“আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে।”
আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগের একটি সকাল। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে একটি সুঠামদেহী বেঁটেখাটো মানুষ। হাতে পাথরের তৈরি ছোটখাটো একটা বল্লম জাতীয় কিছু। কোমরে বাঁধা গাছের ছালের বন্ধনীতে ঝুলছে ঘষে ঘষে তীক্ষ্ণ করে রাখা পাথরের চাকু। সকালের নরম রোদে মেপে নিচ্ছে পাহাড়ের চারদিক। যুদ্ধে বেরোনোর আগে নিখুঁত প্রস্তুতি। প্রতিদিনের মতো। বেঁচে থাকার, জীবনযুদ্ধ। তারপর…
*
বিকেলে সমুদ্রের পাড়ে বসেছিলাম আমরা। আমি আর শিল্পা। ঢেউ গুনতে। রোজই যেমন আসি। আমাদের ইউনিভার্সিটি থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্ব। সারাদিন জ্ঞানগর্ভ লেকচার শোনার পর সমুদ্র দেখতে বড্ড ভালো লাগে। জীবনের ছোট্ট ছোট্ট আনন্দের গল্প করতে করতে ঠিক সন্ধ্যা নেমে যায়। এই ঢেউগুলোর মতো জীবনও কতটা অনিশ্চিত সেটা শিল্পা বোঝায়। এর পেছনে একটা গল্প আছে।
*
পন্ডিচেরীতে সেসময় খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। নিয়মিত। একটা ছাতার বড্ড প্রয়োজন ছিল। নইলে ক্যাম্পাসের লং ওয়াকগুলো নিয়মিতভাবে মিস হচ্ছিল। শিল্পার কিছু জমানো টাকা ছিল, তা থেকেই কিছুটা নিয়ে একটা সাধের ছাতা কিনল ও। আমি একটা ছোট্ট স্কলারশিপ পেতাম। টানাটানি সংসার। ওতেই সাহস করে কোপ বসাব কিনা ভাবছি, সেই সময় ব্রিটিশ কাউন্সিল একটা কুইজ কম্পিটিশন-এর ঘোষণা করে ফেলল। ড্যাং ড্যাং করে নামও লিখিয়ে ফেললুম। উপরওলার কী লীলা! আমাকে তো প্রথম করলেনই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আর একজন ললনাকেও একই সঙ্গে প্রথম করলেন। অথরিটি বললেন রাজ্যপাট ওই কন্যার সঙ্গেই ভাগাভাগি করে নাও বাপু, নইলে হিসেব মিলছে না। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, এও কি কখনও হবার! তাই সেই চিরাচরিত প্রথা মেনে এক টাকার কয়েনেই আমার ভাগ্য ঝুলে রইল। টস ভাগ্যটা আমি সারাজীবন গাঙ্গুলির সঙ্গেই শেয়ার করে এসেছি। যথারীতি হারলাম। আর আমার চোখের সামনে থেকে লোভনীয় আই-পডটা নিয়ে কন্যাও খুশি মনে বিদায় নিল। কিন্ত লীলার শেষটা তখনও বাকি ছিল। ওটার পরিবর্ত হিসাবে আমি যে পুরস্কারটা পেলাম, সেটা আর কিছুই না। একটা নীল রঙের রেইনকোট। ডাক ওয়ার্থ লুইসে আমরা দুজনেই জিতলাম। কিন্তু রোসো। গল্পের এখানেই শেষ না। ছাতা আর রেইনকোট দুটোই যেদিন আমরা পকেটে পুরলাম, বৃষ্টি সেদিনই হাওয়া হয়ে গেলেন। ওই সিজনে আর এক ফোঁটাও ঝরলেন না। ওই অনিশ্চিত ঢেউগুলোর মতো। জীবনের পরের মুহূর্তে তোমার জন্যে কী অপেক্ষা করে আছে, কেও তা জানে না।
*
শিল্পা আপাদমস্তক নোমাড। মুক্তি ওর নেশা। পায়ের তলায় সর্ষে নিয়ে হাওয়ায় উড়ে বেড়ায়। এই মুহূর্তেও জীবনের যাবতীয় সেভিংস বনে জঙ্গলে পাহাড়ে উড়িয়ে দিয়ে আসে। সেদিন ওর কাছ থেকেই আইডিয়াটা এল। ট্রেকিং-এর। পূর্বঘাট পর্বতমালার মাঝখানে কোনও এক জোয়াদু হিল পাহাড়ের উপর মানচিত্রে উপেক্ষিত একটি স্থান। ঘোরার ব্যাপারে আমার যেহেতু না নেই, তাই মাথা নাড়ালাম। জয় চন্দ্রণকে সঙ্গে নিলাম। ওখানকার এক আদিবাসী গ্রামে ওর একটা রিসার্চের কাজ আছে। আর নিলাম রামকে। রামকুমার ধর্মপুরী। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সহজ সারল্য ভরা তরুণ।
ব্যাগপত্র নিয়ে রাতে পন্ডিচেরী বাসস্ট্যান্ড থেকে রওনা দিলাম। গন্তব্য থিরু আননামালাই। প্রায় একশ কুড়ি কিলোমিটার। রাত দ্বিপ্রহর তখন, পৌঁছলাম মন্দিরের শহরে। প্রচুর মন্দির এখানে। সেই রাতে কোথাও যাবার নেই, আর আমাদের থাকার জায়গাও নেই। অগত্যা বাস স্টেশনেই কাটিয়ে দিলাম রাতটা। চায়ের পর চায়ের চুমুকের মধ্য দিয়ে ভোর হল। এতক্ষণ নজরে পড়েনি, বাস স্টেশনের বাঁ পাশেই উঠে গেছে সুউচ্চ পাহাড়। তার উপরে শিবের মন্দির। প্রতি প্রথমা আর পূর্ণিমায় এখানে শিবের পুজো হয়। লাইন ধরে আবালবৃদ্ধবনিতা ক্লেশে অক্লেশে উঠে যায় ভক্তি নিবেদনের উদ্দেশ্যে।
*
ফ্রেশ হয়ে আমরা জোয়াদু হিলের উদ্দেশ্যে আবার বাসে চড়ে উঠলাম। নিতান্তই সাধারণ লোকাল বাস। লোকজন খুব কম। প্রচণ্ড তর্জন গর্জন করতে করতে সেই বাস উঠতে থাকল পাহাড়ের পাকদণ্ডি বেয়ে বেয়ে। এই রাস্তায় সবুজের ছড়াছড়ি বেশ ভালোই চোখে পড়ল। প্রায় সত্তর-আশি কিলোমিটার এঁকেবেঁকে যাওয়ার পরে নেমে পড়লাম আমাদের গন্তব্যে। তামিলনাড়ুর লোকাল বাস চড়ার অভিজ্ঞতা যাদের নেই, তাদের বলি, এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। তোমার নিজের সিটে বসে আছো নিপাট ভদ্র হয়ে। জানালার পাশে বসে একটু কবি-কবি ভাব আনার চেষ্টা করছ। হঠাৎ বাসের মিউজিক সিস্টেমে বেজে উঠবে— ‘আড়া রা মাজা দা, আড়া মাজা দা…’ রিদমিক মিউজিকের তালে তুমি লক্ষ করবে তোমার পা-ও তাল ঠুকছে। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ একটি লোক লুঙ্গি তুলে দুলতে শুরু করবে। তুমি ভাববে, এ কী রে বাবা! লোকটি কি লজ্জার মাথা খেল নাকি? ওর কথা ভাবতে ভাবতে মনে মনে একটু সহানুভূতি প্রকাশ করবে। কিছুক্ষণ কাটতে দাও। ওর সঙ্গে জুটে যাবে আরও কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ। উদ্দাম নৃত্যের তালে তালে জীবনের প্রকাশ বিচ্ছুরিত হতে থাকবে। একসময় মনে হবে পুরো বাসটাই গানের তালে তালে নাচছে। তুমি তখন তোমার নিজের কথা ভাববে। লজ্জার মাথা খেয়ে তুমি চুপচাপ ভদ্র হয়ে বসে আছো। চুক করে কখন যে নিজের প্রতি একটু সহানুভূতি দেখিয়ে ফেলবে, সেটা বুঝতেও পারবে না। প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ আর রিদমিক এই জাতিটা। না ভালোবেসে উপায় নেই।
*
এবার আমাদের সভ্য পথ শেষ। শুধু হাঁটার পালা। বন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পথ খুঁজে পাথর ধরে। একটি জলের ধারার গুনগুনানি অনেকক্ষণ থেকেই পাচ্ছিলাম। অবশেষে সেই তন্বী স্রোতস্বিনীর সান্নিধ্য পেলাম। হাত মুখ ধুয়ে শীতল হলাম। তারপর এগিয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ পর একটি আদিবাসী গ্রামে পৌঁছলাম। কুট্টা কারাই। ছোট্ট জনবসতি। আদিমতার গন্ধের সঙ্গে মিলে মিশে আছে ডিস টিভি। একটু বিশ্রাম করে জল টল খেয়ে পা বাড়ালাম। জয় চন্দ্রণ, রামকুমার ওদের কাছে রাস্তাটা একবার বুঝে নিলাম। বুঝতে পারলাম হেঁটে যাওয়াতে কিছু লোকের বিশেষ সায় নেই। তবুও। কী আর করা। উত্তর দিক ধরে নাক বরাবর সোজা হাঁটা দিলাম।
*
একটি পাহাড়। দুইটি পাহাড়। তিনটি পাহাড়। আমাদের গলা পর্যন্ত শুকিয়ে এসেছে। বাধ্য হয়ে কখনও গাছের পাতা চিবুচ্ছি। পৃথিবীর অভিকর্ষ হঠাৎ কিছুটা বেড়ে গেছে। টলছি। আর সে অবস্থাতেও দেখছি এক অদ্ভুত অবিশ্বাস্য ছবি। আদুল গায়ে আদিবাসী বালক হেলায় পর্বতপ্রমাণ জিনিসপত্র নিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। আমাদের টলোমলো ব্যাল্যান্সে সেই নিখুঁত চলার ছন্দ সেই সময়ে কবিতা মনে হল।
*
শেষমেশ আমাদের পাহাড়টি দূর থেকে দেখতে পেলাম। মধ্যে তিন-চার কিলোমিটারের এক প্রান্তর। আমাদের তিনজনের হাতে লাঠি। মাথায় অত্যধিক গরমের কারণে গামছাকে পাগড়ির মতো বেঁধেছি। পিঠে ব্যাগ। মাঝে মাঝে কিছু জিজ্ঞাসু চোখ আমাদের জরিপ করে যাচ্ছে। আমরা এগোচ্ছি। সেই বিশাল মাঠের ভেতরে দুইটি বাড়ি। ছড়ানো ছিটানো টুকরো ধানের জমি। কাকিমার মতো এক মহিলা আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। সব শুনে আমাদের জল খেতে দিলেন। অমৃত মনে হল। তারপর এগিয়ে চললাম। এবার চড়াই পথ। শেষ পাহাড়। সব কিছু ঠিক থাকলে এর চূড়াতেই আছে আমাদের স্বপ্ন। লাঠি দিয়ে গাছ সরিয়ে সরিয়ে এগুচ্ছি। অনেকটা উপরে উঠে এসেছি। অদ্ভুত বন্য আওয়াজ ভেসে আসছে বিভিন্ন দিক থেকে। জনমানবহীন এই চরাচর। সভ্যতা থেকে কয়েক যোজন দূরে। গহিন আদিমতার ভেতর দিয়ে একটা বাঁক ঘুরতেই শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। শিল্পাকে আমি আড়াল করে দাঁড়ালাম।
কে ও! আমাদের থেকে প্রায় দশ মিটার দূরে বসে আছে সে। গায়ের রং মিশকালো। অনেক বছরের চুল দাড়িতে মুখটা ভর্তি। খালি গা। একটা ছোট্ট হাফ প্যান্ট জাতীয় কিছু পরনে। এই শুনশান মনুষ্যবিহীন স্থানে চুপচাপ বসে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। বুকটা হিম হয়ে গেল, যখন দেখলাম ঠিক তার হাতের কাছেই পড়ে আছে একটি ধারালো অস্ত্র। দা সম্ভবত।
এখানে এসে সময় কিছুক্ষণ থমকে গেল। রামকুমার আর জয় চন্দ্রণকে দেখেও কিছুটা আড়ষ্ট মনে হল। প্রথম প্রশ্নটা এদিক থেকেই গেল। উত্তর এল। আবার প্রশ্ন। এটারও উত্তর এল। স্বাভাবিকতা ফিরতে শুরু করল। যা কিছু হল সব তামিলে। কিছুক্ষণ পর আমরা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলাম। নিতান্তই দরিদ্র একজন। গাছের কাঠ কাটে। সংসার বলে কিছু নেই। এভাবেই দিন চলে। এখনও স্বীকার করি, ওই পরিবেশে দেখে আমি সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছিলাম।
*
চরম উৎসাহে আমরা উঠে এলাম পাহাড়ের চূড়ায়। কিন্তু কোথায় কী? পুরোটাই তো ফাঁকা। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এত পরিশ্রমের ফল কি তবে এভাবেই পেতে হবে? জয় চন্দ্রণ চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে পাশের আর একটা চূড়ার দিকে হাত দেখাল। আবার নামা। আবার ওঠা। ফিঙ্গার ক্রসড হয়ে আছে। আমাদের সাধ কি পূরণ হবে? পাব তো দেখা সেই অমূল্য দৃশ্যের।
শেষ বাঁকটি পার হয়ে ভয়ে ভয়ে উঁকি দিলাম পাহাড়ের উপরে, আর তারপরেই দিলাম একটা রাম লাফ। ইউরেকা। ভাগ্যিস কাছেপিঠে কোনও বাথটাব ছিল না।
*
পাহাড়ের উপরে ছড়ানো রয়েছে অনেকগুলি গুহা। চৌকো চৌকো পাথর, ছোট ছোট করে কেটে সাজিয়ে বানানো গুহাগুলি। লম্বায় প্রায় পাঁচ ফুট, চওড়াই তিন ফুট মতো। এর কম বেশিও হতে পারে। নিওলিথিক পিরিয়ড অর্থাৎ নব্য প্রস্তর যুগে বানানো এই গুহাগুলি। অদ্ভুত অনুভূতিতে ভরে গেল চারপাশ। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলাম পাথরগুলিকে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম পাহাড়ের খাদের ধারে। অসম্ভব সুন্দর নিসর্গ। একটা অদ্ভুত হলুদ রঙের ফুল ফুটে আছে দেখলাম। অজানা। বেশ বড়। উজ্জ্বল। বসে পড়লাম গুহার গায়ে হেলান দিয়ে। দূরে আলগোছে বিছিয়ে থাকা পাকদণ্ডিগুলো ক্রমশ ধূসর হয়ে উঠল। ঠিক তখনই দেখলাম। “আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে।” আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগের একটি সকাল। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে একটি সুঠামদেহী বেঁটেখাটো মানুষ। হাতে পাথরের তৈরি ছোটখাটো একটা বল্লম জাতীয় কিছু। কোমরে বাঁধা গাছের ছালের বন্ধনীতে ঝুলছে ঘষে ঘষে তীক্ষ্ণ করে রাখা পাথরের চাকু। সকালের নরম রোদে মেপে নিচ্ছে পাহাড়ের চারদিক। যুদ্ধে বেরোনোর আগে নিখুঁত প্রস্তুতি। প্রতিদিনের মতো। বেঁচে থাকার, জীবনযুদ্ধ। ঠিক পেছনেই গুহার চারধারে খিলখিলিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে তার ভবিষ্যৎ। অনেক সকাল, অনেক সন্ধ্যার রূপকথা তাদের বুকে বুকে। কত হাসি, কত কান্না। কত সুখ, কত দুঃখ। আনন্দ, হাসি, বেদনা। কিছু জন্ম, কিছু মৃত্যু। সে জানে তার পথ কত দীর্ঘ। সে সময়ের হিসেব তার কাছে নেই। তবে সে জানে, সেই পথের আশেপাশে আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর পরে তারই মতো কেউ এসে বসবে। এইখানে। সে যেন বুঝতে পারে, ভবিষ্যতের জন্যে সে কী করে গেছে।