অনেকদিন না কি অল্পদিন, অনেকমাস না কি অল্পমাস, এই বাড়িটাতে থাকি। কত ঘর, সিঁড়ি, খাট, টেবিল, চেয়ার। আর নীলজামামেয়ে। কত আলো। কী সুন্দর জায়গা। কত ফুলগাছ। কিন্তু সেই বাড়িটা কোথায়? সেই ছেলেটা, কী যেন নাম… সেই লোকটা… ওরা কোথায় কে জানে। আমার এখানে বেশ লাগে। পাখিরা ‘গুড মর্নিং’ বলে। ওই যে পাহাড়ের গায়ে উনুনে রান্না হয়। মা রান্না করে। ছোট ছেলেটা খেলা করে। বিকেলে কীসের যেন গান শোনা যায়। শুধু মাঝে মাঝে শীত করে। তখন একটা হলুদ রঙের কম্বল গায়ের ওপর দিয়ে দেয়।
এখন বোধ হয় সকাল। নীলজামামেয়ে জানলা খুলে দিল। ছোট ছোট ওগুলো কী যেন দেখা যাচ্ছে? ‘ওগুলো টিলা।’ সাদা সাদা কী যেন চামচ করে খাইয়ে দিল। ওই তো ওরা হেঁটে হেঁটে টিলার ওপর উঠছে মায়ের হাত ধরে। হাত ছেড়ে দৌড় দৌড়। মা নিশচয়ই বকছে, ‘পড়ে যাবি তো!’ ওরা কী সব নিয়ে গোল হয়ে বসেছে। খেলনাবাটি বোধ হয়। আমার খেলনাবাটিগুলো কোথায় যে গেল। সেই যে সেবার মেলা থেকে দিদা কিনে দিল! ওরা এবার সব নুড়িপাথর সাজিয়ে রান্নারান্না খেলছে। ওগুলো কী? পাতা বোধ হয়। ওই যে ছোট ছেলেটা সব কাঠকুটো নিয়ে এল। ওর নাম কি ইভান? ‘খুদে ইভান বড় বুদ্ধিমান।’ পাহাড়ের একপাশে কী ধোঁয়া, ওদের মা বোধ হয় উনুন ধরাল। ভাত চাপাতে হবে, ডাল রাঁধতে হবে, ইস্কুলে যাবে তো! মা তো বড় ইস্কুলে যায়। ওরাও কি ইস্কু্লে যাবে? কিন্তু এখনও তো খেলেই চলেছে! কখন লেখাপড়া করবে কে জানে! আচ্ছা ওরা কোথায় ঘুমোয়? ওদের কি হলুদ কম্বল আছে? ওদের নাম কী? আমার নাম কী? আমার বাড়ি কোথায়?
নীলজামামেয়ে চুল আঁচড়িয়ে দেয়। বলে যায়— মা, এবার তোমার ন্যাপ টাইম। আরও কে যেন বলল, ‘মা।’ ওই যে সেদিন বলে গেল— ‘দেখেছ, এখানে কত সবুজ! তুমি তো পাহাড় ভালোবাস। ওই যে টিলা দেখা যাচ্ছে! বারান্দায় কত ফুলগাছ!’
‘শুয়ে পড়ো, শুয়ে পড়ো। ও মা, তুমি তো দেখছি দই ছাড়া কিছুই খাওনি। বিকেলে তোমার লেবু লজেন্স নিয়ে আসব।’ নীলজামামেয়ে চলে গেল। বাবা নিশ্চয়ই ট্রেন থেকে নিয়ে এসেছে লেবু লজেন্স, আর মা ঠিক কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। ইস্কুল থেকে ফেরার আগেই খুঁজেপেতে বার করে নিতে হবে।
আলোগুলো জ্বলে ওঠে। শীতজড়ানো লাল র্যাপারখানা গায়ে দিয়ে কাঠের চেয়ারে যেই না বসা, নীলপাখি এসে হাজির! এ গাছ থেকে ও গাছ। শুধু লাফায়। বড্ড চঞ্চল। আবার দুষ্টুমি করে দু-চারটে পাতা ছিঁড়েছে। মা দেখলেই বকবে। আমায় দেখে হাসলও। মাটিতে কী সব খোঁজে আর বকবক করে। এ কথা ও কথা, হঠাৎ বলে— ‘একটা কথা বলব?’ আমি ঘাড় নাড়তেই বলে, ‘নাহ, পরের দিন বলব।’ বলেই ফুড়ুৎ। আমি বসে থাকি, আর আসে না। বন্ধুদের কাছে যায় বোধ হয়।
এই তো সেদিন আমি লালফুলদের সঙ্গে গল্প করছি, হঠাৎ দেখি ও মা, ওই তো! আমার দিকে পিছন ফিরে বসে কার সঙ্গে যেন বকরবকর করছে। আমায় যেন চেনেই না। ক-দিন পরেই ফুড়ুৎ করে চেয়ারের হাতলে এসে বসে আবার কত গল্প, ওর ইস্কুলের গল্প, পাহাড়ের গল্প, গাছের গল্প, বাড়ির গল্প। অনেকক্ষণ নাকি অল্পক্ষণ, নীলপাখি গল্প করে, গান করে, তারপর বলে ওঠে, ‘শোনো।’ কী একটা হয় আর দৌড়ে চলে যায়। কী যে বলতে চায়…
আলোগুলো কতক্ষণ জ্বলে থাকে কে জানে! গাছ, পাখি, টব সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, অন্য একটা চেয়ারে এসে বসি। একটা বেড়াল চোখ পিটপিট করে। ওর নাম বোধ হয় ‘তুপা’। ও তো পাখি ধরে না। খালি ঘুমোয়। অনেক লোক এখানে কথা বলে, গান করে— আমি কি এদের চিনি? এদের নাম কী? এরা কি আমার বন্ধু? নীলজামামেয়ে বলে, ‘ওরা তো টিভিতে কথা বলছে। তুমি চা খাও।’ আমার মন কেমন করে।
মাঝেমাঝে সেই লোকটা আসে। নীলজামামেয়ে বলে, ‘আজ তোমায় ন্যাপ নিতে হবে না।’ ব্যাগে করে কত কী নিয়ে আসে। কী নিয়ে আসে? চেয়ারে বসে বই পড়ে দেয়, ছবি দেখায়, হাত ধরে বসে থাকে, কিছু বলে না। এ কি সেই লোকটা? সবসময় আমার আঁচল দিয়ে চশমার কাচ মুছত? ওর নাম কী? কবে যেন বলেছিল, ‘একটা কথা বলব?’ ওর চশমা কোথায়? কী দিয়ে মোছে? আমার তো কোনও শাড়ি নেই। তাই বোধ হয় আর চশমাও পরে না।
চেয়ার থেকে উঠে আলো জ্বালিয়ে দেয়। আস্তে আস্তে পড়তে শুরু করে, ‘ছোট্ট গোল রুটি, চলেছি গুটি গুটি…’ আমার একটু একটু শীত করে, ঘুম পায়। কম্বলটা আমার গায়ে দিয়ে দেয়।
অনবদ্য👌👌👌
It’s really a heart touching piece. Felt like getting lost in an abysmal darkness. Looking forward to read more.
Very interesting. Loved it.
দারুন
Good one, Kajori!
প্রিয় কাজরি, অসাধারণ একটা লেখা পড়লাম। বাকরুদ্ধ। এর পরে কিছু বলা চলে না। শুধু মুগ্ধতা।
দেবলীনা