১
ঘরের বাইরে থেকে খাবারের গন্ধ আসছে। মুতো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে থাকে দরজার বাইরে। একবার গলা খাঁকরানি দেয়। সাবিত্রী শুনতে পায় না। মুতো দোনোমনা করে তারপর কড়া নাড়ে আলতো করে। জোরে কড়া নাড়লে যে আওয়াজ হবে তাতেই যেন তার লজ্জা কিংবা কুণ্ঠা। সাবিত্রী এবার অবশ্য সেই আওয়াজেই বেরিয়ে আসে– “আরে চাচা, কিতনা ওয়াক্ত আপ বাহার মে খাড়া হ্যায়। অন্দর আইয়ে। ওহ বাহার গয়ে মেঠাই লানে।” মুতো তবু ঘরের ভিতরে ঢুকতে চায় না, একটা বিড়ি ধরায় সে– “হাম বাহার ঠিক হুঁ সাবিত্রী। সুখন কো আনে দো।” সাবিত্রী মাথা নেড়ে ঘরে ঢুকে যায়।
মুতো বিড়ি টানতে টানতে উবু হয়ে রাস্তার পাশে বসে পড়ে। আজ ভূত-চতুর্দশীর রাত। মাঝে মাঝেই বাজির শব্দ কানে আসছে। দিওয়ালির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে গোটা দুনিয়া। আকাশের দিকে তাকালে থেকে থেকেই দেখা যাচ্ছে আলোর রোশনাই। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার অবসর কিংবা ইচ্ছে কোনোটাই অবশ্য মুতোর নেই, কোনোদিনও বিশেষ ছিলও না। সে বরাবর মাটির দিকে মুখ নামিয়ে রাখা মানুষ। একদল ছেলে হল্লা করে চলে যাচ্ছে। এদের সবাইকেই মুতো ছোটবেলা থেকে চেনে, এখন এরা সবাই লায়েক হয়েছে। একটা চকোলেট বোম ফাটল একটু দূরে। ছেলেগুলো পরেরটা ছুঁড়ে দেয় তার দিকেই। লাফিয়ে সরে যায় মুতো। “শালা মুতো, শালা বুড়ো গান্ডু,” জোরে হাসতে থাকে ছেলেগুলো। “তোদের বাপের বিয়ে দেখেছি রে আমি, শালা কুত্তার বাচ্চা সব।” গজগজ করতে থাকে সে। জোরে বলতে সাহস হয় না। বলা তো যায় না, যদি ছেলেগুলো শুনে ফেলে কিছু কাণ্ড ঘটায়।
২
“বাবু, এ আমার দ্বারভাঙার লোক আছে। খুব বিশ্বাস করতে পারবেন বাবু। মাথায় একটু খাটো তবে মিছে কথা বলে না বাবু। ওই ছোটবেলায় মাথায় ইটের বস্তা পড়ে গিয়ে এমন বোকা হয়ে গেছে বাবু, বিদ্যে-বুদ্ধিও কিসসু হয়নি আর তার পর থেকে। যা বলবেন সব কাজ করে দেবে বাবু।” মুনিসিপালের বাবুকে সে কথাই বলেছিল রামবিলাস, লখনকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে। লখনের শরীর-স্বাস্থ্য ভালো ছিল, মুনিসিপালবাবু বাড়িতে চাকরের কাজে নিয়ে নিলেন সেই ইস্তক– “থাকা খাওয়া আর খোরাকি পাবি আপাতত, পরে দেখব কী করা যায়।” ব্যাস, লখন কলকাতায় থেকে গেল।
রামবিলাস পোড়-খাওয়া ধোপা। সে জানে কলকাতায় একবার কোনও কাজে জুতে যেতে পারলে টিকে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। লখনের মা খুব ধরেছিল রামবিলাসকে– “রাম, তুয়ার ভাইয়াটাকে দেখস নাই তু। কলকত্তা লে কে যা বাবুয়া।” গ্রামে থেকে যে কিছু হবে না সেটা লখনের মা বিলক্ষণ জানত। এমনিতেও ছেলে গোঁয়ার-গোবিন্দ, তা সত্ত্বেও লখনের বিয়েও দিয়েছিল সে, মোটা পণও নিয়েছিল চাচার জমি দেখিয়ে। ভালোই চলছিল লখনের মা-র। ছেলে পুরো বাওরা। তাতে কী? ছেলে তো! তাকে দিয়েই তুলসী গাছের পাশে একটা ঘর তুলিয়ে ছিল লখনের মা।
চিরকাল তুলসী গাছে সন্ধের পর জল দিত লখনের মা। বিয়ের পর লখনের বউ শিবিও শুরু করেছিল জল দেওয়া। একদিন অমন সন্ধের সময় শিবি সবে মাথায় ঘোমটা টেনে জল দিতে নিচু হয়েছে আর তখনই ‘হেই নাগিন’ বলে কোত্থেকে ছুটে আসে লখন। রামবিলাসের সঙ্গে ধোপাপল্লীতে কাপড় কাচার জন্য যে কাঠের ধোকা, সেটা ছিল হাতে। এক বাড়িতেই শিবি ‘মাঈ রে’ বলে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। আওয়াজে লখনের মা বেরিয়ে এসে আঁতকে ওঠে, লখন বারবার বলতে থাকে তুলসী গাছের সামনে শিবি ছিলই না, একটা বিশাল কেউটে দেখেই সে ধোকার বাড়ি মারে– “হাম নাগিন কো হি দেখা সচ মে। হামে ক্যায়সে পাতা বহু কাহাসে ঘুস গায়ি।” লখনের মা এসব বিশ্বাস করে না, ছেলের মাথার ব্যামো আছে তাই চুপ করে যেতে চায়। কিন্তু গাঁ-গঞ্জে কথা চাপা থাকে না, শিবির বাবা এক হপ্তার মধ্যে এসে শিবিকে নিয়ে চলে যায়। পঞ্চায়েতে কথা তুলবে, সে শাসানিও দিয়ে যায়। এরপরেই লখনের মা রামবিলাসকে জোরাজোরি শুরু করে লখনকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। ছেলেকে সে কোনোদিনও বাগে আনতে পারেনি। ভেবেছিল বিয়ে দিলে মতি ফিরবে, তাও হল না, এর জন্য অবশ্য সে বহুকেই দোষ দেবে– এ কেমন মেয়েমানুষ যে পুরুষকে বশ করতে পারে না!
রামবিলাসের সঙ্গে লখন সেই যে চলে এল কলকত্তা, সেই থেকেই লখনের জীবন পালটে গেল। মা-কে লখনের কোনোদিন ভালো লাগত না, তাকে খুব খাটাত মা। বাবুজিকেই ভালোবাসত সে, তো বাবুজিও নাগিনের কামড়ে নিধন হয়ে গেল সেই কোন ছোটবেলায়। শিবির মুখটাও লখনের আর ভালো মনে পড়ত না– শুধু মনে ছিল ওর একজোড়া মোটা কালো ভুরু আর নাগিনের মত লম্বা বেণী। সেটা বললে শিবি খুব হাসত হিসহিস করে, আর লখন বহুকে আরও ভয় পেতে থাকত ক্রমশ। শিবির চোখগুলো অসম্ভব কালো ছিল, চকচক করত নাগিনের পিঠের মতো– লখন ভয় পেলেই শিবি জোর করে ওর মাথাটা নিজের বুকের ওপর টানত। লখন আড়ষ্ট হয়ে শিবির বুকের ধকধক শব্দ শুনত, রেললাইনে কান পেতে দূর থেকে ছুটে আসা রেলগাড়ির আওয়াজের মতো।
কলকত্তায় প্রথম প্রথম হাঁপিয়ে উঠেছিল লখন। রাস্তা পার হতেই ঘাম ছুটে যেত তার। তার ওপর ভাষাটাও ঠিকঠাক বুঝতে পারত না। এভাবে প্রায় চল্লিশটা বচ্ছর পার হয়ে গেল। লখন রয়ে গেল কলকাতায়। মা মরে যাওয়ার পর এক রাতের জন্য গেসল দেশে। চাচা সব জমিজিরেত নিজের নাম লিখিয়ে নিল– “তু তো আর আসবি নাই লখন, সারে জমিন হামে হি দেখনা পড়েগা।” শিবির সঙ্গে আর কোনোদিন দেখাই হল না লখনের। মা মরে যাওয়ার পর রামবিলাস বলেছিল অনেক করে– “উসকো পাতা হোনা চাহিয়ে। শাশুমা হ্যায় না!” লখন গা করেনি কিছু। কী লাভ এসব করে? এদ্দিন পর। তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে রাতের দিকে শিবিকে মনে পড়ত না যে তা নয়।
মুনিসিপালবাবুর বাড়িতে চাকরের কাজটা লখন ভালোবেসে করেছিল অনেক বছর। মুনিসিপালবাবুর বিধবা মা লখনকে ভালোও বাসতেন। ফাইফরমাস খাটতে পারে ছেলেটা, প্রতিদিন কোলে তুলে ছাদে নিয়ে বসিয়ে দিত, নামিয়ে আনত। তারপর তিনি চোখ বুজতে মুনিসিপালবাবুর বাড়িতে তার থাকা মুশকিল হয়ে গেল। শেষমেষ অনেক ধরাধরি করে একটা চাকরি পেয়ে গেল সে। বড় রাস্তার মোড়ে একটা নতুন শৌচালয় তৈরি হয়েছিল সে সময়। সেখানেই সারাদিন বসে থাকার চাকরি পেল লখন। ওর ভেতরেই একটা ঘুপছি ঘর মতো– তাতেই একটা বিছানা মতো করে থাকা, জল, পেচ্ছাব-পায়খানা, মায় চানেরও চিন্তা নেই, খাবার কিছুদিন এদিক ওদিক করে শেষে ওই একধারে একটা পায়খানার ঘরের বাইরে উনুন জ্বালিয়ে ভাত ফুটিয়ে নেওয়া। এতে তার কোনও অসুবিধা হয় না। প্রথম প্রথম পেচ্ছাবের গন্ধ নাকে আস্ত খুউব। বমি হয়েছিল একবার রান্না করতে করতে। এখন অভ্যেস। রাতে গ্রিলটা টেনে দিয়ে ঘুমিয়ে নেয় সে। কখনও সখনও দূরপাল্লার কোনও গাড়িতে মেয়েমানুষ থাকলে গ্রিলে খটখটি হয়, ছেলেরা তো বাইরে সেরে নয়, পায়খানা পেলে আলাদা কথা। ঝামেলা-ঝনঝাট যে হয় না তা নয়। সেবার ভোটের পর কোত্থেকে দুটো ছেলেকে ধরাধরি করে নিয়ে এল– কী রক্ত, তাদের জলের তলায় রক্ত ধুইয়ে দিতে থাকল দলের লোক। আরেকবার কাদা ফুটবল খেলে পাড়ার বিচ্ছুগুলো সেই ঢুকবেই– বিশাল ঝামেলা লখনের সঙ্গে। বকেঝকে শেষ পর্যন্ত তাদের ভাগিয়ে দেয় সে। আরেকবার তাদেরই একজন পরে রাত বারোটার সময় একটা মেয়ে নিয়ে ঢুকতে দেওয়া নিয়েও ঝামেলা করল। সে প্রায় হাতাহাতি। চানের ঘরটা খুলে দিতে হবে এই নিয়ে শাসানি প্রায়। লখন গ্রিলে তালা দিয়ে দেয়– কিছুতেই ঢুকতে দেয় না কাউকে। পরের দিনই মুনিসিপালবাবুর কাছে গিয়ে “বাবু, ইতনা মুসিবত। পিসাবখানাকে তো লোকে পিসাবের বদলি অন্য কামে লাগাতে চায়।” মুনিসিপাল বাবু রেগে যান– “তোকে তো কাজ পাইয়ে দিয়েও স্বস্তি নেই দেখছি। তুই সামলা নিজে, আমার কাছে আসিস না।” রামবিলাসও বলে, “গুসসা মত কিয়া কর লখন। নোকরি জায়েগি তো ক্যায়া করেগা তু, ইয়ে শোচ।”
লখন কিছু বলে না এর পর থেকে। নিজে নিজেই উপায় কিছু বার করে নিতে হবে, সেটা বুঝে যায়।
৩
সুখন হাতে একটা ঠোঙা নিয়ে আসে, মুতোকে দেখে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে– “আরে চাচা, আপ বাহার কিঁউ?” “তেরে লিয়েই ইধার খাড়া হুঁ রে, চল অন্দর।” ঠেকুয়ার ঠোঙাটা সাবিত্রীর হাতে দেয় সুখন– “লিট্টি তৈয়ার হুয়া?” সাবিত্রী মাথা নাড়ে– “চাচা আপ বিস্তর পর হি বৈঠিয়ে।” সাবিত্রীর কাঁচা বয়স, সবে বিয়ে হয়ে কলকত্তা এসেছে, বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে সে, “তো ক্যায়সে হুয়া ইয়ে সব চাচা? পয়দা আপ কে সামনে হুয়া? ক্যায়া শরম,” খিল খিল করে হাসে সে। “তু চুপ যা বহু,” সুখন মাঝে মাঝেই বুজুর্গ লোকদের সামনে সাবিত্রীকে নিয়ে বিপদে পড়ে। কখন যে কাকে কী বলে তার ঠিক নেই কোনও! “আরে নাহি রে, এইসে ক্যায়সে হোগা,” মুতো বলে।
দিন সাতেক আগের ঘটনা। রাত ওই দশটা নাগাদ, মুতো তখন গ্রিলটা টেনে দেবে ভাবছে, হঠাৎ একটা বোঁচকা নিয়ে একটা মেয়ে “আমার একটু সময় লাগবে” বলে ঢুকে পড়ে একটা খোপে। মুতো এই সময়টায় একটু নেশা করে– সুখন বা রামবিলাস কেউ না কেউ জুটেই যায় রোজ। সেদিনও তিনজনে তারা বাইরে শৌচালয়ের একটু পাশে বসে খুরিতে করে অল্প অল্প চুমুক দিচ্ছে, রামবিলাস এবার দেশে যাবে দিওয়ালিতে– তার গল্প হচ্ছে। রামবিলাসের মেয়ের বয়স হয়েছে, বিহা দিতে হবে, বহু ডেকে পাঠিয়েছে। পণের টাকা কীভাবে যোগাড় হবে সেই চিন্তায় তিনজন মশগুল– “আরে, ওহ মাইয়া বিমার হ্যায় ক্যায়া?” সুখন বলে ওঠে। মুতো ফিরে দেখে সেই মেয়েটা কোনোরকমে পা টেনে টেনে যাচ্ছে রাস্তা পেরিয়ে। “আরে ক্যায়া কার রহি ও?” রামবিলাস চেঁচিয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গেই ঘ্যাঁচ করে ট্রাকটা ব্রেক কষে থেমে যায় হাত পাঁচেক দূরে। মেয়েটাকে চাকায় টেনে নিয়ে যায়। রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে লোকগুলো ছিল কেউ চায়ের দোকানে বা কেউ বাস স্ট্যান্ডে তাদের কেউ কেউ ছুটে এল। এমন ঘটনা হামেশাই ঘটে রাতের দিকে, সেদিকে বেশি সময় দেওয়ার সময় কারও নেই। সুখন উঠে দেখে আসে– “মার গয়ি বেচারি। চাচা অন্দর যাও, পুলিশ অনেওয়ালা হ্যায়।” পুলিশ এলে ঝামেলা অনেক– মুতো তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়ে নিজের কোটরে। আর তখনই হঠাৎ একটা কান্নার শব্দ– খুব মিহি। মুতো প্রথমে ভাবে নিশ্চই ভুল শুনেছে কিছু। না, আবার শোনা যাচ্ছে। এবার একটু জোরে। বিল্লি হবে, মুতো ভাবে। “শালা কাল সুবহে কচরা সাফ করতে হবে।” গজগজ করে মাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে সে। কিন্তু রাস্তার আওয়াজ কমে এলে কান্নার শব্দটা বাড়তে থাকে। উঠতেই হয় মুতোকে– আওয়াজটা আসছে ওই খোপটা থেকে যেখানে এই মেয়েটা ঢুকেছিল, মুতো উঁকি মারে ভেতরে। মাথাটা বোঁ করে ঘুরে যায় তার। অল্প আলোতেও সে দেখতে পায় একটা মানুষের বাচ্চা প্যানের পাশে শুয়ে আছে, হাত পা ছুঁড়ছে আর কাঁদছে। গলার জোরটা একনাগাড়ে কেঁদে কেঁদে আর খিদেতেই বোধহয় ক্রমশ কমে আসছে। মুতো ঝটতি নিচু হয়ে তুলে নেয়। রক্তে মাখামাখি, বাচ্চাটা, মেয়ে। বুকে আঁকড়ে বেরিয়ে আসে সে। রাস্তার মোড়ে একটা পুলিশের গাড়ি আর একটা অ্যাম্বুলেন্স এসেছে। ট্রাকটা পালিয়ে গেছে, পুলিশের কোনও কাজ নেই লাশ মর্গে পাঠিয়ে দেওয়া ছাড়া, তাছাড়া এমনিতেই এই শীত পড়ার ঠিক আগে আগে একটা হিমেল নিস্তেজ আবহাওয়া। মুতো সোজা চলে যায় পুলিশের ভ্যানটার দিকে। “স্যার, ওই মেয়েটা আমার ওই পিসাবখানায় এই বাচ্চিটা পয়দা করেছে।” পুলিশ কনস্টেবলটি সবে আরাম করে একটা সিগারেট ধরিয়েছিল, ঘুরে দেখে তার মাথায় রাগ চড়ে গেল– “শালা গান্ডু , রাত বিরেতে মাজাকি করছিস?” তারপর ঝুঁকে পড়ে– “তুই এই বাচ্চাটা পেলি কোত্থেকে? তুলে নিয়ে এসেছিস নাকি? জেলে ভরে দেব বানচোত।” মুতো ঘাবড়ে যায়– “না হুজুর, এই মাইয়াটা যেটা কাটা পড়ল ওটা এইমাত্র বিইয়েছে এটা, হামলোগ বাহার রাস্তে মে থা হুজুর, হামকো কুছু পাতা নাহি, সাচ বোলা হুজুর।” চায়ের দোকানি, যার কাছ থেকে টহলদারী পুলিশ বিনি পয়সায় চা-সিগারেট পায়, সে-ও বলে, “ও সাদা আদমী স্যার। বিহারি। ওই টয়লেটটার কেয়ারটেকার। ও সত্যি এতক্ষণ বাইরেই ছিল স্যার।” পুলিশ কিছুক্ষণ ভাবে– “নে চল থানায়, বেওয়ারিশ বাচ্চা নিয়েছিস, থানায় তো যেতেই হবে।”
অনেক কাকুতি মিনতি করেও সে রাতে থানায় যেতে হয় মুতোকে। বাচ্চাটাকে নিয়ে পুলিশ কী করল আর জানতে পারে না সে। রাতে থানায় দুটো বিস্কুট দিয়েছিল খেতে। মুতোর একটুও ঘুম হয়নি রাতে। পরেরদিন সকালে বড়বাবুর কাছে কান্নাকাটি করে ছাড়া পেতে পেতে দুপুর গড়িয়ে গেল। বেরিয়ে এসে একটা বিড়ি ধরায় সে। “আচ্ছা, আমি জার্নালিস্ট। আমি একটা কেসের ব্যাপারে থানায় এসে তোমার কথাটা শুনছিলাম।” মুতো ঘুরে দেখে একটা মেয়ে– ছোট চুল, চোখে চশমা, প্যান্ট-শার্ট পরা, মাথায় টুপি। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সে– “আরে আমি টিভি-র লোক, মেয়ে দেখোনি নাকি, আজব মাইরি।” মেয়েটা বুঝিয়ে দিতে চায়। “হামি বেকসুর আছি দিদি।” বলেই মুতো জোরে জোরে পা চালাতে থাকে। পাছে মেয়েটা আবার ধরে, প্রায় ছুটতে থাকে সে। এক নিঃশ্বাসে এসে রামবিলাসের বাড়িতে ঢোকে, রামবিলাস সব শুনে, পিঠ চাপড়ে দেয়– “মর্দ মাফিক কাম কিয়া তু লখন।” দুজনে ছাতু খেয়ে মুতো আরাম করতে যায় নিজের ডেরায়। বিকেলে খবর পেয়ে সুখন আসে– “চাচা, ক্যা সব সুনা, খবর ক্যায়া হ্যায়?” মুতো বেরিয়ে দেখে সেই মেয়েটা, এখন সঙ্গে আরেকটা ছেলে তার হাতে ইয়া বড় একটা ক্যামেরা। মেয়েটা হাতে একটা মাইক নিয়ে এগিয়ে আসে– “এখন আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন যিনি, তিনি এক মহান মানুষ, আপনার নামটা একটু বলুন।” মুতো ঘাবড়ে গিয়ে এদিকে ওদিক তাকায় ।
“ওদিকে না আপনি ওই ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকবেন আর যা জিজ্ঞেস করছি উত্তর দেবেন।” মুতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। সুখনও একটু ঘাবড়েই যায় পুরো ব্যাপারটায়।
“বলুন আপনার নাম,” মেয়েটা তাড়া দেয়।
“আজ্ঞে লখন,” বলে ওঠে মুতো।
“আরে মুতো, মুতো,” পেছন থেকে পাড়ার ছেলেগুলো বলে ওঠে। কখন যে ওরা এসে জুটেছে, মুতো টের পায়নি। “মুতখানার মুতো।” একটা হাসির হররা ওঠে। মাইক হাতে মেয়েটাও হেসে ওঠে। খবর পেয়ে মুনিসিপালবাবুও চলে আসেন, মুতোর কাঁধে হাত রাখেন– “ওকে আমি-ই বিহার থেকে নিয়ে আসি। ছোটবেলা থেকেই ওর ভেতর একটা হনেস্টি দেখেছিলাম। আর তার সঙ্গে হৃদয়টাও খুবই বড়।” মুনিসিপালবাবু বলেই চলেন, মুতোর কানে কিছুই ঢোকে না। সে দেখে তার সামনে ভিড় বেড়েই চলেছে। কত মানুষ, সবাই ক্যামেরার সামনে এসে কিছু বলতে চাইছে। ধাক্কাধাক্কি হওয়ার অবস্থা, মেয়েটি বলে, “এই যে বাচ্চাটার প্রাণ বাঁচালেন কাল। কী মনে হচ্ছে? আপনার এই চ্যারিটির পিছনে মূল ইনস্পিরেশন কী?” মুতো কী বলবে বুঝে ওঠে না। মুনিসিপালবাবু এখন পুরো ক্যামেরা ক্যাপচার করে নিয়েছেন, মুতো আস্তে করে পিছিয়ে হল্লা থেকে বেরোতে যাচ্ছিল, কেউ একটা আবার ঠেলে এগিয়ে দেয় তাকে।
“আমি অত কিছু ভাবিনি স্যার। আমার নিদ আসছিল না বাচ্চিটার রোনায়।”
এর পরেও অনেকক্ষণ ধরে চলে এই প্রশ্নোত্তর সেশন, যতক্ষণ না মুতো একজন মহান মন-রূপে প্রতিষ্ঠা পায়। পাড়ার ছেলেরা তার সততার উদাহরণ দিতে থাকে, তারাও যেন এই প্রথম মুতোকে অন্য চোখে দেখতে থাকে।
8
সাবিত্রীর রুটি বানানো হয়ে গেছে। “আইয়ে চাচা। আপ তো টিভি স্টার বান গায়ে।” সাবিত্রী আবার হাসতে শুরু করে। “আরে চুপ রহ,” সুখন ঝাপটে ওঠে, ভাবে চাচা কী ভাববে। মুতো কখনও অন্য কারও বাড়িতে খায় না সাধারণত, নিজের ডেরাতে পেচ্ছাবের গন্ধমাখা খাবার বানিয়ে খেতেই তার অভ্যেস। সে খেয়াল করেছে সেদিনের সেই টিভি-র ঘটনার পর তার ইজ্জত বেড়ে গেছে পাড়ায়। লোকাল কাউন্সিলরও এসেছিলেন পরের দিন, মহিলা, সিরিয়ালে পার্ট করে শুনেছিল সে। নাকে রুমাল চেপে “আপনি এমন একটা মহান কাজ করেছেন, আমরা এলাকাবাসীরা সবাই গর্বিত। পার্টি আপনার সঙ্গে আছে। আমরা সমস্ত উন্নয়নমূলক কাজে মানুষের পাশে থেকেছি, থাকব।” পরক্ষণেই “উফ কী গন্ধ এখানে” বলে কেটে পড়েন তিনি, তাঁর চ্যালারা একটা মালা দিয়ে যায়। গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন লোক দেখা করেছে, “তেরা নসিব খুল গয়া রে লখন, হামকো ভুল না জানা,” বলেছিল রামবিলাস।
“সুখন, তু মুঝে খানা মেরা ঘর ভেজ দে।” লখন বলে। সুখন অবাক হয়, চাচা কোনও কারণে রেগে গেল নাকি? “গুসসা হুয়া চাচা?” সুখন জিজ্ঞেস করে রাগ-রাগ মুখে তাকায় সাবিত্রীর দিকে। সাবিত্রী ভয় পায় এই বুঝি আবার বকা খেতে হয়। “নাহি রে, মেরা ডেরা হি আচ্ছা রহেগা।” সুখন চুপ করে থাকে।
“আরে, ঘাবড়া মত, মেরা ও বদবু পে নাশা হো গায়া।” লখন বলে, “ওহ হি মেরা আসলি জাগা হ্যায়, সমঝা কি নাহি?”
“নাহি চাচা,” সুখন বলে।
“আরে মেরা নাম মালুম নাহি তুঝে? ওহ ছোকরে লোগ হামে ক্যা বলে পুকারতে হ্যায়।” হা হা করে হেসে ওঠে লখন– “আরে মেরা নাম হ্যায় মুতো, মুত কা বদবু বিনা মুঝে খানা আচ্ছা নাহি লাগতা রে।”
মুতো ওরফে লখন, বিহারী, দ্বারভাঙার লখন যাদব নিভন্ত ভূতচতুর্দশীর রাতে হাহা করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। ল্যাম্পপোস্টের আলো ওপর থেকে ধরতে থাকে তাকে আর সে অতিক্রম করতে থাকে সুদূর নীহারিকা। কলকাতা শহর ঘুমিয়ে থাকে– দীপাবলী আসছে, আলোর উত্সব।