বিলুচাচা আর তার বাক্স

মহম্মদ কাইফ

বিলুচাচাকে তার বাক্স ছাড়া কেউ কোনোদিন দেখেনি। শীতকালের ভোরের ঘন কুয়াশায় বা বর্ষার মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে, বিলুচাচা ক্রমশ অষ্পষ্ট হয়ে গেলেও, পিঠে ফেলে রাখা বাক্সটা কিন্তু জ্বলজ্বল করতে থাকত। সেই বাক্সে কী আছে কাউকে বলত না বিলুচাচা। ছোট্টো স্টিলের তৈরি বাক্স পিঠে ফেলে আপন মনে ঘুরে বেড়াত সে। কারও সঙ্গে কথা বলত না। বিলুচাচার বাক্সের রহস‍্য নিয়ে অনেক গল্প ভেসে বেড়াত হাওয়ায়, গল্পগুলো লেগে থাকত অ্যান্টেনায় আটকানো ভোকাট্টা ঘুড়ির সঙ্গে। কেউ বলত ভিনগ্ৰহীদের সঙ্গে বিলুচাচার সম্পর্ক আছে। তারা নাকি খুব রাতে নেমে আসত বিলুচাচার সঙ্গে কথা বলতে। আমাদের বাড়ির পাশেই যে পার্কটা, যেখানে আমরা দল বেঁধে খেলতাম, সেখানেই এলিয়েনদের সঙ্গে বিলুচাচাকে আড্ডা দিতে দেখেছিল সুবীরকাকু‌। পরেরদিন সকালে পার্কের রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল সুবীরকাকু। জ্ঞান ফিরে সবাইকে সেই গল্প বলেছিল সে। কেউ বিশ্বাস করেনি হয়তো, কারন সুবীরকাকু প্রায়শই রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরত। নেশার ঘোরে কী না কী দেখেছে!
কিন্তু মা বলত বিলুচাচা বাক্সে ভূত পোষে। ভাতের থালা নিয়ে মা বলত, “সবটা না খেলে বিলুচাচাকে ডাকব আর বাক্সটা খুলে দিতে বলব, ভেতরে কী আছে জানিস তো?”

তখন ছোট ছিলাম , বুঝতাম না। সব গল্পকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার সাহস বুকপকেটে জন্মায়নি‌। কিন্তু তারপর বড় হতে হতে সেই গল্পগুলোকে ক্রমশ ফিকে হয়ে যেতে দেখেছি। বিশ্বাস করতে শুরু করেছি বিলুচাচা পাগল আর পাগলদের এক একটা জিনিসের প্রতি অদ্ভুত মায়া থাকে, বাক্সটার উপর হয়তো বিলুচাচার নিতান্ত একটা মায়া জড়িয়ে আছে; আর কিছু নয়!

কিন্তু আমার ভুল ভাঙল একদিন। সেবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছিল বেশ ক-দিন ধরে। আমি পার্কের বেঞ্চটায় বসে ছিলাম সেরকমই একটা বৃষ্টির দিন। পাশে বাইসাইকেলটা দাঁড় করিয়ে রেখেছি। সাইকেলে রাখা স্কুলব‍্যাগ। ব‍্যাগের মধ্যে লাল-নীল চিঠি; আইসক্রিম আর অনেকটা মনখারাপ। আমার চোখেও সেদিন মেঘ করেছিল। চুপচাপ বসেছিলাম‍। খেয়াল করিনি পাশে কখন এসে বসেছে বিলুচাচা। খুলেছে তার বাক্স। হঠাৎ চোখ পড়তেই চমকে গিয়েছিলাম‍। ভয়ে তার পাশ থেকে সরে এসেছিলাম একটুখানি। কিন্তু বিলুচাচার মুখে এক অদ্ভুত হাসি লেগেছিল। আমার ভালো লাগছিল। খোলা বাক্স থেকে বিলুচাচা বের করে আনল একটা কাঁচের গ্লোব। আকাশে মেঘের ঘনঘটায় চারপাশটা স্লেটের রঙের মতো হয়েছিল। কিন্তু তার মধ‍্যেই গ্লোবটার ভেতর সাতটা রামধনু রঙ ভেঙে ভেঙে অদ্ভুত একটা রঙিন মেঘ তৈরি করছিল। আমি হাতে নিতে চাইলাম সেটা। বিলুচাচা বাড়িয়ে দিল সেটা আমার হাতে। হাতে নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলাম সেই গ্লোবের ভেতর। আস্তে আস্তে একটা আবেশে চোখ বুজে আসছিল আমার। শুনতে পাচ্ছিলাম খুব মৃদু একটা ঝরনার শব্দ। কোথাও কুহু কুহু করে একটানে একটা পাখি ডেকে যাচ্ছে। আমার চোখ বুজে আসছিল ক্রমশ…
ঘুম ভাঙলে নিজেকে আবিষ্কার করলাম ছোট্টো একটা চার দেয়ালের ঘরে। একটু যেন নড়ছে ঘরটা। তারপর আরও অনেককে দেখতে পেলাম সেই ঘরে। সবাই হাসিমুখে বসে আছে। কারও কোনও মনখারাপ নেই। আমারও নিজেকে অনেক হালকা লাগছে। এখান থেকে আর বেরোতে ইচ্ছে করছে না। মুখ তুলে দেখলাম উপরে নীল আকাশ। তুলোর মতো মেঘ বিভিন্ন আকৃতি নিয়ে ছুটে চলেছে। একটা পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে নিজেকে দেখলাম উড়ে যেতে। এই ঘরে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। বিলুচাচার বাক্সের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি৷ ঘুমের মধ্যে সময় পেছনে ছুটতে লাগল। আমার ফেলে আসা সময়গুলোকে আলোর গতিতে পেরিয়ে যেতে দেখলাম।
দেখলাম, মা ভাতের থালা নিয়ে আমার সামনে বসে৷ বলছে, “পুরোটা খেতে হবে কিন্তু, নইলে…”
মাকে থামিয়ে আমি বললাম, “মা, বিলুচাচা বাক্সের ভেতর ভূত পোষে না…”

3 comments on “

বিলুচাচা আর তার বাক্স

মহম্মদ কাইফ

  1. খুব স্বচ্ছন্দ মুক্তগদ্য…উপভোগ করলাম

  2. এই গুণ টা তো দুর্দান্ত , আগে তো খেয়াল করিনি। যাই হোক, খুব অন্যরকম। এগিয়ে যাও ভাই। আশীর্বাদ রইলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *