠাৎ এই প্রশ্ন?
শু- তোমার কণ্ঠস্বরে কী একটা আছে। কেমন যেন আবেশ জড়ানো। নেশা ধরিয়ে দেয়।
ক- বাবা! এমন সার্টিফিকেট আমাকে কেউ কখন দেয়নি। আসলে, তোমার মনটা এখন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে। তাই আমার কণ্ঠস্বর তোমার কানে আবেশ ধরাচ্ছে।
শু- সত্যি বলছি। তুমি যদি গায়িকা হও, আমি আশ্চর্য হব না। আমি স্বীকার করছি, আমার প্রথম প্রেমিকা… তোমার কণ্ঠস্বর।
ক- সে কী! আজকেই তো প্রথম সেইভাবে আলাপ হল। আমার কণ্ঠস্বর শুনলে কখন?
শু- আমার চোখ এবং কান তোমাকে ধাওয়া করে বেড়ায় সারাদিন। আমার সঙ্গে আগে তোমার কথা হয়নি ঠিকই, তাতে তোমাকে দেখা বা কণ্ঠস্বর শোনা আটকাবে কে।
ক- আমি বিশ্বাসই করি না। আজ ডেকে আলাপ না করলে কোনোদিনই তুমি নিজে এসে আলাপ করতে না। আমি তোমাকে চিনেছিলাম আর সেই জন্যেই তো…
শু- সেই জন্যেই তো কী?
কস্তুরী চুপ করে আছে। সময় কাটছে। শু- কী হল? চুপ করে আছো যে।
ক- কিছু না।
শু- কিছু না মানে? ‘সেই জন্যেই তো’ বলে থেমে গেলে কেন? বলবে না?
ক- আমার লজ্জা করছে, শুদ্ধ।
শু- লজ্জা করলে শুনব কী করে?
ক- এরপরে যেদিন আজকের মতো তোমাকে একা পাব, সেদিন বলব।
শু- যাহ! আপাতত সবটা তাহলে হিমঘরে চলে গেল। এত আমের অমন প্লাস্টিক চাটনিতে কড়া চিরেতার জল ঢাললে কস্তুরী। এরই মধ্যে মা আবার ডেকে যাচ্ছে একটানা। আসছি মা। কস্তুরী তোমাকে কলব্যাক করছি একটু পরেই। চলে যেও না কোথাও।
নিচের তলায় শুদ্ধর মা, অপর্ণার গলা শোনা গেল।
অপর্ণা- কী হলো কী তোর, ডেকে সাড়া পাচ্ছি না? বাড়িতে ঢুকেই টেলিফোনে মজে আছিস, ব্যাপারটা কী?
শু- কী আবার। কথা বলছিলাম সুশান্তর সঙ্গে।
অ- সুশান্তর সঙ্গে, এত নিচু গলায়, ফিসফিস করে। ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম… হুঁশ ছিল না তোর। কী ব্যাপার?
শু- ব্যাপার আবার কী।
অ- কিছু না হলেই ভালো। খাবারটা ঠান্ডা হয়ে গেল তো। খেয়ে নে।
সেদিন আর তেমন করে শুদ্ধ কস্তুরীর সঙ্গে কথা বলতে পারল না। দিনের কাজ সেরে এই সময়টা মা এসে বসেন শুদ্ধর কাছে। সঙ্গে থাকে শুদ্ধর বোন। দাদার সঙ্গে তার বন্ধুত্বটা বেশ গভীর। শুদ্ধ একবার শুধু কস্তুরীকে জানাতে পেরেছিল সংক্ষেপে ঘরের পরিবেশ কথা বলার পক্ষে কতটা পরিপন্থী। মেসেঞ্জারে কয়েকবার কথোপকথন চালাবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তাতেও মা রেগে যাচ্ছিলেন।
অ- কী তখন থেকে মোবাইলে উটখুট করছিস বল তো? যা বলছি তাতেই হুঁ, হ্যাঁ উত্তর দিচ্ছিস। মন কোথায় পড়ে আছে তোর। তখন থেকে মোবাইলে টুং করে বেজে উঠছে আর কী সব খুট খুট করে যাচ্ছিস।
অগত্যা মন টেলিফোনের দিকে পড়ে থাকলেও সেদিনের মতো কস্তুরীর কণ্ঠস্বর শোনার বাসনাকে দমিয়ে রাখতে হল।
পরের দিন ওরা যে গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের সামনে দেখা করবে সেটা পূর্বপরিকল্পিত ছিল। আজ শুদ্ধ সঙ্গে বাঁশি আনতে ভোলেনি। দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলল লেকের দিকে। এখনও লেকে বিকেলের ভিড় শুরু হয়নি। স্বাস্থ্য সচেতন পুরুষ ও মহিলারা হাঁটাহাঁটি, দৌড়, নানা অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি, সমবেত এবং পরিমিত অট্টহাস্য ইত্যাদি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো প্রধানত সকালে সেরে লেককে দুপুর থেকে খানিকটা মুক্তি দেন শুদ্ধ আর কস্তুরীদের একান্ত নিরালায় মুখোমুখি বসার জন্যে। বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছিল। ধূসর মেঘের ছায়া নামছে লেকের জলে। গাছের পাতায় আর ডালে এক কোমল অস্থিরতা। পাখিদের ঘরে ফেরার ডাকাডাকির সঙ্গে মিলেমিশে গেল আজকের বাঁশিতে বাজা সুর। শুদ্ধর বাঁশি গেয়ে চলেছে ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে…’ এমন একটা পড়ন্ত বিকেলের জন্যে প্রস্তুত ছিল না কস্তুরী। ছিটেফোঁটা বৃষ্টি শুরু হল। হাতটা রাখতে ইচ্ছে করছে ওর শুদ্ধর হাতে, কিন্তু উপায় নেই। শুদ্ধর দু-হাতের আঙুল তখন বৃষ্টিভেজা বিকেলের সুর বুনে চলেছে বাঁশিতে। কস্তুরী একদৃষ্টে তাকিয়েছিল বংশীবাদকের দিকে… ভাবছিল বাঁশি হাতে শুদ্ধ এক আলাদা মানুষ, তার মনে তখন বোধ হয় নেই দিনান্তের মন খারাপ করা বৃষ্টি, নেই লেকের জলে ঘনিয়ে আসা মেঘের ছায়া, নেই পাখিদের বাসায় ফেরার কোলাহল বা কস্তুরীর কোমল কোনও উষ্ণ ছোঁয়া। আছে সুরের ঘাটে ঘাটে পৌঁছতে পারার এক বাঁধনছেঁড়া উন্মাদনা। বাঁশি বাজানো শেষ করে শুদ্ধ তাকিয়ে আছে কস্তুরীর দিকে।
ক- কী দেখছ অমন করে?
শু- তোমাকে।
ক- আমাকে তো কতবার দেখলে এই দুদিনে।
শু- তোমার চোখে আর কণ্ঠস্বরে কী একটা মাদকতা আছে কস্তুরী। প্রথম যেদিন তোমাকে আমি দেখেছিলাম সেইদিন তোমার চাহনি আমাকে কেমন চঞ্চল করে তুলেছিল। তারপর কফি হাউসে একদিন এলে সুশান্তর সঙ্গে। একদল চেনা অচেনা মানুষের মধ্যে থেকে তোমাকে দেখলাম, পরে শুনলাম তোমার সেই নেশা ধরানো কণ্ঠস্বর।
দুজনে দুজনের চোখে চোখ রেখে কেটে গেল কিছু সময়।
ক- এবার চোখটা সরাও লক্ষীটি।
চোখ না সরিয়েই শুদ্ধ বলল।
শু- সরাতে পারি কিন্তু এই কথাটা আর একবার বলতে হবে।
ক- কোন কথাটা?
শু- এই যে… এক্ষুনি চোখ সরাবার কথা বললে। ওই কথাটা যেমন করে বললে, ঠিক সেই রকম করে আর একবার বলো।
ক- কেন?
শু- আমার ভীযণ ভাল লাগলো শুনতে। কী মিষ্টি করে বললে তুমি, লক্ষীটি।
ক- এতক্ষণ একটানা আমাকে দেখেও তোমার আশ মিটছে না?
শু- না, সত্যিই মিটছে না। কই বাঁশি শুনে ভালো-খারাপ কিছু বললে না তো?
ক- বলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আর যেভাবে বলা যায় সেটা এইখানে বসে বলতে পারব না।
কস্তুরীর কণ্ঠে আজ কী ভর করেছে শুদ্ধ জানে না। আবেশ জড়ানো কণ্ঠস্বর যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে শুদ্ধকে।
শু- বৃষ্টি নেমেছে, কেউ কোথাও নেই কস্তুরী। লক্ষীটি বলো।
কস্তুরী শুদ্ধর হাতটা ধরে তুলে নিল। বৃষ্টিভাঙা ধোঁয়াশার আড়ালে কস্তুরীর কোমল ঠোঁটের দীর্ঘ স্পর্শে রোমাঞ্চিত হচ্ছিল শুদ্ধর হাত, শরীর… মন।
শিলিগুড়ির একচিলতে শোবার ঘরের জানলা দিয়ে ঝিরঝিরে হাওয়ায় কেবলই এইসব কথা ভাবছিল শুদ্ধ। মাঠ পেরিয়ে দূরের রাস্তাটা বাঁক নিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে একপাল গাছের আড়ালে। নিঃস্তব্ধ শীতের শুরু থেকে প্রায়ই, এই জানলা দিয়েই দেখা যায় সাদা বরফে মাথা মুড়ি দিয়ে যেন আকাশে ভেসে আছে… কাঞ্চনজঙ্ঘা। সরু রেলের পথ ধরে ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে মুখ ঢেকে খেলনা ট্রেন দিনে কয়েকবার ডাকতে ডাকতে চলে যায় অনেক দূরে… ট্রেন চলে গেলে আবার সেই নিস্তব্ধতা। মাঝে মাঝে শুধু অচেনা কোনও পাখির একটানা অলস ডাকে ফিরে আসে ফেলে আসা অনেকটা সময়। আজ বড্ড সেই কস্তুরীর কথা মনে পড়ছে শুদ্ধর, যে কস্তুরী ইউনিভার্সিটির সিঁড়ির কোণ থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল, “সকালে ক্লাস করেননি নাকি?” বিয়ের আগে প্রথমদিন চৌরঙ্গীর ভিড়ে কত ছেলেমানুষি গল্প। কস্তুরীর একটু ছোঁয়া পেতে কত চাতুরি। বাঁশি শুনিয়ে যে প্রাপ্তি ঘটেছিল লেকে তার নরম উষ্ণ ছোঁয়ায় আজও সিক্ত আছে শুদ্ধর হাত।
কস্তুরী একদিন বলেছিল, “তুমি তো ভগবান বিশ্বাস করো না, তাই না?”
শু- বিশ্বাস করার পিছনে কোনও যুক্তি খুঁজে পাইনি, কিন্তু বিশ্বাস না করার পিছনে যুক্তিটা অনেক শক্তিশালী।
ক- অত তর্কে আমি তোমার সঙ্গে পারব না। কিন্তু আমাকে একটা কথা দাও শুদ্ধ।
শু- কী এমন কথা যা তোমার মনে হচ্ছে আমি নাও রাখতে পারি?
ক- বিয়ের পরে আমাকে একটু পুজো করতে বাধা দিও না লক্ষ্মীটি।
শু- সে কী! তুমি পুজো করলে আমি বাধা দেবার কে। আমার মা-ও তো পুজো করেন।
কস্তুরী খুশী হয়ে আদর করেছিল শুদ্ধর গাল টিপে।
কস্তুরীর মা ও বাবা এক বছরের ব্যবধানে মারা যান। তখন শুদ্ধ সবে ইউনিভার্সিটির গণ্ডি পার হয়ে পি এইচ ডি-র জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল। পি এইচ ডি করা আর হয়নি। সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসতে হল… চাকরিটা খুব প্রয়োজন ছিল শুদ্ধর। পরীক্ষায় রেজাল্ট হল খুব ভালো। সরকারি চাকরির সূত্রে প্রথমেই যেতে হল মেদিনীপুর। এক বছরের মধ্যে বিয়ে হয়েছিল ওদের। প্রথম প্রথম কিছুদিন কস্তুরী মেদিনীপুরে শুদ্ধর কাছে থাকত। কিন্তু কস্তুরীর ভাইয়ের জন্যে কস্তুরীকে কলকাতায় ফিরে আসতে হত। কস্তুরীর ভাই সন্তু তখনও স্কুলে পড়ছে, কিন্তু বাবা-মা মারা যাওয়ার পর তার দৈনন্দিন অনেক কিছুই কস্তুরীকে সামলাতে হত। তার অর্থনৈতিক অনেক সমস্যাই শুদ্ধকে মেটাতে হত। কস্তুরী সংসারে খুব ব্যস্ত থাকে। সপ্তাহখানেক আগে ফোন করেছিল, ছেলেমেয়ের রেজাল্টের খবর জানাতে। ভাইয়ের চাকরির ইন্টারভিউ আর তার প্রেমিকার সঙ্গে মনোমালিন্য এবং শেষ পর্যন্ত ছাড়াছাড়ির দীর্ঘ ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ শুনতে হয়েছিল শুদ্ধকে।
শুদ্ধ বলেছিল, “জানো কস্তুরী আমাকে যে ছেলেটি রোজ এখানে খবরের কাগজ দিয়ে যায়, মাঝে মাঝে সে নাকি আমার বাঁশি বাজানো শুনেছে আড়াল থেকে। এই ছেলেটিও বাঁশি বাজায়। ওর বাঁশি শুনে আমি একটা পাহাড়ি সুর ওর কাছে শিখেছি। কী সুন্দর যে সেই সুর তোমাকে বলে বোঝাবার ভাষা নেই আমার। তুমি এখানে এলে তোমাকে শোনাব।
কস্তুরী বলেছিল, “হ্যাঁ শুনিও। আর তোমাকে বলেছিলাম না, কাউকে বলে কয়ে সন্তুর একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দাও না গো। তোমার তো কত জানাশোনা আছে। কত লোকের তো কত কী করে দিচ্ছ। সন্তুর চাকরিটা হলেই একটা ভালো মেয়ে দেখে ওর বিয়ের ব্যবস্থা করে দেব। আগের মেয়েটা কি পাজি একবার দেখলে তো?”
শুদ্ধ আর কথা বাড়ায়নি।
অনেকদিন হল শুদ্ধ কলকাতা যায়নি। ক-দিন ধরেই ওর পড়ার ঘরটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। পড়ার টেবিলটা ঘরের এককোণে পড়ে থাকত। বই আর খাতায় এলোমেলো স্তূপ হয়ে উঠলেই মা এসে গুছিয়ে পরিষ্কার করে দিত। মনে পড়ছে জানলার কোণে রাখা অ্যাশট্রেটার কথা। শুদ্ধর বোন কোথা থেকে যেন দাদাকে এনে দিয়েছিল। ঘরের জানলার নিচে বাইরের দেওয়ালে, ইঁটের কোন ফাঁকে সাদা-কালো একটা পায়রা ছিল তার প্রতিবেশী। এক কৌটো দানা আসত তার জন্যে মাসের কেনাকাটার সঙ্গে। এক-এক দানা নির্ভেজাল ভালোবাসা উজাড় করে দিত শুদ্ধ, পায়রাটার জন্যে। কস্তুরীর কাছে তার প্রতিবেশীর খবর নিয়েছে সে কয়েকবার। কিন্তু কস্তুরী অনেকদিন দেখেনি পায়রাটাকে। নিয়ম করে দানা খাওয়ানোর কথা কস্তুরীর অত মনে থাকে না।
কলকাতায় থাকতে বাড়ির যেসব আসবাবপত্র তার দৈনন্দিন সঙ্গী ছিল, তাদের আলাদা করে মনে পড়ত না শুদ্ধর। টেবিলের কোণে পালিশ উঠে একটা বিশেষ চেনা আকার ফুটে উঠেছিল। সেই আকারটা শুদ্ধই শুধু চিনত। এরা ছিল তার প্রতিদিনের চেনা, প্রতিদিনের সঙ্গী। শিলিগুড়ি থেকে কলকাতার ছোট্ট দূরত্বটুকু ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। চেনা আসবাব, বন্ধু-বান্ধব, টেবিলের পালিশ ওঠা চেনা চিত্র, ইঁটের ফাঁকে দানা পাওয়ার অপেক্ষায় সাদা-কালো পায়রাটা, ছেলে-মেয়ে আর কস্তুরীদের ছুঁতে আকুল হয়ে ওঠা অপেক্ষমাণ শুদ্ধ কখন যেন চলতে চলতে পিছিয়ে পড়েছে। শুদ্ধর বাঁশি কস্তুরীর কাছে অনেক চেনা আর অনেক শোনা, হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। শুদ্ধর শরীরের উষ্ণতায় অচেনা কোনও রোমাঞ্চ নেই। কস্তুরীর চোখে নিজেকে সে খুঁজে পায় রোজকার দেখা জানলার কোণে পড়ে থাকা অ্যাশট্রে কিংবা উপেক্ষার ধুলো জমা, পড়ার টেবিলে। কস্তুরী খবর রাখে না দানা পেতে পেতে আর না পেতে পেতে পায়রাটা কখন ইঁটের ফাঁকটুকু ছেড়ে চলে গেছে… আর কোনোদিন না ফেরার জন্যে।

মোহনকাল

মহসীন আলম শুভ্র

নিড়াইয়া জুইত নাই, বেলা যাইতে যেই সেই। এত ঘাস অইলে সারাদিন নিড়াইলেও শেষ অয়! মারানির ঘাস! গাছের চৌ-ডবল ঘাস। দূর! বলেই নিড়-কাচিটা নিয়ে আইলে এসে কাছা সরিয়ে বসে পড়ে হাসমত। কোঁচড় থেকে দিয়াশলাই ও মস্তান বিড়ির প্যাকেটটা বের করে একটা বিড়ি ছাই-কালো ঠোঁটে রেখে দেয়। তারপর দিয়াশলাই থেকে একটা কাঠি বের করে। ঘষে আগুন জ্বালবার চেষ্টা করে, কিন্তু কামিয়াব হয় না। আবার আরেকটা কাঠি নিয়ে জ্বালবার চেষ্টা করে। এবার হয়। কাঠিটা বিড়ির আগায় দিতেই ধরে যায়। হাসমত আরামসে বিড়ি টানতে শুরু করে।

হাসমত নামের পর আলী শব্দটাও আছে। তবে হাসমত এটা ব্যবহার করে না। হাসমতেই তার শোকরিয়া। আলী শব্দটা তার দাদার কাল থেকে আসা। এর আগে এটা ছিল না। দাদার পীর হুজুরের দেওয়া। কোনোবার এক বরষার মৌসুমে পীর হুজুর তাদের বাড়িতে দাওয়াতে আসেন। সেটা তাদের পরম সৌভাগ্য। তিনি খুব একটা দাওয়াতে আসেন না। তার ওপর আবার মুরিদের নাবাবি হাল যদি না থাকে। হাসমতের দাদা কেরামত মিয়া মেহমানদারীর কমতি রাখেন নাই। ঋণ করে ভালোই আপ্যায়ন করেছিলেন। আবার যাওয়ার সময় উত্তম হাদিয়া। আপ্যায়নে খুশি হয়ে পীর হুজুর কেরামত মিয়াকে ‘আলী’ উপহার দিয়েছিলেন। কেরামত আলী। সেই থেকে ওয়ারিশক্রমে আলী শব্দটা তার নামের সাথেও লেগে যায়; সাথে লেগে যায় দারিদ্র্যের সিল মোহর। ঋণ করে মেহমানদারি আর খাস দোয়ার বৌদোলতে তার পরের মৌসুম থেকে জমিচাষ করে খুব একটা লাভ হয়নি। নিজেদের যা জমি ছিল, তা ঋণশোধে প্রায় চলে যায়। তারপর থেকে পরের জমিতে বর্গা চাষ করে তার বাবার জীবন পড়ন্ত প্রহরের আগেই অস্ত যায়। এখন অবশিষ্ট বলতে সে আর এককানি বসতভিটা। আর সব কিছু অতীত এবং স্মৃতি। হাসমতের জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ কেটে গেল পরের জমিতে বর্গা চাষ করে। মাথার ঘাম মাটিতে মিশিয়ে ফসল ফলিয়ে পেট ভরানোর সংগ্রাম যেন শেষ হয় না, শুধু বাড়ে।

বিড়ি টানতে টানতে হাসমতের মনে পড়ে যায় এক বরষা মৌসুমের কথা। সে তখন মাস দুয়েক কাল হল বিয়ে করেছে। বিছান্দি গ্রামে। তার গ্রাম কুমড়াখালি থেকে আট-ন ক্রোশ দূরে। জহির মোল্লার বড় মেয়ে মরিয়ম বিবিকে। পড়শি সালেম বেপারী সম্বন্ধটা করে দেয়।
বিয়ের আগে হাসমতের জীবন ছিল উদাস ও আলাভোলা রকমের। যা ইচ্ছে তাই করত। কিন্তু বিবি ঘরে আসতেই তার জীবনে রঙ লাগা শুরু হয়। সংসারের অস্তিত্ব অনুভব করতে শুরু করে। বিয়ের পর বিবির আদর-যতনে দিন তার ভালোই কেটে যায়। খেতে কাজ করে ফসল ফলায় আর অবসরে বিবির চুলে নিজেকে গুঁজে রাখে।

বিয়ের হলুদমাখা দিনগুলোর পর মাছের মৌসুম। তখন মরিয়ম বিবি চার মাসের পোয়াতি। চারদিকে তরতর করে পানি। খেত আর খালগুলো পানিতে টইটুম্বুর। এদিকে মাছেরও তাজ্জব মাইর পড়তে শুরু করে। বড় বড় শোল, বোয়াল, বাইম, কাতল আরও হরেক রকমের মাছ। বর্ষায় আসলে খেতের কাজ কমে যায়, সারা খেত শুধু পানি আর পানি। তাই সবাই মাছ ধরতে ব্যস্ত হয়ে যায়। হাসমতও ব্যস্ত হয়ে যায়। জাল টানা শুরু করে। সন্ধ্যায় বিলে গিয়ে জাল টেনে মাছ যা পায়, মাছ জিয়ানোর চাইয়ে রেখে দেয়। সকালে জাল টেনে সব মাছ একত্র করে বাজারে বিক্রি করে দেয়। আর কিছু মাছ রাখে খাওয়ার জন্য।
বউয়ের যতন আর মাঝে মাঝে কাজল বয়াতীর বাড়িতে রাতে বাউল গানের আসরে শরিক হয়ে সময় কাটে তার। মধ্যে মধ্যে সেও গান ধরে। দরাজ গলা। অনেকে তারিফ করে। গান সে সহজে গায় না, শোনে। সবাই জোরাজোরি করলে গায়। কিন্তু বউকে সে তার রসিক গলার উপস্থিতি নিয়মিত জানান দেয়। ‘আসমানে পিদিম জ্বলে, জলে পড়ে জল। তোর পরানের গহিনে সই ক্যার কথা, বল।’

– হইছে এইবার থামেন, এই নেন ভাত খাইয়া লন। বাইম ভাজার লগে শুকনা মরিচ তেলো দিছি, খাইয়া লন।
হাসমত খেতে বসে। বউ হাতপাখায় বাতাস করে। হাসমত খায় আর বউয়ের মাছ ভাজার প্রশংসা করে, রসিক চোখে তাকায়। এভাবে-সেভাবে বউয়ের সাথে দহরম-মহরম লেগেই থাকে তার। যেন গাঙের সাথে পানির সম্পর্ক।

– বউ, আইজ রাইতে মাছ মারতে যামু। সবুরগো লগে। হুনলাম বিলের উত্তর দিহে নাকি মাছের ঝাঁক আর ঝাঁক। হোইল আর রুইতের ঝাঁক।
– ক্যান জাল টানবেন না আইজ?
– টানুম, জলদি টাইনা যাইমু। নমজের পর আন্ধার অইলে যামু।
– শুনছি মাছ মইরা খাওন ভালা না। মন্দ অয়।
– বিবি, খারাপ ভালা ওই খোদার আতে, জীবের আতে নি! মাছ তো খোদাও আমাগো লইগাই বানাইছে!

সন্ধ্যার নামাজ শেষ করে হাসমত বাড়ি চলে আসে। দেউড়ি ঘেষে কুঁপি হাতে মরিয়ম দাঁড়িয়ে।
হাসমত এসে রোয়াকের শালপাটিতে বসে। বিবি হাত ধোয়ার পানি আগায় দেয়। সে হাত ধুয়ে গামলায় রাখা ভাতে হাত দেয়। কলমি শাক আর শাপলা দিয়ে পুঁটি মাছের ঝোল।
তা দিয়েই পেট ভরে ভাত খেয়ে নেয়। খাওয়া শেষে বিবি গামছা দিলে। হাত-মুখ মুছে শোকর আদায় করে সে ঘাটের দিকে রওনা হয়।

নাওয়ের আগায় লাগানো লগ্গিটার থেকে নাওয়ের বান খুলে লগ্গিটা তুলে সে নাও ছেড়ে দেয় সবুরদের বাড়ির ঘাটের উদ্দেশ্যে। জলদি করে হাত চালায়। মিনিট দশেকের মধ্যেই ঘাটে হাজির। হাজির হয়ে দেখে সবুর, মোনসর আর জব্বর বড় নাওয়ে বসা।

– ত্বরায় আবি না? দেরি অয়ে যায়। বলে সবুর।
– খাইয়া দেরি করি নাই। ত্বরাই কইরাই চইলা আইলাম।
– অয় মোনসর, হারিকেন আর টেঁটা লই হাসমতের নাওয়ে উড। সবুর ত্বরায় দেয় মোনসরকে।

মোনসর মাছ মারার দরকারি উপকরণ নিয়ে হাসমতের নাওয়ে চলে আসে। সবুর আর জব্বর এক নাওয়ে, হাসমত আর মোনসর এক নাওয়ে।
হাসমত নাও ভাসায় দেয়। সবুরও দেয়। দুই নাও রওনা করে মোহন বিলের উত্তরের উদ্দেশ্যে।
মাছ মারতে যাওয়ার একটা আলাদা আনন্দ আর উত্তেজনা আছে যা নিজের ভিতর একটা সতেজ ভাব এনে দেয়। বেশিক্ষণ লাগে না, আধঘণ্টার মধ্যেই তারা মোহন বিলের সীমানায় উপস্থিত। নিশি রাত, কিন্তু দুধের মতো ফকফকা শাপলার হাট যেন। বিলের মাঝের দিকে আসতেই নাও দুটোর গতি কমে আসে। প্রায় নিশ্চল। এখন তারা শেষ প্রস্তুতি নেয়। লুঙ্গির গিঁট ঠিক করে, গামছাটা মাথায় ঠিক করে বাঁধে, টেঁটা ধরার সেপটা বোঝে, হারিকেনের আলোটা একটু উস্কে দেয় এবং বিড়িও টেনে নেয়।
এখন মুখের কথা বন্ধ। কথা হয় ইশারায়। নৌকা দুটো উত্তরের কাছাকাছি এনে দুই দিকে চলে যায়। সুবরেরটা যায় উত্তর-পশ্চিম। আর হাসমত চলে আসে উত্তর-পূর্ব দিকে।
মাঝির দায়িত্ব নেয় হাসমত। মোনসর ধরে টেঁটা। শুরু হয় মাছ মারতে তায়ে তায়ে থাকার পালা।

কিছুকাল মাছ মারার পর কাজের বিরতি দেয় হাসমত আর মোনসর। বিড়ি ধরায় দুজন। ভালোই মাছ পড়ছে। শোল, বাইল্যা, কাতল। বিড়ি টানা শেষ হলে পালাবদল। হাসমত টেঁটা ধরে। শুরু হয় তার তায়ে তায়ে থাকা। শকুনের দৃষ্টি। ত্রুটিমুক্ত হওয়া চাই। মাঝে মাঝে দু-একটা ফসকেও হয়। ওটা কপালের ফের। মাছের বরাত।
হাসমতের কাপলে মাছও পড়ে ভালো। বাইল্যা, আইড়, কাতল আর একটা দেশি মাগুরও মিলে যায়।
দুটো ফুটন্ত শাপলার পাতার দিকে চোখ পড়ে হাসমতের। মাছের মাথা। মনে হয় শোল। মাথাটা বড়। মনে হয় বেশ বড়ই হবে। একশ্বাসে মাছটার দিকে ঠিক ঠায় ও নিশ্চুপ ক্ষিপ্রগতিতে টেঁটা ছোঁড়ে হাসমত। ভালো করে লেগে যায়। বড় এক মাছ উঠে আসে নাওয়ে। তবে সেটা শোল নয়, গজার মাছ। ঠিক পেটের মাঝটায় টেঁটা গেঁথে রক্ত পড়ছে। গরগর রক্ত। মাছটার পেটের দিকে চোখ আটকে যায় হাসমতের। বিশাল মাছ। গায়ের রঙও উজ্জ্বল, ঝিলমিল করে। দশ-বারো সের ওজন হবে। বেশিও হতে পারে। মাছটা ধরে সে খানিক উৎফুল্ল বোধ করে। মোনসরও দেখে খুশি হয়। তারপর মাছটাকে পাটাতনের নিচে রেখে দুজন দুটো বিড়ি ধরায় টানতে থাকে।

* * *

বিয়োনের আগেই হাসমতের বিবি মারা যায় আশ্বিনের এক রাতে। বিবি তখন তার বাপের বাড়ি। বাজান এসে পোয়াতি নায়র নিয়ে যায়। কেউ বলে কালাজ্বর, কেউ বলে খারাপ বাতাস লাগছিল। কেউ বলে খোদার জিনিস খোদায় উঠায় নিয়া গেছে। কবিরাজ-ফকির কোনও কিছুতেই কাজ হয় নাই। তিনদিনের জ্বরে মরিয়ম মারা যায়। বাচ্চাটাও দুনিয়ার মুখ দেখেনি।
বিবির মৃত্যুর কথা ভাবতেই বুক থেকে দীর্ঘ একটা শ্বাস ছাড়ে হাসমত। তারপর লুঙ্গির গিঁটটা ভালো করে বেঁধে নিড়িকাচিটা হাতে তোলে নেয়। না, আইজ আর নিড়িইয়া কাম নাই। আসমান ভার করছে। গাদলা নামব মনে অয়। যে কোনও সময় হড়হড় করে বৃষ্টি হবে। বাজ পড়বে। তারচে ভালো বাড়িতে চলে যাওয়া। খাওয়ার জন্য কিছু পুঁইশাক পাশের খেত থেকে কেটে গামছা দিয়ে বেঁধে নেয় সে। ডগমগ আর টাটকা। অনেকগুলোই নেয়। তারপর আইল ধরে দ্রুত গতিতে হাটতে থাকে। কোনোদিকে তাকানোর সময় নেই। দাঁড়ানোর সময় নেই।

স্কেল চেঞ্জার

প্রতীক বন্দ্যোপাধ্যায়

“তোমার গলাটা তো চমৎকার! আর কী সুন্দর উচ্চারণ! পরপর গেয়ে যাচ্ছ অথচ একটা কথাও ভুল হচ্ছে না, সুরও কেটে যাচ্ছে না! নিশ্চয়ই গান শিখেছ?”
কথাটা শুনে ছেলেটা ম্লান হেসে বলল, “ভালো লাগে তাই গাই, বৌদি। কোথায় আর শিখব?”
“শুধু ভালো লেগে তো এরকম গাওয়া যায় না, ভাই। আমি গানের দিদিমণি। আমাকে ফাঁকি দেওয়া অত সোজা না।”
“না, আসলে একা একা কাজ করছি তো, গান গাইতে গাইতে করলে কিছু মনেই হয় না। আর করব না। আপনি পেঁপেদাকে কিছু বলবেন না বৌদি।”
“আচ্ছা বলব না। যদি তুমি আমায় সত্যি কথাটা বলো।”
“কী কথা?”
“গান কোথায় শিখলে? আর এত ভালো গান জেনে রঙের মিস্তিরির কাজ কেন করছ?”
“শিখেছিলাম মা-র কাছে।”
“তোমার মা গায়িকা?”
“যেমন তেমন গায়িকা নয়, বৌদি। রেডিওর অডিশনে পাশ করা গায়িকা। রেডিওতে মা-র গান শুনেছে লোকে। সে অবশ্য আমার জম্মের আগে।”
“বাহ! তারপর?”
“তারপর আর কী? গরিব লোকের গানবাজনা হয় না।”
“আরে বাবা, তোমায় তো শিখিয়েছেন তারপরেও।”
“সে বড় কষ্টের গল্প।”
“তবু। শুনিই না। দুঃখ ভাগ করলে কমে।”
“কী আর শুনবেন? মামুলি লোকের মামুলি ব্যাপার।”
“তুমি মোটেই মামুলি লোক নও। আমার ষাট বছর বয়স হতে চলল, কোনোদিন শুনিনি কোনও মিস্তিরি কাজ করতে করতে নিখুঁত সুরে, কথায় এইসব গান গায়। এভাবে মইয়ের উপর দাঁড়িয়ে দেয়াল রঙ করতে করতে গাইতে আমি বাপু পারতাম না।”
“মা এমন করে শিখিয়েছিল যে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গাইলেও বোধ হয় সুর ভুল হবে না।”
“সেই শেখানোর গল্পটাই শুনি না হয়।”
“আপনি তো ছাড়বেন না দেখছি,” ছেলেটা করুণ হেসে বলে। “আচ্ছা, আমি বরং কথা বলতে বলতে খেয়ে নিই। তাহলে আর সময় নষ্ট হবে না। এ ঘরটা আজ শেষ করে যেতেই হবে।”
রঙের কৌটো আর পাটের তুলিটা হাতে নিয়ে মই থেকে নেমে আসে ছেলেটা। নামিয়ে রেখে হাত ধুতে যায়। পরশু থেকে আমাদের দোতলাটার রঙ শুরু করেছে ও। ছেলের বিয়ে দেব বলে দোতলা করিয়েছি, রঙ করাব গোটা বাড়িটাই। পরশু থেকে কাজে লেগেছে ছেলেটা। এতবড় বাড়ি কখনও একজনে রঙ করতে পারে? সেকথা বলতেই পেঁপেবাবু আমায় আশ্বাস দিয়েছিলেন ওঁর দুটো ফ্ল্যাটের কাজ একসাথে চলছে বলে আপাতত একজনকে দিচ্ছেন, পরে আরও একজনকে দেবেন। কিন্তু এ ছেলে তিনদিনে বেশিরভাগটাই সেরে ফেলেছে দেখছি। সেটা আশ্চর্য নয়, আশ্চর্য ওর গান গাওয়া।
মিস্তিরিরা অনেকেই কাজ করতে করতে গান গায়। এ আর নতুন কী? হিন্দি সিনেমার গান গাইতে শুনেছি, বাংলা সিনেমার গান গাইতেও শুনেছি। বিশেষ করে কিশোরকুমারের গান। কিন্তু এই প্রথম শুনলাম কোন মিস্তিরি ‘এ কি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’ গাইছে। পরশু দুপুরে খেতে বসে প্রথম কানে এল ছেলেটা এই গানটা গাইছে। এসে থেকেই গুনগুন করে কিছু না কিছু গাইছিল, কিন্তু কী গাইছে খেয়াল করিনি একাজে সেকাজে। খেতে বসে কানে যাওয়ামাত্রই চমকে গেলাম। প্রথমে ভাবলাম অন্য কোনও বাড়ি থেকে আসছে আওয়াজটা। উঠে সিঁড়ির মুখে গিয়ে দাঁড়ালাম। না, দোতলা থেকেই তো আসছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্যে কয়েক ধাপ উঠলাম। দেখি আমাদের রঙের মিস্তিরিই গাইছে। রঙ গুলতে গুলতে।
সেদিনই ভালো লেগেছিল, তবে ভেবেছিলাম এ আর বলার কী আছে? কিন্তু দুদিন ধরে প্রাণ ভরে অনেক গান শোনার পরে একটু প্রশংসা করতে না পারলে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। তার উপর কৌতূহলও হচ্ছিল ভীষণ। দুদিন ধরে বেশ শক্ত শক্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত, সেই উত্তম-সুচিত্রার আমলের বাংলা ছবির গান— এসব গাইতে তো শুনেছিই, এমনকী অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তের গানও রঙ করতে করতে কী অনায়াসে গায় ছেলেটা! তারপর আজ সকালে যখন শুনলাম ‘সুখের কথা বোলো না আর, বুঝেছি সুখ কেবল ফাঁকি’ গাইছে, তখন নিশ্চিত হলাম এ ছেলে গান শিখেছে এবং খুব মন দিয়ে শিখেছে। নইলে আজকাল দ্বিজেন্দ্রগীতি ক-জন জানে? সেই ছেলে এই কাজ করে কেন? সেটা না জানতে পারা পর্যন্ত আমার কিছুতে মন বসছিল না।
ছেলেটা খাবে বলে হাত ধুয়ে এসে টিফিন কৌটো খুলে মাটিতে বসতে যাচ্ছিল। আমি বললাম, “এখানে বসলে বাপু তোমার কথা শোনা আমার হবে না। এই হাঁটু নিয়ে আমি মাটিতে বসতে পারব না। তুমি নিচে এসো।”
ছেলেটা ইতস্তত করে, তারপর নেমে আসে আমার পিছু পিছু। অনেক করে বলি ডাইনিং টেবিলে বসতে, সে কিছুতেই বসবে না। শেষে আমি বসি চেয়ারে, ও বসে মাটিতে।
“আমার মায়ের নাম কাবেরী। কাবেরী সাহা। রেডিওয় গাওয়ার সময় ছিল কাবেরী দাস,” ছেলেটা বলে। “এখন আর নাম শুনে কেউ চিনবে না। মা যখন সবে আঠারো, তখনই রেডিওর অডিশনে পাশ করে গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। বছরখানেক গেয়েছিল। তারপরেই আমার দাদু মারা গেল, মায়ের কাকারা ঝটপট বিয়ে দিয়ে দিতে চাইল, কলেজটাও শেষ করতে দিল না। দিদিমা, একা মেয়ে নিয়ে কী আর বলবে?”
“বিয়ের পরে আর গান গাওয়া হল না?”
“বাবা ওসব পছন্দ করত না যে। আর আমার ঠাকমাও ছিল মহা দজ্জাল। দেখেছি তো।”
“কী করতেন তোমার বাবা?”
“ওই রেললাইনের ওপারের গদির কারখানায় কাজ করত। আমার ছোটবেলাতেই সে কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে রাস্তার ধারে সব্জির দোকান করেছে, ট্রেনে বাদাম বিক্রি করেছে, ভ্যান রিকশা টেনেছে। কোনোটাতেই সুবিধে করতে পারেনি। কারণ নেশা।”
“ইশ! কী পাষণ্ড তোমার মায়ের কাকারা! অমন মেয়েকে এমন ছেলের সাথে বিয়ে দিল!”
“না দিয়ে উপায় কী বলুন? আমার দাদুদের তো নিজেদেরও অবস্থা ভালো ছিল না। মায়ের বাবার ছিল ছোট একখানা সেলুন। ভাইরা একজন হার্ডওয়্যারের দোকানে কাজ করত, আরেকজন কিছুই করত না। আমার বাবার চেয়ে ভালো পাত্র আর পেত কোথায়? নগদ চায়নি বিয়েতে। শুধু একখানা সাইকেল।”
আমি কিছুতেই মানতে পারি না। ছেলেটা আমার মুখ দেখে বিজ্ঞের মতো হাসে। রুটি চিবোতে চিবোতে বলে, “আপনার এসব শুনতে অদ্ভুত লাগবে। বড় ঘরের মেয়ে আপনি। আপনাদের ঘরে লেখাপড়া করা, গানবাজনা জানা মেয়েদের অমন বিয়ে হয় না তো।”
“তা হয় না। তবে তোমার মায়ের বিয়ে তো আর আজকের কথা নয়। পঁয়ত্রিশ চল্লিশ বছর আগে আমাদের মত পরিবারেও ওরকম হত,” আমি সামলে নিয়ে বলি।
ছেলেটা আরও বিজ্ঞের মতো বলে, “আমাদের মধ্যে এখনও হয়।”
“যাহ!”
“বিশ্বাস হচ্ছে না, না?” হেসে কুটিপাটি হয়ে সে বলে। “আপনি অবশ্য জানবেনই বা কী করে।”
“মানে? তোমার মেয়ে থাকলে তুমি এমন বিয়ে দিতে?”
“নিজের পেটে ভাতের ঠিক নেই, বিয়ে দিলে যদি মেয়েটা খেয়ে পরে বাঁচবে মনে হয়, কেন দেব না?”
“আরে বাবা, গান গেয়েও তো মানুষ পেট চালাতে পারে।”
“ওসব পেটে বিদ্যে থাকলে তবে লোকে বুঝতে পারে। আমার বাপটা ক্লাস এইট পাশ না, ঠাকমা তো অক্ষরই চিনত না। বস্তিবাড়িতে আবার গান।”
“হা ভগবান! কী যে গেছে তোমার মায়ের ওপর দিয়ে।”
“তা গেছে। তবে মা আমার শক্ত লোক। বাবার কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে শাড়িতে ফলস লাগানো, ব্লাউজ বানানো— এসব করত। ঠাকমা কিটিরকিটির করত, তবু। বাবাও প্রথমদিকে রাগারাগি করত। পরে বুঝে গেছিল মা রোজগার করে বলে নেশা করতে পয়সাকড়ি পাওয়া যায়।”
“তবুও তোমার মায়ের গানের শখ যায়নি, না?”
“যার ভেতর গান আছে, বৌদি, তাকে জলেই ডোবান আর আগুনেই পোড়ান… গান তার মরবে না।”
কথাটা বলে ছেলেটা মন দিয়ে রুটি চিবোয়, আমি ভাবতে চেষ্টা করি আমার ভেতরে গান আছে কিনা। যদি কেউ গান গাইলেই জলে ডুবিয়ে মারবে বলে দাঁড়িয়ে থাকে, তবু কি আমি গাইব? কেউ যদি হাতে মশাল নিয়ে তৈরি থাকে, আমি গাইলেই আমার গায়ে আগুন দেবে, তাও কি আমি গাইতে সাহস করব? পারব না বোধ হয়। বড় অস্থির লাগে। ভাবটা কাটানোর জন্যে প্রশ্ন করি “তা তোমায় শেখালেন কী করে সেটা বলো।”
ছেলেটা মাথা নেড়ে বলে, “আমার যখন বছরপাঁচেক বয়স তখন মা একখানা সেকেন্ড হ্যান্ড হারমোনিয়াম কিনল। সেই নিয়ে বাড়িতে কী অশান্তি, ঠাকমা কী গালাগালটাই না করল মাকে! বলল ‘সংসারের দরকারে হাত দিয়ে পয়সা গলে না, হারমোনিয়ামের পয়সা আসে কোত্থেকে?’ বাবাকে দিল উস্কে, বাবা দিল কয়েক ঘা বসিয়ে।”
আমি শিউরে উঠি।
“কিন্তু মায়ের সেই এক গোঁ ‘ছেলেকে আমি গান শেখাবই।’ তা মারধোর খেয়ে কেনা হল হারমোনিয়াম। যতই মারো আর গাল দাও, মায়ের রোজগারে তখন সংসার চলে। তা এল জিনিসটা। জম্মে ইস্তক মার কাছে যা গল্প শুনেছি সবই গানের গল্প, বুঝলেন না? মার গুরুদের গল্প, আকাশবাণীতে অডিশন দিতে যাওয়ার গল্প, তারপর মা যে ক-বার গাইতে গেছিল, তার মধ্যে একবার দেবব্রত বিশ্বাস আরেকবার হেমন্ত মুখার্জির পায়ে হাত দিয়ে পেন্নাম করার গল্প… আর মা গুনগুনিয়ে গাইত সারাক্ষণ। দাদু কেমন অনেকদিন ধরে পয়সা জমিয়ে স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিল, সেসব শুনে শুনে তদ্দিনে আমার মুখস্থ। মাকে জিগেস করলাম ‘মা, স্কেল চেঞ্জ করে কী করে?’ মা বললে, ‘এতে স্কেল চেঞ্জ হয় না, বাবা। আমার তো অত পয়সা নেই। তোকে গান শেখাব, তুই বড় শিল্পী হবি, তখন কিনবি একটা ভালো স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়াম। সেইটা নিয়ে তুই ফাংশানে গাইবি, আমি ভি আই পি টিকিটে বসে শুনব।’
“প্রথম যেদিন আমার পুরো সরগম হারমোনিয়ামের সাথে মিলল… সেদিন আমায় জড়িয়ে ধরে মায়ের কী কান্না! বাপ রে! তখন তো আর বুঝিনি তার মানে। এখন…”
ওর গলা বুজে যায়, আমি কী বলব ভেবে পাই না। ভেবে ভেবে যে কথাটা একেবারেই বলা উচিৎ ছিল না ঠিক সেটাই বলে ফেলি— “মায়ের এত সাধ ছিল, তোমারও তো সাধ্য নেহাত কম নয়। তবু তুমি গান ছেড়ে দিলে, বাবা?”
“ছেড়েছি কি আর এমনি, বৌদি? ওই সেকেন্ড হ্যান্ড হারমোনিয়ামেই আমার শেখা দিব্যি হচ্ছিল। স্কুলের ফাংশানে গেয়ে-টেয়ে দিব্যি নামডাকও হয়েছিল মাস্টারমশাই, দিদিমণিদের কাছে। তারপর যখন ক্লাস এইটে পড়ি, মা বলল, ‘আমার যতটুকু বিদ্যে আমি শিখিয়ে দিয়েছি। এবার তোকে আমার গুরুর কাছে দিতে হবে।’ বলে নিয়ে গেল মা যেখানে গান শিখত সেইখানে। গিয়ে দেখি মায়ের গুরু তদ্দিনে থুত্থুড়ে বুড়ো, গলা দিয়ে আওয়াজই বেরোয় না, কথা বলতে কষ্ট হয়। তবু মাকে ভালোবাসতেন বলে নাতনিকে বলে দিলেন আমায় শেখাতে। বিনা মাইনেয়।
“দুই কি তিন হপ্তা গেছি, ভদ্দরলোক পটল তুললেন। তারপর থেকে দেখি দিদিমণি আমায় গান শেখাচ্ছে কম, ফাইফরমাশ খাটাচ্ছে বেশি। সবাই ক্লাস করছে আর আমি যাচ্ছি মুদির দোকান থেকে মাল এনে দিতে।”
আমি আর সামলাতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করেই ফেললাম “কার কাছে শিখতে গো?”
ছেলেটা জিভ কেটে বলল, “এ রাম! গুরুনিন্দা করে ফেলছি। থাকগে, নাম বলব না। উনি আমায় শেখাতে না চাইলেও আমি তো শিখেছি ওনার কাছে। বদনাম করব না।”
“মানে? বাজার করে করে শিখলে?”
“উপায় কী বলুন? মাইনে দেওয়া তো আমাদের দ্বারা হত না। আমি রেগে গিয়ে মাকে বলেছিলাম আর যাব না। মা বললে, ‘গুরুকে তো দক্ষিণা দিতে হয়। মনে কর এটাই তোর দক্ষিণা। আমরা তো পয়সাকড়ি কিছু দিতে পারি না।’ মা-র কথা তো ফেলতে পারি না, তাই দাঁতে দাঁত চেপে শিখেছিলাম চার বছর। তারপর আর হল না।”
“কেন?”
“আমার বাপটার জন্যে। জ্বালিয়ে মারছিল। ‘ছেলে বড় হয়েছে, সংসার চলে না, রোজগার করতে হবে।’ রোজ অশান্তি, রোজ অশান্তি। মাকে ধরে মারবে সে কি আর ওই বয়সে সহ্য করতে পারি, বলুন? তাই গানও গেল, সেকেন্ড ডিভিশনে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছিলাম, লেখাপড়াও আর হল না। ঢুকে গেলাম ব্যবসায়।”
“কীসের ব্যবসা?”
“কিছুই না। বাবার চেনাজানা ছিল। কিছু টাকা তাদের দিতে হল, তারা সবুজগ্রাম স্টেশনে ডাউন প্ল্যাটফর্মে একটা জায়গা করে দিল; পান, বিড়ি, সিগারেট, চা, বিস্কুটের দোকান খুললাম। মা খুব কান্নাকাটি করেছিল। বলেছিলাম গান আমি ঠিক করে যাব। কিন্তু বললেই কি আর হয়? রেয়াজের সময় কোথায়? তবে প্ল্যাটফর্মে দোকান দেয়ায় হল কী, ট্রেনে যারা বক্স নিয়ে গান গায়, দেখেছেন তো? ওদের সাথে আমার খুব দোস্তি হয়ে গেল। দোকানে কাজ করতে করতে আমি আপন মনে গাইতাম, কেউ শোনাতে বললে শোনাতাম। ওই করতে করতে আমাকে বিল্টুদা বলে ওদের একজন, খুব বেসুরে গান গাইত, সে বলল, ‘তুই এত ভালো গাস, দোকান বিক্রি করে দে। আমার সাথে ট্রেনে গান কর। তুই গাইলে আমি আর গাইব না, তোর সাথে থাকব, পয়সা তুলব। বক্সের খরচা আমার। যা পাওয়া যাবে হাফ তোর, হাফ আমার।’ দিলাম দোকান বেচে বিল্টুদার ভাইকে।”
“ট্রেনে গান গেয়ে দোকানের চেয়ে বেশি রোজগার হয়?”
“অত কিছু ভেবেই দেখিনি তখন। গাইতে পারব এই আনন্দেই আত্মহারা। মা-ও খুশি, তবে বলেছিল, ‘কোথায় গাইবার কথা ছিল আর কোথায় গাইবি।’”
“আর তোমার বাবা কিছু বলল না? ঠাকুমা?”
“ঠাকমা তদ্দিনে ওপরে। বাবা চোটপাট করেছিল… কিন্তু আমি জোয়ান হয়ে গেছি, বেশি ঘাঁটাতে সাহস পায়নি। আর মায়ের গায়ে হাত তুললে আমি তখন দেখাতাম মজা।
“প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হচ্ছিল, বুঝলেন? আমি তো রবীন্দ্রসঙ্গীত, অতুলপ্রসাদ এইসবই শিখেছিলাম। ট্রেনে ওসব আর ক-জন ভালোবাসে? তারপর বিল্টুদা বলল ‘তুই কিশোরের গান ধর, তোর গলায় ভাল্লাগবে।’ কিশোর আমি শুনতাম এমনিতে, খারাপ লাগত না। তবে হিন্দি গান গাইব? ভাবতেই কেমন লাগত। তা পেটের দায়ে মানুষ কী না করে? তাও করতাম কী, কিশোরের একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে শুরু করতাম। ধরুন ‘মায়াবন বিহারিণী’। তারপর হিন্দি গান ধরতাম। রোজগার যা-ই হোক, লোকের কিন্তু ভালো লাগত। অনেকে পিঠ চাপড়ে প্রশংসাও করত। আর কী চায়, বলুন, একজন গায়ক? কিন্তু ও সুখ টিকল না।”
“কেন? রোজগারে পোষাচ্ছিল না?”
“দাঁড়ান। হাতমুখ ধুয়ে আসি।”
“এই বেসিনে ধুয়ে নাও।”
“না না, আমি হাত ধুলেই রঙ বেরোবে। আমি কলপাড়ে যাচ্ছি।”
অনেক চাপাচাপি করেও ছেলেটাকে রাজি করানো গেল না। আমি বসে বসে ভাবছি ওটুকু সুখও কেন এই দুঃখী মানুষটার জীবনে সইল না, সে ওদিকে কলপাড়ে টিফিন কৌটো ধুচ্ছে তো ধুচ্ছেই।
“সংসার মোটামুটি চলে যাচ্ছিল, বুঝলেন?” ফিরে এসে শুরু করল। “মা-র সেলাইফোঁড়াই আর আমার গানে দুবেলা দুমুঠো আমাদের দিব্যি জুটে যাচ্ছিল। গান গাইতে যাবার সময় পরব বলে একটা ভালো ফুলহাতা সাদা শার্ট, কালো টেরিকটের প্যান্ট আর একজোড়া বুট কিনেছিলাম। লাইনের লোকেরা সেইজন্যে ক্ষেপাত, কিন্তু জামাকাপড়টা ঠিকঠাক না থাকলে, আমার মনে হয়, গানটা ঠিক করে হয় না। শিল্পীর তো একটা ডিসিপ্লিন থাকা উচিৎ নাকি, বৌদি?”
আমি অবাক হতে হতে শুধু মাথাই নাড়তে পারি।
“বছরদুয়েক চালিয়েছিলাম। শুধু ওই করে তো চলে না। দোলের আগে রঙ বিক্রি, কালীপুজোর আগে বাজি বিক্রি, কখনও ধূপ বিক্রি— এসবও করছিলাম সাথে সাথে। বিয়েও করলাম। ওরম করেই তো সংসার চলে আমাদের। মুশকিল হয় গরিবের ঘরে বড়লোকের রোগে ধরলে। আমারও তাই হল। দু-হাজার দশে বাবার ক্যান্সার হল… শালা হবে না কেন? কত লিটার চোলাই যে খেয়েছে…”
“তখনই তুমি অন্য কাজের খোঁজ করলে?”
“না করে আর উপায় ছিল না। মা-র সামান্য গয়নাগাঁটির মধ্যে খালি একগাছা চুড়ি ছিল, সেগুলোও বেচতে যাচ্ছিল। এরপরে কি আর গানের মায়া করা যায়, বলুন? পেঁপেদার সাথে বিল্টুদাই আলাপ করিয়ে দিল সেইসময়। তখন তো এই কাজ জানতাম না, পেঁপেদা ওর হার্ডওয়্যারের দোকানে কাজ দিল প্রথমে। তারপর আস্তে আস্তে এই কাজ শিখে নিলাম।”
“গান তাহলে সেই থেকে বন্ধ?”
“না, বন্ধ কোথায়? সারাক্ষণই তো গাইছি।”
“না, মানে হারমোনিয়াম নিয়ে রেওয়াজ টেওয়াজ একেবারে বন্ধ।”
“তা বন্ধ। হারমোনিয়ামটা তো সেসময় বেচেও দিতে হল। বাবাকে অত করেও বাঁচানো গেল না, তবে পেঁপেদা ছিল বলে আমার সংসারটা ভেসে যায়নি। বাবা দুটো বছর ভুগেছিল। যা খরচ, শুধু আমাদের টালির চালের বাড়িটা বেচতে বাকি ছিল। পেঁপেদা আমায় অনেক টাকা ধার দিয়েছে। সব এখনও শোধও করতে পারিনি।”
শিল্পীর অপমৃত্যুর এমন গল্প শুনে মনটা ভারী হয়ে গিয়েছিল। ছেলেটা দিব্যি উপরে চলে গিয়ে রঙ করা শুরু করে দিল, আমি অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। কতক্ষণ কেটেছে ওইভাবে খেয়ালও করিনি, হঠাৎ চমকে উঠলাম ওর ডাকে।
“বৌদির তো মনটা বড্ড খারাপ হল দেখছি,” একগাল হাসি নিয়ে ছেলেটা সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে বলছে। “অত মন খারাপ করবেন না। গান জীবন থেকে বাদ যায়নি। মা আছে না? মা-র কাছে একটা পোকায় কাটা গীতবিতান আছে। ওইটা নিয়ে রোজ কিছু না কিছু গায়। রোজ শুনতে পাই বলেই না এত মনে আছে।”
আমি হাসি। ছেলেটা বলে চলে, “হারমোনিয়ামও আবার কিনব একটা। আমার মেয়েটাকে মা খালি গলাতেই গাওয়াচ্ছে আজকাল। সুর আছে ওর গলায়। একটা হারমোনিয়াম হলে ভালো করে শিখতে পারবে।”
ওহ! কী ভালোই যে বাসে এরা গানকে! ওদের জন্যে কিছুই কি করতে পারি না আমি? ভাবতেই মনে পড়ে আমার হারমোনিয়ামগুলোর কথা। কিন্তু ও কি নেবে? বলা কি উচিৎ হবে? গোটা দুপুরটা দোনামোনা করে শেষে ছেলেটা কাজ শেষ করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলেই ফেলি, “তোমার নামটা যেন কী বললে, ভাই?”
“সুবল, বৌদি। সুবল সাহা।”
“আর তোমার মেয়ের নাম?”
“শ্যামা। আমার মায়ের দেয়া নাম।”
“আচ্ছা সুবল, তুমি শ্যামার জন্যে কী রকম হারমোনিয়াম কিনবে ভাবছ?”
“সাধারণ হারমোনিয়াম। নতুন স্কেল চেঞ্জার তো কিনতে পারব না।”
“আমার কাছে একটা ভালো স্কেল চেঞ্জার হারমোনিয়াম আছে। বছরখানেক পুরনো। সেটা নেবে?”
“নেব? আচ্ছা। তবে… দাম দিয়ে নেব কিন্তু।”
আমি নিশ্চিন্ত হই।
“তাই নিয়ো।”
“কাল তাহলে বাড়ি যাওয়ার সময়ে একটা রিকশা ডেকে নিয়ে যাব?”
“তাই কোরো। এখন একবার জিনিসটা দেখে যাবে না? পয়সা দিয়ে কিনছ।”
শুনেই সুবলের চোখদুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে, ঠিক যেমনটা আশা করেছিলাম।
আমার গানের ঘরটা খুলে ওই হারমোনিয়ামটা ওর দিকে এগিয়ে দিই। সুবল একটু বাজিয়ে নেয় প্রথমে। তারপর গাইতে শুরু করে— “সুখের মাঝে তোমায় দেখেছি/ দুঃখে তোমায় পেয়েছি/ পেয়েছি প্রাণ ভরে।”