মণিহারা

ফাল্গুনী ঘোষ

“উই জি আলে গত্ত গুল্যান দেখছেন বাবু…”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ওগুলো তো সাপের বাসা। ওখানেই…”
“না না বাবু, উ ল্যয়! মা মুনসা বুল্যেন।”
হাঁ হাঁ করে সন্দীপকে থামায়। পরম ভক্তিভরে মা মনসার উদ্দেশ্যে কপালে হাত ঠেকায় জটা।
“ক্যামেরাবাবু, ইসব বুনে বাদাড়্যে, আলে-খালে ঘুরতে জেল্যের মা মুনসাকে তুষ্টু রাখত্যে হয়। আমরা লতা বুলিঙয়ে। মা মুনসার ও নামট্যো লিয়ে নাখো।”
এই ক্যামেরা বাবুট্যো জি কী কর‍্যে। খালে-ঝোপে পোকামাকড় ধর‍্যি ছবি তুলত্যে লেগেছ্যে। মনে মনে ভাবে জটা। ই বাবুট্যোকে বুলতেই হবে আজ, মা মুনসার মহিমার কথাট্যো। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে বলে চলে জটা—
শুন্যেন বাবু, তেনার কত লীলা, রঙ্গ। কি বিচিত্র রূপ— খরিস, চিতি, ইনি, ঢ্যামনা কত্ত নাম। পায়ে পায়ে চলে। কথায় বলে, সাপের ল্যাখা/ বাঘের দ্যাখা। তা তেনাদেরকে ত্যাল, সিন্দুর, ধূপ-দীপ দিঙয়ে মানত করে না তোষালে কি এই আলে-খালে, বুনে বাদাড়্যে, মাঠে-ঘাটে রাখাল বাগালের কাজ করত্যি পার‍্যি? না কি এই দুপুর রোদে দাড়িঙে ডেলি রোদট্যো খেত্যে পার‍্যি!”
সন্দীপের ভ্রু কুঁচকে যায়। মুখ ঠেলে বেরিয়ে আসে অবিশ্বাসী স্বর— “কিন্তু গোরুগুলোকে কামড়ে দেয় যদি!”
“আমাদের যে মিতে পাতানো আছ্যে। ওদেরক্যে মের‍্যো না। তুমি ওদের শান্তি দাও, অরাও তোমার পায়ে পায়ে পথ ছেড়্যি দিবে। অরা মানুষ বুঝে। মানুষের ছোয়া ল্যায়। গভভধারিনী মেয়্যা লোকের বুকের দুদ খায়। সুদু কি মেয়্যা! গাই বিয়ান জেল্যের বাঁটে মুখ লাগায়। কুনো লাজ নাই। তখুন বড়ো ঢ্যামনা উটো। আমার বাপ দাদুদের নিজ্যের চোখে দিখ্যা বাবু।”
দামি ডিএসএলার-টা হাতে নিয়ে জটাধারীর সঙ্গে পথ চলে সন্দীপ। এই অসভ্য, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অশিক্ষিত প্রাণগুলির দৈনন্দিন যাপন শুনতে শুনতে কেমন ঘোর লাগে। পেশায় স্কুলশিক্ষক সন্দীপ আপাদমস্তক শহুরে। নেহাত কৌতূহলের বশে ক্যামেরায় হাতেখড়ি। সে কৌতূহল আজ নেশা। তার জন্য জলে-জঙ্গলে, ঠা ঠা রোদে, ছমছমে সন্ধেয়, কাকভিজে হয়ে মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াতে তার আপত্তি নেই। এখন ফণা তুলে উদ্যত সাপের ছবি তোলার জেদ এসেছে মনে। দেশ-বিদেশ অনেক জায়গায় তার ছবি নাম পেয়েছে। কত মেডেল, পুরস্কার। চোখে স্বপ্ন ঝিকিয়ে ওঠে সন্দীপের। মনের গোপনে সে পুষে রাখে বড় ফোটোগ্রাফার হওয়ার স্বপ্ন। আরও নিখুঁত আরও অন্য ধরনের ছবি তুলতে চায় সে। এভাবেই পথে পথে চলতে ফিরতে এই মাঝদুপুরে রাখাল বাগালগুলোর সাথে প্রাণের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তার। সাথে সাথেই শুনতে পায়, জানতে পারে পরম্পরায় চলে আসা সাপকেন্দ্রিক এদের বিচিত্র সংস্কার ও ভাবনার কথা।

* * *

কামিনী। খালপারের বাগাল পাড়ার বিশু বাগালের কন্যা। কালো, মসৃণ চকচকে চামড়ার মেয়ের চলার ছন্দ যেন হিসহিসে নাগিনী। তার চোখের মাদকতার বিষে যে জড়িয়েছে তার আর নিস্তার নেই। রাখাল বাগাল বাড়ির গাবদা-গোবদা, গালফুলো আঁটি করে টেনে খোঁপা বাঁধা মেয়েগুলোর পাশে কামিনী বড়ই বেমানান। কী করে যে বাগাল বাপের ঘরে তার জন্ম হল। এ নিয়ে অবশ্য কানাঘুষো আছে এলাকায়। বিশু নাকি কুড়িয়ে পেয়েছিল কামিনীকে। কে জানে কোন অজাত-কুজাত বংশের মেয়ে— বলে ঠোঁট উলটায় গাঁ ঘরের মেয়ে বৌ-রা। নাহলে কি সাপ পোষে! এত দুঃসাহস!
কামিনীর নিজেরও মনে হয় সে এখানে পরগাছা। বিশ্বাস-অবিশ্বাস, বোঝা না-বোঝার আলো-আঁধারিতে দুলতে দুলতে তার মন চলে সেই পদ্মবিলে। যেন ফেলে আসা জন্মের নাগিনী কন্যার দেশে। যেখানে নাগে-নরে মেলামিলি। সাপ তাড়া করে হাতের মুঠোয় ধরতে সে ওস্তাদ। এ খেলাতে সে প্রাণ পায়। প্রকৃতির আদিম রহস্য আর প্রবৃত্তি দুইই এঁকেবেঁকে নৃত্যের তালে চলে। সেখানেই বাঁধা পড়ে থাকে কামিনীর মন আষ্টেপৃষ্ঠে। তার আকৃতি, প্রকৃতির রহস্যময়তা সে আরও বেশি উপলব্ধি করে চারপাশে পুরুষদের সরীসৃপ দৃষ্টি থেকে।
সম্বৎসরের হাজার একটা নিয়ম, আচার-বিচারের মধ্যে মনসা পুজোর সময় এলে বুকে পদ্মের সুবাস ছাড়ে কামিনীর। বিশুর স্ত্রীর দুলে দুলে পড়তে থাকা দশহরা ও নাগপঞ্চমীর ব্রতকথা কামিনীকে বিভোর করে। পুজোর উপাচার সামান্যই দুধ আর কলা। পুজো সেরে পান্তাভাত প্রসাদ নিয়ে তেল সিদুঁরের তিলক কেটে বাগালির কাজে বেরোয় পুরুষেরা। পুকুর ঘাটে মনসার মূর্তি ভাসান দিয়ে কামিনী বিষণ্ণ মনে পা ছড়িয়ে বসে থাকে। দ্যাখে জলের মধ্যে খেলা করা কুচো মাছ। গামছা ছেঁকে ধরে নিয়ে এসে বাড়িতে হাঁড়ির মধ্যে জিইয়ে রাখে। কিন্তু কয়েকদিন পর সে বোঝে ওই মাছগুলোর মধ্যে একটা মা মনসার বাচ্চা।
কাউকে কিছু না জানিয়ে দুধ কলা খাইয়ে বহু যত্নে লুকিয়ে বড় করতে থাকে সে তার মণিকে। যেন নিজের সন্তান। মনে মনে নাম রাখে মণি। ঠিক তার মতোই কালো উজ্জ্বল হিসহিসে গা। পেটের দিকটা ছাই ছাই ডোরা। এখন থেকেই ফণা তোলার চেষ্টা! কী তেজ! মনে মনে পুলকিত হয় কামিনী। কিন্তু এসব সুখ কপালে বেশিদিন সইল না। বিশুর স্ত্রী ও বিশু দূর দূর করে বাড়ির বাইরে করে দিল মণিকে। মনে মনে গাল পাড়ে বিশুর স্ত্রী— “পেটে ধরিন্যি বলেই এই শত্তুতা; নিজের মেয়্যা হল্যি এই করত্যে পারত্যি?” গায়ের জ্বালা মেটাতে ঘরে শিকলবন্দি রাখে কামিনীকে— “সোমত্তু মেয়্যা! এবার তুর বিহ্যা দিছি দ্যাখ।” বিশু মাঠ থেকে ফিরতে না ফিরতেই গোপন পরামর্শে ঠিক হয় পাত্রের নাম। পাড়ারই জটাধারী ক্ষ্যাপা। তাছাড়া “উ মুনসার ভকত্যো বট্যে”— মাথা নাড়ে বিশু।
ওদিকে অন্ধকার মাটির ছোটো খুপরিতে গুমরে গুমরে ক্লান্ত দৃষ্টি জানলায় মেলে কামিনী দেখে তার মণি জানলার ফাটল দিয়ে তার সাথে দেখা করতে এসেছে। এরপর চলতে থাকে সবার চোখ এড়িয়ে মা-ছেলের দেখা সাক্ষাৎ।
কালা বাবার থানে মানত করা জটাধারী, এখন বাপ-মা মরা ছেলে। মনিবের চোখের আড়ালে ফাঁকি মারতে জটা জানে না। একটেরে, একবগ্‌গা জটা নিজের স্বভাব চরিত্রের গুণে তাই হয়ে ওঠে জটা ক্ষ্যাপা। মা মনসার একনিষ্ঠ ভক্ত জটার কোনও নেশা নাই। মদ, গাঁজা, বিড়ি, মেয়েমানুষ সব নেশা সে জয় করেছে মা মনসার কৃপায়। মনসা যে কাঁচা দেবতা। রাত বিরেতে মনসা নিজে তার পথ ছেড়ে দেয়। শুধু এ কারণেই সে মনসার ভক্ত হয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু যেদিন ভরা দুপুরে ভিজে কাপড় জড়ানো স্নানসিক্ত কামিনীর ছিপছিপে কোমরের তরঙ্গ আর ভারী স্তনের ছন্দ শ্যাওড়া ঝোপের আড়াল থেকে দেখেছে সেদিন থেকে জটা বড় আনমনা। কামিনীর অগ্নিদৃষ্টি তা এড়ায়নি।
এসব কথা জটা নিজের মনেই চেপে রাখে। তাছাড়া কামিনীর নামেও নাকি কী সব বদনাম আছে। দুধ-কলা দিয়ে সাপ পোষে। সে সাপ দেখা করতেও আসে সাঁঝের আঁধারে। তাই সেদিন রাতের বেলায় সস্ত্রীক বিশু বাগালকে তার বাড়িতে আসতে দেখে চমকেই যায় জটা। এ যে অভাবিত প্রস্তাব। ধুমধাম সহ জটাধারী একদিন জটা ক্ষ্যাপা থেকে হয়ে যায় কামিনীর স্বামী।
এভাবেই শম্বুকগতিতে চলে গ্রামজীবন। যে জীবনের পায়ে পায়ে অজস্র রহস্যজালের বেড়ি। নির্বিষ, নিরীহ দৃষ্টির সাথে পথ হাঁটে কামুক দৃষ্টি। কামিনী গর্ভধারিনী হয়। কোল জুড়ে সন্তান আসে। জটা মনের আনন্দে বন্ধুদের মোড়ের মাথার চমচম বিলি করে।

* * *

সন্দীপ জটার মুখ থেকেই তার আর কামিনীর গল্প শুনেছিল। এই সরল অশিক্ষিত মনসাপ্রেমী জটাকে সন্দীপের বড় ভালো লাগে। সেদিন সন্দীপ মাঠের পথে একা এলোমেলো ভাবনা ভাবতে ভাবতে চলেছে। নিত্যদিনের সঙ্গী জটা সদ্যোজাতকে নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু চলতে চলতে একসময় জটার সাক্ষাৎ পায় সন্দীপ।
“মা মুনসা কামিনীর বুকের দুদ খেয়্যে জেল্য কাল…” হন্তদন্ত জটা হাঁফায়, থরথর করে কাঁপে।
বলে কী! “তুমি নিজের চোখে দেখেছ জটা! তোমার বউ সুস্থ আছে?”— জটাকে সঙ্গে নিয়ে সন্দীপের অনুসন্ধানী চোখ ছুটে চলে জটার বাড়ির বারান্দায়। যেতে যেতে জটার বর্ণনা শোনে—
“ছেল্যাট্যোকে মাই দিয়ে, ঘুম পাড়িঙে গরমে কাহিল হলছিল্যো বউট্যো। মাঝরেতে দাওয়ায় এলোচুলে খুটিতে ঠেসান দিঙয়ে বস্যি ছিল্য। নিসাড়ে বৌট্যোর পেয়ারের মণি এস্যি পা দুখ্যান পেচিঙে ধরল্যে! ঝাপটানির আওয়াজে চোখ রগুড়ে দেখি ইসব। সে মেয়্যার তো চোখ দাড়িঙ জ্যালো। মারলে নাকি লেজ্যের ঝাপটা। তারপর কাপড়ের ভিতরি সেদিঙে দিলে দুদে মুক।” দম নিয়ে জটা বলে, “কিন্তু বাবু মা মুনসার কিরিপা আছে! বৌট্যো আমার জানে বেঁচ্যি জেল্য। মণি বড় পেয়ারের পত্থুম ছেল্যা তো কামিনীর।”
সন্দীপ কামিনীকে দেখে গ্রাম্য লোকেদের উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে। কালো পাথরের ভাস্কর্য যেন! ঠেলে ওঠা উদ্ধত যৌবন। শুধু ঝিমিয়ে বসে আছে। আর ঘোরলাগা লাল চোখে চারিদিক চেয়ে দেখছে মাঝে মাঝে। এত ভিড়ে কামিনীর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলে কৌতূহল নিরসন সম্ভব নয়। বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়ায় না সন্দীপ। একটা সাপ এসে কামড়ে দিয়ে গেল, অথচ মেয়েটার কিছুই হল না! কোনও ডাক্তার-ওষুধ নেই। তার যুক্তিবাদী মন কোনও উত্তর খুঁজে পায় না। রহস্যজালে ভিজে শালিখের ডানার মতো মনটা চুপসে যায় সন্দীপের। কে জানে হয়তো নির্বিষ সাপ ছিল!

* * *

পরের দিন বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের পাতায় একটি খবর প্রকাশিত হয়, ‘মাতৃদুগ্ধ পানে সদ্যোজাতর মৃত্যু। মা সুস্থ আছে। তবে ডাক্তারি পরীক্ষায় সন্দেহ করা হচ্ছে মায়ের দুধে সাপের বিষ ছিল।’

4 comments on “

মণিহারা

ফাল্গুনী ঘোষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *