দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল পৃথা। খয়েরি আঁচলটা দিয়ে ঘাম মুছছিল কপালের। স্টেশন থেকে প্রায় দশ মিনিটের হাঁটাপথ। আজ গুমোটটাও বড্ড বেশি। তা সেই আঁচল হাতে ধরা রইল। ভ্রূ কুঁচকে রইল কিছুক্ষণ। লেটারবক্সটা তেরছা হয়ে ঝুলছে পেন্ডুলামের মতো। গত শীতে বাড়ি রং করার সময় এটার উপরেও মেহগনি পোচ পড়েছিল। সদর দরজার রঙের সঙ্গে ম্যাচিং করে।
এখন আর লেটারবক্সের দরকার পড়ে না তেমন। কালেভদ্রে দু-চারটে কেজো অকেজো চিঠি আসে যদিও। পৃথা দেখেও দ্যাখে না। রোদ, জল, ধুলোময়লা খেয়ে মুড়মুড়ে হয়ে ওঠে। হঠাৎ কোনোদিন বাড়ি ঢোকার মুহূর্তে খেয়াল হলে বের করে চোখ বুলিয়ে আড়াআড়ি ছিঁড়ে রান্নাঘরের বিনে গুঁজে দেয়।
তবু লেটারবক্সটা আছে, সদর দরজার শো-পিস হয়েই আছে। বারদুয়েক সোজা করার চেষ্টা করেও লাভ হল না। ডানদিকের পেরেকটা খুলে পড়ে গেছে নিচে। আধোঅন্ধকারে এদিক-ওদিক খুঁজে নজরে এল না।
নেহাত কম বয়স হল না! সংক্রান্তির মেলা থেকে কিনে এনেছিল মা। পৃথা তখন ক্লাস ফাইভ বা সিক্স।
– কী মজা! আমাদের দরজায় লাগাবে এটা? পাল্লাটা বারবার খোলাবন্ধ করছিল সে।
– করিস না! কমজোরি কবজা, খুলে যাবে কিন্তু! ভাত মাখতে মাখতে চেঁচিয়ে উঠেছিল মা।
পৃথার বেশ একটা উত্তেজনা হচ্ছিল। পাড়ায় সবার বাড়ির দরজায় লেটারবক্স আছে। শুধু ওদেরটাই কেমন ন্যাড়া!
পরদিন মিহিরদা এসে লাগিয়ে দিয়ে গেছিল। ফ্যান, লাইট, ছাদের কাপড় টাঙানোর দড়ি, এককথায় যে-কোনো প্রয়োজনে মুশকিল আসান মিহিরদা। কাজ সেরে এককাপ চা খেয়ে দু-চারটে কথা বলেই বেরিয়ে যেত। দরজা বন্ধ করতে গিয়ে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকত মা। বেশ কিছুক্ষণ ধরে মায়ের গলায় অচেনা গুনগুন কানে আসত পৃথার। সাহস করে পায়ে পায়ে কাছে গিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়াত। হেসে মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিত মা তখন।
– আমার সোনা মা! বলেই জড়িয়ে ধরত পৃথা। বুকের ভেতর জমাট অভিমানগুলো গলে গলে পড়ত তখন। সে ছাড়া কেউ তার খবরও রাখত না।
এবার কি পিয়নকাকু আমাদের চিঠিগুলো এটাতে ফেলে দিয়েই চলে যাবে? কড়া নাড়বে না? ছোট্ট পৃথা খুশি হবে না দুঃখ পাবে ভেবে পাচ্ছিল না।
স্কুল থেকে ফিরে নিজের মনে খেলত পৃথা। মা ফিরত বিকেল পার করে। গারমেন্ট ফ্যাক্টরিতে ছুটি হত পাঁচটায়। বাড়ি ফিরে এলিয়ে পড়ত, মরা মানুষের মতো ঘুমোত। বইখাতাগুলো নিয়ে মায়ের গা ঘেঁষে বসত পৃথা। শরীরের সবটুকু ওম শুষে নিত ওই সময়টায়। সমস্ত ভয় আর মনকেমন পালিয়ে যেত তখন।
– কার চিঠি গো মা? বাবার? একদিন, শুধু একদিনই প্রশ্নটা করেছিল সে। ডিউটি থেকে ফিরে বিছানায় শুয়ে কারও একটা চিঠি পড়ছিল মা। উত্তর না পেয়ে সন্দেহটা দৃঢ় হয়েছিল আরও।
– আমার কথা কী লিখেছে মা? কবে আসবে গো আমাদের কাছে? ওমা! বলো না!
ঠাস করে একটা চড় আছড়ে পড়েছিল গালে। ঘটনার আকস্মিকতায় থমকে গেছিল পৃথা!
– লজ্জা করে না? ফেলে চলে গেছে তবু সারাক্ষণ বাবা বাবা করিস! মা কেউ নয় তোর? যা না! যা তোর বাপের কাছে! কেমন রাখে দেখব!
আর কখনও বাবার প্রসঙ্গ তোলেনি পৃথা। কোনোদিন ভুলেও জিজ্ঞেস করেনি— এত যত্ন করে সিঁদুর কেন পরো মা? কার জন্য?
বড় হতে হতে জেনেছে সবটুকু। একটা প্রশ্ন অবচেতন মনে পাক খেয়েছে কখনো-সখনো, নিজের মেয়েকে একবারও দেখতে ইচ্ছে করে না? একবারও মনে পড়ে না? একটা দু-লাইনের চিঠিও কি লেখা যায় না?
হেলে পড়া লেটারবক্সটার গায়ে অকারণেই হাত বোলায় পৃথা। পঁচিশ বছর বয়স হল প্রায়। আচ্ছা, একটা লেটারবক্সের আয়ু কতদিন? তার নিজেরও তো ছত্রিশ পেরোল। জোরে হাঁটলে হাঁফ ধরে আজকাল, কুলকুল করে ঘাম হয়। শিয়ালদা স্টেশনের বাইরে সেদিন আচমকা দেখা অনিন্দ্যর সঙ্গে।
– এরকম চেহারা হয়েছে কেন? চেকআপ করাও একবার!
– তোমারও তো ভুঁড়ি হয়েছে বেশ! ছেলের কোন ক্লাস হল যেন? ম্লান হেসে কথা ঘুরিয়েছিল পৃথা। অনিন্দ্য হাসেনি, সেই অদ্ভুত ভিতরছোঁয়া দৃষ্টিতে এঁফোড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছিল প্রায়।
– যেটা বললাম, শোনো। একটু তাকাও নিজের দিকে। স্কুল থেকে ছুটি নাও কদিন।
একরকম পালিয়েই এসেছিল পৃথা সামনে থেকে। বাড়ি ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়েই ছিল। চোখের নিচে কালি, মুখভর্তি অসংখ্য দাগ, সামনের কয়েকগাছি রুপোলি চুল সুযোগ পেয়ে প্রাইমারির বাচ্চাগুলোর মতো সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠেছিল— ভালো নেই! আমরা ভালো নেই কেউ!
আচ্ছা, অনিন্দ্য তো অপেক্ষা করতে চেয়েছিল সারাজীবন! আজ সে থাকলে কি আর-একটু ভালো থাকত পৃথা?
ছোটবেলার মতোই পাল্লাটা খোলাবন্ধ করছিল পৃথা। এখন ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ হয় একটা। হঠাৎ চোখে পড়ল, ভেতরে একটা পোস্টকার্ড, দু-ভাঁজ করা! কতদিন পর একটা পোস্টকার্ড দেখল সে! তার মানে চিঠি, কারও লেখা চিঠি! মুঠোর ভেতর নিয়ে বেল বাজাল দ্রুত। মিনুদি খুলল দরজা, রোজকার মতো। সাত বছর ধরে খুলছে। সেই যবে থেকে বিছানায় পড়ে গেল মা, বেঁকে গেল মুখ, বন্ধ হয়ে গেল কথা!
এবার এককাপ চা করে দিয়ে বেরিয়ে যাবে। দৌড়ে ঘরে গেল পৃথা। ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে দিয়ে একনিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল পোস্টকার্ডটা।
তারপর ধীর শান্ত পায়ে ঢুকল মায়ের ঘরে। চোখ বন্ধ, ঘুমোচ্ছে কি না বোঝার উপায় নেই। কপালে হাত রাখল মায়ের। সিঁথিতে সিঁদুর কেন দেয়, জানা হল না আর। কত কিছুই যে জানা হল না! মিনুদি চলে যাচ্ছে।
– আমি বেরোলাম। দরজাটা দিয়ে দিয়ো। আর হ্যাঁ, লেটারবক্সটা হেলে গেছে, দেখেছ?
– ওটার আর প্রয়োজন নেই। খুলে নিয়ো কাল। অস্ফুটে বলল পৃথা, আর-একজনের কান বাঁচিয়ে।
‘ফিরে পড়া গল্প’ বিভাগে প্রকাশিত গল্প সংকলন থেকে গল্প তুলে আনছি আমরা। সম্পাদকের পছন্দ অনুসারে সৃষ্টি-র এই সংখ্যায় রইল দেবাশিস সেনগুপ্ত-র ‘লেটারবক্স’ গল্প সংকলন থেকে একটি গল্প। বইটি অনলাইন অর্ডার করা যাবে এখানে।