যদি এমন না হত

হৃষীকেশ বাগচী

(১)

ট্রেনে যেতে যেতে কালকের রাতটার কথা ভাবছিল ইন্দ্রগুপ্ত। দেড় মাসের বিবাহিত জীবন। শুকনো রজনীগন্ধার স্টিকের মতো হয়ে যাচ্ছে। তুঁতে-গোলা জল ছড়িয়ে রংচঙে না করলে আর উপায় নেই।
এক্সপ্রেস ট্রেন চলেছে বাসনাপুর। মাঠভর্তি কেটে নেওয়া ধানের ঝুঁটি। বসে বসেই ঝিমোতে থাকে ইন্দ্রগুপ্ত। বিয়ের পর থেকে তার সকালের দিকটাতেই বেশি ঘুম আসে। রাতে ঘুমোতে ঘুমোতে রোজ তিনটে বেজে যায়। কিন্তু এতক্ষণ সে যে কী করে তা নিজেই বুঝতে পারে না। কেন যে রোজ এত রাত হয় ঘুমোতে তার কোনও সঠিক ব্যাখ্যা নেই তার কাছে। অন্য নববিবাহিতদের একটা ব্যাখ্যা অবশ্য আছে। কিন্তু মা কালীর দিব্যি বলছি, তার ক্ষেত্রে তেমন জুৎসই কোনও ব্যাখ্যা নেই।
এসব ভাবতে ভাবতেই কপালটা মাথাটা বিন্দু বিন্দু ঘামে ভরে উঠল। পকেট থেকে রুমাল বের করে মাথাটা মুছল। একটা দীর্ঘকালীন বেদনা তার দৃষ্টিকে ছোট করে দিল।
ভক-ভক করে ধোঁয়া উড়িয়ে ট্রেন চলছে। বাইরে পুজো-পুজো আমেজ। কিন্তু তার মনে কোনও কিছুর প্রক্ষেপ নেই।
তার মনে শুধু গতকালের রাত। কী তার আগের রাত্রিগুলি। তার দিনের আলোয় থাবা বসিয়েছে রাত। তার চেতনা জুড়ে শুধুই রাত। আর পাশ ফিরে শোবার গল্প।
ব্রিফকেসটা আগলে নিয়ে স্টেশনে নামল। এত মানুষের ভিড়েও সে কেমন জানি নিঃসঙ্গ বোধ করে। রাতে ঘুম কম হবার জন্য মাথাটা কেমন ভোঁ-ভোঁ করছে। ওভারব্রিজ পেরিয়ে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে গেল। অন্যান্য দিন সরাসরি লাইন পেরিয়ে পারাপার করে। আজ কেন নিজের অজান্তেই ওভারব্রিজের দিকে এগিয়ে গেল সেটা সে একটু ভাবার চেষ্টা করে।
এখন কয়েকদিন ধরেই ওর নিজের আচরণে নানারকম অসামঞ্জস্য খুঁজে পাচ্ছে। রাস্তায় হাঁটলে মনে হয় তার চারপাশে কেউ নেই। আর সব অসংগতি নিয়ে মুখ গোমড়া করে ভাবতে বসাটাও নতুন ডেভেলপমেন্ট।
প্ল্যাটফর্মের ওপর মাসিক বইয়ের দোকান। মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে মাঝারি মানের পর্নোগ্রাফি। অতিরিক্ত বক্ষসমৃদ্ধ মেয়েদের ছবি। ইন্দ্রগুপ্তের আজ সেসবও দেখতে ইচ্ছে করছে না। ও কি অসুস্থ?
চারপাশে নিত্যযাত্রীরা হাসতে হাসতে চলেছে। একেকজনের কমপক্ষে আট কী দশ বছরের বিবাহিত জীবন। কাউকে দেখে ওর মতো ক্লান্ত বলে মনে হচ্ছে না তো! তাহলে ওদের কাল রাতে হয়নি? না কি ওরা সব অভিজ্ঞ পল্টন, কোথায় কখন বন্দুক রাখতে হয় জেনে গেছে?
কী সব আজেবাজে ভাবছে! নিজেকে কিছুটা ধিক্কার কিছুটা সহানুভূতি জানাতে জানাতে ওর জন্য দাঁড়িয়ে থাকা সাদা অ্যাম্বাসেডরটার দিকে এগিয়ে গেল।

(২)

অফিসে আজ প্রচণ্ড কাজের চাপ। যান্ত্রিকভাবে সে কাজগুলো করতে লাগল। ফাইলের পর ফাইল টেবিলে জমেছে। ও একটার পর একটা সই করে যাচ্ছে। স্বাক্ষরবাবুর সাথে টাইপ করা চিঠির বয়ান নিয়ে চেঁচামেচি করল অনেকক্ষণ। যেটা সে কোনোদিন করে না। স্বাক্ষরবাবু তার বাপের বয়েসি লোক। হতেই পারে দু-একটা ব্যাকরণগত ত্রুটি। চায়ে চিনি কম দেয়ায় পিওন খাকিয়া পান্ডেকে প্রচণ্ড ঝাড়ল। যদিও চা বানায় মাসি ব্যঞ্জনবালা।
অফিসের সবাই যেন বড়বাবুর মেজাজে তটস্থ হয়ে উঠল। এমন সময় ঘরে ঢুকল দোলাচলী।
– আপনি এই সময়? আপনার যে চিঠিগুলো পাঠানোর কথা পাঠিয়েছেন?
– না, মানে স্যার… বলছি… গ্রেড টু কর্মী দোলাচলী ঘাবড়ে গেল। স্যারের কাছে এমন সরাসরি আক্রমণ সে অনেকদিন পায়নি। স্যারের কাছে চিরদিন সে মিষ্টি ভব্যতাই পেয়ে এসেছে।
ইন্দ্রগুপ্তও নিজের ব্যবহারে অবাক হল। হেঁটে যাওয়া দোলাচলীর পেছনটা লক্ষ করল। ওখানটা লক্ষ করা ওর অনেকদিনের ব্যসন। কিন্তু আজ সবকিছুতে কেমন জানি অসহিষ্ণু লাগছে। রাতে ভালো ঘুম না হলে…আচ্ছা কত লোক তো তার মতোই ব্যস্ত। তার চেয়েও ব্যস্ত। বয়স্ক। ওরা এত জার্নি করে বাড়ি গিয়ে রাতে করে কীভাবে? ভালো হয়? না হলে অত হেসে গালগল্প করে অফিসে এসে ফেরত যায় কীভাবে? একবার জিজ্ঞাসা করলে হত।
দরজা খুলে আবার দোলাচলী ঢুকলেন। বয়সে তার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়। তার বউ চটুলাক্ষির মত সুন্দরী না হলেও চেহারায় চটক আছে। দুই ছেলের মা। ভারী বুক। পঁচিশ হাজার টাকা মাইনের শাসিত বুক। কত ঝড়ঝাপটা গেছে, তবু কত উদ্ধত। পরের জন্মে সে মেয়ে হয়ে জন্মাবে। আর শুধু-শুধু শুয়ে থেকে ব্যাটারির চার্জ মাপবে। মেয়েদের এই নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে কিছু হোস্টেলে শেখা সুভাষিত ওর মনে এল।
– স্যার চিঠিগুলো তৈরি। পিওনকে দিয়ে দেব?
কতক্ষণ দোলাচলীর বুকের দিকে তাকিয়ে ছিল খেয়াল নেই। সম্বিত ফিরলে দেখল দোলাদি অভিমানাহত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
দোলাদি এত টিপটপ। এই বয়েসেও এত মেনটেন করেন। চটুলাক্ষিও তো গোছানো, পরিপাটি। তবে কাল রাত্রে কেমন একটা রংচটা ব্লাউজ পরে ছিল। সন্ধেবেলায় গা ধোয়নি। তাই তো কাল একটা… দুটো… তিনটে কিছুতেই…
– স্যার চিঠিগুলো পাঠিয়ে দেব?
ছি, ছি আবার! ইন্দ্রগুপ্ত সম্মতি দিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। দু-চারজন লোক ওর টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে গেছে। সে ফাইলগুলো আবার সই করতে থাকে।
কী যে হচ্ছে আজকে ওর! আজ শুধু নয় বিয়ের পর দেড়মাস ধরেই হচ্ছে। মাথায় সবসময় একটা অন্যকিছু ঘুরছে। সবসময় একটা ভয়-ভয় লাগে। এই বুঝি আলো নিভে যাবে। দরজা বন্ধ হবে। চটুলাক্ষি হালকা প্রসাধনী সেরে তার পাশে এসে শোবে। তার গায়ে হাত রাখবে। আস্তে আস্তে গায়ে পা-টা তুলে দেবে। ইন্দ্রগুপ্ত ওর হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাবার আভাস পেল। কেমন যেন একটা অজানা আশঙ্কা শিরশিরানি হয়ে ওর মেরুদণ্ড দিয়ে নেমে আসছে…
ফাইলটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল হয়তো। পাশে স্বাক্ষরবাবু ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ও একটু অপ্রতিভ হয়। সাতটা বেজে গেল। আধঘণ্টার মধ্যেই বেরোতে হবে। নইলে ফিরতি ট্রেনটা পাবে না। সাড়ে সাতটা। মানে বাড়ি ফিরতে সেই সাড়ে দশটা। তারপর একটু নিউজ চ্যানেল। ডিনার। মা-র সাথে কিছু সুখদুখের আলাপ। বারোটা বেজে যাবে। তারপর সে দোতলায় উঠবে। বেঁটে রোগা একটা ছায়া ঘরে ঢুকবে। লাইট বন্ধ হবে। চটুলাক্ষি হালকা প্রসাধনী সেরে…
ওহ অসহ্য! কী হচ্ছে এসব! আজ যেন অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি হচ্ছে।
আসলে এসব হতই না। অন্তত এতটা হত না সে জানে। তার জন্য চটুলাক্ষিই দায়ী। কাল রাতে বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর বউ তার মাথায় তবলা বাজিয়ে দিয়েছে।
এই অপমানটা ও আজ কিছুতেই হজম করতে পারছে না। বৌ তার পৌরুষ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করলে সে মনে কিছু করত না, কিন্তু মাথায় মানে পেল্লাই টাকে তবলা বাজিয়ে দেওয়াটাকে ও কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না।

(৩)

টাক বংশগত সবাই জানে। কিন্তু এ বংশগত ফাঁড়া যার কপালে আছে, তার যে কী অবস্থা হয়, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে।
ছোটবেলা থেকে সে যে কতরকম তেল আর কতরকম চিরুনি ব্যবহার করেছে তার হিসেব নেই। যতরকম শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপন হয়, তারা কোনও না কোনও সময় তার বাথরুমে শোভাবর্ধন করেছে। কিন্তু কোথায় কী? তার স্বপ্নে-দুঃস্বপ্নে-জাগরণে বালিশে টাটকা চুলে ভরে গেছে।
অন্ধকারে মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ধড়মড়িয়ে উঠে ছাদে চলে গেছে। মনে হয়েছে পৃথিবীতে তার মতো দুঃখী মানুষ আর দুটো নেই। দিনে দিনে খিদে কমে গেছে। ওজন কমে গেছে। সে একটু পরপর উঠে আয়নার সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে এসেছে।
সবচেয়ে মন খারাপ হত চুল কাটতে গেলে। সামনে আর মাঝখানে কোনোভাবেই ঢেকে রাখা যায় না। যতক্ষণ চুল কাটা হয় ও চোখ বন্ধ করে রাখে। চুল কাটার পর ভয়ে ভয়ে আয়নার দিকে তাকায়। পাশে বসে বছর পঞ্চাশের একজন চুল কাটাচ্ছে। মাথাভর্তি চুল। চুল কাটার কত রকম নকশা। টাকা মিটিয়ে রবিবারের রাস্তায় নেমে হাঁটতে হাঁটতে কতদিন ভুল করে অন্য রাস্তায় চলে গেছে।
যে যখন যা তেলের কথা বলেছে, তা-ই মাথায় মেখেছে। রাতে শোবার আগে তেল লাগিয়ে শুয়েছে। বালিশে তেল চিটচিটে দাগ পড়ে গেছে। তেলের গন্ধে বিছানায় পিঁপড়ে উঠে গেছে। কিন্তু চুল গজায়নি।
কয়েকদিন মাথায় টুপি পরে বাইরে বের হত। শীত নেই গ্রীষ্ম নেই, মাথায় টুপি। বন্ধুরা অতিরিক্ত আওয়াজ দেওয়াতে সেটা বন্ধ হয়েছে। আঙুলে আঙুল ঘষে রামদেবও করেছে। কোনও সুরাহা হয়নি। ডাক্তার বন্ধুর পরামর্শে টানা ছয়মাস ওষুধও খেয়েছে। কোথায় কী! এখন তাই সব ছেড়ে দিয়েছে। হতাশাটা কয়েকদিন বেশ স্তিমিত হয়ে আসছিল। বেড়ে গেল বিয়ের পর। বিয়ের বাসর জাগার দিনই তার শালা-শালীরা টাক নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করেছে। সবাই যত মজা করেছে তত সে কুঁকড়ে গেছে ভেতরে ভেতরে।
এদিকে চটুলাক্ষি যথেষ্ট সুন্দরী। স্বাস্থ্যও সুন্দর। বিবাহিত বন্ধুরা বিয়ের আগে তার প্যাংলা চেহারার জন্য যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এদিকে বউ প্রায় তার মাথায় মাথায়। ছেলে আন্দাজে ইন্দ্রগুপ্তকে লম্বা বলা যায় না মোটেই। তাই বিয়েতে সম্মতি দিতে সে প্রথম প্রথম একটু ইতস্তত করেছিল। বন্ধুরা বলল, “ইন্দ্র তুই এত বড় চাকুরে। এই পৃথিবীতে পয়সা যার সবই তার। আর অসুবিধে হলে আমরা তো আছিই ইত্যাদি।”
যা হোক, বিয়ে তো হয়ে গেল। বিয়ের দিন রাতে বাসর জেগে ভোররাতে শোবার পর বউ পাশে শুয়ে সবার মধ্যেই ওর পায়ে পা দিয়ে চিমটি কেটেছে। কোথায় উৎসাহিত হবে তা নয়। সে চমকে উঠে ঘাবড়ে গেছে।
সেই ঘাবড়ে যাওয়া এখনও চলছে। কিছুতেই রাতের বেলা ঠিকঠাক হচ্ছে না। চটুলাক্ষি প্রতিদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শোয়, আর সে তার পৌরুষকে গালি দিতে দিতে রাত জেগে কাটায়।
শারীরিকভাবে সে যে অসমর্থ নয়, ইন্দ্র তা জানে এবং সেটা প্রমাণিতও। কিন্তু তার সমস্যা হল সে সবসময় জেগে উঠতে পারছে না। সে জানে এটা কোনও সমস্যা নয়। নতুন বিয়ের পর পর হয়। তা বলে চটুল কাল রাতে টাকে তবলা বাজিয়ে দেবে?

(৪)

সমস্যাটা এতই গোলমেলে যে কারোর সাথে আলোচনাও করা যাচ্ছে না। কথা বলতে গেলেই একটা রটনা হবে। তবে তার চিত্তবৈকল্য লক্ষ করে স্বাক্ষরবাবু ওকে উপদেশ দিয়েছেন বাসনাপুরের এক সাধুর কাছে যেতে। উনি নাকি ত্রিকালজ্ঞ মহাপুরুষ। কপালদেব। কপাল দেখে ভাগ্য নির্ধারণ করেন। তাঁর নিদান একেবারে অব্যর্থ।
প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও পরে সে ব্যাপারটাকে অবহেলা করতে পারল না। একদিন চলেই গেল অফিস থেকে আগে বেরিয়ে।
কপালদেব একটা বিরাট বড় অশ্বত্থ গাছের নিচে চাতালে বসেছেন। চতুর্দিকে ভক্তবৃন্দ পরিবৃত। বাবার মাঝে মাঝে ভর হচ্ছে, আবার প্রকৃতিস্থ হচ্ছেন। ভক্তরা অবিরাম জয়ধ্বনি দিচ্ছে। চারিদিকে খোল কত্তাল বাজছে। ধুনোর ধোঁয়ায় জায়গাটা ভরা। তার কেমন আচ্ছন্নের মতো লাগল।
সে সাহস করে বাবার কাছে এগিয়ে এল।
কপালদেব তাকে দেখে হঠাৎ বলে উঠলেন, “অক্ষম যৌনজীবন, হতাশা, অপূর্ণতা– শনি তোর মাথায় চড়ে বসেছে একেবারে। দাঁড়া, দাঁড়া বল তোর কী চাই?”
ইন্দ্রগুপ্ত তো যাকে বলে একদম বাক্যরহিত। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল।
– বল বাবা বল তোর যা চাই আমাকে বল। সব কামনা বাসনার প্রাপ্তিযোগ আজ তোর কপালে লেখা আছে। তুই খালি প্রাণ ভরে চেয়ে নে।
সে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না।
– বাবা আপনি তো সবই জানেন। আপনার কাছে কি কিছু গোপন থাকে?
– তবু তোকেই চাইতে হবে। আমি তো তোকে দেবার জন্য বসে আছি রে পাগল।
– যা চাইব তা-ই পাব? সে একটু ইতস্তত করে।
– যা চাইবি, আজ তা-ই পাবি। একবার দিল সে মাঙ্গকে তো দেখ।
– বাবা আমার মাথায় টাক। চুলে ভরে দাও। আর বড্ড রোগা আর বেঁটে। আমাকে স্বাস্থ্যবান পুরুষ করে দাও।
– বেশ তাই হবে। এই বলে কপালদেব তার মাথায় গায়ে যজ্ঞের বিভূতি আর জল ছড়িয়ে দিলেন।
– কিন্তু একটা শর্ত আছে।
– কী শর্ত বাবা? পয়সাকড়ি যতই লাগুক তার কোনও আপত্তি নেই। এতকাল তো কম পয়সা ঢালেনি! আর মাথাভর্তি চুল। উফ! ভাবলেই ওর গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
– শোন, তুই যখন পূর্ণরূপ লাভ করবি, তখন বউকে জিজ্ঞাসা করবি তোর নতুন রূপ বউয়ের পছন্দ হয়েছে কিনা। যদি তোর বউ অসম্মতি জানায়, তবে কিন্তু তুই আবার আগের রূপেই ফিরে আসবি।
হায় রে হায়! এটা কোনও শর্ত হল। চটুলাক্ষি তো সবসময় তাকে বলছে মাথায় উইগ পরতে। তার ওপর পার্মানেন্ট চুল। ভাবা যায়! আর চেহারার ব্যাপারটা ছেড়েই দিলাম। মেয়েরা ওটা ঠিকঠাক হলে আর কী চায়?
– ঠিক আছে বাবা আমি শর্তে রাজি। কিন্তু বাবা আমার রূপ কখন ফিরে পাব?
– পাব মানে? পেয়ে গেছিস।
আস্তে আস্তে মাথায় হাত দিয়ে দেখল মাথায় ভরে গেছে টোপরের মতো চুলে। বুকের চামড়াও টানটান লাগছে। হাতের পাঞ্জা চওড়া হয়ে গেছে। বসে থাকা অবস্থাতেই তাকে অনেকটা লম্বা লাগছে।
– শোন তুই যে এখানে আসার পর পালটে গেছিস এটা গোপন রাখবি। কাউকে কিছু বলবি না। যা, এখন বাড়ি যা।
– বাবা আপনার দক্ষিণা? কপালবাবার পা ছুঁয়ে কৃতজ্ঞতায় গলে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে।
– যা যা, বাড়ি যা। আমি সাধক। অর্থে লালসা নেই।
হাতে ব্রিফকেসটা নিয়ে স্টেশনের দিকে ছুটতে থাকে। পৌঁছে দেখে বাসনাপুর এক্সপ্রেস ছাড়ব ছাড়ব করছে। ট্রেনে উঠে প্রচণ্ড উত্তেজনায় আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আহা কী অনুপম দৃশ্য! মাথাভর্তি ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। এই দৃশ্যটা দেখবার জন্য সে স্বপ্নে জাগরণে কতদিনই না অপেক্ষা করে আছে।

(৫)

চোখে মুখে একটা উৎকণ্ঠা নিয়ে কলিং বেলটা টিপে দিল ইন্দ্রগুপ্ত।
– কে? কাকে চান আপনি?
– মা আমি ইন্দ্র। কাতরস্বরে বলল।
– তুই? কী বলছিস? মা দ্বিধাবিভক্ত। তবু গলার স্বর শুনে আর মুখের মিল দেখে দরজা খুললেন।
– তোর মাথাভর্তি চুল এল কীভাবে? আর… আরও কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন।
– এসে গেল মা। ভগবানের কাছে চাইলাম, উনি দিয়ে দিলেন। সে তাড়াতাড়ি দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল।
– ভোজবাজি নাকি? চাইলাম আর এসে গেল!
– হ্যাঁ মা সত্যি। আমি তো নিজেই অবাক। ও ব্যাপারটা লঘু করার চেষ্টা করে।
– আপনার মানে তোর বাবার নাম কী? তোর জন্ম কত সালে? তুই কবে মাধ্যমিক পাশ…?
– মা, মা… তোমার হলটা কী? বলতে বলতে সে জামা তুলে পেটের কাটা দাগটা দেখায়। ছোটবেলায় বটির ওপর পড়ে গিয়ে দশটা সেলাই পড়েছিল।
– তা না হয় হল, কিন্তু আর… আরও কিছু বলতে গিয়ে স্থিতিশীলাদেবী থেমে গেলেন।
ইন্দ্রগুপ্ত আর কথা না বাড়িয়ে দোতলায় উঠে গেল।
অন্যান্য দিন হলে চটুলাক্ষিও উপরে আসে। আজ আর এল না। ইন্দ্রগুপ্ত আগে হলে এই নিয়েই আধঘণ্টা ভাবত। আজ তার ভাবার অবকাশ নেই।
বাথরুমে গিয়ে তিনবার করে মাথায় শ্যাম্পু করল। হাতে কোনও চুল নেই। একটাও চুল ওঠেনি। আনন্দে লাফাতে ইচ্ছে করছে ওর। শাওয়ার খুলে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আয়নায় নিজের চেহারা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল কিছুক্ষণ। মিকেলেঞ্জেলোর ডেভিড। আস্ত একটা গ্রিক ভাস্কর্য যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
খাওয়া-দাওয়া বেশ নীরবেই হল। মা-বউ ওর সব কাজকর্ম লক্ষ করছে, এটা সে বুঝতে পারল। মুখে মিটিমিটি হাসল। অন্যান্যদিন হলে এটা নিয়েই আধঘণ্টা… কিন্তু আজ তার ভাবার সময় নেই।
প্রতিদিন রাতে সে ভেতরে কাঁপতে কাঁপতে মাথায় হাত দিয়ে শোয়। চটুল নিজের থেকে এসে একটু নাড়াচাড়া করে। আজ তার সারা শরীরে কীসের যেন একটা আলোড়ন চলছে। লক্ষ করল চটুলাক্ষি পাশ ফিরে শুয়ে আছে। সে বউয়ের কাছে গেল। চটুলাক্ষি একটু হাসল। বাধা দিল না।
তারপর যা হল ইন্দ্রগুপ্ত বুঝতে পারল হওয়াটা স্মরণীয় হতে হলে কেমন হতে হয়। প্রচণ্ড তৃপ্তি নিয়ে সে শুল এবং এক ঘুমে সকাল।

(৬)

সকালবেলা স্নানের পর ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পরম তৃপ্তিতে ইন্দ্রগুপ্ত আয়নার সামনে তাকাল। ঝকঝকে মুখ। কোনও ক্লান্তির ছাপমাত্র নেই।
পাশেই দেখল হাসিমুখে চটুল এসে দাঁড়িয়েছে। তার জামায় পারফিউম ছড়িয়ে দিল। চ্যাপ্টা সিঁদুর। চোখমুখে ক্লান্তির ছাপ। ঠিক অন্যান্য দিন তার যেমন অবস্থাটা হয়। তবে তার প্রসন্নতাটা ইন্দ্রগুপ্তের চোখ এড়াল না।
হঠাৎ তার কপালদেবের শর্তের কথা মনে পড়ে গেল। এটাই তো জিজ্ঞাসা করার আদর্শ সময়। না, থাক যাবার সময় জিজ্ঞাসা করবে।
তবে চটুলের চোখে-মুখে তার প্রশ্নের উত্তর সে পেয়েই গেছে।
আবার খাবার টেবিলে মা নীরব। চটুল মুচকি হেসে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আহা, তার প্রাণভোমরা ওই হাসিটাই তার সব টেনশন কেড়ে নিচ্ছে।
চটুলের চোখে-মুখে প্রশ্নের উত্তর সে পেয়েই গেছে।
অফিসে বেরোবার আগে সে বউকে একটু কাছে টেনে নিল। লক্ষ করল জুতো ছাড়াই সে বউয়ের থেকে অনেকটা লম্বা হয়ে গেছে। বউয়ের মুখের দিকে সে চাইল। সেই মুচকি হাসি।
এবার ওর কেমন একটু ভয়-ভয় করছে। তবে সাহস করে বলেই ফেলল কথাটা, আচ্ছা সোনা আমাকে তুমি এখন যেমন দেখছ তাতে বেশি ভালো লাগছে, নাকি আগে বেশি ভালো লাগত?
চটুলাক্ষি একবার মুখ তুলে তাকাল। মুখে সেই মুচকি হাসি।
– আমার তো তোমাকে আগেই বেশি ভাল লাগত গো। বলে হাসিতে ফেটে পড়ল চটুলাক্ষি। তারপর ছুটে পাশের ঘরে চলে গেল।
– হাসিটা অট্টহাসি হয়ে যেন তাকে বজ্রাহত করে দিল।
মা-কে প্রণাম করে ইন্দ্রগুপ্ত রিক্সায় উঠল।
বাসনাপুর এক্সপ্রেসে অনেকক্ষণ আনমনা বসে থেকে তার একটু একটু গরম লাগতে লাগল। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল। রুমাল বের করে সে কপাল, মাথা… মানে পরিব্যাপ্ত টাকটা মুছল।
জীবনে এই প্রথমবার সে একটা দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ল। হাসবে না কাঁদবে ঠিক বুঝতে পারল না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *