“তোমার গলাটা তো চমৎকার! আর কী সুন্দর উচ্চারণ! পরপর গেয়ে যাচ্ছ অথচ একটা কথাও ভুল হচ্ছে না, সুরও কেটে যাচ্ছে না! নিশ্চয়ই গান শিখেছ?”
কথাটা শুনে ছেলেটা ম্লান হেসে বলল, “ভালো লাগে তাই গাই, বৌদি। কোথায় আর শিখব?”
“শুধু ভালো লেগে তো এরকম গাওয়া যায় না, ভাই। আমি গানের দিদিমণি। আমাকে ফাঁকি দেওয়া অত সোজা না।”
“না, আসলে একা একা কাজ করছি তো, গান গাইতে গাইতে করলে কিছু মনেই হয় না। আর করব না। আপনি পেঁপেদাকে কিছু বলবেন না বৌদি।”
“আচ্ছা বলব না। যদি তুমি আমায় সত্যি কথাটা বলো।”
“কী কথা?”
“গান কোথায় শিখলে? আর এত ভালো গান জেনে রঙের মিস্তিরির কাজ কেন করছ?”
“শিখেছিলাম মা-র কাছে।”
“তোমার মা গায়িকা?”
“যেমন তেমন গায়িকা নয়, বৌদি। রেডিওর অডিশনে পাশ করা গায়িকা। রেডিওতে মা-র গান শুনেছে লোকে। সে অবশ্য আমার জম্মের আগে।”
“বাহ! তারপর?”
“তারপর আর কী? গরিব লোকের গানবাজনা হয় না।”
“আরে বাবা, তোমায় তো শিখিয়েছেন তারপরেও।”
“সে বড় কষ্টের গল্প।”
“তবু। শুনিই না। দুঃখ ভাগ করলে কমে।”
“কী আর শুনবেন? মামুলি লোকের মামুলি ব্যাপার।”
“তুমি মোটেই মামুলি লোক নও। আমার ষাট বছর বয়স হতে চলল, কোনোদিন শুনিনি কোনও মিস্তিরি কাজ করতে করতে নিখুঁত সুরে, কথায় এইসব গান গায়। এভাবে মইয়ের উপর দাঁড়িয়ে দেয়াল রঙ করতে করতে গাইতে আমি বাপু পারতাম না।”
“মা এমন করে শিখিয়েছিল যে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গাইলেও বোধ হয় সুর ভুল হবে না।”
“সেই শেখানোর গল্পটাই শুনি না হয়।”
“আপনি তো ছাড়বেন না দেখছি,” ছেলেটা করুণ হেসে বলে। “আচ্ছা, আমি বরং কথা বলতে বলতে খেয়ে নিই। তাহলে আর সময় নষ্ট হবে না। এ ঘরটা আজ শেষ করে যেতেই হবে।”
রঙের কৌটো আর পাটের তুলিটা হাতে নিয়ে মই থেকে নেমে আসে ছেলেটা। নামিয়ে রেখে হাত ধুতে যায়। পরশু থেকে আমাদের দোতলাটার রঙ শুরু করেছে ও। ছেলের বিয়ে দেব বলে দোতলা করিয়েছি, রঙ করাব গোটা বাড়িটাই। পরশু থেকে কাজে লেগেছে ছেলেটা। এতবড় বাড়ি কখনও একজনে রঙ করতে পারে? সেকথা বলতেই পেঁপেবাবু আমায় আশ্বাস দিয়েছিলেন ওঁর দুটো ফ্ল্যাটের কাজ একসাথে চলছে বলে আপাতত একজনকে দিচ্ছেন, পরে আরও একজনকে দেবেন। কিন্তু এ ছেলে তিনদিনে বেশিরভাগটাই সেরে ফেলেছে দেখছি। সেটা আশ্চর্য নয়, আশ্চর্য ওর গান গাওয়া।
মিস্তিরিরা অনেকেই কাজ করতে করতে গান গায়। এ আর নতুন কী? হিন্দি সিনেমার গান গাইতে শুনেছি, বাংলা সিনেমার গান গাইতেও শুনেছি। বিশেষ করে কিশোরকুমারের গান। কিন্তু এই প্রথম শুনলাম কোন মিস্তিরি ‘এ কি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’ গাইছে। পরশু দুপুরে খেতে বসে প্রথম কানে এল ছেলেটা এই গানটা গাইছে। এসে থেকেই গুনগুন করে কিছু না কিছু গাইছিল, কিন্তু কী গাইছে খেয়াল করিনি একাজে সেকাজে। খেতে বসে কানে যাওয়ামাত্রই চমকে গেলাম। প্রথমে ভাবলাম অন্য কোনও বাড়ি থেকে আসছে আওয়াজটা। উঠে সিঁড়ির মুখে গিয়ে দাঁড়ালাম। না, দোতলা থেকেই তো আসছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্যে কয়েক ধাপ উঠলাম। দেখি আমাদের রঙের মিস্তিরিই গাইছে। রঙ গুলতে গুলতে।
সেদিনই ভালো লেগেছিল, তবে ভেবেছিলাম এ আর বলার কী আছে? কিন্তু দুদিন ধরে প্রাণ ভরে অনেক গান শোনার পরে একটু প্রশংসা করতে না পারলে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। তার উপর কৌতূহলও হচ্ছিল ভীষণ। দুদিন ধরে বেশ শক্ত শক্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত, সেই উত্তম-সুচিত্রার আমলের বাংলা ছবির গান— এসব গাইতে তো শুনেছিই, এমনকী অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তের গানও রঙ করতে করতে কী অনায়াসে গায় ছেলেটা! তারপর আজ সকালে যখন শুনলাম ‘সুখের কথা বোলো না আর, বুঝেছি সুখ কেবল ফাঁকি’ গাইছে, তখন নিশ্চিত হলাম এ ছেলে গান শিখেছে এবং খুব মন দিয়ে শিখেছে। নইলে আজকাল দ্বিজেন্দ্রগীতি ক-জন জানে? সেই ছেলে এই কাজ করে কেন? সেটা না জানতে পারা পর্যন্ত আমার কিছুতে মন বসছিল না।
ছেলেটা খাবে বলে হাত ধুয়ে এসে টিফিন কৌটো খুলে মাটিতে বসতে যাচ্ছিল। আমি বললাম, “এখানে বসলে বাপু তোমার কথা শোনা আমার হবে না। এই হাঁটু নিয়ে আমি মাটিতে বসতে পারব না। তুমি নিচে এসো।”
ছেলেটা ইতস্তত করে, তারপর নেমে আসে আমার পিছু পিছু। অনেক করে বলি ডাইনিং টেবিলে বসতে, সে কিছুতেই বসবে না। শেষে আমি বসি চেয়ারে, ও বসে মাটিতে।
“আমার মায়ের নাম কাবেরী। কাবেরী সাহা। রেডিওয় গাওয়ার সময় ছিল কাবেরী দাস,” ছেলেটা বলে। “এখন আর নাম শুনে কেউ চিনবে না। মা যখন সবে আঠারো, তখনই রেডিওর অডিশনে পাশ করে গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। বছরখানেক গেয়েছিল। তারপরেই আমার দাদু মারা গেল, মায়ের কাকারা ঝটপট বিয়ে দিয়ে দিতে চাইল, কলেজটাও শেষ করতে দিল না। দিদিমা, একা মেয়ে নিয়ে কী আর বলবে?”
“বিয়ের পরে আর গান গাওয়া হল না?”
“বাবা ওসব পছন্দ করত না যে। আর আমার ঠাকমাও ছিল মহা দজ্জাল। দেখেছি তো।”
“কী করতেন তোমার বাবা?”
“ওই রেললাইনের ওপারের গদির কারখানায় কাজ করত। আমার ছোটবেলাতেই সে কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে রাস্তার ধারে সব্জির দোকান করেছে, ট্রেনে বাদাম বিক্রি করেছে, ভ্যান রিকশা টেনেছে। কোনোটাতেই সুবিধে করতে পারেনি। কারণ নেশা।”
“ইশ! কী পাষণ্ড তোমার মায়ের কাকারা! অমন মেয়েকে এমন ছেলের সাথে বিয়ে দিল!”
“না দিয়ে উপায় কী বলুন? আমার দাদুদের তো নিজেদেরও অবস্থা ভালো ছিল না। মায়ের বাবার ছিল ছোট একখানা সেলুন। ভাইরা একজন হার্ডওয়্যারের দোকানে কাজ করত, আরেকজন কিছুই করত না। আমার বাবার চেয়ে ভালো পাত্র আর পেত কোথায়? নগদ চায়নি বিয়েতে। শুধু একখানা সাইকেল।”
আমি কিছুতেই মানতে পারি না। ছেলেটা আমার মুখ দেখে বিজ্ঞের মতো হাসে। রুটি চিবোতে চিবোতে বলে, “আপনার এসব শুনতে অদ্ভুত লাগবে। বড় ঘরের মেয়ে আপনি। আপনাদের ঘরে লেখাপড়া করা, গানবাজনা জানা মেয়েদের অমন বিয়ে হয় না তো।”
“তা হয় না। তবে তোমার মায়ের বিয়ে তো আর আজকের কথা নয়। পঁয়ত্রিশ চল্লিশ বছর আগে আমাদের মত পরিবারেও ওরকম হত,” আমি সামলে নিয়ে বলি।
ছেলেটা আরও বিজ্ঞের মতো বলে, “আমাদের মধ্যে এখনও হয়।”
“যাহ!”
“বিশ্বাস হচ্ছে না, না?” হেসে কুটিপাটি হয়ে সে বলে। “আপনি অবশ্য জানবেনই বা কী করে।”
“মানে? তোমার মেয়ে থাকলে তুমি এমন বিয়ে দিতে?”
“নিজের পেটে ভাতের ঠিক নেই, বিয়ে দিলে যদি মেয়েটা খেয়ে পরে বাঁচবে মনে হয়, কেন দেব না?”
“আরে বাবা, গান গেয়েও তো মানুষ পেট চালাতে পারে।”
“ওসব পেটে বিদ্যে থাকলে তবে লোকে বুঝতে পারে। আমার বাপটা ক্লাস এইট পাশ না, ঠাকমা তো অক্ষরই চিনত না। বস্তিবাড়িতে আবার গান।”
“হা ভগবান! কী যে গেছে তোমার মায়ের ওপর দিয়ে।”
“তা গেছে। তবে মা আমার শক্ত লোক। বাবার কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে শাড়িতে ফলস লাগানো, ব্লাউজ বানানো— এসব করত। ঠাকমা কিটিরকিটির করত, তবু। বাবাও প্রথমদিকে রাগারাগি করত। পরে বুঝে গেছিল মা রোজগার করে বলে নেশা করতে পয়সাকড়ি পাওয়া যায়।”
“তবুও তোমার মায়ের গানের শখ যায়নি, না?”
“যার ভেতর গান আছে, বৌদি, তাকে জলেই ডোবান আর আগুনেই পোড়ান… গান তার মরবে না।”
কথাটা বলে ছেলেটা মন দিয়ে রুটি চিবোয়, আমি ভাবতে চেষ্টা করি আমার ভেতরে গান আছে কিনা। যদি কেউ গান গাইলেই জলে ডুবিয়ে মারবে বলে দাঁড়িয়ে থাকে, তবু কি আমি গাইব? কেউ যদি হাতে মশাল নিয়ে তৈরি থাকে, আমি গাইলেই আমার গায়ে আগুন দেবে, তাও কি আমি গাইতে সাহস করব? পারব না বোধ হয়। বড় অস্থির লাগে। ভাবটা কাটানোর জন্যে প্রশ্ন করি “তা তোমায় শেখালেন কী করে সেটা বলো।”
ছেলেটা মাথা নেড়ে বলে, “আমার যখন বছরপাঁচেক বয়স তখন মা একখানা সেকেন্ড হ্যান্ড হারমোনিয়াম কিনল। সেই নিয়ে বাড়িতে কী অশান্তি, ঠাকমা কী গালাগালটাই না করল মাকে! বলল ‘সংসারের দরকারে হাত দিয়ে পয়সা গলে না, হারমোনিয়ামের পয়সা আসে কোত্থেকে?’ বাবাকে দিল উস্কে, বাবা দিল কয়েক ঘা বসিয়ে।”
আমি শিউরে উঠি।
“কিন্তু মায়ের সেই এক গোঁ ‘ছেলেকে আমি গান শেখাবই।’ তা মারধোর খেয়ে কেনা হল হারমোনিয়াম। যতই মারো আর গাল দাও, মায়ের রোজগারে তখন সংসার চলে। তা এল জিনিসটা। জম্মে ইস্তক মার কাছে যা গল্প শুনেছি সবই গানের গল্প, বুঝলেন না? মার গুরুদের গল্প, আকাশবাণীতে অডিশন দিতে যাওয়ার গল্প, তারপর মা যে ক-বার গাইতে গেছিল, তার মধ্যে একবার দেবব্রত বিশ্বাস আরেকবার হেমন্ত মুখার্জির পায়ে হাত দিয়ে পেন্নাম করার গল্প… আর মা গুনগুনিয়ে গাইত সারাক্ষণ। দাদু কেমন অনেকদিন ধরে পয়সা জমিয়ে স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিল, সেসব শুনে শুনে তদ্দিনে আমার মুখস্থ। মাকে জিগেস করলাম ‘মা, স্কেল চেঞ্জ করে কী করে?’ মা বললে, ‘এতে স্কেল চেঞ্জ হয় না, বাবা। আমার তো অত পয়সা নেই। তোকে গান শেখাব, তুই বড় শিল্পী হবি, তখন কিনবি একটা ভালো স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়াম। সেইটা নিয়ে তুই ফাংশানে গাইবি, আমি ভি আই পি টিকিটে বসে শুনব।’
“প্রথম যেদিন আমার পুরো সরগম হারমোনিয়ামের সাথে মিলল… সেদিন আমায় জড়িয়ে ধরে মায়ের কী কান্না! বাপ রে! তখন তো আর বুঝিনি তার মানে। এখন…”
ওর গলা বুজে যায়, আমি কী বলব ভেবে পাই না। ভেবে ভেবে যে কথাটা একেবারেই বলা উচিৎ ছিল না ঠিক সেটাই বলে ফেলি— “মায়ের এত সাধ ছিল, তোমারও তো সাধ্য নেহাত কম নয়। তবু তুমি গান ছেড়ে দিলে, বাবা?”
“ছেড়েছি কি আর এমনি, বৌদি? ওই সেকেন্ড হ্যান্ড হারমোনিয়ামেই আমার শেখা দিব্যি হচ্ছিল। স্কুলের ফাংশানে গেয়ে-টেয়ে দিব্যি নামডাকও হয়েছিল মাস্টারমশাই, দিদিমণিদের কাছে। তারপর যখন ক্লাস এইটে পড়ি, মা বলল, ‘আমার যতটুকু বিদ্যে আমি শিখিয়ে দিয়েছি। এবার তোকে আমার গুরুর কাছে দিতে হবে।’ বলে নিয়ে গেল মা যেখানে গান শিখত সেইখানে। গিয়ে দেখি মায়ের গুরু তদ্দিনে থুত্থুড়ে বুড়ো, গলা দিয়ে আওয়াজই বেরোয় না, কথা বলতে কষ্ট হয়। তবু মাকে ভালোবাসতেন বলে নাতনিকে বলে দিলেন আমায় শেখাতে। বিনা মাইনেয়।
“দুই কি তিন হপ্তা গেছি, ভদ্দরলোক পটল তুললেন। তারপর থেকে দেখি দিদিমণি আমায় গান শেখাচ্ছে কম, ফাইফরমাশ খাটাচ্ছে বেশি। সবাই ক্লাস করছে আর আমি যাচ্ছি মুদির দোকান থেকে মাল এনে দিতে।”
আমি আর সামলাতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করেই ফেললাম “কার কাছে শিখতে গো?”
ছেলেটা জিভ কেটে বলল, “এ রাম! গুরুনিন্দা করে ফেলছি। থাকগে, নাম বলব না। উনি আমায় শেখাতে না চাইলেও আমি তো শিখেছি ওনার কাছে। বদনাম করব না।”
“মানে? বাজার করে করে শিখলে?”
“উপায় কী বলুন? মাইনে দেওয়া তো আমাদের দ্বারা হত না। আমি রেগে গিয়ে মাকে বলেছিলাম আর যাব না। মা বললে, ‘গুরুকে তো দক্ষিণা দিতে হয়। মনে কর এটাই তোর দক্ষিণা। আমরা তো পয়সাকড়ি কিছু দিতে পারি না।’ মা-র কথা তো ফেলতে পারি না, তাই দাঁতে দাঁত চেপে শিখেছিলাম চার বছর। তারপর আর হল না।”
“কেন?”
“আমার বাপটার জন্যে। জ্বালিয়ে মারছিল। ‘ছেলে বড় হয়েছে, সংসার চলে না, রোজগার করতে হবে।’ রোজ অশান্তি, রোজ অশান্তি। মাকে ধরে মারবে সে কি আর ওই বয়সে সহ্য করতে পারি, বলুন? তাই গানও গেল, সেকেন্ড ডিভিশনে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছিলাম, লেখাপড়াও আর হল না। ঢুকে গেলাম ব্যবসায়।”
“কীসের ব্যবসা?”
“কিছুই না। বাবার চেনাজানা ছিল। কিছু টাকা তাদের দিতে হল, তারা সবুজগ্রাম স্টেশনে ডাউন প্ল্যাটফর্মে একটা জায়গা করে দিল; পান, বিড়ি, সিগারেট, চা, বিস্কুটের দোকান খুললাম। মা খুব কান্নাকাটি করেছিল। বলেছিলাম গান আমি ঠিক করে যাব। কিন্তু বললেই কি আর হয়? রেয়াজের সময় কোথায়? তবে প্ল্যাটফর্মে দোকান দেয়ায় হল কী, ট্রেনে যারা বক্স নিয়ে গান গায়, দেখেছেন তো? ওদের সাথে আমার খুব দোস্তি হয়ে গেল। দোকানে কাজ করতে করতে আমি আপন মনে গাইতাম, কেউ শোনাতে বললে শোনাতাম। ওই করতে করতে আমাকে বিল্টুদা বলে ওদের একজন, খুব বেসুরে গান গাইত, সে বলল, ‘তুই এত ভালো গাস, দোকান বিক্রি করে দে। আমার সাথে ট্রেনে গান কর। তুই গাইলে আমি আর গাইব না, তোর সাথে থাকব, পয়সা তুলব। বক্সের খরচা আমার। যা পাওয়া যাবে হাফ তোর, হাফ আমার।’ দিলাম দোকান বেচে বিল্টুদার ভাইকে।”
“ট্রেনে গান গেয়ে দোকানের চেয়ে বেশি রোজগার হয়?”
“অত কিছু ভেবেই দেখিনি তখন। গাইতে পারব এই আনন্দেই আত্মহারা। মা-ও খুশি, তবে বলেছিল, ‘কোথায় গাইবার কথা ছিল আর কোথায় গাইবি।’”
“আর তোমার বাবা কিছু বলল না? ঠাকুমা?”
“ঠাকমা তদ্দিনে ওপরে। বাবা চোটপাট করেছিল… কিন্তু আমি জোয়ান হয়ে গেছি, বেশি ঘাঁটাতে সাহস পায়নি। আর মায়ের গায়ে হাত তুললে আমি তখন দেখাতাম মজা।
“প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হচ্ছিল, বুঝলেন? আমি তো রবীন্দ্রসঙ্গীত, অতুলপ্রসাদ এইসবই শিখেছিলাম। ট্রেনে ওসব আর ক-জন ভালোবাসে? তারপর বিল্টুদা বলল ‘তুই কিশোরের গান ধর, তোর গলায় ভাল্লাগবে।’ কিশোর আমি শুনতাম এমনিতে, খারাপ লাগত না। তবে হিন্দি গান গাইব? ভাবতেই কেমন লাগত। তা পেটের দায়ে মানুষ কী না করে? তাও করতাম কী, কিশোরের একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে শুরু করতাম। ধরুন ‘মায়াবন বিহারিণী’। তারপর হিন্দি গান ধরতাম। রোজগার যা-ই হোক, লোকের কিন্তু ভালো লাগত। অনেকে পিঠ চাপড়ে প্রশংসাও করত। আর কী চায়, বলুন, একজন গায়ক? কিন্তু ও সুখ টিকল না।”
“কেন? রোজগারে পোষাচ্ছিল না?”
“দাঁড়ান। হাতমুখ ধুয়ে আসি।”
“এই বেসিনে ধুয়ে নাও।”
“না না, আমি হাত ধুলেই রঙ বেরোবে। আমি কলপাড়ে যাচ্ছি।”
অনেক চাপাচাপি করেও ছেলেটাকে রাজি করানো গেল না। আমি বসে বসে ভাবছি ওটুকু সুখও কেন এই দুঃখী মানুষটার জীবনে সইল না, সে ওদিকে কলপাড়ে টিফিন কৌটো ধুচ্ছে তো ধুচ্ছেই।
“সংসার মোটামুটি চলে যাচ্ছিল, বুঝলেন?” ফিরে এসে শুরু করল। “মা-র সেলাইফোঁড়াই আর আমার গানে দুবেলা দুমুঠো আমাদের দিব্যি জুটে যাচ্ছিল। গান গাইতে যাবার সময় পরব বলে একটা ভালো ফুলহাতা সাদা শার্ট, কালো টেরিকটের প্যান্ট আর একজোড়া বুট কিনেছিলাম। লাইনের লোকেরা সেইজন্যে ক্ষেপাত, কিন্তু জামাকাপড়টা ঠিকঠাক না থাকলে, আমার মনে হয়, গানটা ঠিক করে হয় না। শিল্পীর তো একটা ডিসিপ্লিন থাকা উচিৎ নাকি, বৌদি?”
আমি অবাক হতে হতে শুধু মাথাই নাড়তে পারি।
“বছরদুয়েক চালিয়েছিলাম। শুধু ওই করে তো চলে না। দোলের আগে রঙ বিক্রি, কালীপুজোর আগে বাজি বিক্রি, কখনও ধূপ বিক্রি— এসবও করছিলাম সাথে সাথে। বিয়েও করলাম। ওরম করেই তো সংসার চলে আমাদের। মুশকিল হয় গরিবের ঘরে বড়লোকের রোগে ধরলে। আমারও তাই হল। দু-হাজার দশে বাবার ক্যান্সার হল… শালা হবে না কেন? কত লিটার চোলাই যে খেয়েছে…”
“তখনই তুমি অন্য কাজের খোঁজ করলে?”
“না করে আর উপায় ছিল না। মা-র সামান্য গয়নাগাঁটির মধ্যে খালি একগাছা চুড়ি ছিল, সেগুলোও বেচতে যাচ্ছিল। এরপরে কি আর গানের মায়া করা যায়, বলুন? পেঁপেদার সাথে বিল্টুদাই আলাপ করিয়ে দিল সেইসময়। তখন তো এই কাজ জানতাম না, পেঁপেদা ওর হার্ডওয়্যারের দোকানে কাজ দিল প্রথমে। তারপর আস্তে আস্তে এই কাজ শিখে নিলাম।”
“গান তাহলে সেই থেকে বন্ধ?”
“না, বন্ধ কোথায়? সারাক্ষণই তো গাইছি।”
“না, মানে হারমোনিয়াম নিয়ে রেওয়াজ টেওয়াজ একেবারে বন্ধ।”
“তা বন্ধ। হারমোনিয়ামটা তো সেসময় বেচেও দিতে হল। বাবাকে অত করেও বাঁচানো গেল না, তবে পেঁপেদা ছিল বলে আমার সংসারটা ভেসে যায়নি। বাবা দুটো বছর ভুগেছিল। যা খরচ, শুধু আমাদের টালির চালের বাড়িটা বেচতে বাকি ছিল। পেঁপেদা আমায় অনেক টাকা ধার দিয়েছে। সব এখনও শোধও করতে পারিনি।”
শিল্পীর অপমৃত্যুর এমন গল্প শুনে মনটা ভারী হয়ে গিয়েছিল। ছেলেটা দিব্যি উপরে চলে গিয়ে রঙ করা শুরু করে দিল, আমি অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। কতক্ষণ কেটেছে ওইভাবে খেয়ালও করিনি, হঠাৎ চমকে উঠলাম ওর ডাকে।
“বৌদির তো মনটা বড্ড খারাপ হল দেখছি,” একগাল হাসি নিয়ে ছেলেটা সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে বলছে। “অত মন খারাপ করবেন না। গান জীবন থেকে বাদ যায়নি। মা আছে না? মা-র কাছে একটা পোকায় কাটা গীতবিতান আছে। ওইটা নিয়ে রোজ কিছু না কিছু গায়। রোজ শুনতে পাই বলেই না এত মনে আছে।”
আমি হাসি। ছেলেটা বলে চলে, “হারমোনিয়ামও আবার কিনব একটা। আমার মেয়েটাকে মা খালি গলাতেই গাওয়াচ্ছে আজকাল। সুর আছে ওর গলায়। একটা হারমোনিয়াম হলে ভালো করে শিখতে পারবে।”
ওহ! কী ভালোই যে বাসে এরা গানকে! ওদের জন্যে কিছুই কি করতে পারি না আমি? ভাবতেই মনে পড়ে আমার হারমোনিয়ামগুলোর কথা। কিন্তু ও কি নেবে? বলা কি উচিৎ হবে? গোটা দুপুরটা দোনামোনা করে শেষে ছেলেটা কাজ শেষ করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলেই ফেলি, “তোমার নামটা যেন কী বললে, ভাই?”
“সুবল, বৌদি। সুবল সাহা।”
“আর তোমার মেয়ের নাম?”
“শ্যামা। আমার মায়ের দেয়া নাম।”
“আচ্ছা সুবল, তুমি শ্যামার জন্যে কী রকম হারমোনিয়াম কিনবে ভাবছ?”
“সাধারণ হারমোনিয়াম। নতুন স্কেল চেঞ্জার তো কিনতে পারব না।”
“আমার কাছে একটা ভালো স্কেল চেঞ্জার হারমোনিয়াম আছে। বছরখানেক পুরনো। সেটা নেবে?”
“নেব? আচ্ছা। তবে… দাম দিয়ে নেব কিন্তু।”
আমি নিশ্চিন্ত হই।
“তাই নিয়ো।”
“কাল তাহলে বাড়ি যাওয়ার সময়ে একটা রিকশা ডেকে নিয়ে যাব?”
“তাই কোরো। এখন একবার জিনিসটা দেখে যাবে না? পয়সা দিয়ে কিনছ।”
শুনেই সুবলের চোখদুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে, ঠিক যেমনটা আশা করেছিলাম।
আমার গানের ঘরটা খুলে ওই হারমোনিয়ামটা ওর দিকে এগিয়ে দিই। সুবল একটু বাজিয়ে নেয় প্রথমে। তারপর গাইতে শুরু করে— “সুখের মাঝে তোমায় দেখেছি/ দুঃখে তোমায় পেয়েছি/ পেয়েছি প্রাণ ভরে।”