নিড়াইয়া জুইত নাই, বেলা যাইতে যেই সেই। এত ঘাস অইলে সারাদিন নিড়াইলেও শেষ অয়! মারানির ঘাস! গাছের চৌ-ডবল ঘাস। দূর! বলেই নিড়-কাচিটা নিয়ে আইলে এসে কাছা সরিয়ে বসে পড়ে হাসমত। কোঁচড় থেকে দিয়াশলাই ও মস্তান বিড়ির প্যাকেটটা বের করে একটা বিড়ি ছাই-কালো ঠোঁটে রেখে দেয়। তারপর দিয়াশলাই থেকে একটা কাঠি বের করে। ঘষে আগুন জ্বালবার চেষ্টা করে, কিন্তু কামিয়াব হয় না। আবার আরেকটা কাঠি নিয়ে জ্বালবার চেষ্টা করে। এবার হয়। কাঠিটা বিড়ির আগায় দিতেই ধরে যায়। হাসমত আরামসে বিড়ি টানতে শুরু করে।
হাসমত নামের পর আলী শব্দটাও আছে। তবে হাসমত এটা ব্যবহার করে না। হাসমতেই তার শোকরিয়া। আলী শব্দটা তার দাদার কাল থেকে আসা। এর আগে এটা ছিল না। দাদার পীর হুজুরের দেওয়া। কোনোবার এক বরষার মৌসুমে পীর হুজুর তাদের বাড়িতে দাওয়াতে আসেন। সেটা তাদের পরম সৌভাগ্য। তিনি খুব একটা দাওয়াতে আসেন না। তার ওপর আবার মুরিদের নাবাবি হাল যদি না থাকে। হাসমতের দাদা কেরামত মিয়া মেহমানদারীর কমতি রাখেন নাই। ঋণ করে ভালোই আপ্যায়ন করেছিলেন। আবার যাওয়ার সময় উত্তম হাদিয়া। আপ্যায়নে খুশি হয়ে পীর হুজুর কেরামত মিয়াকে ‘আলী’ উপহার দিয়েছিলেন। কেরামত আলী। সেই থেকে ওয়ারিশক্রমে আলী শব্দটা তার নামের সাথেও লেগে যায়; সাথে লেগে যায় দারিদ্র্যের সিল মোহর। ঋণ করে মেহমানদারি আর খাস দোয়ার বৌদোলতে তার পরের মৌসুম থেকে জমিচাষ করে খুব একটা লাভ হয়নি। নিজেদের যা জমি ছিল, তা ঋণশোধে প্রায় চলে যায়। তারপর থেকে পরের জমিতে বর্গা চাষ করে তার বাবার জীবন পড়ন্ত প্রহরের আগেই অস্ত যায়। এখন অবশিষ্ট বলতে সে আর এককানি বসতভিটা। আর সব কিছু অতীত এবং স্মৃতি। হাসমতের জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ কেটে গেল পরের জমিতে বর্গা চাষ করে। মাথার ঘাম মাটিতে মিশিয়ে ফসল ফলিয়ে পেট ভরানোর সংগ্রাম যেন শেষ হয় না, শুধু বাড়ে।
বিড়ি টানতে টানতে হাসমতের মনে পড়ে যায় এক বরষা মৌসুমের কথা। সে তখন মাস দুয়েক কাল হল বিয়ে করেছে। বিছান্দি গ্রামে। তার গ্রাম কুমড়াখালি থেকে আট-ন ক্রোশ দূরে। জহির মোল্লার বড় মেয়ে মরিয়ম বিবিকে। পড়শি সালেম বেপারী সম্বন্ধটা করে দেয়।
বিয়ের আগে হাসমতের জীবন ছিল উদাস ও আলাভোলা রকমের। যা ইচ্ছে তাই করত। কিন্তু বিবি ঘরে আসতেই তার জীবনে রঙ লাগা শুরু হয়। সংসারের অস্তিত্ব অনুভব করতে শুরু করে। বিয়ের পর বিবির আদর-যতনে দিন তার ভালোই কেটে যায়। খেতে কাজ করে ফসল ফলায় আর অবসরে বিবির চুলে নিজেকে গুঁজে রাখে।
বিয়ের হলুদমাখা দিনগুলোর পর মাছের মৌসুম। তখন মরিয়ম বিবি চার মাসের পোয়াতি। চারদিকে তরতর করে পানি। খেত আর খালগুলো পানিতে টইটুম্বুর। এদিকে মাছেরও তাজ্জব মাইর পড়তে শুরু করে। বড় বড় শোল, বোয়াল, বাইম, কাতল আরও হরেক রকমের মাছ। বর্ষায় আসলে খেতের কাজ কমে যায়, সারা খেত শুধু পানি আর পানি। তাই সবাই মাছ ধরতে ব্যস্ত হয়ে যায়। হাসমতও ব্যস্ত হয়ে যায়। জাল টানা শুরু করে। সন্ধ্যায় বিলে গিয়ে জাল টেনে মাছ যা পায়, মাছ জিয়ানোর চাইয়ে রেখে দেয়। সকালে জাল টেনে সব মাছ একত্র করে বাজারে বিক্রি করে দেয়। আর কিছু মাছ রাখে খাওয়ার জন্য।
বউয়ের যতন আর মাঝে মাঝে কাজল বয়াতীর বাড়িতে রাতে বাউল গানের আসরে শরিক হয়ে সময় কাটে তার। মধ্যে মধ্যে সেও গান ধরে। দরাজ গলা। অনেকে তারিফ করে। গান সে সহজে গায় না, শোনে। সবাই জোরাজোরি করলে গায়। কিন্তু বউকে সে তার রসিক গলার উপস্থিতি নিয়মিত জানান দেয়। ‘আসমানে পিদিম জ্বলে, জলে পড়ে জল। তোর পরানের গহিনে সই ক্যার কথা, বল।’
– হইছে এইবার থামেন, এই নেন ভাত খাইয়া লন। বাইম ভাজার লগে শুকনা মরিচ তেলো দিছি, খাইয়া লন।
হাসমত খেতে বসে। বউ হাতপাখায় বাতাস করে। হাসমত খায় আর বউয়ের মাছ ভাজার প্রশংসা করে, রসিক চোখে তাকায়। এভাবে-সেভাবে বউয়ের সাথে দহরম-মহরম লেগেই থাকে তার। যেন গাঙের সাথে পানির সম্পর্ক।
– বউ, আইজ রাইতে মাছ মারতে যামু। সবুরগো লগে। হুনলাম বিলের উত্তর দিহে নাকি মাছের ঝাঁক আর ঝাঁক। হোইল আর রুইতের ঝাঁক।
– ক্যান জাল টানবেন না আইজ?
– টানুম, জলদি টাইনা যাইমু। নমজের পর আন্ধার অইলে যামু।
– শুনছি মাছ মইরা খাওন ভালা না। মন্দ অয়।
– বিবি, খারাপ ভালা ওই খোদার আতে, জীবের আতে নি! মাছ তো খোদাও আমাগো লইগাই বানাইছে!
সন্ধ্যার নামাজ শেষ করে হাসমত বাড়ি চলে আসে। দেউড়ি ঘেষে কুঁপি হাতে মরিয়ম দাঁড়িয়ে।
হাসমত এসে রোয়াকের শালপাটিতে বসে। বিবি হাত ধোয়ার পানি আগায় দেয়। সে হাত ধুয়ে গামলায় রাখা ভাতে হাত দেয়। কলমি শাক আর শাপলা দিয়ে পুঁটি মাছের ঝোল।
তা দিয়েই পেট ভরে ভাত খেয়ে নেয়। খাওয়া শেষে বিবি গামছা দিলে। হাত-মুখ মুছে শোকর আদায় করে সে ঘাটের দিকে রওনা হয়।
নাওয়ের আগায় লাগানো লগ্গিটার থেকে নাওয়ের বান খুলে লগ্গিটা তুলে সে নাও ছেড়ে দেয় সবুরদের বাড়ির ঘাটের উদ্দেশ্যে। জলদি করে হাত চালায়। মিনিট দশেকের মধ্যেই ঘাটে হাজির। হাজির হয়ে দেখে সবুর, মোনসর আর জব্বর বড় নাওয়ে বসা।
– ত্বরায় আবি না? দেরি অয়ে যায়। বলে সবুর।
– খাইয়া দেরি করি নাই। ত্বরাই কইরাই চইলা আইলাম।
– অয় মোনসর, হারিকেন আর টেঁটা লই হাসমতের নাওয়ে উড। সবুর ত্বরায় দেয় মোনসরকে।
মোনসর মাছ মারার দরকারি উপকরণ নিয়ে হাসমতের নাওয়ে চলে আসে। সবুর আর জব্বর এক নাওয়ে, হাসমত আর মোনসর এক নাওয়ে।
হাসমত নাও ভাসায় দেয়। সবুরও দেয়। দুই নাও রওনা করে মোহন বিলের উত্তরের উদ্দেশ্যে।
মাছ মারতে যাওয়ার একটা আলাদা আনন্দ আর উত্তেজনা আছে যা নিজের ভিতর একটা সতেজ ভাব এনে দেয়। বেশিক্ষণ লাগে না, আধঘণ্টার মধ্যেই তারা মোহন বিলের সীমানায় উপস্থিত। নিশি রাত, কিন্তু দুধের মতো ফকফকা শাপলার হাট যেন। বিলের মাঝের দিকে আসতেই নাও দুটোর গতি কমে আসে। প্রায় নিশ্চল। এখন তারা শেষ প্রস্তুতি নেয়। লুঙ্গির গিঁট ঠিক করে, গামছাটা মাথায় ঠিক করে বাঁধে, টেঁটা ধরার সেপটা বোঝে, হারিকেনের আলোটা একটু উস্কে দেয় এবং বিড়িও টেনে নেয়।
এখন মুখের কথা বন্ধ। কথা হয় ইশারায়। নৌকা দুটো উত্তরের কাছাকাছি এনে দুই দিকে চলে যায়। সুবরেরটা যায় উত্তর-পশ্চিম। আর হাসমত চলে আসে উত্তর-পূর্ব দিকে।
মাঝির দায়িত্ব নেয় হাসমত। মোনসর ধরে টেঁটা। শুরু হয় মাছ মারতে তায়ে তায়ে থাকার পালা।
কিছুকাল মাছ মারার পর কাজের বিরতি দেয় হাসমত আর মোনসর। বিড়ি ধরায় দুজন। ভালোই মাছ পড়ছে। শোল, বাইল্যা, কাতল। বিড়ি টানা শেষ হলে পালাবদল। হাসমত টেঁটা ধরে। শুরু হয় তার তায়ে তায়ে থাকা। শকুনের দৃষ্টি। ত্রুটিমুক্ত হওয়া চাই। মাঝে মাঝে দু-একটা ফসকেও হয়। ওটা কপালের ফের। মাছের বরাত।
হাসমতের কাপলে মাছও পড়ে ভালো। বাইল্যা, আইড়, কাতল আর একটা দেশি মাগুরও মিলে যায়।
দুটো ফুটন্ত শাপলার পাতার দিকে চোখ পড়ে হাসমতের। মাছের মাথা। মনে হয় শোল। মাথাটা বড়। মনে হয় বেশ বড়ই হবে। একশ্বাসে মাছটার দিকে ঠিক ঠায় ও নিশ্চুপ ক্ষিপ্রগতিতে টেঁটা ছোঁড়ে হাসমত। ভালো করে লেগে যায়। বড় এক মাছ উঠে আসে নাওয়ে। তবে সেটা শোল নয়, গজার মাছ। ঠিক পেটের মাঝটায় টেঁটা গেঁথে রক্ত পড়ছে। গরগর রক্ত। মাছটার পেটের দিকে চোখ আটকে যায় হাসমতের। বিশাল মাছ। গায়ের রঙও উজ্জ্বল, ঝিলমিল করে। দশ-বারো সের ওজন হবে। বেশিও হতে পারে। মাছটা ধরে সে খানিক উৎফুল্ল বোধ করে। মোনসরও দেখে খুশি হয়। তারপর মাছটাকে পাটাতনের নিচে রেখে দুজন দুটো বিড়ি ধরায় টানতে থাকে।
* * *
বিয়োনের আগেই হাসমতের বিবি মারা যায় আশ্বিনের এক রাতে। বিবি তখন তার বাপের বাড়ি। বাজান এসে পোয়াতি নায়র নিয়ে যায়। কেউ বলে কালাজ্বর, কেউ বলে খারাপ বাতাস লাগছিল। কেউ বলে খোদার জিনিস খোদায় উঠায় নিয়া গেছে। কবিরাজ-ফকির কোনও কিছুতেই কাজ হয় নাই। তিনদিনের জ্বরে মরিয়ম মারা যায়। বাচ্চাটাও দুনিয়ার মুখ দেখেনি।
বিবির মৃত্যুর কথা ভাবতেই বুক থেকে দীর্ঘ একটা শ্বাস ছাড়ে হাসমত। তারপর লুঙ্গির গিঁটটা ভালো করে বেঁধে নিড়িকাচিটা হাতে তোলে নেয়। না, আইজ আর নিড়িইয়া কাম নাই। আসমান ভার করছে। গাদলা নামব মনে অয়। যে কোনও সময় হড়হড় করে বৃষ্টি হবে। বাজ পড়বে। তারচে ভালো বাড়িতে চলে যাওয়া। খাওয়ার জন্য কিছু পুঁইশাক পাশের খেত থেকে কেটে গামছা দিয়ে বেঁধে নেয় সে। ডগমগ আর টাটকা। অনেকগুলোই নেয়। তারপর আইল ধরে দ্রুত গতিতে হাটতে থাকে। কোনোদিকে তাকানোর সময় নেই। দাঁড়ানোর সময় নেই।
ভাই অনেক ভালো হইছে। কিপ ইট আপ 💙